অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সুরভি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে। গাড়ি এই দ্রুত আসছে এবং যাচ্ছে। রিক্সা নেই। সিএনজি একটিও দাঁড়াচ্ছে না। এর মধ্যে বৃষ্টির গতি বাড়ছে, বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে। অন্যদিন হলে নিজেই খুশিমনে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতো, কিন্তু এই শাড়ি পরে তীব্র বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হওয়ার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ালো লম্বা একটি কালো রঙের গাড়ি। গাড়ি থেকে ফজলু মিয়া বের হয় একটি ছাতা নিয়ে, “আপা গো আপা, বৃষ্টিতে ভিইজা হইয়া যাইতাসে চুবচুবা। আহেন, ভেতরে আইসা বহেন। আমার অভ্রভাই বড্ড দিলিদার, লিফট দিয়া দিব আপনি চাইলে একবার।”
“আপনার অভ্র ভাই থেকে আমার কোন সাহায্য প্রয়োজন নেই। আপনারা যেতে পারেন। আমি নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিব।”
জানালার কাঁচ অর্ধেক খুলে। অভ্রর চোখ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টর আলোয় তার ধূসর চোখখানা আরও বেশি হালকা রঙ্গের দেখাচ্ছে। আকর্ষণীয় লাগছে। সুরভী বেশি সময় ধরে তাকিয়ে থাকলো না সে দৃষ্টির দিকে। চোখ সরিয়ে নিলো।
অভ্র বলে,”তুমি আহনাফের অপেক্ষা করলে জানিয়ে দেই সে চলে গেছে। আর এদিক থেকে তোমার বাড়ি পর্যন্ত সিএনজি পাওয়া খুব মুশকিল। পাবে বললে সন্দেহ। আর বৃষ্টির গতিও বাড়বে মনে হচ্ছে। ভেবে নেও, এত রাতে একটি মেয়ে রাস্তায় একা থাকা সুরক্ষিত হবে? দেখো সাদা শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। হয়তো কোনো খারাপ মানুষের দৃষ্টি তোমার উপর আটকালে তোমার বিরাট বড় সমস্যা হতে পারে অথবা সাদা শাড়িতে ভূতচূত ভেবে কোনো বেচারা হার্ট এট্যাক করতে পারে। দুইপক্ষ থেকেই ক্ষতি তো হবে আমাদের দেশেরই। তাই লক্ষ্মীমেয়ের মতো বসে পড়ো গাড়িতে।”
সুরভি ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
অভ্র জিজ্ঞেস করে, “আসবে না?”
সুরভি এবারও উত্তর দেয় না। অভ্র ফজলুকে আদেশের সুরে বলে, “ফজলু গাড়িতে বস। এখন আমি সাহায্যের চেষ্টা তো করেছি। কেউ নিজের ভালো না বুঝলে আমার তো কিছু করার নেই।”
সুরভী ভেবেছিল আরো এক দুইবার অভ্র জিজ্ঞেস করলে সে গাড়িতে উঠবে। কিন্তু অভ্র আরেকটিবারও তাকে না জিজ্ঞেস করে এভাবে চলে যাবে, তা সে ভাবে নি।”
ফজলু মিয়া কোন কথা না বলে উঠে বসে গাড়িতে। গাড়ি স্টার্ট দেওয়া হয়। অভ্র জানালায় কাঁচ উঠায়।
সুরভি চিন্তা করে এই মুহূর্তে তার জন্য নিজের অহং থেকে বড় তার সুরক্ষা। তাই নিজেই ছোট হয়ে সাহায্য ছাড়া অভ্রর কাছ থেকে। জানালায় ঝুঁকে বলে, “আপনি যেহেতু এত বলছেন, আমি যেতে রাজি।”
অভ্র আবারো জানালার কাঁচ নিচে নামায়, “আহা আমার কথা এত চিন্তা করার প্রয়োজন নেই তোমার। আমি কিছুই মনে করব না।”
সুরভি নিজের রাগ চাপা দিয়ে অনুরোধের সুরে বলে, “প্লিজ আমাকে লিফট দিয়ে উদ্ধার করুন।”
“আমার মন অনেক বড় বুঝলে। অসহায়দের সাহায্য করতে আমার অনেক ভালো লাগে। তাই আসো। উঠে বসো।”
অভ্র গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে নিজে অন্য পাশে সরে যায়।
সুরভি চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে গাড়িতে। অভ্রর প্রতি বিরক্ত থাকলেও মনে মনে সেও জানতো, এই মুহূর্তে অভ্র সাহায্য না করলে সে সমস্যাতে পড়তে পাড়তো। আহনাফের উপর সবচেয়ে বেশি রাগ উঠা উচিত তার। রাগ করে এসে পড়েছে বলে কি একটিবার কল দিবে না? এমন অচেনা স্থানে তাকে একা ফেলে রাখার জ্ঞান কীভাবে হয় আহনাফের। একারণে অভ্রর প্রতি কৃতজ্ঞতা তার মনে আছে। সে মৃদুস্বরে বলে, “ধন্যবাদ।”
“কি বললে? শুনতে পাইনি।”
“বলেছি ধন্যবাদ। সাহায্য করার জন্য।”
“মিস ক্যাঁক্যাঁ এর মুখে আজ কোয়েলের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বাহ! আমার লক্ষ্মী বলার প্রভাব না’কি?”
সুরভি তার কথায় তোয়াক্কা না করে নিজের হাল্কা ভেজা চুলে হাত বোলাতে থাকে। অভ্র তাকায় তার দিকে। তার মুখে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে। যা আলোয় চিকচিক করা মুক্তোর ন্যায় দেখাচ্ছে। এই জলের বিন্দুগুলো তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। মুহূর্তে নিজেই চোখ সরিয়ে নিলো। নিজের পাঞ্জাবির উপরের কটি খুলে এগিয়ে দিলো সুরভির দিকে, “পরে নেও। কিছুটা ভিজে গেছো।”
সুরভি কিছুটা অবাক হয় তার ব্যবহারে। সে কটিটা নিয়ে পড়ে নেয়। বলে, “আরিফুর ইসমাত অভ্র নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্যকারো ব্যাপারেও চিন্তা করে, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য বটে।”
“মনে করিয়ে দেই আমি একজন নেতা। মানুষের সাহায্য করাই আমার কাজ।”
“আর নিজের স্বার্থ বাদে কয়জনকে সাহায্য করেছেন।”
“আর কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে কেন?”
সুরভি বিরক্তিতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
হঠাৎ সে বলে, “আল্লাহ আমি আমার বাসার এড্রেসই তো বললাম না।”
“প্রয়োজন নেই আছে।”
“আছে মানে? আমার এড্রেস আপনার কাছে এলো কিভাবে?”
“আমি যেসব তথ্য চাই, তা পেতে বেশি সময় আমার লাগে না।”
“মানে আপনি আমার তথ্য বের করেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“আমার ইচ্ছা।”
“আপনাকে…আপনার মাথা ফাটাতে মন চাইছে আমার। অভদ্র লোক একটা।”
তখনই গাড়ি মোড়ে ঘুরতেই সুরভি টলে পড়ে অভ্রর দিকে। তার বুকের উপর। অভ্র তাকে সাবধানে ধরে বলে, “আর এই অভদ্র লোকের বাহুডোরে আসতে তোমার অনেক ভালো লাগে তাই না? একারণেই তো ইচ্ছা করে এসে টলে পড়ো আমার উপর।”
সুরভি তাকায় তার দিকে। ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে। তার চোখে চোখ পড়ে। সে সূরমা চোখে একরকম মুগ্ধতা ছড়ানো ছিলো। সে দৃষ্টি যেন মাদকাময়। সুরভি চেয়েও দৃষ্টি সরাতে পাড়ল না। হঠাৎ তার হৃদপিণ্ড স্পন্দিত হতে ভুলে যায়। অভ্র তার হাত মুখ ছুঁতেই সুরভির ধ্যান ভঙ্গ হয়।
সে দ্রুত সরে যায়। লজ্জায় গাড়ির অন্যপাশে যেয়ে বসে সংকোচিত হয়ে। তার বুকের ভেতরটা এমন ধুকপুক করছে কেন? এ-তো ভালো লক্ষ্মণ নয়। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে আহনাফের সাথে। অন্যকোনো পুরুষের কারণে তার হৃদস্পন্দন এমন বাড়তে পারে না। অন্য পুরুষের কথা ভাবাও তার জন্য অন্যায়। হঠাৎ ফজলু মিয়া বলে, “আপা আমার অভ্র ভাই দেখতে কঠিন হইলে কি হইব, তারে জানলে সে রসিক মানুষ আছে মানতে হইব। কী কন?”
সুরভি উওর দেয় না। সে কথা বললেই কথা বাড়বে। তাই কথা বাড়িয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারার ইচ্ছা নেই তার। তাই সম্পূর্ণ রাস্তা একদম চুপ কাটায় সে।
বাসার সামনে এসে গাড়ি থামে। সে গাড়ি থেকে নামার পূর্বে কেবল অভ্রকে বলে, “থ্যাঙ্কিউ লিফট দেবার জন্য।” বলে এক দৌড়ে চলে যায় সেখান থেকে। তার যাবার পর ফজলু মিয়া বলে, “ভাই কাহিনী কি কন তো, এই আপার উপর এত মেহেরবান কেন আপনে আমারে জানান তো।”
“কাহিনী কিছু না।”
“আচ্ছা ভাই আপনে কি ওই ভয়ানক আপার লগে বিয়া করবেন হাছা? তার এক ধমকে আমার জান বেরিয়ে গেছেগা।”
“ওকে বিয়ে না করলে আমার স্বপ্নপূরণের জন্য ফান্ডিং পাব কোথা থেকে? দাদাজানের শর্ত তো মানতেই হবে। আর বিয়ে করলে মন্দ হবে না। মেয়েটার বুদ্ধি আছে, ওর বুদ্ধি কাজে লাগাতে পাড়ব ভবিষ্যতে।”
দরজা খোলা ছিলো। সুরভি দৌড়ে নিজের রুমে এসেই দরজা লাগায়। তার বুকের ভেতর এখনো কেমন করছে। লজ্জায় না অপরাধভাবে? নিজের উপর রাগ লাগছে না। অন্য পুরুষের জন্য তার মনের ভেতর এক মুহূর্তের জন্যও অনুভূতি কীভাবে জাগ্রত হতে পারে? তাও এমন পুরুষের জন্য। সে নিজেকে সংযত রাখে। যখন আমরা একটি সম্পর্কে থাকি তখন নিজের অনুভূতিকে খাঁচায় বন্দি রাখতে হয়। এটাই নিয়ম। যথাসম্ভব অভ্রর থেকে দূরে থাকতে হবে তার। সে নিজেকে বুঝ দিয়ে ফ্রেশ হতে যায়। আয়নার সামনে যেতেই দেখতে পায় অভ্রর কটিটা। অভ্র যে কটিটা তাকে পরতে দিয়েছিল তা ফেরত দেওয়া হয় নি।
এমন সময় ফোন আসে আহনাফের। ফোন দেখে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে কল রিসিভ করেই তার রাগ ঝারে, “এখন কল করছেন কোন দুঃখে? এমন অচেনা স্থানে একা রেখে এসেছেন। যখন কল দেওয়া উচিত ছিলো তখন তো দেন নি।”
“ওয়েট তুমি তো আমার আগেই রওনা দিয়েছিলে না? তুমি এখনো ওখানে?”
“না, মাত্র বাসায় এসেছি। আর আমি রাগ করে এসেছিলাম। আমি কী জানতাম ওখানে রিক্সা সিএনজি পাব না। লিফট নিয়ে আসতে হয়েছে।”
“বলো কি?” বিস্মিত কন্ঠ শোনায় আহনাফের, “কিন্তু অভ্র স্যার তো বলেছিল তুমি চলে গেছো। তাইতো আমিও চলে এলাম। তোমার মেজাজ খারাপ বলে কল দেই নি। এখন কল দিলাম ঘর পৌঁছেছ না’কি জিজ্ঞেস করতে।”
“অভ্র আপনাকে বলেছে যে আমি এসে পড়েছি?” এবার তার কন্ঠ শান্ত শোনায়।
“হ্যাঁ উনিই বলেছিল।”
“বুঝেছি।” তার এবার সত্যিই রাগ উঠে অভ্রের উপর। লোকটা চাইছেটা কী?
“সরি, তখন আমার এসব কথা বলা উচিত হয় নি। আমাদের ডিনারটা নষ্ট করলাম।”
“ইট’স ওকে। আর আমিও সরি এমন ব্যবহার করার জন্য।”
“আচ্ছা, তুমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে কল দেও আমাকে।”
“হুম।”
সুরভি কল রেখে রাগে কাঁপতে থাকে। গায়ের থেকে কটি খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারে। ক্রোধিত সুরে বলে, “আমার সাথে এমন কাজ করে ভালো করেন নি আরিফুর ইসমাত অভ্র। আমার জীবনে দখল দেওয়া উচিত হয় নি আপনার। সবার জীবনের সাথে খেলতে খুব মজা লাগে আপনার তাই না? এবার দেখাচ্ছি আসল খেলা কাকে বলে। সম্পূর্ণ দেশের সামনে আপনার আসল রূপ না আনলে আমার নামও সুরভি না।”
.
.
মিষ্টি বাতাস বইছে। চিকচিকে রোদ আকাশ থেকে ঝরে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছে সভ্য। তার সামনে বসে আছে ইনারা। বাতাসে তার চুল দুলছে। এসে মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে সভ্যের। তার চুল থেকে আসা সুবাস মাতোয়ারা করছে মহলটাকে। সভ্য অভিমানী গলায় বলে, “একদিকে একটু রোমেন্সও করতে দিবে না আর অন্যদিকে নিজে সাইকেল চালিয়ে আসবে না। এত সুন্দর করে সেযে আমার এত কাছে এসে বসবে। মানে আমাকে জ্বালাতেই হবে তোমার। আমার মনের কথাও একবার ভাবো।”
ইনারা মুখ ফিরিয়ে তাকাল সভ্যের দিকে। তারপর বুকে মাথা ঠেকাল। শুনল তার স্পন্দনের সুর। তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। সে বলল, “বিয়ের এতমাস পরও যদি মনের এমন বেহাল অবস্থা হয় এতে আমার কী দোষ?”
“বছরের পর বছর পাড় হয়ে গেলেও তোমার ছোঁয়ায় আমার মনের অবস্থা এমনই থাকবে।” বলে ইনারার মাথায় চুমু খায়।”
“সামনে দেখে চালান, আমার দিকে তাকিয়ে নয়। নাহলে আর বছর পাড় করা লাগবে না। সোজা উপরে চলে যাব।”
সভ্য হাসে। সামনে তাকাতেই চোখে পড়ে বিশাল জলরাশি। থৈথৈ জলের লাহরীর বয়ে আসছে তীরে। তীর ঘেঁষে বিশাল অংশ জুড়ে বালুকণার ঢের। পৃথিবীর বুকে যেন একটুকরো স্বর্গের সৌন্দর্য ছুঁয়ে গেছে। জায়গাটি চোখে আটকাতেই ইনারা সাইকেল থেকে নেমে দ্রুত যায় সেদিকে। পিছনে ফিরে পিছন দিকে চলতে চলতে সভ্যকে বলে, “সভ্য জলদি আসুন।”
সভ্য সাইকেল পার্ক করে দেখে ইনারা সমুদ্রের পানিতে লাফাচ্ছে, নাচছে, দৌড়াদৌড়ি করছে। ঠিক যেন বাচ্চার মতো। সে হাসে। আজ তারা ম্যাচিং করে জামা পরেছে। আকাশী রঙের। যা এই সুন্দর মহলটার সাথে মিলে যাচ্ছে।
সভ্য পকেটে হাত দিয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে আসছিল ইনারার দিকে। কিন্তু ইনারা যেই এই মহল দেখে মাতোয়ারা হয়ে গেছে। বাচ্চার মতো নেচে বেড়াচ্ছে আপন মনে। হাতে পানি নিয়ে ছিটাতে শুরু করে সভ্যর দিকে। তার খিলখিল হাসির শব্দে যে সমুদ্রও মাতাল হয়ে ঢেউয়ের গতি বাড়িয়েছে।
সভ্য বলে, “আরে থামো করছটা কী? ভিজে যাব তো।”
ইনারা বাচ্চামো আরও বাড়ে। সে পানি আরও ছিটাতে শুরু করে সভ্যর দিকে। সভ্য এসে তাকে ধরে নেয়। বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলে, “এবার বলো কী করবে? আমি তো ছাড়ছি না।”
সে ইনারার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে, “গানের সুর থেকেও তোমার খিলখিল হাসির সুর আমার পছন্দ, তুমি জানো?”
ইনারার লজ্জামাখা মুখ নিয়ে মাথা নত করে তার বুকে ঠেকায়, “জানি।”
“ইশশ…এই মেয়ে কতবার আমাকে তোমার প্রেমে পাগল করবে বলোতো। এত সুন্দর করে কেউ লজ্জা পায়?”
.
.
জোহান গানের প্রাক্টিস করছে সে সকাল থেকে। এখন তার ট্রেনার তাকে আধাঘন্টার বিরতি দিয়ে বাহিরে গেল। সে ক্লান্ত হয়ে বসে আছে । এরপর তার ডান্সের কিছু সময় প্রাক্টিস করা হবে। সাইদ বসেছিল তার সামনে। তাই সে রাগটা তার কাছেই প্রকাশ করল, “এই মায়া আর আনন্দ স্যার, দুইজনে এক নাম্বারের খাটাইশ। মানুষের নামের সাথে পার্সোনালিটির একটু তো মিল থাকা উচিত। উনাদের মা বাবা কী ভেবে নাম রাখল উনাদের। মায়ায় মনে মায়া নেই, আর আনন্দ স্যারকে জীবনে আনন্দিত হতে দেখলাম না। দুইজনে মিলে কারও কাছ থেকে আমাকে মার্ডারের কাজ নিয়েছে আমি নিশ্চিত।”
“কুল ডাউন। কুল ডাউন। এত হাইপার হচ্ছো কেন?”
“তুমি তো মজাতেই আছো। মীরজাফরের মত আমাকে রেখে পালিয়ে গিয়েছ। শাস্তি তো আমি পেয়েছি। ওই স্যারের সাথে দুইঘন্টা বেশি কাটাতে হবে। ভেবেই তো আমার মাথা ঘুরায়।”
“মায়া ম্যাডামের কাছে অনুরোধ করলেই হবে। দেখো উনি মেনে যাবে। আমার মনে হয় না উনি এতটা শক্ত হবে।”
“ভাই ওই মেয়ে আস্তো এক পাগল। আই মিন কে তার এক্সকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য অন্যকাওকে বিয়ে করে? সে অভ্রর সাথে একারণেই সে রেস্টুরেন্টের গিয়েছিল জানি তার এক্স-ফিয়োন্সে দেখে। কে এমন করে? তাও এত বছর পর। ছয় বছর কেটে গেছে। যাস্ট ওভার ইট। আমি আজ অফিসে এসে জানতে পারি যে আসলে মায়ার সাথে তার বিয়ে ছোটবেলায় ঠিক হয়েছিল। কিন্তু ছেলেটা ওকে ভালোবাসতো না। ওর ফ্রেন্ডকে ভালোবাসতো। তাই এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে দিয়েছে। আই মিন এটা ঠিকই তো, বিয়ের পর দুইজনের মধ্যে কেউ সুখে থাকতো না। কিন্তু মিস মায়া একথা কীভাবে বুঝবে? সে তো কেবল বিজনেস ডিল করতে জানে। ভালোবাসার অনুভূতি সে বুঝার যোগ্যও না। নো ওয়ান্ডার ওই ছেলে মায়াকে ছেড়ে অন্যমেয়ের কাছে গিয়েছে।” একটানা কথাগুলো বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জোহান। আবার বলে, “এখন শান্তি লাগছে।”
সাঈদ হাসে। সে মুখ তুলে তাকাতেই ভূত দেখার মত চমকে যায়। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। জোহান বলে, “তোমার কী হলো? এমন ভাব করছ যেন….”
“আমার প্রশংসা করে মনে শান্তি এসেছে আপনার।” মায়ার কণ্ঠ শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় জোহান। পিছনে তাকাতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায় তার। মায়া দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে কিছু কর্মীও। তাদের মুখে চাপা হাসি। মায়া তাদের দিকে ঘুরে তাকাতেই দুজন মাথা নিচে নামিয়ে নেয়।
জোহান বলে, “আই এম সরি। আসলে আসলে ওসব কথা…”
“আমি তদারকি করছিলাম সকল আর্টিস্টদের। ভাবলাম আপনার কাছেও আসি। কিন্তু এখানে দেখে আপনি আরাম করছেন।”
“আসলে আনন্দ স্যার অন্যান্য ট্রেনারদের দেখতে গিয়েছে।”
“তাই বলে আপনি আরাম করবেন? যাইহোক, একটি গান শুনান। তারপর আপনার এলবামের কথা চিন্তা করব।” সে যেয়ে বসে একটি চেয়ারে। পা’য়ের উপর পা তুলে।
একজন কর্মী তার মুখোমুখি একটি চেয়ার এনে রাখে। জোহানের বসার জন্য। জোহান সেখানে বসে। গিটার তার কোলে নিয়ে। গিটারের তার বাজায় এবং গানের সুর ধরে,
“আমার সকল অভিযোগে তুমি
তোমার মিষ্টি হাসিটা কি আমি
আমার না বলা কথার ভাঁজে
তোমার গানের কত সুর ভাসে
তোমায় নিয়ে আমার লেখা গানে
অযথা কত স্বপ্ন বোনা আছে
আমার হাতের আঙুলের ভাঁজে
তোমাকে নিয়ে কত কাব্য রটে
ভুলিনি তো আমি তোমার মুখে হাসি
আমার গাওয়া গানে তোমাকে ভালোবাসি…”
মায়া থামিয়ে দেয় তাকে, “থামুন। আমি ভেবেছিলাম দুইমাস বললেও এই মাসের শেষে আপনার এলবামের কাজ ধরব। কিন্তু এখন দেখছি আপনার আরও প্র্যাকটিসের প্রয়োজন। প্র্যাকটিস থেকে বেশি আপনার নিজের অনুভূতিকে নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। ভালোবাসার গানে অনুভূতি সর্বোপরি থাকতে হয়। অনুভূতি অনুভব করতে হয়। যেন সামনের মানুষটাও গানটাকে অনুভব করতে পারে। কিন্তু আপনার ওখানে কোন অনুভূতি আমি পাচ্ছি না। তাই এলবামে রিজিল আরও পরে করব। আপনি প্রাক্টিস করুন।”
মায়া তার মন্তব্য জানিয়ে উঠে যায়। দরজার কাছে যেতেই জোহানের কণ্ঠ শুনে থামে সে, “এই মন্তব্যের কারণ কী একটু আগে আমার বলা কথাগুলো?”
মায়া ফিরে তাকায়, “আমি আমার কারণগুলো জানিয়েছি। ”
“কিন্তু সে কারণ আমার যথার্থ লাগে নি। আর আপনি কে মন্তব্য দেওয়ার? না আপনি ভালোবাসা সম্পর্কে জানেন, আর না গান সম্পর্কে।”
জোহান তার গিটার নিয়ে যেয়ে দাঁড়ায় মায়ার সামনে, “আমি গানের জন্য নিশ্বাস নেই আর ভালোবাসার অনুভূতি আমার কাছে আছে। এরচেয়ে বেশি আছে না পাবার অনুভূতি। আর এই না পাওয়ার অনুভূতি আমার থেকে বেশি আপনি ভালো বুঝতে পাড়বেন না। আপনি একজন অনুভূতিশূন্য মানুষ। তাই নিজের মন্তব্য নিজের কাছে রাখুন।”
তার এমন কড়া কথা শুনে মায়ার সাথে আসা দুটো কর্মী ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করে দেয়। মায়া তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই তারা চুপ করে যায়। তারপর মায়া তাকায় জোহানের দিকে৷ রাগে। কিন্তু কিছু বলে না। সেখান থেকে চলে আসে নিজের কেবিনে।
কেবিন লক করে দিয়ে চেয়ারে যেয়ে বসে। আরে হেলান দিয়ে কিছু সময় ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। তার রাগ জলের ধারা হয়ে বেরিয়ে আসে তার চোখের কোণা থেকে। কিছু সময় এভাবেই কাটে। মায়া চোখ খুলে। উঠে বসে তার টেবিলের ড্রয়ের খুলে কতগুলো ফাইল সরিয়ে বের করে একটি ছবির ফ্রেম। সে ছবিতে মাইকের সামনের দাঁড়িয়ে আছে সে। স্টেজে গান গাচ্ছে। তার সাথে আছে আরও চারজন। ছবিতে সে তাকিয়ে আছে তার পাশের ছেলেটির দিকে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “আমার সবকিছুর বিলিয়ে দিয়েও যদি অনুভূতি শূন্য হতে পারতাম, তাহলে নিজের সব বিলিয়ে দিতাম। কেবল তোর দেওয়া কষ্টগুলো ভোলার জন্য। তখন তোকে ভালোবাসাটা আমার সৌভাগ্য মনে হতো, আজ সে ভালোবাসা আমার জীবন বিষাক্ত করে দিয়েছে। তোকে ভালোবেসে আমি সব হারিয়েছি ওয়াহেদ। সব।” সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ইশশ সে স্মৃতিগুলো যদি জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারতাম, কিন্তু কীভাবে মুছি? এইদিনগুলোই তো আমার জীবনের একমাত্র খুশির অধ্যায় ছিলো।” সে হাত বুলায় ছবির ফ্রেমেতে, “তোরাই আমার খুশি ছিলি।”
ফ্রেমটা বুকে জড়িয়ে আবারও চেয়ারে হেলান সে মায়া। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে তার জীবনের সে খুশিভরা দিনগুলো।
চলবে….
অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ফ্রেমটা বুকে জড়িয়ে আবারও চেয়ারে হেলান সে মায়া। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে তার জীবনের সে খুশিভরা দিনগুলো।
সাত বছর পূর্বে…..
মায়া ভার্সিটি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিল। তার মা নাস্তার প্লেট এনে রাখে তার টেবিল, “আজও নাস্তা করতে এলি না। তোর বাবা রেগেমেগে বকে গিয়েছে আমায়।”
“আহা মা, নাস্তা থেকে আমার ঘুম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর বাবার এই কথার জন্যই আমি টেবিলে বসে খাই না। তার সামনে গেলেই কথন শুরু হয়ে যায় তার, বড় বোন থেকে ভদ্রতা শিখতে পাড়িস না? দুইদিন পর পর তোর নামে বিচার আসে। বড় ভাইয়ের রেজাল্ট দেখ, একটু নিজেও চেষ্টা কর। সারাদিন বাহিরে ঘুরে বেড়ানো এবং গান গাওয়া। এসব করে জীবন চলে? তোর আরেকটা বিচার আসলে ঘর থেকে বের করে দিব। পরেরদিন আবার বিচার আসবে, আবার সেইম ভাষণ। না ভাই, আমার নাজুক কান এটা সহ্য করতে পারব না।”
“মায়া একটু তো গম্ভীর হ। আলাউদ্দিন ভাই বললেন মমতা ও ওমরের এনগেজমেন্টের সাথে তোর ও ওয়াহেদেরও এনগেজমেন্ট করাবেন। দুই ভাইয়ের অনুষ্ঠান একসাথে করতে চাইছেন । তোর এখনো এমন বাচ্চামো স্বভাব থাকলে কীভাবে হবে বল?”
কথাটা শুনে যেন মায়ার মন খুশিতে উড়ু উড়ু করে, “বলো কি মা সত্যি?”
সে যেয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে। তাকে ধরে রুমে নাচতে শুরু করে। মা বলে, “থাম থাম। এসব কান্ড বাহিরে কারও সামনে বলিস না। মেয়েরা এমন কাজ করলে তাদের নিলজ্জ বলে।”
“আর মা কে এই ডেফিনিশন দেয় যে এই কাজ করলে মেয়েরা সভ্য হয়, আর এই করলে নিলজ্জ। মানে মেয়েরা হাসিখুশি থাকলেও নিলজ্জ হয়ে যায়। হায় খোদা এই হিসেবে তো আমার রোবট সেজে বসে থাকা উচিত।”
“পারলে তাই কর। তোর এসব কান্ড দেখে তোর ছোটবোনও একরকম হয়ে যাচ্ছে। তোর সাথে ওয়াহেদের বিয়ে ওমর-মমতার সাথেই ফিক্স করে দিয়েছিলাম। কিন্তু মিতার জন্য তো ছেলে দেখতে হবে।”
“আরে মাতাজি চিল করো। ফিউচারের চিন্তা করে আজ কেন বরবাদ করছ?” সে একদিকে ঝুঁকে তাকায় ঘর ঝাড়ু দেওয়া সহিয়া চাচীর দিকে। তিনি অনেকবছর ধরে তাদের বাড়িতে কাজ করে। তাকে জিজ্ঞেস করে মায়া, “কী বলেন চাচী?”
“একদম ঠিক কইছো? মানুষের কি? মানুষ তো কথা কইবোই, তাগো কামই কথা কওয়া। অন্যের খুশি তাগো সহ্য হয় না।”
“দেখছো মা সহিয়া চাচীও বুঝে। তোমরাই বুঝলে না।”
“বুঝা লাগবে না আমার। তোর সাথে কথা বলা মানে দেয়ালে মাথা ফাটানো। কোনো লাভ নেই।”
“সকাল সকাল সবাই এত চিল্লাচিল্লি করছ কেন?” মিতা দরজা থেকে হেঁটে এলো। চোখ ডলতে ডলতে এসে আবারও শুয়ে পড়ল বিছানায়। মা বিরক্তির সুরে বলে,”এই মেয়েকে সে আধাঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠিয়েছি। এখন আবার এখানে এসে ঘুমাচ্ছে।” সে মায়ার জন্য আনা নাস্তা নিয়ে মিতাকে খাওয়ানো শুরু করলেন, “উঠে বস। খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে সোজা যাবি কলেজে। কতদিন ধরে যাচ্ছিস না। একেকটা ফাঁকিবাজ।”
টিভি চালু ছিলো। টিভি থেকে ভেসে আসছিল পঞ্চসুরের গান।
“ঝুমঝুমে বৃষ্টি নামে মনের কিনারায়
রাত জেগে আকাশ ডাকে কোন সে ইশারায়
মেঘডুবি কথা বলো চাও কী আমায়?
প্রেমজোয়ারে আসো ভেসে যাই
অনুভবের পৃথিবীতে হারিয়ে যাই
অনুভবে, অনুভবে, তুমি আমার অনুভবে….”
গান শুনে মিতা ও মায়া দুইজনেই একসাথে বলে, “পঞ্চসুরের নতুন গান…” বলেই তারা দুইজনে দৌড়ে যায় বাহিরে ড্রইংরুমে। তার বড় ভাই টিভি দেখছিল। তাদের দুইজনকে দেখে রাগান্বিত সুরে বললেন, “কলেজ, ভার্সিটিতে যাবার সময় তোদের এনার্জি থাকে না। গান শুনতেই একগাদা এনার্জি এসে পড়ে তাই না? তোদের জন্য টিভি অফফ, বাবা আদেশ দিয়ে গেছে।”
“এটা ঠিক না। পৃথিবীর সবকিছু একদিকে আর ফাইভ মেলোডির গান একদিকে।” মিতা বলল উদাস সুরে। তাকাল মায়ার দিকে, “আপু কিছু করো।”
মায়া রুমে তাকাল সবার দিকে। তারপর নিজের হাতে থাকে চিরুনীর দিকে চোখ আটকায়। সোফায় লাভ দিয়ে উঠে। চিরুনীটা মুখের সামনে তুলে চোখ টিপ মারে মিতার দিকে। নিজেই গান গাওয়া শুরু করে,
“স্বপ্নরা পেখম মেলে, উড়ে বেড়ায় মেঘের শহরে
আবারও হবে দেখা, ভাসব আবার প্রেমজোয়ারে….
উড়ে বেড়ায় এই মন বেপরোয়া
তোমার অনুভূতির আসমানে
স্বপ্নরা পেখম পেলে, উড়ে বেড়ায় অনুভূতির শহরে….
আমার অনুভবে তুমি, অনুভবে তুমি, অনুভবে শুধু তুমি…”
মায়া সোফা থেকে লাফ দিয়ে নেমে একবার সহিয়া চাচীর সাথে নাচে। আবার তার মা’য়ের সাথে। অবশেষে তার ভাইকেও ছাড়ে না। তার ভাই প্রথমে রাগ হলেও তার পাগলামো দেখে তার মিথ্যে রাগের ভান ছাড়তে বাধ্য হয়। মায়া গান গেয়ে নাচতে নাচতেই বেরিয়ে পড়ে তার স্কুটি নিয়ে। যাবার পর তার ভাই বলে, “এমন বেপরোয়া ভাব নিয়ে এই জীবনে কিছু করবে কি করে? জীবনে তো একটু সিরিয়াস হওয়া প্রয়োজন। আল্লাহ জানে কী হবে ওর।” বলে হেসে দেয়।
মায়া স্কুটি নিয়ে রওনা দেয় তার গন্তব্যে। গন্তব্য হচ্ছে ওয়াহেদের বাড়ি। সে প্রতিদিনই ওয়াহেদের বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে ভার্সিটি একেবারে যায়। আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেল। তাইতো ওয়াহেদের বাড়ির সামনে যেয়ে দেখে তার গাড়ি বের হচ্ছে। সে স্কুটি থামায় একদম গাড়ির সামনে। সাথে সাথে গাড়িটি থেমে যায়। ওয়াহেদ গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে, “মিষ্টির বাচ্চা এখন আসার সময় হলো তোর?”
তারপর সে গাড়ি থেকে বের হয়ে মায়ার স্কুটির পিছনে বসে, “আমি ভেবেছি আজও তুই ভার্সিটিতে যাবি না। তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রথম ক্লাস হয়ে গেছে।”
“ভালোই হইসে। বরকত স্যারের ক্লাস আমার বিরক্তিকর লাগে। আর আজ ক্লাস করতে যাচ্ছি না’কি? নবীনবরণ হবে সেজন্যে প্লানিং করতে যাচ্ছি। একটা ক্লাসও করব না। তন্নি, আশরাফ ও মেহেদী ক্যান্টিনে বসে আছে।”
“পড়াশোনা ছাড়া সবকিছুর জন্যই তোর সময় আছে। আমি বুঝি না তোর রেজাল্ট আমাদের সবার থেকে ভালো হয় কীভাবে?”
“টেলেন্ট মামা…এই না। তুই তো আমার হবু জামাই। টেলেন্ট মিস্টার হবু জামাই, ইট’স ট্যালেন্ট।”
ওয়াহেদ তার মাথায় টোকা মেরে বলে, “আসছে ট্যালেন্টওয়ালি। তাড়াতাড়ি চল। আমি তো ক্লাস করব।”
“আরেকবার মারলে একবারে স্কুটি থেকে ফেলে দিব মনে রাখিস।”
“হো হো ঠিক আছে। এখন স্কুটি চালু কর।”
মায়া ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে, “ইয়ো করিম মামা, হোয়াটস আপ?”
“মামা আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
“বিন্দাস। আচ্ছা মামা আমরা যাই। নাহলে এই পিছনে বসা জন্তুটা খ্যাটখ্যাট করবে।”
ওয়াহেদ বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করল, “এই ড্রাইভার তো নতুন আসলো। আমি তো এখনো নাম জানি না, তুই তাকে চিনলি কীভাবে?”
“মায়া সব জানে।”
ভার্সিটিতে যেয়ে মায়া জোর করে ওয়াহেদকে নিয়ে যায় ক্যান্টিনে। সেখানে অপেক্ষা করছিল তন্নি, আশরাফ ও মেহেদী। মায়া একটি চেয়ারে বসে উৎসুক গলায় বলল, “নবীনবরণের প্লান বল।”
তন্নি বলে, “বেবস নবীনবরণ শেষে আশরাফের বাড়িতে পার্টি করি চল। আন্টিকে মানানোর দায়িত্ব তোর।”
“সেসব আমার উপর ছেড়ে দে। পটানোতে আমি ওস্তাদ। আমি জিজ্ঞেস করছি পার্ফরমেন্সের ব্যাপারে। পঞ্চসুরের গান গাই চল। আমরাও পাঁচজন।”
ওয়েহেদ বিরক্তর সুরে বলে, “তুই আর তোর পঞ্চসুর। অন্যকিছুও ভাব।”
মায়া গালে হাত রেখে তাকায় ওয়াহেদের দিকে, “কেন জান, তোমার হবু বউ অন্যকারো কথা ভাবছে বলে তোমার জ্বেলাস ফিল হচ্ছে?”
“জ্বেলাস ফিল হবে কোন দুঃখে? তোকে বিয়ে করছি যেন অন্যকোনো পোলার কিসমত না নষ্ট হয়। সমাজসেবা করছি।”
মায়া প্রথমে মুখ বানায়, তারপর ওয়াহেদের হাতে জোরে কামড় দেয়। ওয়াহেদ শান্ত সুরে বলে, “এই মাসে সতেরোবার কামড় দিলি। ভাবছি কুকুরের কামড়ে যে ইনজেকশন লাগায়, তা লাগিয়ে নিব।”
কথাটা শুনে মায়ার রাগ বাড়ে। সে একের পর এক মারতে থাকে ওয়াহেদকে। থামানোর চেষ্টা করেও থামে না। অবশেষে ওয়াহেদ তাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে তার চেপে ধরে, “এবার মেরে দেখা।”
আশরাফ উঠে দাঁড়ায়। বিরক্তির সুরে বলে, “তুই আর তোদের ঝগড়া। আজ আর কোনো প্লানিং হবে না। আমি ক্লাসে গেলাম।”
ওয়াদেরও ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, “আমিও আসছি সাথে। মিষ্টি যাবি?”
“যা তোরা বোরিং ক্লাসে। আমি ক্যাম্পাসে একটু চক্কর লাগায়া আসি। তারপর গানের ক্লাসে যাব।”
মায়া পরেছিল হলুদ রঙের লম্বা স্কার্ট, উপরে গোলাপি রঙের টপ। তার কাঁধে ঝুলানো একটি ব্যাগ। তার চুলগুলো হাঁটু পর্যন্ত আসছে। হাঁটার সাথে সাথে দুলছে তার কেশ। সে ক্যাম্পাস ঘুরছিল এমন সময় দেখে কয়েকটি ছেলে একটি মেয়েকে বিরক্ত করছিল। মেয়েটিকে দেখেই মনে হচ্ছিল সে ভয় পাচ্ছে। তাই মায়া গেল সেখানে। ছেলে দু’টি বলল, “আপনারা মেয়েটাকে বিরক্ত করছেন কেন?”
“বিরক্ত করছি না তো। আমরা তো তাকে স্বাগতম করছি।” ছেলে দু’টির মধ্যে একজন বলল।
মায়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে, “ওদের কাওকে চিনো?”
মেয়েটির চোখে ভয়। সে সংকোচিত হয়ে ডানে বামে মাথা নাড়ায়।
“ও আপনাদের থেকে ভয় পাচ্ছে। ওকে বিরক্ত করবেন না।”
“ওকে না হলে তোকেই বিরক্ত করি।” বলে ছেলেটা হাত ধরে মায়ার।
“ভাই এভাবেই হাত ধরে রেখেন কেমন?” এরপর মায়া চিৎকার করতে শুরু করে, “বাঁচাও…কেউ বাঁচাও। এই ছেলেটা আমাকে হুমকি দিচ্ছে। আমার সাথে উল্টাপাল্টা করে ফেলবে।”
“এই মেয়ে বলে কী? আমি একথা কখন বললাম? এই মেয়ে চুপ করো।”
মায়া আরও জোরে চিৎকার শুরু করল। ছেলে দুটো ভয়ে দৌড়ে পালায়। তারপর মায়া মেয়েটির দিকে ফিরে তাকায়, “তুমি ঠিক আছো?”
“অনেক ধন্যবাদ আপু। আমি তাদের রেশমা ম্যাডামের গ্লানের ক্লাসের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর তারা বিরক্ত করতে শুরু করে দিলো।”
“রেশমা ম্যাডামের কাছে তো আমিও যাচ্ছি। আমার সাথে আসো। ভালো কথা তোমার নামই জিজ্ঞেস করা হয় নি। নাম কী তোমার?”
“আমার নাম দিয়া।”
দরজায় টোকা পড়তেই ধ্যান ভাঙে মায়ার। সে অতীতে ফিরে। ছবির ফ্রেম ড্রয়েরে রেখে নিজেকে সংযত করে। উঠে যেয়ে দরজা খুলে। চমকে উঠে সে। ওয়াহেদ এখানে কী করছে? সে নিজের অন্তরটা শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি এখানে?”
“কিছু কথা ছিলো মিষ্টি।”
মায়া কঠিন গলায় বলে, “মায়া…আমার নাম মায়া চৌধুরী।”
“ভেতরে আসতে পারি?”
“কোম্পানির কথা হলে আসতে পারেন। ব্যক্তিগত হলে না।” সে যেয়ে বসে নিজের চেয়ারে।
ওয়াহেদ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “তুই না’কি নেতা অভ্রর সাথে বিয়ে করছিস?”
“ও খবর পেয়ে গেছেন? নিজের পরিবারের সাথে অবশ্যই আসবেন। বিশেষ করে আপনার বাবাকে নিয়ে আসবেন।”
“মিষ্টি প্লিজ তুই আমার উপর রাগ উঠানোর জন্য বিয়েটা করিস না। নেতা মানুষদের কত শত্রু থাকে। তোর কিছু হয়ে গেলে?”
“এসব মিথ্যা নাটক আমার সামনে করার প্রয়োজন নেই। কোনো কাজ থাকলে বলুন, নাহলে চলে যান।”
ওয়াহেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “জোহানের কথাও বলার ছিলো। ওকে নিয়ে এত কনট্রভার্সি থাকা সত্ত্বেও কেন ওকে কোম্পানির আর্টিস্ট করলি?”
“সি.ই.ও হিসেবে এটা আমার সিদ্ধান্তেই কাজ হবে এখানে। আপনি নিজের শেয়ারের মূল্যের সাথে মতলব রাখেন।”
“কোম্পানির কোনো সমস্যা হলে সবাই তোকেই দোষারোপ করে। আমি তোর কথাই চিন্তা করছিলাম।”
মায়া চৌধুরী তাচ্ছিল্য হেসে পা’য়ের উপর পা তুলে বসে, “আমার কথা তখন চিন্তা হয় নি যখন সকলে আপনার কারণে আমাকে কত জঘন্য কথা শুনিয়েছে বিশেষ করে আপনার বাবা। তখন তো মুখ ফুটে কথা বের হয় নি।”
“এর জন্য আমি ক্ষমা চেয়েছি। শাস্তিও পেয়েছি। তোকে ছাড়া এত বছর কাটানো আমার জন্য শাস্তি থেকে কম?”
“কীসের শাস্তি? এখানে তো সবাই ছিলো আপনার কাছে। আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব আর প্রেমিকা। ও আচ্ছা আপনার প্রেমিকা এই কোম্পানিতে আছে তাই ভয়ে আছেন ওর ক্যারিয়ারে কোনো ইফেক্ট পড়বে না তো জোহানের কারণে। তাই না?”
“মিষ্টি প্লিজ। আমি তোর কথা ভাবছি।”
মায়া উঠে দাঁড়ায়। তার আর সহ্য হচ্ছে না। সে বলে, “অনেক হয়েছে এবার বের হন। আমি নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পাড়ব। দাঁড়ান স্যার, আমিই আপনার জন্য গেইট খুলে দিচ্ছি।”
মায়া এগিয়ে যেতে নিবে তখনই ওয়াহিদ তার হাত ধরে নেয়। মায়া পিছনে তাকিয়ে রাগে ফেটে পড়ে, “হাত ছাড়ুন। আমাকে ছোঁয়ার সাহস কী করে পেলেন আপনি?”
“মিষ্টি…” গলা কাঁপছিল ওয়াহিদের। তার দৃষ্টি অসহায়। তার দৃষ্টি দেখে বুক কেঁপে উঠে মায়ার। তার মনের ভেতরটা কাঁপে।
না মায়া, তুই নরম পড়তে পারিস না।
কিছুতেই না। তোর সাথে যা হয়েছে, সে কষ্টগুলো এত সহজে ভুলতে পাড়িস না। কিছুতেই না।
তার অন্তর কথা মানে না। অনুমতিবিহীনই তার চোখে জল ভেসে উঠে। সে ঢোক গিলে।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ আসে। জোহান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “মায়া আই এম সরি। আমার কথাগুলো…” থেমে যায় সে। মায়া ও ওয়াহেদকে একসাথে হাত ধরে থাকতে দেখে বিব্রত অবস্থায় পড়ে যায়। সে জোরপূর্বক হেসে বলে, ” সরি নক করে ঢুকতে ভুলে গেছি। পরে আসি।”
মায়া তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “যাবার প্রয়োজন নেই। আমি ফ্রী আছি। মিস্টার ওয়েহেদ যেতে পারেন আপনি।”
“মিষ্টি আমার কথা শেষ হয় নি।”
“আগেও বলেছি, এখনও বলছি আমার নাম মায়া। মিষ্টি নামের কাওকে আমি চিনি না। যেতে পারেন। আমার এখন কাজ আছে।”
ওয়াহেদ আর না পেরে সেখান থেকে চলে গেল। যাবার পূর্বে একবার সরু চোখে তাকাল জোহানের দিকে। তার এমন তাকানোর কারণটা বুঝে উঠতে পারে না জোহান। ওয়াহেদ যাবার পর জোহান কৌতুহলী কন্ঠে মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার ও এই লোকের না কি হয়েছে। আপনি তার থেকে প্রতিশোধ নিতেন। আর আজ…”
“আপনার আমার জীবনের কাহিনী এত দেখে লাভ নেই। নিজের গানের দিকে খেয়াল দিন। আপনার উপর যে টাকা ইনভেস্ট হচ্ছে তা ফেরতও আনতে হবে জলদি। সাথে আমার সিদ্ধান্তের উপর যাদের ডাউট আছে তাদের ভুল প্রমাণও করতে হবে।”
“আমি তো আপনাকে কেবল সরি বলতে এসেছিলাম।”
“আমি আপনার সরি শুনতে চেয়েছি? আমার কথা না ভেবে নিজের চরকায় তেল দিন।”
“কী আজব!”
“আমি আজবই।”
“মানুষ ঠিকই বলে। আপনি একটা…” বাকিটা বিড়বিড় করে বলে জোহান, “রাক্ষুসে মহিলা।”
“কী বললেন?”
“কিছু না। আমি যাচ্ছি তাহলে।”
জোহান দরজা দিয়ে বের হয়ে আবার উঁকি মারে ভেতরে, “এই’যে মিস মায়া…সরি।” বলেই চলে যায়।
মায়া কথা নাড়িয়ে বলে, “ইডিয়ট।”
.
.
আজ অভ্রর ইন্টারভিউ। এই কারণে সকলে কাজে জুটে আছে জোরেশোরে। স্টুডিওতে দৌড়াদৌড়ি করছে তারা। বিশেষ করে আহনাফকে ভীষণ ব্যস্ত দেখাচ্ছে। এই কাজ ছেড়ে ওই কাজের পরিদর্শন করছে। আজ সব পার্ফেক্ট হওয়া চাই। এতদিন সকল নিউজ চ্যানেলে অভ্রর খবর চলেছে। আজ লাইভে তার ইন্টারভিউ তাদের চ্যালেন থেকে আসলে টি-আর-পি উচ্চে চলে যাবে। তাই সবকিছু সঠিক হওয়া চাই।
অভ্রর গাড়ি এসে থামলো তাদের স্টুডিওর সামনে। সকল স্টাফ তাকে রিসিভ করতে আসে। আহনাফ তাকে ফুল দিয়ে রিসিভ করে। সে ভেতরে আসে। এত মানুষের মাঝেও তার দৃষ্টি খুঁজে একটি মেয়েকে। কিন্তু তার দেখা পায় না। ক্যামেরা সেটিং করে তাকে বসানো হয় অতিথির সোফায়। তার সামনে একটি টেবিল এবং অন্য একটি খালি সোফা। সোফাটির দিকে তাকিয়ে সে আহনাফকে ডাক দেয়। জিজ্ঞেস করে, “ইন্টারভিউ সুরভির নেবার কথা না? তোমাকে এই শর্ত দিয়েই ইন্টারভিউ দিতে এসেছি।”
“জ্বি স্যার, অবশ্যই। আপনার কথা ফেলাতে পারি আমরা?”
“তাহলে ও কোথায়?”
“ও হয়তো নার্ভাস। দেখে আসছি আমি।”
সুরভির জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। কিন্তু তাকে মোটেও নার্ভাস দেখাচ্ছে না। বরং আত্নবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। তার হাতে একটি কাগজ। সে স্টুডিওতে ঢুকতেই দেখা হয় আহনাফের সাথে, “তোমার সাথেই দেখা করতে আসছিলাম। তুমি ঠিক আছো তো? নার্ভাস তো লাগে না।”
“না আমি একদম পার্ফেক্ট।”
“তাহলে আসো। লাইভে আসার সময় হয়ে যাচ্ছে।”
সুরভি মাথা নাড়ায়। যেয়ে বসে অভ্রর সামনে। তাকে দেখেই অভ্র ভ্রু নাচায়। তারপর বাঁকা হাসি দেয়।
সুরভি বরাবরই তাকে এড়িয়ে যায়। সে বসে। ইন্টারভিউ চালু হয়। লাইভে যায়। লাইভে যাওয়ার পর সুরভি সুন্দর করেই অভ্রকে তার প্রফেশনাল লাইফের কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। তার দল নিয়ে, এক দল ছেড়ে অন্য দলে যুক্ত হওয়া নিয়ে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। বিরতি নেওয়া হয়। বিরতির সময় অভ্র এসে দাঁড়ায় সুরভির সামনে। তাকে বলে, “আই এম ইম্প্রেশড মিস ক্যাঁক্যাঁ। তোমাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে না এটা তোমার প্রথম ইন্টারভিউ। পুরো প্রফেশনাল লাগছে।”
সুরভি তীক্ষ্ণ হেসে বলে, “বিরতির পরের ইন্টারভিউ আপনার আরও ভালো লাগবে। আই প্রমিজ।”
“তাই? অপেক্ষায় থাকবো তাহলে।”
ফজলু মিয়া অভ্রর জন্য কফি এনে দিলে সে নিজের সোফায় যেয়ে বসে আবার। সুরভি আশেপাশে তাকায় কিন্তু কোথাও পায় না আহনাফকে। ভাবে কোনো কাজে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু এর থেকে বেশ জরুরী কাজ এখন কি হতে পারে?
বিরতির পর আবারও ইন্টারভিউ শুরু হয়। আবারও শুরু হয় প্রশ্ন-উত্তর। তখনো অভ্রর দেওয়া প্রশ্নগুলো দিয়েই ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে সুরভি, “আচ্ছা মিস্টার অভ্র, আপনি তো একজন নেতা। তাও কয়েকবছর ধরে। একজন সাধারণ নেতার তো এত ইনকাম হবার কথা না যত আপনার আছে। এই লাক্সারি কার, লেভিস হাউস, ব্যান্ডের জিনিসপত্র। এতকিছু একজন নেতার আয় হিসাবে নেওয়া কীভাবে সম্ভব তা জানতে ইচ্ছা করছে। এসব তো দুর্নীতি ছাড়া অর্জন করা সম্ভব না।”
প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠে অভ্র। এমন কোন প্রশ্ন সে লেখেনি। সে ভাবেও নি সুরভি লাইভ টিভিতে সম্পূর্ণ দেশের সামনে তাকে এমন এক পরিস্থিতিতে ফেলবে। তাই এর প্রিপারেশনও নেয় নি সে। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। সামলে উঠার পূর্বেই আরেকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে নেয় সুরভি, “আপনি মিস্টার সভ্যর ভাই তা হঠাৎ প্রকাশ করলেন কেন? যেন নির্বাচনের পূর্বে আপনি সরকারি দলে যেতে পারেন? যে দলের বিজয়ী হবার সুযোগ এবার অনেক।”
অভ্রর রাগে রক্ত মাথায় উঠছিল। তার দেহের শিরায় শিরায় যে অগ্নিশিখা জ্বলছে। সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সুরভির দিকে। সুরভির চোখে এক রকমের স্বস্তি, শান্তি। যেন এই প্রশ্নটা করে সে বিরাট বড় তীর মেরে নিয়েছে।
অভ্র গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। সম্পূর্ণ দেশের সামনে নিজে দোষী দেখানো যাব না। সে হেসেই উওর দেয়, “আপনারা হয়তো জানেন আমি ইসমাত বংশের ছেলে। স্বাভাবিক আমার কাছে সম্পদ হবেই। ইসমাত কোম্পানির শেয়ারের এক অংশও আমার নামে। এছাড়া আমি আমেরিকায় কিছুবছর কাজ করেছি এবং সেখানে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার আছে আমার কাছে। যা লাভজনক। উল্টো আমি এই প্রফেশন থেকে যত অর্থ পাই সব দান করে দেই। আর কি জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনি? হ্যাঁ, সভ্যর ব্যাপারটা। সভ্য আমার ছোট ভাই। তাকে আমি আমার ভাই বলবই তো। এছাড়া সভ্যই মিডিয়ার সামনে আমার কথা বলেছে। আর বাকিটা রিপোর্টাররাই ছড়িয়েছে। তাই এই উওর আমার কাছে নেই।”
সুরভি ভ্যাবাচেঁকা খেয়ে যায়। অভ্র এত সুন্দর করে এই উওর দিবে সে ভাবে নি। সে দেখতে পায় ক্যামেরার পিছন থেকে তুষার তাকে ইন্টারভিউ শেষ করবার কথা বলছে। তাদের সবার মুখে হয়তো ভয়, নয়তো রাগ। যেন সে বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে।
সুরভি ইন্টারভিউ শেষ করতেই তুষার উঠে আসে স্টেজে, “তুমি পাগল হয়ে গেছ সুরভি? এটা কী করলে তুমি? লাইভে এসে…এটা তোমার প্রথম এবং শেষ ইন্টারভিউ। তোমার এই জব থাকবে না’কি তাই দেখো।”
“স্যার আমিতো…”
“চুপ। একদম চুপ করো।”
সে দ্রুত যায় অভ্রর কাছে, “স্যার ক্ষমা করে দেন। ও ছোট তো বুঝে নি। আমি ওর পক্ষ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। সুরভি এদিকে আসো। স্যারের কাছ থেকে ক্ষমা চাও।”
“অসম্ভব।” জোর গলায় বলল সুরভী। অভ্র অগ্নিদৃষ্টিতে চোখ তুলে দেখায় তার দিকে। তুষারকে বলে, “একমিনিটের জন্য একটু নিচে নামুন। আমার ওর সাথে কথা আছে।”
“জ্বি স্যার। এই সবাই সরো। সরো দেখি।”
অভ্র তার পাঞ্জাবির পকেটে হাত রেখে এগিয়ে যায় সুরভির দিকে। সুরভি তখন হাত আড়া-আড়ি করে ভাঁজ করে ছিলো। অভ্র তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “মনে হচ্ছে না কত বড় তীর মেরে ফেলেছ? এতদিন তো মুখে মুখে মজার ছলে কিছু কথা বলেছি। এখন দেখো আমি কি করি। তুমি যদি আমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে মাফ না চাইছ তাহলে আমার নাম অভ্র না।”
“আচ্ছা নাম চেঞ্জ করার অপেক্ষায় থাকবো।”
অভ্র বাঁকা হাসে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে চলে যায়। তুষার সহ সকল স্টাফরাও ক্ষমা চাইতে চাইতে তার পিছু পিছু যায়।
চলবে….
[দয়া করে ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্প নিয়ে মন্তব্য জানাবেন। ভালো অথবা খারাপ।]