অনুভূতির খাঁচা পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0
22

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মায়া আজ চারদিন পর অফিসে আসে। ঘরে কর্মহীন বসে থাকা তার পছন্দ নয়। এর উপর তার কোম্পানি ছাড়ার পূর্বে কিছু কাজ করতে হবে। সে নিজের ফাইলগুলো চেক করছিল এর মধ্যেই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে তাকায় উপরের দিকে। ওয়াহিদকে দেখে বলে, “নক করে ভেতরে আসতে হয়।”
ওয়াহেদ তার কথা যেন কানেই তুলে না। সে দ্রুত যেয়ে বসে মায়ার সামনে। তার আতঙ্কিত কন্ঠে বলে, “তোর না’কি এক্সিডেন্ট হয়েছে। বেশি লেগেছে তোর? তুই কোথায় ছিলি? এই খবর শোনার পর তোর বাসায় আমি কতবার গিয়েছি জানিস? ফোনেও ব্লক করে রেখেছিস।”

মায়া তার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ঝাঁজালো গলায় বলে, “আমার এত খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি।” বলে সে চেয়ার ঘুরাতে নিলে ওয়াহেদ তার দিকে চেয়ারটা ধরে রাখে। নিজের দিকে ঘুরায়, “তুই কি আমাকে কখনো মাফ করতে পাড়বি না মিষ্টি?”
মায়া উওর দেয় না।
ওয়াহেদ জানায়, “আমি জানি আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে তুই যে শাস্তি দিবি আমি মাথা পেতে নিব। কিন্তু অন্তত তোর খবর জিজ্ঞেস করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করিস না। সাত বছর বয়স থেকে আমরা একসাথে ছিলাম। তোকে সব আঘাত থেকে বাঁচিয়েছি। তুই আমার জন্য অমূল্য। সে তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে এই শুনে আমার কতটা অস্থির লেগেছিল তোকে কীভাবে বলে বুঝাব? তোকে প্রেমিক হিসেবে ভালোবাসিনি, কিন্তু বন্ধু হিসেবে তোকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি। তোকে কখনো আমি সে নজরে দেখতেই পাড়িনি। ভাবতে পাড়িনি। এর শাস্তি এভাবে দিবি আমাকে?”

মায়ার মন গলে যায় আজকাল খুব তাড়াতাড়ি। তার কখনোই ওয়াহেদের না ভালোবাসার আক্ষেপ ছিলো না কিন্তু তার কারণে হওয়া অপমানগুলো সে ভুলতে পাড়ে না। সে জানে ভালোবাসা জেনে বুঝে হয় না। জেনে বুঝে ভালবাসতে পাড়লে, সে কখনো জোহানকে বেছে নিতো না।

মায়ার মন কিছুটা কোমল হলেও সে দৃঢ় সুরে বলে, “আমার কাছে শরীরের আঘাত কিছুই না। কিন্তু আমাকে যে মনের আঘাত দিয়েছিলি তার কী? যদি কেবল অভিমানটা ভালোবাসার জন্য হতো তাহলে আমি এতদিনে স্বাভাবিক হয়ে যেতাম। কিন্তু সেদিন আমার অপমান হয়েছিল তোর জন্য। আমার আত্নসম্মান আমার কাছে যেকোনো সম্পর্ক থেকে বেশি। বলছিস আমি তোর কাছে অমূল্য। তাহলে এই অমূল্য মানুষটার অপমান সেদিন কীভাবে সহ্য করলি? এসব ঢঙ আমার সামনে করতে আসবি না। গেট লস্ট।”
“সেদিন আমি লজ্জায়, সংকোচে কিছু বলতে পাড়িনি মিষ্টি। প্লিজ মাফ করে দেয়। সব আমার দোষ।”
“অফকোর্স সব তোর দোষ। সেদিনের অপেক্ষা না করে যদি আমাকে আগে থেকেই সব জানাতি তাহলে আমি নিজেই সরে যেতাম। কোনো ঝামেলা হতো না সেদিন। হয়তো আমি ভালোবাসা না পাবার কষ্ট পেতাম কিন্তু অন্তত আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটা তো সে কষ্ট ভুলানোর জন্য পাশে থাকতো। তাই না? তোর কী বন্ধুত্বেও এতটুকু বিশ্বাস ছিলো না যে আমি তোর ভালোবাসার মাঝে কখনো আসবো না?”
কথাটায় ওয়াহেদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আশাবাদী দৃষ্টিতে তাকায় মায়ার দিকে, “প্লিজ মাফ করে দে।”
“যা এইখান থেকে। আমার মাথা ব্যাথা করছে প্রচুর।”
মায়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

ওয়াহেদ আর কিছু বলল না। সে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। বের হতেই সে দেখা পেল আশরাফ ও তন্নির। তারাও মায়াকে দেখতে এসেছিল। এই চারদিনে প্রতিদিনই অফিসে যাবার আগে দুইজন জোহানের বাসায় যেতো তাকে দেখতে। আজ যেয়ে যখন সৌমিতা আন্টির কাছে জানে মায়া অফিসে এসেছে তাকে বকা দিয়ে ফেরত বাসায় নিয়ে যেতেই তারা এসেছিল। কিন্তু মায়ার কেবিনের সামনে ওয়াহিদকে দেখে তন্নি যেন অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠে, “তুই এখানে? তোকে আমি মানা করেছিলাম না মায়ার আশেপাশেও আসবি না?”

ওয়াহিদ শান্ত কন্ঠে উওর দেয়, “ও অসুস্থ শুনে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম তাই দেখতে এসেছি।”
“চিন্তায় আর তুই? চিন্তা করলে ওই দিয়ার সাথে মিলে ওকে এত কষ্ট দিতি না। ওর কষ্ট দু:খ আমরা দেখেছি। দেখ ওয়াহিদ আমি তোকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি। এরপর যদি ওর আশেপাশে তোকে দেখি তাহলে… ”
“তাহলে?” আচমকা ওয়াহিদও রেগে যায়। সে-ও উচ্চকণ্ঠে উওর দেয়, “তাহলে কী করবি তুই? তোর থেকে দশ বছর আগের থেকে ও আমার ফ্রেন্ড। তোর থেকে বেশি অধিকার আছে ওর উপর আমার।”
আশরাফ দুইজনকে থামাতে চায়, “তোরা থামবি? এটা অফিস।”
কিন্তু কেউ চুপ করার নাম নেই। তন্নি উল্টো বলে, “অধিকার? অধিকার তো তুই তখনই হারিয়ে ফেলেছিস যখন তুই মায়াকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে ভালোবেসেছিস। অধিকার মারাতে আসবি না। তুই আমাদের বন্ধু হবার যোগ্যই না।”

মায়া তার কেবিনের বাহির থেকে শব্দ শুনে সেদিকে এগোল। দরজা খুলতেই প্রথমে ওয়াহিদের কথা তার কানে স্পষ্ট এলো, “যোগ্যতা? তুমি আমাকে বন্ধুত্বের যোগ্যতা শিখাবি? তুই যোগ্য? তুই ভুলিস না তুই-ও আমার ও দিয়ার মতো একইভাবে ওর অপরাধী। কেবল আমি চুপ করে আছি বলে আজও মায়া তা জানে না।”
“হোয়াট ননসেন্স! ”
“ননসেন্স? জানিস মায়া কী বলেছে? ওকে যদি আমার ও দিয়ার কথা আগে জানাতাম ও নিজেই সরে যেত। ওর নিজের ভালোবাসা থেকে ওর বন্ধু হারানোর কষ্ট বেশি। আমি আগে ওকে জানালে অন্তত ওর বন্ধু কষ্ট ভাগ করার জন্য ওর কাছে থাকতো।”

এতক্ষণে কয়েকজন স্টাফ এসে জমাট বেঁধেছে জায়গাতে। জোহানও সে পথ দিয়ে যাবার সময়। শব্দ শুনে এসেছে।

ওয়াহিদ আরও যোগ করে, “আমি তো মায়াকে আমাদের ব্যাপারে সব জানাতে গিয়েছিলাম। তখন তুই আমাকে আটকিয়েছিলি। বলেছিলি মায়া সহ্য করতে পাড়বে না। আমার যে করেই হোক মায়াকে ভালোবাসতেই হবে। তুই আমাকে ফোর্স করেছিলি তন্নি। তুই সেদিন ফোর্স না করলে আজ হয়তো আমাদের পাঁচজনের বন্ধুত্বটা আগের মতো থাকতো। আমাদের ফ্রেন্ডশিপ আমি না তুই ভেঙেছিস। আমি মায়াকে একথাটা জানাতে পাড়তাম বাট আমি চাই না তোদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরুক। মায়ার জীবন থেকে আরেকজন ভালোবাসার মানুষ হারাক।”

এমন সময় মায়া সম্পূর্ণ দরজা খুলে বের হয়। তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে কিন্তু তার মুখে কোনো অনুভূতি নেই। তাকে দেখেই সকলে ভূত দেখার মতো চমকে যায়। ওয়াহিদের মাথায় এতক্ষণে কথাটা আসে, সে মায়ার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

মায়া উচ্চস্বরে সবাইকে শাসানি স্বরে বলে, “এখানে কি নাটক চলছে? সবাই ভীড় করেছ কেন? গো টু ইউর ওয়ার্ক। রাইট নাউ।”
সবাই যেতে নিলে সে তার এসিস্ট্যান্ট মনিশাকে বলে, “আজ আমার এন্ট্রি ক্যান্সেল করে দেও৷ আমার ভালো লাগছে না।”
মায়া সেখান থেকে যেতে নিলে তন্নি তার হাত ধরে নেয়, “দোস্ত…আমার কথা শুন। আমি তোর জন্যই তো….”
মায়া আস্তে করে তন্নির হাত ছাড়িয়ে নেয়। শান্ত স্বরে বলে, “আমার এখন মাথা ব্যাথা করছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
তার শান্ত কন্ঠ শুনে আরও ভয় পেয়ে যায় তন্নি। এই সময় তার রাগ করা উচিত। রাগ করে মনের ক্ষোভ বের করা উচিত। কিন্তু মায়া শান্ত? এই ভেবেই তার বুক কেঁপে উঠে। কয়েকবছর আগে যখন মায়া এমন শান্ত হয়ে গিয়েছিল তখন সবাইকে ছেড়ে চলে পা জমিয়েছিল বিদেশে। তাদের তিন বন্ধু ও মিতা ছাড়া কারো সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করে নি। আজও তার পরিবার ও ওয়াহিদের সাথে কথা বলে না। যদি এবার মায়া তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়? ভাবনাতে কথটা আসতেই তন্নি কান্না করে দেয়৷ তার কান্নার শব্দে যখন মায়া থামে না তখন তার বুকের ভেতর আরও তীব্র ঝড় উঠে। আশরাফকে জড়িয়ে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

জোহান একবার তাদের দিকে তাকিয়ে মায়ার পিছনে দৌড় দেয়। মায়াকে ডাকলেও সে দাঁড়ায় না। সোজা বেরিয়ে যায় কোম্পানির বাহিরে। সে বের হয়ে ড্রাইভারকে কল দেয়। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে জোহান তার কাছে আসে। মায়া বিরক্তির স্বরে বলে, “আপাতত আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। যাও এখান থেকে।”
জোহান তার হাত ধরে বলে, “আমি তোমার সাথে যাব।”
“আমি মানা…..”
মায়া দেখতে পায় একটি গাড়ি তাদের কোম্পানির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়িটিতে থেকে বডিগার্ড ও সুমনকে নামতে দেখে মায়া মৃদু স্বরে বলে, “তৌফিক এসেছে। যাও এখান থেকে।”
জোহান গাড়ির দিকে তাকিয়ে হাত মুঠো করে নেয়৷ তার মন চাইছিল লোকটাকে এখানেই টুকরো করে ফেলতে। মায়ার দিকে খারাপ নজরে তাকালে সাহস কি করে হলো? কিন্তু সে নিজেকে সংযত রাখল। এখানে অনেকের জীবনের প্রশ্ন জুড়িয়ে আছে। ভেতরে যাবার পূর্বে সে মায়াকে বলে, “ভুলেও ওর সাথে কোথাও একা যাবে না। নিজের গাড়িতে উঠো। আমি আসছি।” বলে সে সরে যায়।”

মায়ার গাড়ি আসায় সে স্বাভাবিক ভাবেই নামল সিঁড়ি দিয়ে। হঠাৎ সুমন তার সামনে এসে দাঁড়ালে মায়া ভ্রু কুঁচকায়, “কে আপনি? কী চাই?”
“গাড়িতে উঠুন। স্যার আপনার সাথে দেখা করার জন্য বসে আছে।”
“কোন স্যার?”
“তৌফিক স্যার।”
“কোন তৌফিক?” মায়া তার বুকের উপর হাত ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করে।
“আপনি… আপনি মজা করছেন তাই না? তৌফিক স্যার। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে।”
“ওহ ইয়েস। উনাকে বলুন উনি যেন বাহিরে এসে কথা বলে। আমি কোন গাড়িতে উঠতে পাড়বো না।”
“আপনি কি ভুলে গেছেন উনি কে?”
“যেই হোক। যার কাজ তারই এগিয়ে আসা লাগে।”

কথাটা শেষ হতেই সুমন কিছু বলতে যাবে এর আগেই তৌফিক গাড়ি থেকে নেমে আসে। নিজের গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবিটা টেনেটুনে ঠিক করে বলে, “আপনার নামে যা ভেবেছি তা সব ঠিক মনে হচ্ছে।”
“এত বড় নেতা হয়ে আমাকে নিয়ে ভাবার মতো আজাইরা সময় আপনার আছে?”
” ক’দিন আগে দেখা হলো আর আপনি তো এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন।”
“তৌফিক নামের তো মানুষের অভাব নেই তাই না? আর আপনার সাথীরা এতও গুরুত্বপূর্ণ না। আর আমি অগুরুত্বপূর্ণ জিনিস মাথায় জমিয়ে রাখি না। এসব আজাইরা জিনিস জমিয়ে রাখলে ব্রেন ওয়ার্ক করা বন্ধ করে দিবে।”
তৌফিক কথাটায় হাসে। মায়ার মাথার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে, “হোয়াট হ্যাপেন্ড?”
“নাথিং মাচ। যাস্ট কয়েকটা স্টুপিড, ইডিয়ট টাকার জন্য কিডন্যাপ করতে এসেছিল৷ নর্দমার কীটার মতো পিষে দিয়েছে। গাঁধার দল ছিলো বুঝলেন। এটা যাস্ট ছোট একটা আঘাত।”
কথাটা শুনে সুমনসহ সবাই একে অপরের দিকে তাকাল। জানা -অজানাই তাদেরই তো অপমান হলো।
“ওহ মিস মায়া দেখছি ভালোই সাহসী।” তৌফিক বাঁকা হেসে বলে।
“আপনি নিশ্চয়ই এখানে আমার সাহসীকতার প্রশংসা করতে আসেন নি। শুনেছি তিনদিন আগেও আমার অফিসে এসেছিলেন। এসিস্ট্যান্টকে বলে গিয়েছেন যেন আমি আসলে আপনাকে জানাক। কেন?”
“আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো। একটা বিজনেজ প্রাপোজাল ছিলো। ”
“নেতাগিরি ছেড়ে ব্যাপারি হওয়ার শখ জাগলো নাকি আপনার?”
“আপনার কথা খুব ধাঁরাল। সবার সাথে সব ভাবে কথা বলা যায় না জানেন তো?””
“যা বলি সোজাসাপটা বলি। আর ব্যাবসায়ে ধারালো ভাবে কথা না বললে হয় বলুন? সবাইকে নিজের স্থান বুঝিয়ে ব্যবসা সামলাতে হয়।”
“এজন্যই তো আপনাকে খুঁজছিলাম।”
“আপনার স্থান বুঝানোর জন্য?”
তার কথায় তৌফিক জোরপূর্বক হাসে।
“আপনি ভালোই রসিকতা করতে পারেন। কোথাও যাওয়া যাক? বসে এই ব্যাপারে কথা বলি?”
“আজ না মিস্টার তৌফিক। শরীর ভালো না। বাসায় যাব।” সে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বলে, “আমার ফোন নাম্বার, রাতে কল দিবেন।”
তৌফিক তার দিকে তাকিয়ে থেকে কার্ড নেবার বাহানায় তার হাত ছোঁয়।

মায়া কপাল কুঁচকে তার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার তৌফিকের দিকে তাকায়। সাথে সাথে হাত ছাড়িয়ে বলে, “গেলাম। আল্লাহ হাফেজ।”
বলে তার গাড়ির দিকে যায়। আর তৌফিক পিছন দিক থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে।

সুমন রাগান্বিত স্বরে বলে, “ভাই কত বড় সাহস আপনার সাথে বেয়াদবি করেছে। একবার বলুন চুল ধরে টেনে এনে আপনার সামনে ফালাবো।”
কথাটায় তৌফিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সুমনের দিকে। তার বুকে একটা লাথি মারলে সে যেয়ে ধাক্কা খায় গাড়িতে, “তোর সাহস তো কম না। যে জিনিসকে আমি চোখ দিয়ে উপসনা করছি তাকে ছোঁয়ার কথা বলছিস?” তারপর নিজের হাত নাকের কাছে নিয়ে লম্বা নিশ্বাস নেয়, “ওকে ছোঁয়ার সাথে সাথে আমার ঠিক তেমন অনুভূতি হয়েছে যেমন মেঘলাকে প্রথম ছুঁয়ে হয়েছিল। ওই হারামজাদি তো আমার অমান্য করলে ক্ষোভ হয় কিন্তু মায়ার বেখেয়ালি ভাবটাই আমাকে আরও আকর্ষণীয় করছে। ওকে পাওয়ার আকাঙ্খা বাড়ছে আমার। সুমন…”
“জ্বি…জ্বি স্যার?”
“আজ রাতের প্লান সব ক্যান্সেল করে দে।”
কথাটা শুনে চমকে উঠে সুমন, “স্যার আজকে বুধবার।”
“হোক।” বলে সে গাড়িতে উঠে পড়ে। তার পিছে সুমনও উঠে। বডিগার্ডরাও পিছনের গাড়িতে উঠে রওনা দেয়।
তারা যাবার পর জোহানও জলদি গাড়ি নিয়ে যায় মায়ার এপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে।

জোহান মায়ার এপার্টমেন্টের সামনে দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কলিংবেল দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু মায়া দরজা খুলছে না। কলও দিচ্ছে কিন্তু সে তাকে ব্লক করে রেখেছে। এখন তার ভীষণ চিন্তা হলো। সে চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর হঠাৎ সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠলো।

তার ভাবনা ঠিক ছিলো। সে মায়াকে পেল ছাদেই। সে ছাদের বর্ডারে বসে পা ঝুলিয়ে মেঘলা আকাশ দেখলে। এই দেখে চিন্তার মাঝে ভীষণ রেগে গেল জোহান। সে দৌড়ে যেয়ে মায়াকে বকুনি দেয়, “তোমাকে কতবার বলেছি বর্ডারে পা দিয়ে বসতে না”
মায়া তার দিকে একপলক তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”
জোহানের এবার রাগ আরও বাড়ে। সে মায়ার কোমড় আঁকড়ে ধরে তাকে নিজের দিকে ঘুরায়। তারপর কোলে তুলে নামায় তাকে। মায়া রেগে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “কী সমস্যা তোমার? আমাকে কি শান্তির কিছু মুহূর্ত দেওয়া যায় না?”
“তোমার মনে ডর ভয় নেই বলে কি মিনিটে মিনিটে আমাকে হার্ট অ্যাটাক দিবে নাকি?”
“বিরক্ত না করে যাও তো।”

মায়া তাকে আবার ধাক্কা দিয়ে সরাতে নিলে জোহান তার বাহু ধরে নেয়, “আমি জানি তোমার এই মুহূর্তে তন্নির উপর ভীষণ রাগ উঠছে। কষ্ট লাগছে ওর কাজে। তোমার রাগ উঠলে রাগ বের করো, কান্না করলে কান্না করো। তবুও এমন স্বাভাবিক হবার নাটক করো না।”
“হ্যাঁ তোমরাও তো সব ঠিক করবে। আমার কান্না করা লাগবে, কখন হাসা লাগবে, কাকে ভালোবাসা লাগবে! সব তো তোমরা সবাই-ই সিদ্ধান্ত নিতে পাড়ো। ছোটবেলা থেকে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে আমাকে কেমন ব্যবহার করতে হবে, কি নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে, কাকে বিয়ে করতে হবে, সব। তারপর যখন বিয়ের সময় এগোল আমি ওয়াহিদকে ভালোবাসলাম তখন ওয়াহিদ সিদ্ধান্ত নিলো সে অন্যকাওকে বিয়ে করবে। তন্নি সিদ্ধান্ত নিলো ওয়াহিদ না ভালোবাসলেও আমার সাথে থাকতে হবে। সে আমাকে কিছু জানাবে না। পরিণাম কি? আমাকে ভরা মানুষের মধ্যে অপমানিত হতে হলো। মুহূর্তে বড়দের সিদ্ধান্ত পালটে গেল, আমার বদলে দিয়া ও ওয়াহিদের এনগেজমেন্ট হবে। আমি দিনরাত পরিশ্রম করেছি আমার জীবনের রশি আমার হাতে নেবার জন্য। আমার সিদ্ধান্তগুলো যেন আমি নিতে পাড়ি এজন্য। আমার জীবন গুছাতে পারি। কিন্তু না, তুমি আমার জীবন আবার এলোমেলো করে দিলে।” সে জোহানের কলার ধরে বলে, “তুমি নিজে আমাদের ভালোবাসার সিদ্ধান্ত একা নিয়ে নিলে। তোমার মর্জি হিসেবে আমাকে কাছে টানবে আবার দূরে সরিয়ে দিবে? তোমার মনে হয় আমি সারাজীবন তোমার ভালোবাসায় তোমার অপেক্ষা করব?”

জোহান চুপচাপ সব কথা শুনে। একটা শব্দও করে না। মায়াকে তার বুকের কষ্টগুলো বের করতে দেয়। সে দেখে মায়ার রক্তবর্ণ নয়ন সিক্ত হয়ে উঠেছে। মুহূর্ত না পাড় করেই সে মায়াকেই বুকে ভরে নেয়। মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আস্তে আস্তে। মায়া নড়াচড়া করে না। জোহান তার শার্টের ভেজা ভাব অনুভব করতে পেরে মৃদু হাসে। মায়ার কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলে, “তন্নি তোমার জন্যই তো এমন কাজ করেছিল যেন তোমার কষ্ট না পেতে হয়। তোমাকে অনেক ভালোবাসে যে। আর ওয়াহিদও তোমার কষ্ট যেন না বাড়ে একারণে এতবছর একথা লুকিয়েছে। তোমার ঘৃণা একা সহ্য করেছে। মাফ করে দেও ওদের।”
“এখন তুমি এই সিদ্ধান্তও নিবে?” কাঁপা কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বলে মায়া।
জোহান আরেকটু ভালো করে মায়াকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়, “তুমি নিজে এখন ওদের উপর রাগ করে কষ্ট পাচ্ছো।”
“তো কি? আমি কষ্ট পেলেই কি ওদের দেওয়া কষ্ট ভুলে যাব? কষ্ট তো পর লোকেরা দেয় না। দেয় তো আপনরাই। আমরা যাকে যত ভালোবাসি সে ততই কষ্ট দেয় আমাদের। মায়া তাদের ভালোবাসা মানুষদের দেওয়া কষ্ট ভুলে না। তাদের ক্ষমাও করে না।”
জোহান মায়াকে সাথে সাথে ছেড়ে তার কাঁধ ধরে সরিয়ে তার দিকে তাকায়। মায়া সরাসরি তাকায় জোহানের দৃষ্টিতে। সে মুহূর্তে আকাশে গর্জন হয়। বজ্রপাত শুরু হয়। আর মুহূর্তে ঝরঝরে ঝুম বৃষ্টি নামে। জোহান আকাশের দিকে তাকিয়ে মায়ার মাথায় উপর হাত রাখে, “নিচে চলো। তোমার শরীর এমনিতেই খারাপ। শরীর আরও হয়ে যাবে।”
জোহান মায়ার হাত ধরে নিয়ে যেতে নিলেই সে জোহানের হাত টান দিয়ে নিজের দিকে ফেরায়। পা’য়ের পাতা উঁচু তার গলা জড়িয়ে ধরে করে আচমকা অধরে চুমু বসিয়ে দেয়।

হঠাৎ এমন কাজে জোহান নড়ে উঠে। অধরে কোমল স্পর্শের অনুভূতি হতেই তার সম্পূর্ণ দেহ ঝিমঝিম করে উঠল। মায়া তাকে ছাড়তেই পলক ভরে তার দিকে তাকায়। বৃষ্টির ফোঁটা জল তার মুখের উপর ছড়িয়ে আছে। চোখের পলকের উপর বৃষ্টির পানি পড়তেই তার নেশামাখা দৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চুলে বৃষ্টির ফোঁটা লেগে আছে মুক্তোর ন্যায়। নিশ্বাস ঘন। তার চোখ যেয়ে আটকায় মায়ার অধরে। গোলাপি, ফুলো ঠোঁটজোড়ার দিকে তাকাতেই তার নেশা লেগে যায়। সে একহাত মায়ার ভেজা চুলে ডুবিয়ে অন্য হাত তার কোমড়ে রেখে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। মাতোয়ারা হয়ে তার ঠোঁটে ডুব দেয়। আচমকায় তার ধ্যান ভগ্ন হয় ঠোঁটের প্রচন্ড ব্যাথায়। সে ছিঁটকে পিছিয়ে যায়। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দেখে র’ক্ত বের হচ্ছে মায়ার কামড়ে। সে মায়ার দিকে তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। মায়া তার দিকে মলিন নজরে তাকিয়ে বলে, “সরি… ভুলে হয়ে গেছে। তোমাকে কিস করা আমার মোটেও উচিত হয় নি। কেবল ভুল ছিলো এটা।” বলেই মায়া রাগী দৃষ্টি তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

জোহান হাত দিয়ে তার ঠোঁটের র’ক্ত মুছে তাকাল মায়ার যাবার দিকে। সে চোখ ঘুরাল। হাসল। মেয়েটা আসলেই অতিরিক্ত জেদি। সেদিনের ছাদে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিশোধই নিলো আজ।
.
.
দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল। ইতিমধ্যে তৌফিক মায়াকে বারবার দেখা করতে বললেও মায়া এড়িয়ে যায়। তার কলও তেমন ধরে না। তবে সে জানিয়েছে এই সাপ্তাহে দেখা করবে সে। কেননা অভ্রর সাথে তার পরিকল্পনার কাজ শেষ হয়েছে। এখন সব পরিকল্পনা অনুযায়ী চললেই হলো। অন্যদিকে তন্নির সাথে এইমাসে মায়া একটি কথাও বলে নি। তন্নি দেখা করতে গেলেও মায়া তার সাথে কথাই বলে না।

আশরাফ ও তন্নির হলুদসন্ধ্যা। কিন্তু তন্নি বের হতে তৈরিই না। মায়া না আসা পর্যন্ত সে বের হবে না। তার বিয়েতে তার বেস্ট ফ্রেন্ড থাকবে না এটা হতেই পারে না। এই বিয়েই সে করবে না। তার সামনে বসে আছে আশরাফ, মেহেদী, জোহান। আশরাফ অনুরোধের সুরে তন্নিকে বলে, “প্লিজ তন্নি এমন করিস না। বাহিরে সব মেহমান অপেক্ষা করছে।”
মেহেদীও বলে,”ভাই কান্না বন্ধ কর। এমনেই দশকেজি মেকাপের উপর ভূত লাগতাসে। এর উপর কানলে রিয়াল ভূত লাগবো।”
তার কথায় আশরাফ ও জোহান দু’জনেই চোখ রাঙিয়ে তাকায় তার দিকে। মেহেদী দু’জনের তাকানো দেখে ভড়কে যায়।

তন্নি জোহানের দিকে তাকায়। তার হাত ধরে অনুরোধ করে বলে, “জোহান প্লিজ তুমি মায়াকে নিয়ে আসো।”
“গতকাল থেকে ও বাসায় নেই। আজ ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। এখানে আসার পূর্বেও ওর বাসায় গিয়েছিলাম নেই।”
তন্নি কষ্টে তার গলার ফুলের সিতাহার ছিঁড়ে ফেলে, “আমি বিয়েই করবো না। আশরাফ তুই যেয়ে সবাইকে বল এই বিয়ে হবে না।”
আশরাফ বেক্কল হয়ে যায় তার কথায়, “এই… এই কি বলিস তুই? আমার বাপে গলায় পাড়া দিয়া মা’ইরা ফেলবো।”
“তো ম’রে যাবি। প্রেম আর বন্ধুত্বের জন্য এতটুকু করতে পাড়বি না?”
আশরাফও এবার বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, “এই মায়ার বাচ্চাকে এই সময়ই রাগতে হলো? এই পাগল মহিলাকে ও ছাড়া কে সামলাতে পাড়ে?”
তন্নি কথাটায় রাগী দৃষ্টিতে তাকায় আশরাফেরদিকে।

এমন সময় বাহির থেকে মাইকের বিকট শব্দ আসে। সাথে তাকে দরজাতেও টোকা পড়ে। আশরাফ বলে, “আমি দেখছি।”
সে দরজার দিকে এগোয়। খুলে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে চমকে যায়, “আপনি!”

চলবে…”

অনুভূতির খাঁচায়
পর্ব-৪৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

এমন সময় বাহির থেকে মাইকের বিকট শব্দ আসে। সাথে তাকে দরজাতেও টোকা পড়ে। আশরাফ বলে, “আমি দেখছি।”
সে দরজার দিকে এগোয়। খুলে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে চমকে যায়, “আপনি!”

আশরাফের বিস্মিত কন্ঠ শুনে জোহানও উঠে যায়। দরজায় ইনারাকে দেখে সে-ও অবাক হয়, “তুমি এখানে কীভাবে ইনারা?”
ইনারা রুমে উঁকি মারে, “বউ কী এখানে না’কি?”
জোহান দরজার সামনে থেকে সরে তন্নিকে দেখায়। ইনারা এক প্রকার দৌড়ে যায় তন্নির কাছে। তা দেখে জোহান বকুনি দেয় তাকে, “ইনারা লাফালাফি কম করো। আমার ভাতিজা বা ভাতিজি আছে তোমার সাথে। দু’দিন পর বাচ্চা হবে এখন বাচ্চাদের মতো দৌড়াদৌড়ি করছো!”

ইনারা জোহানের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলায়, “হ্যাঁ সভ্য, সুরভি আর মায়া আপু তো কম ছিলো তুমিও বকা শুরু করো।”
তারপর সে তন্নির দিকে তাকায়, “আহা কী সুন্দর লাগছে তোমাকে!” তারপর একটু ঝুঁকে এদিক ওদিক থেকে দেখে, “শুধু কাজল লেপ্টে গেছে। একটু বেশিই।”
শেষ কথাটা বলে জোরপূর্বক হাসল। নিজের পার্স থেকে টিস্যু বের করে আলতো করে তার চোখের নিচে মুছে বলল, “চলো বাহিরে যাই।”
তন্নি না চাইতেও হাসার চেষ্টা করল, “থ্যাঙ্কিউ অনুষ্ঠানে আসার জন্য। কিন্তু আজ মনে হয় অনুষ্ঠান হবে না। মায়াকে ছাড়া আমি বিয়ে করবোই না।”
“আচ্ছা বিয়ে করো না। অনুষ্ঠানটা করে নেও। তোমার জন্য এত সুন্দর স্যারপ্রাইজ রেখেছি। আসো আসো।”
ইনারা জোর করে তন্নিকে নিয়ে যায়। তন্নি ইনারাকে কিছু বলতেও পাড়ে না। নিজেকে ছাড়াতেও পাড়ে না যদি জোর করতে গেলে ইনারার বাচ্চার কোনো সমস্যা হয়?

আশরাফ জোহানকে বলে, “ব্রো সবাই আমার বিয়ের পিছনে হাত ধুঁয়ে পড়ে আছে কেন?”
জোহান হেসে বলে, “চলো আমরাও যাই।”
যাবার সময় সে দেখে মেহেদী হা করে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। জোহান তাকে হাল্কা ধাক্কা দেয়, “কোথায় হারিয়ে গেলে?”
“উফফ ইনারা সিনেমার স্ক্রিন থেকে সামনা-সামনি কত বেশি সুন্দর! একদম পরীর মতো দেখতে।”
জোহান তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “এই পরীর পরা যদি জানে তার বউয়ের দিকে এভাবে হা করে তাকিয়ে ছিলে কাল আশরাফের বিয়ের পরিবর্তে তোমার কবর জেয়ারত করতে হবে। তাড়াতাড়ি আসো।”

তারা সকলে ছাদে এসে দেখে চারদিকে হাল্কা আলো জ্বলানো। তারা যেয়ে দাঁড়ায় ইনারা ও তন্নির দিকে। জোহান প্রশ্ন করে ইনারাকে,
“এখানে কী হচ্ছে?”
“দেখে নিও।”
“তুমি কী জানো মায়া আসবে কি-না?”
তন্নিও প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ মায়ার সাথে তোমার কথা হয়েছে? ও আসবে?”
“ওকেই জিজ্ঞেস করে নিও।”
এমন সময় স্টেজের লাইট জ্বলে। সেখানে আগমন হয় মায়ার। তার হাতে একটা মাইক। সে তন্নি ও আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে, “সে স্কুলজীবন থেকে আজ পর্যন্ত একসাথে আছি। হাসি, কান্না, অভিমানের দিয়েই তো সম্পর্ক গড়ে। হাজারো অভিমান হোক, বন্ধুত্বটা আর অভিমানের ভারে ডুবে যায় না তাই না? আমার আজও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার দুই বেণি করে স্কুলে আসা তন্নি আর সারাক্ষণ এলোমেলো থাকা আশরাফের আগামীকাল বিয়ে। সময় কত দ্রুত যায় তাই না? আচ্ছা তাহলে সময়ের কাঁটাটা ঘুরিয়ে দেই? চল আজ আবার সে কিশোর দিনে প্রস্থান করি। যেকারণে তোর আর আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিল। মনে আছে?”
তন্নি একগাল হাসে কান্নার মাঝে। উচ্চস্বরে উওর দেয়, “পঞ্চসুরকে নিয়ে।”
“স্কুলে থাকতে ক্লাসে এই গানটা গেয়েছি নিজের মতো লিরিক্স বানিয়ে তখন ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিলি। পঞ্চসুরের গানের লিরিক্স কীভাবে পরিবর্তন করতে পারি? কী তুমুল ঝগড়া। সে ঝগড়া থেকে পঞ্চসুরকে নিয়ে ডিসকাশন হয় তারপর আস্তে-ধীরে বন্ধুত্ব। সে ভুল গান দিয়ে যদি অনুষ্ঠানটা না শুরু করি তাহলে হয় বল?'”

মায়া হাসে। তারপর গুণগুণ করে গান ধরে,
“স্বপ্নরা পেখম মেলে, উড়ে বেড়ায় মেঘের শহরে
আবারও হবে দেখা, ভাসব আবার প্রেমজোয়ারে….
উড়ে বেড়ায় এই মন বেপরোয়া
তোমার অনুভূতির আসমানে
স্বপ্নরা পেখম পেলে, উড়ে বেড়ায় অনুভূতির শহরে….
আমার অনুভবে তুমি, অনুভবে তুমি, অনুভবে শুধু তুমি…”

জোহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। তখন ইনারা এসে দাঁড়ায় তার পাশে। তার কাঁধে ধাক্কা দিলে তার ধ্যান ভাঙে। ইনারাকে দেখে হাসে। আবার তাকায় স্টেজে মায়ার দিকে।
ইনারা মিটিমিটি হেসে ধীর সুরে জিজ্ঞেস করে, “তো বাবু কী তোমাকে চাচ্চু ডাকবে না খালু?”
জোহান প্রশ্নটায় তাকায় ইনারার দিকে।
ইনারা বলে, “মায়া আপু কিন্তু আমার বড়বোন। হিসেবে বাবুর খালামণি হয়।”
ইনারা দেখে মৃদু আলোয় জোহান লজ্জা পাচ্ছে। সে মাথা চুলকায়। ইনারা বিরক্তি স্বরে বলে, “কিছু না করে বসে থাকলে এমন মাথাই চুলকাতে হবে বুঝলে? শুনলাম আশরাফের কাজিন না’কি মায়া আপুর পিছনে পড়ে আছে। তোমার পাতা কাঁটার আগে প্রাপোজ করে দেও। ক্লিয়ারলি তুমি আর আপু একে অপরকে ভালোবাসো। কিন্তু গতরাতে মায়া আপু বলল তুমি না’কি বিয়েই করতে চাও না। এবারও ছাগলগিরি কান্ডকারখানা করলে আর মিঙ্গেল হওয়া লাগবে না ভাই, সারাজীবন সিঙ্গেল থেকে যাইবা।”
জোহান পাশ দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে ইনারাকে বলে, “কাওকে বলো না। শুধু তোমাকে জানাচ্ছি।”
“সিক্রেট?”
“আগে আমি সত্যি বিয়ে করতে চাই নি। বাবা মা’য়ের সম্পর্কের ব্যাপারে তুমিও জানো। এর উপর আমার অতীত। আমার ভয় হতো যদি ভবিষ্যতে মায়ার প্রতি তেমন অনুভূতি না আসে তাহলে কী করবো?”
“তুমি এখনো সেসব কথা নিয়ে….”
জোহান ইনারার কথা কেটে বলল, “ছিলাম। এখন আর নেই। সেদিন মায়াকে যখন পাচ্ছিলাম না তখন আমার অনুভব হয়েছি। ওকে ছাড়া আমার থাকাটা কত কষ্টের হবে। এই অনুভূতি আমি কখনো শেষ হতে দিতে চাই না। কখনোই না। তারপর নিজেকে অনেক সময় দিয়েছি। ভেবেছি আমার ভবিষ্যত নিয়ে। সে ভাবনাটায় মায়া না থাকলে আমার নিশ্বাস আটকে আসে। আমি ভবিষ্যত ওকে ছাড়া কল্পনাও করতে পাড়ি না।”
“ওহ হো তুমিও গেছো? অনুভূতির খাঁচায় বন্দী হয়েই গেলে অবশেষে?”
“পনেরো দিন আগে নিজের সিদ্ধান্তে অটল হলাম। মায়া এখন তৌফিকের ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত। ওর একটা ব্যবস্থা করলেই প্রাপোজ করব। জুয়েলার্সে আংটি অর্ডার দিয়েছি। ব্লু স্যাফায়ার।”
“রেড রুবি দিতে। আপুর পার্সোনালিটির সাথে যায়।”
“তোমাদের কাছে ও আগুন হতে পাড়ে, আমার কাছে আসলে পানি হয়ে যায়।”
“ওহ হো ভাই তুমি তো দেখি লাভার বয় হয়ে গেছো সম্পূর্ণ। এখন মিস্টার লাভার বয় স্টেজে যান।”
জোহান স্টেজের দিকে তাকিয়ে দেখে মায়ার গান হয়ে গেছে। সে দৌড়ে যেয়ে তন্নিকে জড়িয়ে ধরেছে। সে ইনারার দিকে তাকায় অবাক দৃষ্টিতে, “আমি কেন যাব?”
“পঞ্চসুর তোমাদের পাঁচজনের একজনকে ছাড়া যে অপূর্ণ।”
জোহান আবার তাকায় স্টেজের দিকে। কয়েকজন লোক বাদ্যযন্ত্র আনছে স্টেজে। তারা নামতেই স্টেজে উঠে সভ্য, সামি, ইরফান ও ঐশি। জোহান একপ্রকার দৌড়ে যায় তাদের দিকে। সভ্যর হাতে দুইটা গিটার ছিলো। জোহানকে আসতে দেখেই সে একটা গিটার তার দিকে ছুঁড়ে মারে। জোহান তা ধরেও নেয়। স্টেজে উঠেই তাকায় তার বন্ধুদের দিকে। সভ্যর দিকে তাকাতেই সে চোখ টিপ মারে। জোহান জিজ্ঞেস করে, “তোরা আমাকেও কী স্যারপ্রাইজ দিলি?”
ইরফান বলে, “এখন চিন্তা তো আমার হচ্ছে। কতদিন গ্রুপ গান করিনি। আজ হঠাৎ। সব মনে আছে তো?”
ঐশি তাকে কাঁধে মারে, “যত্তসব অশুভ কথাবার্তা। সব ঠিক হবে। যত সময়ই হোক। পঞ্চসুর তাদের সুর ভুলতে পারে না।”
সামি তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে বলে, “তোদের উপর ঠাডা পরুক। তোরা কচুর কথাবার্তা শুরু করছিস? এদিকে সবাই আনন্দে মেতে উঠেছে এখন তোদের টেনশন হচ্ছে। আগে ভাবিস নাই কেন?”
সভ্য চোখ রাঙিয়ে তাকায় সামির দিকে, “তুই আর ইনারার আশেপাশে থাকিস না ভাই।”
“তাহলে শুরু করা যাক?” জোহান জিজ্ঞেস করে।
“কোন গান দিয়ে শুরু করবি?”
“সব সময় যেটা দিয়ে শুরু করি।” সভ্য তাকায় ইনারার দিকে, “আমার অনুভবে…”
জোহান তার দিকে তাকিয়ে হাসে। তার সাথীদের একত্রে দেখে প্রশান্তির নিশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে। এটাই তো তার সুখের জায়গা। আজ এতদিন পর তারা একসাথে আবার গাইবে ভেবেই তার বুকের ভেতর উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল। সুখ শব্দটা মাথায় আসতেই তার চোখ আপনা-আপনি চলে যায় মায়ার দিকে। মায়া তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে জোহানও হাসলো আপন মনে।

মায়া স্টেজ থেকে নেমেই তন্নিকে যেয়ে জড়িয়ে ধরে। তন্নি সাথে সাথে ক’টা চাপড় মারে তার পিঠে, “শয়তান, ফাজিল, কুত্তি তুই আমার জান বের করে দিয়েছিলি। এতদিন ইগনোর করার পর আজ ভালোবাসা উতলে পড়ছে?”
মায়া তাকে ছেড়ে বলে, “আমাকে কষ্ট দিয়েছিলি না? শাস্তি তো পেতেই হতো।”
“তুই অনেক বাজে। জানিস?”
“জানি। তোর জন্য আরেকটা স্যারপ্রাইজ আছে।”
“কী?”
পঞ্চসুর স্টেজে উঠলে সকলে আনন্দে মেতে উঠে।অনেকে স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে তন্নি দেখতে পায় ওয়াহেদ ও দিয়া আসছে। তন্নি তাদের আসতে দেখে ক্ষেপে যায়, “ওরা এখানে কী করছে?”
“আমি ডেকেছি।” মায়ার কথা শুনে তন্নি অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।
মায়া বলে, “আমি ওর উপর এজন্য ক্ষেপে ছিলাম যে ও আমাকে আগেও এসে বলতে পাড়তো। যা ও চেয়েছিল…”
“দোস্ত আমি…”
তন্নির কথার মাঝখানে মায়া তার হাত ধরে নিলো, “মাফ করে দিয়েছি। তোকেও, ওকেও। এখনো কষ্ট আছে সেদিন আমার অপমানিত হবার সময় ও আমার জন্য স্ট্যান্ড নেয় নি। কিন্তু পড়ে ভাবলাম আমারও দোষ ছিলো আমি আমার ভালোবাসা ওর উপর চাপাতে চেয়েছিলাম। কখনো ওকে জিজ্ঞেসও করিনি যে ও আমাকে ভালোবাসে কি-না। ওইদিনের জন্য হয়তো আমি নিজেও দায়ী। না-কি জানি না। আগে প্রতিশোধ নেবার জন্য আগুন মনে জ্বলছিল কিন্তু আমার প্রতিশোধে জ্বলা হৃদয় শান্ত হয়ে গেছে।” বলে সে তাকায় জোহানের দিকে, “ওয়াহেদকে দেখলে আজকাল কষ্টের অনুভূতিটা হয় না। হয়তো ভালোবাসাটা নেই এজন্য। আর রইলো দিয়ার কথা ও কখনো আমার জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলোই না। সবার জন্য না হোক নিজের মনের শান্তির জন্য সবাইকে মাফ করে দিলাম। কেবল একজন বাদে।”
“কে?” তন্নি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
মায়া একগাল হেসে তাকায় তার দিকে। ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বাচ্চামো স্বভাবে বলে, “সিক্রেট।”
তন্নি অবাক হয়। কিন্তু প্রশ্ন করার পূর্বেই ওয়াহেদ ও দিয়া এসে পড়ে। তাদের কিছুটা অকোয়ার্ড লাগছিল। ওয়াহেদ আমতা-আমতা করে বলল, “বিয়ের অভিনন্দন।”
তন্নি গোমড়া মুখে উওর দেয়, “থ্যাঙ্কিউ।”
কিন্তু আশরাফ ও মেহেদী তাকে জড়িয়ে ধরে। মুহূর্তে মায়ার সামনে তার কলেজের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠে। আপনা-আপনি হাসি এঁকে উঠে তার ঠোঁটের কোণে।

ওয়াহেদ মায়ার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু একপ্রকার জড়তা কাজ করছিল তার মাঝে। ব্যাপারটা বুঝে আশরাফ নিয়ে যায় তন্নিকে স্টেজের কাছে। মেহেদীও নিয়ে যায় দিয়াকে। ওয়াহেদ তারপরও নিজ থেকে পাড়ে কথা বলতে। অবশেষে সে বলে, “সেদিন আমি ইচ্ছে করে তোর কেবিনের সামনে কথাগুলো বলিনি। তুই যখন বললি আমি তোকে আমার ও দিয়ার ব্যাপারে জানালে আমরা এখনো বন্ধু থাকতাম এরপর থেকে আমার মাথা কাজই করছিল না। বুকে ব্যাথা করছিল খুব। আফসোস হচ্ছিল।”
“তোর মাথা তো কখনো কাজ করে না। নে ক্যান্ডি খেয়ে কান্না বন্ধ কর। ক্যান্ডি খেলে ব্যাথা কমে যায়।” মায়া একটা ক্যান্ডি নিয়ে তার মুখের সামনে রাখলে ওয়াহিদ তার দিকে তাকায়। তাদের প্রথম দেখাটা এভাবেই যে হয়েছিল। মায়া তার ভাইয়ের সাথে খেলা করতে যেয়ে পড়ে ব্যাথা পেয়ে কাঁদছিল। তার ভাই তাকে রেখেই চলে যায়। তখন ওয়াহেদের পরিবার বেড়াতে এসেছিল তাদের বাড়ি। ওয়াহেদ তাকে কাঁদতে দেখে তার পাশে এসে বসে। তাকে একটা ক্যান্ডি দিয়ে বলে, “তুমি কেঁদো না, নেও ক্যান্ডি খেয়ে কান্না বন্ধ কর। ক্যান্ডি খেলে ব্যাথা কমে যায়।”
এতবছর পর একই কথা শুনে সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে মায়ার দিকে। তারপর দু’জনে একসাথে হেসে দেয়। মায়া তার কাঁধে জোরে একটা ঘুষি মেরে বলে, “যাহ মাফ করে দিলাম।”
“আবার কী সব আগের মতো হবে?”
“আগের বয়স তো নেই তাই আগের মতো হবে কি-না জানি না। তবে…” মায়া তার দিকে তাকায়, “তবে তুই সবসময়ই আমার প্রথম বন্ধু থাকবি।” বলে সে ওয়াহেদের হাত ধরে দৌড়ে ভিড় ঠেলে সামনে নিয়ে যায়। সবসময়ের মতো। ওয়াহেদ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ ভিজে যায়, “থ্যাঙ্কিউ দোস্ত। থ্যাঙ্কিউ।”
শব্দের কারণে কথাটা হয়তো মায়া শুনলো না। তার বন্ধুদের কাছে যেয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখতেই তন্নি মায়াকে নিজের দিকে টেনে ওয়াহেদকে দেখে ভেংচি কাটলো। তা দেখে হাসল ওয়াহেদ।

মায়া তাকিয়ে ছিলো জোহানের দিকে। জোহানও তার দিকে তাকাল। হাসলো। তারপর তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আবারও তার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করল। যেন বুঝাল তার সুখের জায়গা কোনটা। মায়া সবই বুঝল। তার চোখে জ্বলজ্বল করা সুখ সে দেখতে পায়। তার হাসি আরও গাঢ় হলো। এমন সময় ওয়াহেদের শব্দ সে শুনল, “আসলে তোকে ভালোবাসে।”
সে অবাক হয়ে তাকায় ওয়াহেদের দিকে। ওয়াহেদ বলে, “আমি এতমাস ওর উপর নজর রাখিয়েছিলাম। তোর জন্য আসলে চেঞ্জ হয়ে গেছে। অন্য কোনো মেয়ের সাথে এখন কথাও বলে না সেভাবে। শুনেছি তোর যেদিন এক্সিডেন্ট হয়েছিল পাগলের মতো তোকে খুঁজেছে। আমি প্রথমে চিন্তায় ছিলাম তুই আবার ভালোবেসে কষ্ট পাবি কিন্তু ও আসলেই তোর জন্য পাল্টেছে মায়া। আমার বান্ধবীকে ওর হাতে দিতে আমি রাজি।”
মায়া জোরপূর্বক হাসে। তারপর মুখ ফিরিয়ে আবার তাকায় জোহানের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলে, “কিন্তু আমি রাজি না।”
যে কথা শব্দেই দেবে যায়। গান শুরু হয় পঞ্চসুরের। তাদের গানের আগেই চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায় মানুষের। আশেপাশে ছাদেও মানুষ জমেছে। তারা হয়তো এখনো জানে না পঞ্চসুরের প্রিয় গান তারা শুনতে যাচ্ছে,

“ঝুমঝুমে বৃষ্টি নামে মনের কিনারায়
রাত জেগে আকাশ ডাকে কোন সে ইশারায়
মেঘডুবি কথা বলো চাও কী আমায়?
প্রেমজোয়ারে আসো ভেসে যাই
অনুভবের পৃথিবীতে হারিয়ে যাই
অনুভবে, অনুভবে, তুমি আমার অনুভবে,
অনুভবে, অনুভবে, তুমি আমার অনুভবে রবে….”

গানের মাঝে মায়ার কিছু মনে হলো। সে আশেপাশে সবাইকে এত খুশি দেখে ভাবল, ” আজ তো বুধবার। এখানে সকলে কত খুশি। আর অন্য জায়গায় মেঘলাসহ বাকি কতগুলো মেয়েকে তৌফিক কতটা অত্যাচার করছে কে জানে! আই হোপ আজকের প্লানটা কাজ করুক। আজ প্লানটা কাজ করলে রবিবারের অপেক্ষা থাকবে কেবল। সেদিন সব ঠিক থাকলে আমরা সবাইকে বাঁচাতে পাড়ব নিশ্চিত। যে সময় ওই সব মেয়ে সে নরক খাঁচা থেকে মুক্তি পাবে সেদিন আমি শান্তি পাব।”
.
.
মায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। সে তৈরি হচ্ছে তৌফিকের বাসায় যাবার জন্য। এতদিন বিভিন্ন জায়গায় দেখা করার কথা সে এড়িয়ে গেছে কারণ তার লক্ষ্য সে সোজা তার বাসায় যাবে। যদিও সেখানে যেয়ে কাজ করাটা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির কিন্তু কথা আছে না, যত ঝুঁকি বেশি ততই বেশি লাভ। ঝুঁকি ছাড়া উওম পরিণাম কল্পনাও সে করে না।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার দিকে তাকিয়ে। সে সময় প্রাইভেট নাম্বার থেকে কল। আসে তার ফোনে। সে কল ধরে, “হ্যালো অভ্র…”
“তুমি কী নার্ভাস মায়া?”
“না।”
“খোঁজ পেয়েছি সেখানে তোমাকে ড্রাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে তৌফিক। যদিও আমার লোকেরা আছে। বলেছি সে খাবার যেন ভুলেও তোমার কাছে না যায় তবুও সাবধানে থেকো।”
“ডোন্ট ওয়ারি। আমি খেয়াল রাখব।আপনারা রওনা দিয়েছেন নাসরিন নিবাসের জন্য?”
“সামনের একটা জায়গায় আছি।”
“কেউ দেখে নিলে? যদি তৌফিক তার লোকদের আপনার পিছনে লাগায়?”
“রেকর্ডে আছে আমি দেশের বাহিরে। হোটেল থেকে আমি অন্য গাড়ি ব্যবহার করে এসেছি। সুরভিও ওর বান্ধবীর বাসা থেকে এসেছে।”
“গুড ওকে বলবেন ওর কাজটাও সাবধানে করতে।”
“সুরভি কথা বলবে তোমার সাথে।”
তারপর ফোন থেকে সুরভির কথা শোনা যায়, “আপু প্লিজ সাবধানে থেকেন। ইনারা আপনার অপেক্ষা করছে কিন্তু। আমিও।”
“তুমিও সাবধানে থাকবে। সাহস রাখবে। সেখানে অনেক ঝামেলা চলবে কিন্তু তুমি রেকর্ডিং বন্ধ করবে না। কিছুতেই না। পরে আমরা মেয়েদের চেহেরা ব্লার করে দিব। এখানে অনেক মেয়েদের সম্মান জড়িত। নিজের সর্বোচ্চটা দিবে।”
“জ্বি আপু।”
আবার অভ্র কথা বলে, “মায়া তুমি চাইলে পিছাতে পাড়ো। আমি চিন্তা হচ্ছে খুব। আমি তোমাকে বিপদে ফেলছি না তো?”
“ওখানে আপনার লোক আছে আপনার চিন্তার প্রয়োজন পড়বে না। আপনি কেবল চিন্তা করুন যেন এই রেকর্ডিং সময় মতো টিভি স্টেশনে পৌঁছে যায়।”
“যাবে।”
ফোন রাখার পর অভ্র গভীর নিশ্বাস ফেলে। তারা গাড়িতে বসে আছে এক নীরব জায়গায়। সে আর সুরভি পিছনে বসা। সামনে ড্রাইভিং করছে ফজলু মিয়া। সে মুখ হাত দিয়ে ঢেকে রাখে কতক্ষণ। সুরভি তার বাহু ধরে। তার কাঁধে আলতো করে মাথা রেখে বলে, “চিন্তা করো না সব ঠিক হবে।”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না সুরভি। আমি শেষ পর্যায়ে। আমার এতদিনের ত্যাগ, পরিকল্পনা, কাজ সবকিছুর পরিণাম পাবো। সব ঠিক হবে তো সুরভি?” সে বিচলিত হয়ে হাত ধরল সুরভির।
সুরভিও তার হাত শক্ত করে ধরে, “সব ঠিক হবে। কেবল আপনি নিজেকে সংযত রাখবেন। তৌফিককে দেখে আপনার রাগ উঠবে জানি কিন্তু নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবেন না।”
.
.
গাড়ি এসে থামে তৌফিকের বাড়ির সামনে। সে গাড়ি থেকে নেমে দেখে আশেপাশে গার্ড ভরা। সে যতটা ভেবেছিল ব্যাপারটা এর থেকে বেশি কঠিন হবে। সুমন নিজে এসে থেকে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। মায়া আশেপাশে সব দেখতে থাকে। দরজায়ই সে দেখতে পায় তৌফিককে। তাকে দেখে মেকি হাসে মায়া,
“জনাব তৌফিক আমার জন্য দরজায় অপেক্ষা করছেন? বাহ!”
“আপনি তো স্পেশাল। আফসোস আপনার জন্য অপেক্ষা করা যায়।”
“আর আমি স্পেশাল কেন?”
তৌফিক তার চোখ দিয়ে মায়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে, “আমার ইচ্ছা তো আপনিই পূরণ করতে পাড়বেন তাই না?”
মায়া দাঁড়িয়ে যায়। তার দিকে তাকায় কপাল কুঁচকে, “মানে?”
“মানে আপনি অনেক বুদ্ধিমতি। এত ছোট বয়সে আর কেউ তার কোম্পানি এমন শীর্ষে পৌঁছাতে পাড়ে নি। আমার নিজের কোম্পানির শুরু করার জন্য এমন একজনকেই লাগতো। এর উপর আপনি নারী। আপনাকে দেখলে অনেকে অনুপ্রেরণা পাবে।”
মায়া আবারও হাঁটতে শুরু করে, “আপনি দেখছি নারীদের নিয়ে ভাবেন।”
“অবশ্যই। অনেক সম্মান করি। অনেক জায়গায় নারী শিক্ষার বৃত্তিও দিয়েছি। মা ছোট থাকতে মারা গেছে তো। মা’কে খুব ভালোবাসতাম। নারীদের একারণেই তো সম্মান করি। তারাও তো কারো মা, বোন, মেয়ে।”
মায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তৌফিকের দিকে। তার কথাগুলো শুনে ঘিনঘিন করতে লাগলো মায়ার। এসব জেনেও লোকটা এত বাজে কাজ করে? না জানলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। নিমিষে কেমন মিথ্যা বলতে পাড়ে লোকটা। মনে মনে হাজারো গালি দিলেও মুখে বলে, “ওয়াও। ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। কিন্তু আমি বলে দেই আমি যদি আপনার কোম্পানিতে কাজ করি তাহলে ত্রিশ পার্সেন্ট শেয়ার আমার হবে। আমিও এই কোম্পানি ছাড়ার কথা ভাবছিলাম আরও ভালো অফারের উদ্দেশ্যে। আপনার মিষ্টি কথা শুনে আমার শেয়ার কমাবো না।”
সোফার রুমে এসে তৌফিক বসার জন্য তাকে ইশারা করে। তৌফিক বসে সোফায়। মায়াও বসতে নিলে তৌফিক জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী অভ্রকে চিনেন মিস মায়া?”

চলবে…

অনুভূতির খাঁচায়
পর্ব-৪৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তৌফিক জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী অভ্রকে চিনেন মিস মায়া?”
মায়া তাকাল তৌফিকের দিকে। সরাসরি তার চোখে। স্বাভাবিকভাবেই উওর দিলো, “অবশ্যই চেনা উনি আমার। আমার সাথে উনার এনগেজমেন্ট হবার কথা ছিলো। একটি কারণবশত ভেঙে গেছে। এছাড়া উনি আমার এক রকমের আত্নীয় হন। আমার চাচাতো বোনের স্বামীর বড় ভাই। দূরের সম্পর্ক। কিন্তু আপনি হঠাৎ উনার কথা তুলছেন কেন?”
“এমনিই।”
“তো আমরা কি কথা বলছিলাম।।আপনি কেমন কোম্পানি শুরু করতে চান?”
“আপনি এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? আগে আমরা ডিনার করে নেই।”
“আমার কাজের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়োটা একটু বেশিই। তবুও আপনি যেহেতু বলছেন সেহেতু….ঠিকাছে ডিনার করেই নেই।”
“তাহলে চলুন। আমার স্ত্রী’কে বলেছি নিজে হাতে আপনার জন্য রান্না করতে।”
“ওহ হ্যাঁ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনার স্ত্রী আছে। আপনি অনেক ইয়াং তো।”
মায়ার কথায় তৌফিকের মনটা উড়ু উড়ু করে। যা তার মুখে স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে।

তৌফিক মায়াকে নিয়ে যায় ডাইনিং রুমে। সেখানে মেঘলা সার্ভেন্টদের সাথে মিলে খাবার গুছাচ্ছিল। তৌফিক যেয়ে হাত রাখল মেঘলার কাঁধে, “জান দেখো, কে এসেছে!”
মেঘলা মায়াকে সেখানে দেখতেই ঘাবড়ে যায়। সে তোঁতলিয়ে বলে, “তু…তুমি? তুমি এখানে কেন?”
তৌফিক তার কাঁধটা শক্ত করে ধরে, “জান মেহমানদের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? ওকে চিনেছো তুমি ওদিন তোমার সাথে গিয়েছিল ইন্টারভিউতে?”
“চি…চিনেছি।”
“গ্রেট। তাহলে আসো, বসো ডিনার করি।”
তৌফিকে মেঘলাকে একটি চেয়ার টেনে বসিয়ে নিজে পাশে বসল। তার সামনে বসলো মায়া।

হেল্পাররা সার্ভ করলো খাবার। তৌফিক টেবিলেও এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিল মায়ার দিকে। মেঘলার নজরেও তা পড়ল। কিন্তু তার কিছু বলা সাহস ছিল না। তার বারবার মনে হচ্ছিল। মায়া তার কারণে তৌফিকের কাছে ফেঁসে গেছে। না সেদিন মায়া তার সাথে দেখা করতে আসতো আর না তৌফিকের নজর তার উপর পড়তো। মায়ার কিছু হলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পাড়বে না। যেমন আজ পর্যন্ত রুমার জন্য পাড়ে না। তার মামাতো বোন যে তাকে পালাতে সাহায্য করেছিল বিয়েতে। তাকে মেঘলার সামনেই তারই বাসররাতে ধ’র্ষণ করেছিল তৌফিক। এরপর তার কি হয়েছে আর খবর পাইনি আর মেঘলা।

মেঘলা দেখল সার্ভেন্ট তিনটি গ্লাসে জুস এনেছে৷ এর মধ্যে যে একটি গ্লাসের সেপ আলাদা তা দিলো মায়াকে। সে ঘাবড়ে গেল। উঠতে নিলেই তৌফিক শক্ত করে তার হাত ধরে নিল। মেঘলা তার দিকে তাকাতেই চোখ দেখে ভয়ে নুইয়ে গেল। কাঁপতে লাগলো তার সারা শরীর ভয়ে, আতঙ্কে। তার জামাটা খামচে ধরল।

মায়া খাবার মুখে দিয়ে প্রশংসা করল, “খাবার অনেক মজা হয়েছে।”
তৌফিক একগাল হেসে বলে, “আমার ওয়াইফের হাতে জাদু আছে।”
“তাহলে আপনি জাদু খাচ্ছেন না কেন? আই মিন খাবার খাচ্ছেন না কেন? ”
“খাচ্ছি তবে নিজের নতুন পার্টনারের সাথে টোস্ট করা উচিত তাই না? আমি ড্রিংক করি না তাই জুস দিয়েই করি?”
মায়া জোরপূর্বক হাসে। কতগুলো এলকাহোল ক্লাব চালিয়ে বলছে ড্রিংক করে না। কী ভন্ড!
মায়া টোস্ট করে গ্লাসটা মুখে কাছে নিতেই অস্বাভাবিক গন্ধ পায়। সে তাকায় তৌফিকের দিকে।
“এনি প্রবলেম?” তৌফিকের প্রশ্নে মায়া হেসে মাথা নাড়ায়।
ছোট এক চুমুক দেবার নাটক করে টেবিলে রাখতে যেয়ে নিচে ফেলে দেয়। সাথে সাথে বিচলিত হয়ে বলে, “সরি..আমি খেয়াল করিনি নি।”
“নো প্রবলেম। আরেকটা আনিয়ে দিচ্ছি। খাওয়া শেষে এটা পরিষ্কার করে নিবে।”
তৌফিক হেল্পারকে ইশারা করতেই সে রান্না করে যেয়ে আরে ক্লাস জুস নিয়ে আসে। মেঘলা দেখতে পায় মাঝ রাস্তায় রিয়াদ তাকে থামিয়ে কি যেন মেশাচ্ছে জুসে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। ছটফট করতে থাকে। ইশারায় মায়াকে বলতে চায় তা না খেতে কিন্তু মায়া তার দিকে তাকায় না। সে হেল্পার থেকে গ্লাসটা নিয়ে জুসটা পান করে। তারপর তৌফিকের সাথে কথা বলতে শুরু করে কোম্পানি নিয়ে। হঠাৎ সে মাথা ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়। তৌফিক জিজ্ঞেস করে, “আর ইউ ওকে?”
“আমার কেমন যেন লাগছে! শরীর ভালো লাগছে না। আমরা অন্যদিন কথা বলি আজ…” সে উঠে দাঁড়াতেই পড়ে যেতে নেয়। তৌফিক সাথে সাথে তাকে এসে ধরে, “এত জলদি না। তুমি আপাতত আমার সাথে রুমে একটু রেস্ট করো।”
সে দেখে মায়া চোখও খুলতে পাড়ছে না। সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়েছে তৌফিকের উপর। সে এবার রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় রিয়াদের দিকে, “তোকে বলেছিলাম না বেশি পাউডার মিশাবি না? ও সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে গেলে মজা পাব কীভাবে?”
“স্যার আমি তো বুঝিনি পাউডার এত স্ট্রং। আপনি তিন চারঘন্টা অপেক্ষা করুন আস্তে আস্তে হুঁশ ফিরে আসবে।”
“তিন ঘন্টা? ওর জন্য দেড় মাস অপেক্ষা করেছি। এত তো আমার বউয়ের জন্যও করিনি। এখন দেড়মাস ওকে ছাড়ছি না। আমি তো এক মুহূর্তও আর অপেক্ষা করতে পাড়ব না।” বলে তাকে কোলে তুলে নিলে মেঘলা সামনে এসে দাঁড়ায়, “প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন। ওর সাথে এই ঘটন করেন না।”
তৌফিক বিরক্ত হয়ে লাথি মারে মেঘলাকে। মেঘলা মেঝেতে পড়েও তার পা ধরে নেয়, “ওকে ছেড়ে দিন। আপনি আমার সাথে যা করার করুন। ওকে ছেড়ে দিন।”
তৌফিক বিরক্ত হয়ে লাথি মারে তাকে আরেকটা, “তুই তো সে কবেই পুরান হয়ে গেছিস। তুই এত সুন্দর বলে এখনো তোকে পাশে রেখেছি। যদি বেশি মেজাজ খারাপ করিস তাহলে মে’রে বাগানে পুঁ’তে রাখলেও কেউ খুঁজতেও আসবে না তোকে।”
সে আবারও লাথি মেরে মায়াকে নিয়ে হাঁটল নিচের গেস্ট রুমের দিকে। তাকে শুইয়ে দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ দেখে ঢোক গিলল। ধীরে ধীরে এলো তার কাছে। তার নীল শার্টের বোতাল খুলতে নিলে মেঘলা এসে আবারও তাকে বাঁধা দেয়, “ওকে ছেড়ে দেন। ওর সাথে এমন করেন না।”
তৌফিক এবার বিরক্ত হয়ে সজোরে ধাক্কা দেয় তাকে। মেঘলা আলমিরার সাথে যেয়ে ধাক্কা খায়।চোটও পায় মাথায়। ফুলে যায় কপালের অংশখানা। তৌফিক যেয়ে তার মুখ চেপে ধরে,”তোর সাহস বেড়েছে আজ খুব? তাহলে তুই নিজের চোখের সামনেই দেখ ওকে কীভাবে উপভোগ করি।”
সে আবার মায়ার কাছে যায়। চোখ বন্ধ থাকা নিস্তেজ মায়াকে দেখে বাঁকা হাসে। তার গালে হাত বুলিয়ে বলে, “তুমি আমাকে অনেক অপেক্ষা করিয়েছ জান। এবার আমার শোধ তোলার পালা। তোমার আগুন পানি না হওয়া পর্যন্ত আমার কাছেই তুমি থাকবে।”
বলে তার শার্টের দিকে হাত বাড়ায়। শার্টের প্রথম বোতামটা খুলতেই রিয়াদ দৌড়ে ঘরে ঢুকে। তাকে দেখতেই মেজাজ চড়ে যায় তৌফিকের, “তোর কি ম’রার শখ জেগেছে? তোকে বুদ্ধিমান ভাবতাম এখন দেখি তোরও নিজের জানের ভয় নাই।”
রিয়াদ আতঙ্কিত সুরে বল, “স্যার এখন আমার জান থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।”
তৌফিকের কপাল কুঁচকায়, “কী হয়েছে?”
“আপনার ফোন কোথায় স্যার? জয় ভাই, সুমন ভাই আপনাকে কতক্ষণ ধরে কল দিচ্ছে। না পেয়ে আমাকে দিলো। নাসরিননিবাসে পুলিশ এট্যাক হয়েছে। পুলিশ মিডিয়া সবাই এসেছে। আপনাকে ওখানে যেতে হবে।”
“এটা কী করে সম্ভব?” তৌফিক হুঙ্কার দিয়ে উঠে। তৌফিক নিজের পকেটে দেখে তাড়াহুড়ো করে। তার ফোন নেই। সে আতঙ্কিত হয়ে উঠে, ” আমার ফোন… ফোন কোথায়?”
“স্যার এসবের সময় নেই। জলদি চলুন। সুমন ভাইও রওনা দিয়েছে।”
“এই গর্দভ ফোন না থাকলে আমি প্রয়োজনীয় কল করব কীভাবে? ওদের আটকাব কী করে?”
“এজন্যই তো সুমন ভাইকে জলদি আস্তে বলেছি। আপনি বের হন। সুমন ভাইয়ের সাথে যান। আমি ফোন খুঁজে দ্রুত আসছি।”
তৌফিক মায়ার দিকে তাকালে রিয়াদ বলে, “স্যার এখন এসবের সময় নেই। আমি রুম লক করে বডিগার্ড রেখে যাব। সব ঠিক করে আপনি আসুন। মেয়েটা এখানেই থাকবে। প্রয়োজনে আবারও ড্রা’গ দিব। আমি নিশ্চিত এই রেইডে এই মেয়ের হাত আছে। আপনাকে বলেছিলাম না একমাস আগে এরা কোন রেস্টুরেন্টে দেখা করেছিল। তাও সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট বুক করে। দেখলেন স্যার? আপনি তখন আমার কথা আমলে নেন নি।”
মেঘলা অবাক হয়ে তাকায় তৌফিকের দিকে। ভয়ে সে কাঁচুমাচু হয়ে সরে বসলো। সে কাঁপছে রীতিমতো। আল্লাহ জানে এখন সে অভ্র ও মায়ার সাথে কি করে!

তৌফিক হাসে রিয়াদের কথায়, “অভ্রকে তো আমি পিঁপড়ার ন্যায় পিষে ফেলতে পাড়বো। কোনো পুলিশ বা মিডিয়ার এত সাহস নেই যে আমার বিরুদ্ধে যাবে। আর ওকে… এসে নেই তারপর ওর আগুন আমি পানি করছি।” তৌফিক দ্রুত বের হয়। রিয়াদ বের হয় তার পিছনে। তৌফিক দুইটা গার্ডকে রুমে যেতে বলে। আর রিয়াদকে বলে, “আমি সব ঠিক করে এসে নেই তোকে একটা বড় উপহার দিব। তুই এখন থেকে আমার সাথে থাকবি সবসময়। প্রধানমন্ত্রী হলে তুই আমার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হবি।”
“সত্যি স্যার? সত্যি বলছেন?” রিয়াদের চোখেমুখে খুশি জ্বলজ্বল করে উঠে। তৌফিক হেসে তার কাঁধে চাপড় মেরে গাড়িতে উঠে নাসরিন নিবাসের উদ্দেশ্যে।”
.
.
পুলিশ দেখে নাসরিন নিবাসে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সবাই ছুটাছুটি করছে। কতগুলো গার্ড পালিয়েছে আর কতজন রয়ে গেছে। প্রধান লোক রীতিমতো হুমকি দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। তাকে ভীষণভাবে মারা হলো। সাথীদেরও আটক করা হলো। তাদের পিছনেই কালো পোশাক পরা অনেকগুলো লোক। তারা তৌফিকের লোকদের বন্দুকের নোখে রাখে। ঢুকে অভ্র ও সুরভি। সাথে সুরভির পরিচিত ক্যামেরাম্যানও ঢুকে। অভ্র ইশারা দিতে সুরভি প্রস্তুত হয়। বাড়ির বাহির থেকেই রেকর্ডিং শুরু করে তারা। নাসরিন নিবাস লেখা থেকে শুরু করে তারা ভেতরে যায়। ভেতরে যেয়ে পরিবেশটা স্বাভাবিক দেখতে পায়। তারা বাসা ঘুরে দেখে সব স্বাভাবিক, চার বেড, ড্রইং, ডাইনিং, কিচেন, স্টাডি রুম। তারা কিছু বুঝতে পাড়ে না। তাহলে তাদের দেওয়া খবর কী ভুল? সুরভি অবাক হয়ে তাকায় অভ্রর দিকে। অভ্রর মুখেও একই চিন্তার রেখা।

এমন সময় ফজলু মিয়া ডাক দেয় তাকে, “ভাই এদিকে আসেন। জলদি।”
তারা ফজলুর ডাকে সোজা যায় মাস্টার বেডরুমে। সেখানে ফজলু নেই। কিন্তু আলমিরা খোলা। সেখান থেকে আলো আসছে। অভ্র এবং সুরভি তাকে একে অপরের দিকে। তারপর তারা তিনজন কতগুলো গার্ডসহ ভিতরে ঢুকে। আলমিরার অন্যপাশের আরেক দরজা। সামনে কাপড় দিয়ে ঢাকা। ভিতরের দৃশ্য দেখতেই আত্না কেঁপে ওঠে সবার। অভ্র সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর উচ্চস্বরে আদেশ করে, “কেউ তাকাবে না। সবাই চোখ বন্ধ করো। এক্ষুণি। সুরভি ওদের দেখ।”
সেখানে অর্ধনগ্ন কতগুলো মেয়ে খাঁচায় বন্দী ছিলো। প্রতিটি খাঁচায় নাম্বার লাগানো ছিলো। মোট পঁচিশটা খাঁচা। সবার অবস্থা করুণ। করুণ বললেও ভুল হবে অর্ধমৃ’ত। তাদের শরীরের এমন কোনো অংশ বাকি নেই যেখানে দাগ নেই। সুরভি হেঁটে তাদের দিকে যাচ্ছে আর তার শরীর কাঁপছে। একটা মেয়ে হয়ে সে এমন কীভাবে সহ্য করবে? সেখানে বারো তেরো দুইটা মেয়েকে দেখে সুরভি আর সহ্য করতে পাড়লো না। কান্না করে দিলো ফুঁপিয়ে। সে দৌড়ে গিয়ে দরজা ঢাকা দেওয়া কাপড়গুলো নিয়ে আসলো। তা দিয়ে ঢাকতে চাইলো মেয়েগুলো। সে উচ্চস্বরে অভ্রকে জানাল, “অভ্র চাবি লাগবে। জলদি চাবি আনুন।”

তার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো মেয়েগুলোর জন্য। তাদের কেমন পশুর মতো বেঁধে রাখা হয়েছে। তারা সবাই বারবার খাঁচা ধাক্কাচ্ছে। যেন এই জেলখানা থেকে বের হতে চাচ্ছে দ্রুত। তাদের হাতে সুরভি জলদি কাপড়গুলো দিলে তারা এত খপ করে নিয়ে সে কাপড় দিয়ে নিজের দেহ ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেখানে একজন উঠেই না। নিস্তেজ হয়ে বসে থাকে। খাঁচায় নাম্বার দেওয়া ১৯। সুরভি তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কাপড়টা এগিয়ে দেয়। মেয়েটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “আমি ধ্বংস হয়ে গেছি বহুবার। এর কাপড় আমার কী করতে পাড়বে আর?”
তার চোখে কোনো অনুভূতি নেই। পানি নেই।
সুরভির তাকে দেখে আরও কান্না বাড়লো। সে হাত বাড়িয়ে যতটুকু পাড়লো ঢাকলো মেয়েটাকে। মেয়েটা বলল, “তুমি যাও, চলে যাও। ও যদি আসে তোমাকেও ছাড়বে না। কষ্ট দিবে। সম্মান শেষ করে দিবে। জ্বালাবে, পুড়াবে, কাঁটবে। ওইটা পিশাচ। পিশাচ থেকেও অধম। চলে যাও। নিজেকে বাঁচাও। বাঁচাও। যেতে বলেছি না। যা। যা বলছি যা।”
হঠাৎ মেয়েটা উচ্চস্বরে শেষ কথাগুলো বলতেই সুরভি আতঙ্কে পিছিয়ে যায়। আতঙ্কে নিচে পড়ে যায়।

অভ্র বাইরে সোফার সামনে বসে আছে। প্রধান লোক তার সামনে। তার লোকেরা তাকে মেরে আধমরা করে দিয়েছে। অভ্র গভীর নিশ্বাস ফেলে দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “বল চাবি কই?”
“তৌফিক ভাই তোদের ছাড়বে না। এক একটাকে শেষ করে দিবে। তোরা কার জঙ্গলে হাত দিয়েছিল জানিস না। তৌফিক ভাইকে তোরা চিনিস না।”
অভ্র তার বুকে একটা লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। গলায় পারা দিয়ে বলে, “কিন্তু তোর তৌফিক ভাই আমাকে ভালো করে চিনে। আজ আরও ভালো করে চিনবে। আমি তার ধ্বংস।” বলে একটা ব’ন্দুক তার করে তার দিকে। লোকটা তবুও কিছু না বললে অভ্র তার হাতের পাশে গুলি করে ফটাফট দুইটা। লোকটা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। তারপর নিজেকে সম্পূর্ণ ঠিক দেখলে তার নিশ্বাস আসে।। তবুও তার দু:সাহস কমে না। সে বলে, “এত কাহিনীর কী দরজার? আমাকে ছেড়ে দেও। মেয়েগুলোর সাথে তোমরা যা করার করো। ওদের তো ভোগ করার জন্যই রাখা হয়েছে। যাকে ইচ্ছা তাকে…” সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই অভ্র তার হাতে একটা গুলি করে। লোকটা সাথে সাথে চিৎকার করে ওঠে। অভ্র তার মাথায় তাক করে, “জীবন প্রিয় থাকলে জলদি বল কোথায়!”
“বলছি বলছি। রুমের পঁচিশ নং খাঁচার পাশে একটি দরজা আছে। ওই রুমের ঢুকে বিছানার সাথে লাগানো একটি বক্সে আছে।”
অভ্র তার গলা থেকে পা সরিয়ে বলে, “থ্যাঙ্কিউ। কিন্তু তোর মতো জানোয়ারদের বাঁচার অধিকার তো নেই। তাই না?” এক এক করে তিনটা গুলি তার বুকে মারে অভ্র। তার দিকে তাকিয়ে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে যায় আবার ভেতরে। সুরভিকে ঢেকে চাবির লোকেশন জানায়।

সুরভি দৌড়ে যায় সে রুমে। সে রুমে ঢুকে আরও স্তব্ধ হয়ে যায়। সেখানে একটি বিছানা আছে। উপরে দড়ি লাগানো। একপাশে বড় ছোট কতরকমের ছু’রি। কিছু ছু’রিতে তো রক্ত লাগানো এখনো। বালতি ভরা কয়লা আরও কতকি। এখানেই বোধহয় মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হয়। এসব দেখে সুরভির বমি চলে এলো। সে দ্রুত চাবি নিয়ে বেরি গেল।

অন্যদিকে অভ্র খুঁজে পেল আরও কিছু গোপন কক্ষ। এক কক্ষে ভরা ইললিগাল ওয়েপন, অন্য রুমে ড্রা’গস ভর্তি। সে অস্ত্রগুলো এত সহজে বিসর্জন দিতে পারে না। তাই তার আন্ডারে কাজ করা সকলে ডেকে এক এক করে উপহার দিলো। যেন তারা আরও নির্মমভাবে মা’রতে করতে পাড়ে তৌফিকের সাথীদের তৌফিকের অ’স্ত্র দিয়েই। এখন কেবল তৌফিকের আসার অপেক্ষা।
.
.
মেঘলা মায়ার কাছে যেয়ে তাকে ঠেলে উঠাতে চায়, “মায়া উঠো। প্লিজ উঠো। পালাও এখান থেকে তৌফিক ফেরার আগে। প্লিজ উঠো।” সে পানি নিতে গেলে গার্ড একজন তার হাত ধরে, “মেডাম আমাদের জোর করবেন না আপনার সাথে কিছু করতে। আপনি যান এখান থেকে।”
“না আমি যাব না। ছাড়ো আমাকে। ওকে যেতে দেও।”
গার্ড তারপরও মেঘলাকে জোর করে। হঠাৎ সে আঘাত অনুভব করে তার বাহুতে। সে মুখ ফিরিয়ে দেখে মায়া উঠে গেছে। মায়া তার শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে, “মেডাম কি বলছে শুনো নি বাছা? ওকে ছাড়ো।” বলে একটা ঘুষি দেয়। সাথে সাথে দ্বিতীয়জন আক্রমণের জন্য তৈরি হয়। মায়া হাত সোজা করে তার গলার মাঝখানে মারতেই লোকটার ম্যাসাল জ্যাম হয়ে যায়। সে মাথা সেভাবে রেখেই বসে পড়ে। এই সময় পেয়েই আরেকজন তার হাত ধরে ঘুরিয়ে তার পিছে নিয়ে তাকে পিন ডাউন করে। মায়া ব্যাথায় নিচে বসে পড়ে। এমন সময় তার কপালে ব’ন্দুক তাক হয়। সে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে রিয়াদ তার মাথায় বন্দুক তাক করেছে।

মেঘলা এতক্ষণ কান্না ভুলে হা করে মায়ার ফাইট দেখছিল। মায়া কোনো মেয়েকে আগে লড়াই করতে দেখে নি। কিন্তু শেষ সময় মায়াকে ধরে ফেলায় সে ঘাবড়ে যায় আরও আতঙ্কিত হয় যখন রিয়াদ তার মাথায় গান পয়েন্ট করে। সে আতঙ্কিত হয়ে মায়ার পাশে যেয়ে বসে। অনুরোধের সুরে বলে, “তোমরা ওকে যেতে দেও প্লিজ। আমি তোমাদের আমার সব স্বর্ণ দিচ্ছি। সব দোষ আমি নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিব। তাও ওকে কিছু করো না। প্লিজ। প্লিজ। ” এতটুকু বলেই কান্না করে দেয় মেঘলা। সে নিজের স্বর্ণ খুলতে শুরু করে। মায়া আড়চোখে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আবার তাকায় রিয়াদের দিকে, “আরও অভিনয় করার এনার্জি আছে তোমার?”
কথাটায় রিয়াদ হাসে। তারপর একে একে গুলি চালায় দুই’জন গার্ডের বাহুতে।

মেঘলা অবাক হয়ে তা দেখে। মায়া বলে, “ও অভ্রের লোক।”
“কিন্তু ও তো অনেক বছর ধরে…”
রিয়াদ তখন বলে, “আমি তো অভ্রভাইয়ের আগের থেকে ওই পিশাচকে খু’ন করতে উতলা হয়ে আছি। কেবল ক্ষমতা নেই বলে কিছু করতে পাড়িনি। আমার জীবনের কেবল একটাই লক্ষ্য ওই তৌফিককে নিজের চোখের সামনে তিলে তিলে ম’রতে দেখা।”
মেঘলা কিছু বুঝে উঠে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। একটুপর নাজীমও আসে, “আমাদের লোকেরা গার্ডদের অধীনে নিয়ে ফেলেছে। আমরা এবার যেতে পাড়ি।”

মায়া মেঘলার হাত ধরে, “চলো, এই নরক থেকে বের হওয়ার সময় এসে পড়েছে।”
মেঘলা ঘাবড়ে যায়, ” না না আমি যাব না। আমি গেলে আমাদের শেষ করে ফেলবে তৌফিক।”
“ও কিছু করতে পাড়বে না। আজ ওর শেষ পরিণতি হবে।”
“তুমি ওকে চিনো না মায়া। ও জানোয়ার থেকেও অধম। ভয়ানক।”
“হোক। সব জানোয়ারদেরও শেষ আসে।”
রিয়াদ মেঘলাকে আশ্বাস দেয়, “এখানে তৌফিকের গার্ডদের সাথে মিশে আছে অভ্রভাইয়ের লোক। আমাদের লোকেরা তাদের বন্দী করে নিয়েছে। আমাদের লোকেরাই বেশি তাই চিন্তা করবেন না। নাজিম সিসিটিভির মেইন সিস্টেমও নষ্ট করে দিয়েছে। আপনি চলুন প্লিজ।”
“কিন্তু…”
মায়া এবার শক্ত গলায় বলে, “তুমি ভয় পাচ্ছো? কী নিয়ে ভয় পাচ্ছো? তোমার কাছে হারানোর মতো আছে কী? কিন্তু পাবার অনেক কিছু আছে। নতুন জীবন, নতুন আশা, তোমার বন্ধু অভ্র। যে তোমাকে এইখান থেকে মুক্তি দেবার জন্য নিজের এতটা বছর দিয়েছে। তুমি কেবল নিজের ভয়কে কাবু করতে দিয়ে তার সব ত্যাগ বিসর্জন দিবে মেঘলা। তোমার ভালোবাসার মানুষের শেষ ইচ্ছা ছিলো তোমাকে মুক্ত করা। তুমি কী তোমার সে ভালোবাসার মানুষের শেষ স্মৃতির কাছে যেতে চাও না?”
“গগণের?” কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে মেঘলা।
“হ্যাঁ।”
মেঘলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় মায়ার দিকে। এই প্রথম মায়া মেঘলার চোখে খুশির ঝলক দেখতে পারে। এতটুকুতেই তার মন ভরে যায়। সে মেঘলাকে নিয়ে বের হয়। মেঘলা দেখে সারা বাড়ির অবস্থা নাজেহাল। সে যত হেঁটে যাচ্ছে দেখছে কতজন লোক তৌফিকের গার্ডদের বেঁধে রেখেছে। সে হেঁটে বাড়ির বাহিরে বের হয়। সে যত যায় ততই তার বুকের ভারটা কমে আসতে থাকে। অবশেষে বাড়ির বাহিরে বের হয় তারা। মায়া মেঘলাকে রিয়াদের সাথে এক গাড়িতে উঠিয়ে নিজে অন্য গাড়ির দিকে এগোতে নিলে মেঘলা তার হাত ধরে নেয়, “তুমি কীথায় যাচ্ছো?”
“তৌফিকের সর্বনাশ করতে। নাসরিন নিবাস। যেখানে অভ্র আছে।”
“আমিও সাথে যাব।”
“না। তুমি রিয়াদের সাথে তোমার ভালোবাসার মানুষটার সাথে দেখা করতে যাও। রিয়াদ অভ্রের সবচেয়ে ভরসার মানুষ। তোমাকে সুরক্ষিত রাখবে।”
ভালোবাসার মানুষটার কথা শুনে মেঘলা চুপ করে যায়। অবাকও হয়। গগন? গগন এখনো কী আছে?

সে দেখে মায়া অন্য গাড়িতে উঠেছে নাজিমসহ আরো দুইজনের সাথে। গাড়িটা আগেই যায়। তখন রিয়াদের কন্ঠ শুনে সে, “ম্যাডাম চিন্তা করেন না অভ্র স্যার সব সামলে নিবে। সে আমাকে আপনার দায়িত্ব দিয়েছে।”
“ও ঠিক থাকবে তো?”
“দোয়া করুন তার বিজয়ের জন্য, আর তৌফিকের ধ্বংসের জন্য। তবে আফসোস করবেন না ওর ধ্বংস আমরা নিজের চোখের সামনেই দেখবো।”
.
.
তৌফিক গাড়িতে উঠে রাস্তায় সুমনকে তুলে। সে সুমনকে
আদেশ দেয়, “জলদি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কল লাগাও। সাহস কি করে হয় আমার ফার্ম হাউসে রেইড দেওয়ার? তারপর মিডিয়া হাউসে কল দিবে, কোনো স্টোরি যেন ভুলেও পাবলিশ না করে। ওই অভ্রকে তো আমি দেখে নিব। আজ ওর শেষ দিন।”
“স্যার আপনার ফোন…”
“পাচ্ছি না আমার ফোন। তোর ফোন দিয়ে কল দে জলদি।”
সুমন সাথে সাথে কল লাগায়। কথা বলে সে তাকায় পিছনে। তৌফিকের দিকে, “স্যার কোনো পুলিশই রেইড দেয় নি সেখানে। কোনো পারমিশন নেওয়াও হয় নি।”
“হোয়াট!” তৌফিক অবক হয়। তারপর বুঝে উঠার পর বলে, “অভ্র আমার সাথে গেইম খেলছে। ওর গেইমে ওকেই মাত দিব। আমাদের গার্ড আরও বাড়া। বাবার গার্ডদের আসতে বল।”
.
.
অভ্র বসেছিলো সোফায়। তারা মেয়েদের বের করে একটি সুরক্ষিত স্থানে পাঠিয়েছেন। এখন কেবল তৌফিকের আসার অপেক্ষা। তৌফিক ঢুকে অভ্রকে পা’য়ের উপর পা তুলে তার স্থানে বসে থাকতে দেখে অগ্নিশিখা হয়ে যায়। সাথে সাথে তৌফিকের লোকেরা হামলা করে দেয়। মুহূর্ত ভাবার সময়ও দেয় না তাদের।
অভ্র উঠে সুরভি যে রুমে আছে সেদিকে যেতে নেবার পূর্বেই কয়েকজন তার উপর হামলে পড়ে। সে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যায়। আর তৌফিক যেয়ে বসে সেখানে যেখানে এতক্ষণ অভ্র বসে ছিলো। এখন সে বসে বসে তামাশা দেখছে। হঠাৎ করে সুমন কোথা থেকে ক্যামেরাম্যানকে আহত অবস্থায় তার সামনে ফেলে। তার নাক মুখ দিয়ে র’ক্ত পড়ছে। তাকে দেখেই অভ্র স্তব্ধ হয়ে যায়। অভ্র তার দিকে এগোতে নিলেই একজন তার মাথার পিছনে আঘাত করে। সাথে সাথে তার ঘাড় দিয়ে ঝরতে থাকে র’ক্ত। সাথে সাথে সে মেঝেতে পড়ে যায়।

তৌফিক হেসে উঠে দাঁড়ায়। সুমন ক্যামেরা ম্যানের ক্যামেরা নিয়ে এক আছাড় মারে। রেকর্ডার দেয় তৌফিকের হাতে। সে রেকর্ডার নিয়ে অভ্রর হাতের উপর পা রেখে বসে তার সামনে। অভ্র র’ক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তৌফিক হেসে তার সামনে রেকর্ডার ঘুরিয়ে বলে, “তুই ভেবেছিস আমি এত সহজে তোর পরিকল্পনা কাজ করতে দিব? কিন্তু তোকে মানতে হবে বটে। জীবনে প্রথম কেউ আমার মনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। আই লাইক ইট। বাট আফসোস তোর এই ভুলের কারণে আজ তোকে ম’রতে হবে।” তৌফিক তার কানের কাছে যেয়ে ফিসফিস করে বলে, “যেভাবে তোর বন্ধুকে মেরেছিলাম। সেদিন তোকে ছেড়ে দিয়ে ভুল করেছিলাম রে। তুই আমাকে অনেক বিরক্ত করেছিস।”
এই বলে তৌফিক অভ্রর কপালে বন্দুক ঠেকায়।

চলবে….