অনুভূতির খাঁচা পর্ব-৯+১০

0
2

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সুরভি বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এলো স্টুডিও থেকে। তুষার স্যার সবার সামনে তাকে কেবল বকেছে। তার এই আনপ্রফেশনাল কাজের জন্য এই চাকরিতে রাখা হবে না’কি তার জন্যও না’কি মিটিং বসবে। অথচ সে সাধারণ প্রশ্নই করেছিল। তার কাছে তো অভ্রর সকল দুর্নীতি অন্তর্ভুক্ত কাজের লিস্ট ছিলো। সে চাইলেই তা পড়ে লাইভ টিভিতে শোনাতে পাড়তো। কিন্তু সে তো এমন করে নি। সীমা রেখেছেন। অথচ সকলে এমন ভান করছে যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। নিউজ চ্যানেল হয়ই তো জনগণের কাছে সত্যটা পৌঁছানোর জন্য। সে তাই করতে চেয়েছিল। এই মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা করার জন্য তার আহনাফের সাথে কথা বলা উচিত। যেহেতু আহনাফ স্টুডিওতে ছিলো না সেহেতু অফিসেই থাকবে। সে আশেপাশে খুঁজে আহনাফকে না পেয়ে তার কেবিনের দিকে এগোয়। যেহেতু অফিসে বেশি লোক নেই এবং এখন তার মাথাও ঠিক নেই তাই অনুমতি ছাড়াই সে ঢুকে পড়ে কেবিনে।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অনুভূতি হয় তার। নিশ্বাসটা যেন আটকে আসে। বুকের ভেতর তোলপাড় হতে শুরু করে। তার বিশ্বাস হয় না নিজের চক্ষুর উপর। সাথে সাথে সে কেবিনের দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজা বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দরজাটির দিকে। সে ঠিক দেখেছে তো? আহনাফ বিধির সাথে এমন আপত্তিকর অবস্থায় কীভাবে থাকতে পারে? নিশ্চয়ই তার ভ্রম হয়েছে। তার ভেবে উঠার পূর্বেই আহনাফ দরজা খুলল। সে কোর্ট পরছিল। বের হয়েই সে জিজ্ঞেস করে, “সুরভি তুমি যা ভাবছ এমন কিছু না। আমরা যাস্ট কথা বলছিলাম এর মধ্যে হঠাৎ… ” সে থেকে কিছুটা জোর গলায় জিজ্ঞেস করে, “তুমি ঢোকার পূর্বে নক করো নি কেন?”

রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় তার হাত মুঠোবন্দী হয়ে গেল। প্রথম কথাটা এই বলার আছে তার? সে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আহনাফের দিকে। সে চক্ষুতে জমে নোনাজল। আহনাফ এগিয়ে এসে বলে, “প্লিজ কান্না করো না। তুমি আমার কথাটা শুনো…” সে হাত তুলে সুরভির মুখে হাত রাখতে নিবে আর সে পিছিয়ে যায়। সে ফিরে দুইগাল মুছতে মুছতে দ্রুত বেরিয়ে যেতে চায় এই জঘন্য পরিস্থিতিতে। সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। এই উঁচু দেয়াল ঘেরা দালান থেকে বের হলে যদি তার নিশ্বাস ফিরে। তার যেতে যেতেই বিধি তার হাত ধরে নেয়, “সুরভি আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেও। দোষ আমার। আমি ফোন করে ডেকেছিলাম আহনাফকে। ও বলেছি তুমি আমার ফিয়োন্সের ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছ যেন আমার মা বাবার সাথে কথা বলতে পারো। তুমি ব্যস্ত ছিলো বলে ও এলো। আমরা কথা বলছিলাম কেবল। আমি কথাগুলো বলতে বলতে আবেগে ভেসে গেলাম। কান্না চলে এলো আমার। আহনাফ কাছে এসে আমাকে কনসোল করছিল কেবল। কিন্তু জানি না এরপর কি হলো…ভুল হয়ে গেছে সুরভি। আমাকে ক্ষমা করে দেও। তুমি আমার সাহায্য করতে চেয়েছ আর আমি… আই এম সরি। আমি আর কখনো তোমাদের কারও আশেপাশেও আসবো না। আই প্রমিজ। আমার কোনো হেল্প লাগবে না।”
“হাত ছাড়ুন আমার।”
“আই এম সরি সুরভি। আই এম সরি।”
সুরভি এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দেয়। আর সে পিছন থেকে পড়ে যেতে নেয়। শেষ মুহূর্তে আহনাফ তাকে ধরে নেয়। আর উচ্চ স্বরে ধমক দিয়ে উঠে, “সুরভি নিজের লিমিটে থাকো। ও তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে আর তুমি ওকে ধাক্কা দিচ্ছো? বিধির যদি কিছু হয়ে যেত? ও যদি ব্যাথা পেত?”

সুরভির ঘেন্না আরও বাড়ে। যন্ত্রণা বাড়ে। বিধির যদি কিছু হয়ে যেত? সে যদি ব্যাথা পেত? তার এই মুহূর্তে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে, “বিধির কথাই আপনার মস্তিষ্কে ঘুরতে থাকলে আমার জীবনের এতটা সময় নষ্ট করলেন কেন? আমার অনুভূতির এত বড় এক অংশ কেড়ে নিলেন কেন? আমার জীবনেই বা এলেন কেন?” কিন্তু প্রশ্নগুলো তার মুখ দিয়ে বের হয় না। সে আহনাফের সামনে নিজের এই ভেঙে পড়া চুরমার হওয়া হৃদয়টা দেখাতে পাড়বে না।

“সুরভি আবার কিছু করেছে?” তুষার স্যার এলেন দরজা দিয়ে। তার পিছনে কতগুলো স্টাফ আসছে। হয়তো স্টুডিও থেকে একসাথে এসেছে তারা। তুষার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলে, “আহনাফ তুমি জানো না এই মেয়ে কি করেছে। ও ইন্টারভিউর শেষ দিকে অভ্র স্যারকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করেছে। ভাগ্যিস স্যার নিজের বুদ্ধি দিয়ে সামলে নিয়েছে সব। এখন সবাই কেবল দোয়া করতে পারি যে স্যার আমাদের চ্যানেলের ক্ষতি না করুক। আমার তো এই মুহূর্তেই ওকে জব থেকে বের করে দিতে ইচ্ছা করছে কেবল তোমার বাগদত্তা বলে চুপ আছি। কিন্তু আমাদের সিনিয়রদের কাছে এই খবর গেলে তারা আমাদের ছাড়বে না।”
আহনাফ সুরভির দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি বুঝতে পাড়ছ, কী করেছ তুমি?”

সুরভি তার স্পর্ধা দেখে অবাক হয়। একটু আগে সে যা করেছে এরপর তার সামনে কথা বলার পূর্বেও তো লজ্জায় ডুবে যাওয়া উচিত। সে নিজেকে সংযত করে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে। তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে, “একচুয়ালি আমি এই মুহূর্ত থেকে আর তার বাগদত্তা না, তাই আপনি যা করার করতে পারেন।”
তুষারের মুখে বিব্রতবোধ ছিলো। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “আহনাফ ও তোমার তো বিয়ে হবার কথা, তাই না?”
এরমধ্যে একটি মেয়ে বলল, “নো ওয়ান্ডার ও একটু আগে যে কান্ড করল স্যার রাগ করে হয়তো বিয়েই ভেঙে দিয়েছে।”

আহনাফ তুষারকে বলল, “তুমি তো জানো ও মাঝেমধ্যে ছোট কথায় অতিরিক্ত রাগ করে। ওর কথায় ধ্যান দিও না।” এবার নরম গলায় সুরভিকে বলে, “সুরভি তুমি বাসায় যাও। এই ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলব।”
“পরে কেন? এখনই বলি। আমার তো মাথা খারাপ হয়েই গেছে। তাহলে বলতে কী সমস্যা? ছোট একটি ঘটনাই তো, তাই না? কেন এখন আপনার ভয় লাগছে যে সবার সামনে আপনার করা এই কাজ প্রকাশ পেলে আপনার সম্মানের কী হবে? যখন আপনার এই কাজ করেছেন তখন এই ভয়টা লাগে নি? অথবা এমন জঘন্য কাজের পর আমার সামনে উঁচু স্বরে কথা বলেছেন তখন তো এই ভয়টা লাগা উচিত ছিলো। কারণ এতদিনে আপনি আমাকে চেনা উচিত ছিলো। আমি এখানে আপনার সামনে বসে কান্না করার মতো মেয়ে না।” সে সকলের দিকে তাকিয়ে বলে, “লেডিস এন্ড জেন্টালমেন আমাদের এনগেজমেন্টের ঘোষণাটা আসলে সেভাবে কখনো করা হয় নি। কিন্তু আজ এনগেজমেন্ট ভাঙার ঘোষণাটা সুন্দরভাবে করছি। মিস্টার আহনাফের মতে এটা খুবই ছোট ঘটনা। আমরা যখন ইন্টারভিউর শ্যুটিং করছিলাম তখন আপনাদের আহনাফ স্যার সেখানে ছিলো না কেউ খেয়াল করেছেন? সে এখানে…”

আহনাফ এসে তার বাহু ধরে ধমকের সুরে বলে, “সুরভি আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে কিন্তু এখন তুমি তামাশা করছ। এখানে আমার সাথে বিধির সম্মানও জড়িত আছে।”
“নিজের সম্মানের ব্যাপারে আপনাদের নিজের সীমা লঙ্ঘন করার পূর্বে ভাবা উচিত ছিলো।” তার দৃষ্টি অগ্নিময় ছিলো। সে বড়বড় ক্রোধিত চোখে তাকিয়ে ছিলো আহনাফের দিকে। তার দিকে তাকিয়েই সকলকে বলল, “যখন আমরা শ্যুটিং এ ছিলাম সে তখন এখানে তার এক্স-গার্লফ্রেন্ডের সাথে রোমেন্স করছিল। ঘনিষ্ঠ হতে ব্যস্ত ছিলো।”
“এমন কিছু হয় নি।” আহনাফ তবুও জোরগলায় কথাটা বলল, “এমন কিছু হয় নি। ও ভুল বুঝছে।”
“আচ্ছা তাহলে আমি কি দেখেছি তা লাইন বাই লাইন বলব যেন সবাই আমাকে বুঝাতে পারে আমি ভুল বলছি না ঠিক।” সে আহনাফের পিছনের বিধিকে দেখে বলল, “আপনি আমাকে বলেছিলেন না যে আহনাফকে পেয়েছি বলে আমি খুব লাকি। এমন লাক আপনিই রাখুন। এই লাক আমার লাগবে না।” বলে তার আঙুল থেকে তাদের এনগেজমেন্ট রিং খুলে আহনাফের মুখের উপর ছুঁড়ে মারে। আর সবার দিকে তাকিয়ে বলে, “আর আপনাদের কাজ আমি সহজ করে দিচ্ছি। আপনাদের কোনো মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া লাগবে না। এই চাকরি আমি নিজে ছেড়ে যাচ্ছি।”

সে বাহিরের পথের দিকে এগোয়। যত দ্রুত সম্ভব সে এই জায়গা থেকে বের হতে চায়। আর কারও চেহেরাও দেখতে চায় না। এক মুহূর্তের জন্যও না। বাহিরে যেয়ে রিক্সায় উঠে। বাসার জন্য রওনা দেয়। নিজেকে খুব সামলায় সে। কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়ে পড়তে থাকে। সে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে বারবার গাল মুছে। লাভ হয় না। যতবার গাল মুছে ততবারই গাল গড়িয়ে জল বয়ে পড়ে। সে মাথা উঁচু করল। তাকাল আকাশপাণে। গোধূলিবেলা। রক্তিমা আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে কতগুলো সাদা কবুতর। সে তাকিয়ে রইল সেদিকে। আর তার চোখের কোণ দিয়ে পড়ল এক ধারা নোনাজল।

“এই সুরভি রাতের খাবার খেতে আয়। অফিস থেকে এসেই রুম বন্ধ করে বসে আছিস। জলদি বের হ।” মা বারবার একই কথা বলছে এবং দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। অবশেষে সুরভি বের হয় রুম থেকে।
মা তাকে দেখে বলে, “মহারাণীর এখন সময় হলো রুম থেকে বের হবার। অফিস থেকে এসেই যে রুমে ঢুকে বসে থাকিস এই কাজ শশুড়বাড়িতে করলে তো সংসারে অশান্তি শুরু হবে।”
বাবা, সাঈদ ও রিধু চেয়ারে বসে ছিলো। বাবা খাবার প্লেটে বাড়তে বাড়তে সুরভীর পক্ষ হয়ে বললেন, “উফফ আমার মেয়েটাকে এত বোকা কেন বলতো। এত পরিশ্রম করে এসেছে আর আসতে না আসতেই কথা শুনানো শুরু করলে। সুরভি আয় তো, আমার পাশের চেয়ারে বস।”

সুরভি চুপচাপ যেয়ে চেয়ার টেনে বসলো। তার মনটা উদাসীন দেখাচ্ছে। সে বসলেও খাবার প্লেটে তুলল না। মা খিটখিটে মেজাজে বললেন, “আমার কথা তো এখন ভালো লাগে না যখন মেয়ের সংসারের সমস্যা হবে এবং ওর বিরুদ্ধে কথা শুনতে হবে তখন বুঝবে।” কথাগুলো বলতে বলতে ও তিনি সুরভির প্লেটে খাবার তুলে দিলেন। যেয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। দেখলেন মেয়ে খাচ্ছে না। তাই নিজের খাবার মেয়েকে খাইয়ে দিতে উঠলেন। প্রথমে গা’য়ে হাত দিয়ে দেখলেন। বললেন, “কিছু বলছিস না যে আজ? অসুস্থ লাগছে শরীর? দেখিতো শরীর গরম না’কি?”
সাইদ বলল, “আরে মা ওর কিছু হয় নি। নিশ্চয়ই আহনাফের সাথে ঝগড়া করে এসেছে।”
“তাই না’কি?” সে ভাত মেখে মেয়ের সামনে তুলে বললেন, ” ছোট ঝগড়া পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু মেয়েদের সামলে চলতে শিখতে হয়। এত রাগ ভালো না। সব মানিয়ে নিতে হয়। নে এখন খেয়ে নে, তারপর আহনাফের সাথে ফোনে কথা বলে নি।”

“কথা বলা আর হবে না মা। ভাইয়া ঠিক বলেছে, ঝগড়া করে এসেছি। আমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।” সুরভি বলল উদাসীন গলায়। তার দৃষ্টি শূন্য। চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না সকলের প্রতিক্রিয়া। তার দেখার ইচ্ছাও নেই। শক্তিও নেই।
মুহূর্তে মা’য়ের গর্জনভরা কন্ঠ তার কানে ভেসে এলো, “এই মেয়ের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এতো ভালো সম্বন্ধে কেউ ভেঙ্গে দেয়? ছেলে ভালো, ছেলের পরিবার ভালো, ছেলের চাকরি ভালো, দুইবছর ধরে কথা বলছিস ওর সাথে। আমাদের সব আত্মীয়রা তোদের বিয়ের কথা জানে। তোর কি মাথা নষ্ট হয়েছিল যখন এই কথা মুখ দিয়ে বের করছিস। ওকে পছন্দ না হলে আগে দিয়েই বলতি। আমরা কী জবরদস্তি করেছিলাম তোর সাথে?”
কথাটা শুনে চকিতে সুরভী তাকায় তার মা’য়ের দিকে, “করোনি? আমি তার সাথে প্রথম দেখার পর থেকে কতবার মানা করেছিলাম বিয়ে করব না। বলেছিলাম উনার মনে এখনো এক্স-গার্লফ্রেন্ডকে পছন্দ করে। এই বলে যে সবার অতীত থাকে। তুমি আর ভাইয়া আমাকে জোর করে উনার সাথে কথা বলতে বললে। আমি বললামও। এই দুইবছর ধরে তাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনলাম। তাকে আমার জীবনের দুইটা বছর দিলাম। আমার খাঁচায় বন্দী থাকে অনুভূতি তার জন্য উজার করে দিলাম। আর আজ সে…” গলায় শব্দরা আটক হলো। নিশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছিল তার। গলা কাঁপছিল। তবুও সে বলল, “আজ আমি তাকে তার অতীতের প্রেমিকার সাথে আপত্তিজনক অবস্থায় দেখেছি।”
“কী!” মা আঁ*তকে উঠলেন।
সাইদ খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ক্রোধিত সুরে বলে, “ওর এত বড় স্পর্ধা? আমি এখনই ওদের বাসায় যাব। আর ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করব যে তার ছেলের এত প্রশংসা করেছে, এই তার প্রশংসার ফল।”
সুরভি থামায় তাকে, “ভাইয়া দাঁড়াও… আংকেল এমনিতেই অসুস্থ থাকে। তাকে কিছু বলার দরকার নেই। আর এখানে তার কোন ফল্টও নেই। দোষ হলো আহনাফের। আর আমার আজ এত কষ্টের কারণ হলো মা এবং তুমি। আমি তখন বারবার মানা করছিলাম। তোমরা কেউ আমার কথা শুনো নি। আজ এর পরিণাম আমি ভোগ করছি। তখন একবার আমার কথা শুনলে আজ আমার এত কষ্ট পেতে হতো না।”
সে উঠে দাঁড়ায়। রুমে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেল তার রুমে। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো।

রাত তখন এগারোটা বাজে। সুরভি বসে আছে বারান্দার এক কোণায়। চুপচাপ। পা গুঁজে বুকের কাছে এনে হাত আবদ্ধ করে রেখেছে। তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পায় সে। পাশে থাকে দেখে তার ভাই সাইদকে। সাইদ প্রশ্ন করে তাকে, “বসতে পারি?”
সুরভী উত্তর দেয় না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। অনুমতি ছাড়াই সাঈদ এসে বসে তার পাশে। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “জানি আমি তোর অপরাধী। তখন তোর সাথে জোর করাটা আমার একদম অনুচিত হয়েছে। কিন্তু কি করতাম বল? তখন আমার চাকরির সমস্যা ছিলো। তুই চাকরি করতি না। বাবার সামান্য আয় দিয়ে ঘর চলছিল। আমি ভয়ে ছিলাম যদি এত ভালো সম্বন্ধ হারিয়ে ফেলি এবং পরে আমি ভালো চাকরি না পাই তখন কি করে তোর বিয়ে দিব? আমি তোর বড় ভাই, নিশ্চয়ই তোর জন্য খারাপ চাইবো না। মধ্যবিত্তদের অনেক মাপঝোঁক করে চলতে হয়। অর্থের ও সম্মানের হিসাব করে। খেয়াল করেছিস কি-না জানি না কিন্তু যখন তুই চাকরি পেলি আর বাবাও চাকরি ছেড়ে একটি হোটেল নিয়ে বসল, আর সে হোটেলে ভালো অর্জন হচ্ছিল এরপর আমি আর তোকে বিয়ের কথা বলিনি। মা তোর চাকরি নিয়ে হাজারো বিরোধ করলেও আমি সব সময় খুশি ছিলাম যে আমার বোন নিজের স্বপ্ন পূরণ করছে এবং নিজের চাহিদা পূরণের ক্ষমতা ও রাখছে। সাথে কখনো মনেই হয়নি যা আহনাফ এবং তোর সম্পর্কে কোনো সমস্যা আছে। তোদের সম্পর্ক একবারে পার্ফেক্ট মনে হতো। ভেবেছিলাম আহনাফ সত্যিই তার অতীত ভুলে গিয়ে তোর সাথে জীবন আগানোর পরিকল্পনা করছে।”

“করেছে, নিশ্চয়ই করেছে। কিন্তু বিফল হয়েছে। তার কথায় আমারও এই ভুল ধারণা হয়েছিল। এটা ঠিক আমার যেমন তার অভ্যাস হয়ে গেছে, তেমন তারও হয়েছিল। কিন্তু অন্তরের মাঝে, কোথাও না কোথাও আমি জানতাম সে এখনো তার অতীত ভুলে নি। আমি কেবল নিজেকে বুঝিয়ে গেছি। এখন যখন ভাবছি, তখন মনে হচ্ছে আমার আগেই বিয়েটার জন্য মানা করা উচিত ছিল। এমন কিছু হওয়ার অপেক্ষা করাটা ঠিক হয় নি। যখন ও মাঝেমধ্যে কথায় কথায় তার অতীতের প্রেমিকার কথা তুলতো, আমার সাথে বিধির তুলনা করতো, আমাকে মিথ্যা বলে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল, তারপর মিথ্যার জন্য আমাকেই গিলটি ফিল করিয়েছিল। অন্তত তখন যখন ওর নিজের কষ্টের কাছে আমার কষ্ট তুচ্ছ ছিল। হ্যাঁ মা বাবা হারানোর থেকে বেশি কষ্টকর আর কিছু হয় না। কিন্তু ওর কাছে যখনই নিজের কষ্ট শেয়ার করতাম, বলতাম কতবছর ডিপ্রেশনের ছিলাম আমি, নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুগুলোকে হারিয়েছি, একটি বন্ধুর লাশকে নিজের চোখের সামনে…” বলেই গভীর নিশ্বাস ফেলে সুরভি। আবার বলে, “ও কখনো আমাকে সান্ত্বনা দেয় নি। সবসময় বলেছে, তুমি এত ছোট বিষয় নিয়ে বলছ অথচ আমি আমার মা’কে হারিয়েছি। ও কষ্টে আছে আমি মানছি কিন্তু আমার কষ্ট তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার অধিকার ওর ছিলো না। আজ ইনারা ও প্রিয়কে খুব মিস করছি ভাইয়া। আজ আমাদের জীবনটা আগের মতো হলে এই কষ্টটা আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করতে পারতো না। আগে কতভালো ছিলো পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব আর পরিবার। কোনো দায়িত্ব না, জীবন এত জটিল না, সম্পর্কগুলো এত কঠিন ছিলো না। আমি আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাই ভাইয়া, এই জীবন আমার ভালো লাগে না। আহনাফ আমার সাথে এত খারাপ কীভাবে করতে পারে ভাইয়া? কীভাবে? এমনটা করার পূর্বে কী আমার কথা একটিবারও সে ভাবে নি?”
হঠাৎ করে হাঁটুতে মাথা রেখে শব্দ করে কান্না শুরু করে।

সাঈদ কি বলবো ভেবে পায় না। এই মুহূর্তে তার কি বলা উচিত? না, মাথায় কিছু আসছে না। তাই সে চুপ রইলো। কিছু বলল না। কেবল সুরভির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
.
.
আজ শেয়ারহোল্ডারদের মিটিং আছে। একটি বিদেশি কোম্পানি তাদের কোম্পানির সাথে যুক্ত হবার পরিকল্পনা করছে। এইকারণে আজ সকল শেয়ারহোল্ডার এবং আর্টিস্টদের একজায়গায় একত্রিত হবার কথা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। জোহান রেস্টুরেন্টে যাবার জন্যই তৈরি হচ্ছিল। মায়ার কেবিনের সামনে দিয়ে যাবার সময় তার কন্ঠ শুনে থেমে গেল। সে নক করল দরজায়।
“কাম ইন।”
অনুমতি পেয়ে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে দেখে মায়া ফাইলের সেল্ফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার কানের কাছে ফোন। সে জোহানকে দেখে বলল, “হঠাৎ এখানে?”
“রেস্টুরেন্টে যাচ্ছিলাম। আপনার কন্ঠ শুনে ভাবলাম এসে দেখি। আপনি যাবেন না?”
“আমি না গেলে মিটিং হবে বলে আপনার মনে হয়? বাইক দিয়ে যাব। অর্ধেক সময়ে জায়গায় উপস্থিত থাকব।”
“গ্রেট…” জোহান ভেতরে ঢুকে একটি চেয়ারে তার গিটার রাখল। মায়ার সামনে যে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে আমাকেও লিফট দিয়ে দিবেন।”
“আমি কখন বললাম আপনাকে লিফট দিব?”
“বলেন নি। কিন্তু পথ তো একই, সাথে নিয়ে এগোতেও পারেন।”
“তাহলে চুপ থাকুন। আমি সেখানে প্রেজেন্ট করার জন্য ফাইল খুঁজছি। পেলে যাব। এক কাজ করুন, এগুলো ধরুন তো।” মায়া তার হাতে কিছু ফাইল ধরিয়ে দিয়ে সেল্ফ থেকে আরও ফাইল বের করে খুঁজতে শুরু করে। তার চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি।
জোহান বলে, “আপনি দেখি আমায় হোল্ডার বানিয়ে দিলেন। এত টেবিল, সেল্ফ আছে। আমাকেই ধরাতে হলো?”
“বেশি কথা বলছেন আপনি। এত ফাইলের মাঝে মিক্স হয়ে গেলেও সমস্যা তাই আপনাকে দিলাম আপনি ধরলে কী সব এনার্জি ক্ষয় হয়ে যাবে?”
“হতেও পারে।”
মায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে। তার চোখে বিরক্তির শেষ নেই। আবার সে কাজে জুটে পড়ে। জোহান একহাতে সব ফাইল রেখে, অন্যহাত তার পকেটে হাত রেখে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। একদৃষ্টিতে। হঠাৎ বলে, “ইন্টারেস্টিং।”
মায়া আবারও তাকায় তার দিকে, “কী ইন্টারেস্টিং?”
“আপনার চোখগুলো। বাংলা উপন্যাসে নারী চরিত্রের যেমন হরিণীর মতো টানা টান দুটো চোখ থাকে, তেমন আপনার চোখ। টানা টানা, সুন্দর। কিন্তু আপনার মুখটায় হয়তো এমন তীক্ষ্ণ ভাব নেই। আপনি মেকাপ দিয়ে এমনভাবে সাজগোজ করেন যেন সবাই আপনাকে খুব রুষ্ট মনে করে এবং ভয় পায়।”
“সাট আপ। আমি কাজ করছি।” কিন্তু সে-ই আবার জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু আপনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কোন দুঃখে?”
“নতুন গান ভাবছি। অনুপ্রেরণা লাগবে, তাই সব জায়গায় খুঁজছি।”
তীক্ষ্ণ হাসে মায়া, “আপনারও অনুপ্রেরণা লাগবে? দেশে বোধহয় আপনার মতো সম্পর্কের খবরে আর কেউ আসে নি।”
“সব খবর সত্যি হয় না। আর সব সম্পর্কে ভালোবাসা হয় না। আর ভালোবাসা পাওয়া হয় না। আমি জীবনে কেবল দুটো মেয়েকে ভালোবেসেছি। বাকিসব পাবলিসিটি ছিলো।”
“ভালোবাসা নামক কিছু নেই… কিছু না…” কথাটি বলে তার দৃষ্টি নরম হতেই সে হাতে থাকা ফাইলটি বন্ধ করে নেয়। বলে, “পেয়ে গেছি। আসুন।”
সে হাঁটতে শুরু করে। তার পিছনে আসে জোহানও।

বাহিরে এসে মায়া জানতে পারে যে ওয়াচম্যানের কাছে মায়ার হেলমেট সে কিছুক্ষণ পূর্বে বাহিরে গেছে। হেলমেট কোথায় রাখা তা কেউ জানে না। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। মায়া রেগেমেগে সবাইকে বকে নিচে আসে। বাইকে উঠে বলে, “আজ প্রেজেন্টেশন, আর আজই এই ঘটনা ঘটার ছিলো। আমার হেয়ারস্টাইলের বারোটা বেজে কাকের বাসা হয়ে যাবে।” তার মুখে বিরক্তির ছায়া বাড়ে। সে জোহানের দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি তাকিয়ে কি দেখছেন? জলদি উঠে বসুন।”
জোহান তার দিকে এগিয়ে আসে। নিজের পকেটে থেকে রুমাল বের করে তার চুলে রুমাল বাঁধতে বাঁধতে বলে, “এত ছোট ছোট বিষয়ে বিরুক্ত হতে নেই। সব সমস্যার সমাধান থাকে।”
জোহানের আচকামকায় এতটা কাছে আসায় বিব্রত হয়ে যায় মায়া। সে জোহানের দিকে তাকায়। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয়।

জোহান রুমাল বেঁধে তার বাইকের পিছনে এসে বসে। বলে, “আপনার চেহেরার সাথে হয়তো লম্বা চুল বেশি মানাবে। লম্বা চুলে সুন্দর লাগবে আপনাকে।”
কথাটা শুনতেই তার বুকের ভেতর কামড়ে উঠে।
সে বলে, “হুম, জানি। আমি যাকে ঘৃণা করি তার আমার চুলগুলো সবচেয়ে বেশি পছন্দের ছিলো। তাই কেটে ফেলেছি।”
জোহানকে কিছু ভাবতে দেওয়ার পূর্বেই মায়া হাওয়ার বেগেতে বাইক চালু করে। আর জোহান সামলানোর জন্য তার কাঁধে হাত রেখে দেয়।

গন্তব্য ছিলো ওয়াহেদদের রেস্টুরেন্টই। সেখানেই যেতেই প্রবেশদ্বারে এসে থামলো মায়ার বাইক এবং তার পাশেই একটি কার। একইসাথে দুটো বাহন ভেতরে ঢুকবে না। মায়ার পাশের গাড়ি থেকে বের হয় ওয়াহেদ। সে মায়ার সাথে জোহানকে দেখে অবাক হয়। ভ্রু কুঁচকে নেয়। তার চোখেমুখে না ভালো লাগাটা স্পষ্ট ফুটে উঠে। একসময় মায়ার স্কুটির পিছনে সে ছাড়া কারও বসার অনুমতিও ছিলো না। আর আজ মায়া যে কাওকে তার বাইকের পিছনে কীভাবে বসাতে পারে? অধিকার কী এত তাড়াতাড়ি ছুটে যায়?
সে নিজের অসন্তুষ্টি গোপনও করে না। তবুও মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাপি বার্থডে মিষ্টি।”
জোহান অবাক হয়, সে জানতোও না আজ মায়ার জন্মদিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে গেল কেউ অফিসে তাকে বার্থডে উইশ করে নি। কেউ আসেও নি তাকে উইশ করার জন্য।

ওয়াহেদের গাড়ি থেকে একটি শাড়ি পরা মেয়েও বেরিয়ে আসে। জোহান চিনেছে মেয়েটাকে। ওয়াহেদের ফিয়োন্সে। সে এসেই ওয়াহেদের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। সেও উইশ করে মায়াকে, “হ্যাপি বার্থডে। কেমন আছিস তুই?”
সে উওর দেয় না। তার দৃষ্টি ছিলো তার ধরা হাতের দিকে। সে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়। গাড়ি পিছাতেই মায়া দ্রুত বাইক ভেতরে ঢুকায়। ওয়াহেদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে মায়ার কাঁধে জোহানের রাখা হাতের দিকে। হঠাৎ তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, “মায়া খুব বদলে গেছে তাই না?”
“হুঁ। সাথে জেদিও হয়ে গেছে। এত করে বলছি জোহান থেকে দূরে থাকতে একটা কথা শুনছে না। জোহানের হিস্ট্রি কী ও জানে না? আমারই কিছু করতে হবে। যত কিছুই হোক না কেন, মিষ্টি আজও আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মধ্যে একজন।”

চলবে….

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-১০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্টই মিটিং এর জন্য বুক করা হয়েছিলো। মানুষ বেশি না হলেও যারা ছিলো সকলে গুরুত্বপূর্ণ। তাই কারও বিরক্তি না হয় এ কারণে রেস্টুরেন্ট খালি রাখা হয়েছে। মায়া রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই দেখে সকলে সময়ের পূর্বেই এসে পড়েছে। এমন কি বিদেশ থেকে আসা ক্লায়েন্টগুলোও। সে কোম্পানি থেকে অবশ্য এসেছে তিনজনই। এরমধ্যে একজন আছে বাংলাদেশী। জনাব খালেকুজ্জামান। মধ্যবয়সী লোক। সে কোম্পানির ডাইরেক্টর হয়। তিনিই এই দুই কোম্পানির মাঝে সংযোগ করেছেন। বাকি দুইজন হলো কোম্পানির মালিক এবং তার এসিস্ট্যান্ট। অবশ্য সাথে কিছু বডিগার্ডও রয়েছে।

মায়াকে দেখতেই তার বাবা এগিয়ে এলেন, “এত দেরি হলো কেন তোর? তারা দশমিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।”
মায়া তার হাতের ঘড়িটা একবার দেখে নিলো, “একদম সময়ে এসেছি আমি। এক সেকেন্ডের দেরিও হয় নি। তারা দ্রুত এসেছে এখানে আমার দোষ নেই।”
“তোর সাথে কথা বলাটাই সময় নষ্ট। সব কথার উওর আছে তোর কাছে।”
“একারণেই তো তোমার কোম্পানি আজ আমি সামলাচ্ছি। তিন তিনটা যোগ্য ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও আমাকে সামলাতে হচ্ছে।”
“ঠেসমারা কথা বন্ধ হবে না তোর?”
মায়া পাশ কাটিয়ে গেল ক্লায়েন্টদের কাছে। তাদের এখানে প্রধান অতিথি লুসি। তিনিই বিদেশি কোম্পানির মালকিন। মায়া তার কাছে যেয়ে নিজের পরিচয় দেয়। তখন লুসি আন্তরিকভাবে তার সাথে হাত মিলিয়ে ইংরেজিতে বলল, “ওহ মায়া চৌধুরী… আপনার নাম শুনেছি। দেখা করেও ভালো লাগলো। আজকাল নারীরা এত বড় বড় পজিশন সামলাচ্ছে দেখে খুব ভালো লাগে। আপনি এই কোম্পানিকে এত কম সময়ে এত সাফল্যে নিয়ে গেছেন তাই কেবল আপনাকে বিশ্বাস করে আপনাদের কোম্পানির সাথে যুক্ত হচ্ছি।”
“ধন্যবাদ। আপনাকে নিরাশ করব না।”
এমন সময় খালেকুজ্জামান এলেন। মায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আরে মিস মায়া কেমন আছেন?”
মায়া হাত মেলায় তার সাথে, “জ্বি ভালো। আপনাদের এখানে কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো?”
“যা কষ্ট ছিলো আপনাকে দেখেই ভুলে গেছি। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে। ম্যাডামকে আপনার খুব প্রশংসা করেছি। ম্যাডাম আবার আমাকে খুব মানে। আমার কথাতেই আপনাদের কোম্পানির সাথে কাজ করার চিন্তা করছে। আমার বিশেষ খেয়াল রাখলে আমি সে চিন্তাকে সত্যিও করতে পারি।” সে মায়ার সাথে হ্যান্ডশেক করার সময় আঙ্গুল তার হাতে বোলাচ্ছিল। মায়ার অস্বস্তি লাগে। তার ভ্রু ভাঁজ হয়। সে নিজের হাত সরিয়ে বলল, “আপনার তো বিশেষ খেয়াল রাখতেই হবে। তাই উপদেশ দিচ্ছি। নিজের হাতটা সামলে রাখুন, নাহয় হাত না থাকলে এখানের আমাদের দেশের মজাদার খাবার খেতে পাড়বেন না। যদি আপনার কাছে খাবার খাওয়ানোর মতো কেউ না থাকে।”
“আমি তো আপনার অতিথি। আপনিই খাওয়াতে পারেন। আপনার হাতগুলোও খুব নরম ও সুন্দর।”
মায়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “কিন্তু এই হাতে কেউ আঘাত পেলে দুইদিন বিছানা থেকে উঠতে পারে না।”
কথাটা হাসিতে উড়িয়ে দেয় খালেকুজ্জামান, “আপনি তো বেশ রসিক মানুষ। ভালো মজা করতে পারেন।”
“সবার তাই মনে হয়। আপনি বসুন আমি প্রেজেন্টেশন দেবার জন্য ফাইল রিচেক করে আসছি।”
“আরে আপনি এত চিন্তা করছেন কেন? বললাম তো আমাকে খুশি রাখলে আপনারা এই ডিল অবশ্যই করতে পারবন।”

মায়া তার কথায় ধ্যান না দিয়ে সেখান থেকে যেয়ে বসল একটি চেয়ারে। তার ফাইল রিচেক করছিলে এমন সময় জোহান তার সামনের চেয়ার টেনে বসে। মায়া জিজ্ঞেস করে, “আবার বিরক্ত করতে কেন এলেন?”
“এখানে আপনাকে ছাড়া কাউকে চিনি না। তাই ভাবলাম নাই মামা থেকে কানা মামা ভালো। কারও সাথে কথা না বলা থেকে আপনার বিরক্তির সুরে বলা কথাও শোনা ভালো।”
মায়া চোখ ঘুরিয়ে নিজের ফাইলের দিকে আটকায়। জোহান বলে, “আচ্ছা একটা কথা বলুন, মিস্টার ওয়াহেদ আপনাকে লাইক করতো না তাই না?”
মায়া বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
“আই মিন লাইক করতো না বলেই তো অন্যকারো সাথে এনগেজমেন্ট করেছে। তাহলে আপনার সাথে তখন বাইকে দেখে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলো কেন?”
“কেমনভাবে?”
“যেন হাতের কাছে পেলে জোয়ালামুখিতে চুবিয়ে মারবে। যেমনটা এখন তাকিয়ে আছে।”
জোহান তাকাল তার ডান পাশে। মায়াও তার দৃষ্টি অনুযায়ী সেদিকে তাকায়। ওয়াহেদই তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকে দেখতেই রাগের মুখটা হাসিমাখা করে নিলো। সে এড়িয়ে যায়। এমন সময় একটা ওয়েট্রেস এলো তাদের টেবিলে কোল্ডড্রিংক নিয়ে। ট্রে রেখে দাঁড়িয়েই রইলো। মায়া বলল, “থ্যাঙ্কিউ, এবার আপনি যেতে পারেন।”
মেয়েটি তবুও দাঁড়িয়ে রইলো।
মায়া জিজ্ঞেস করল, “আপনার কিছু প্রয়োজন।”
“একটা ছবি। জোহান স্যার প্লিজ। আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান। কিশোর বয়স থেকে আপনাকে দেখছি। আপনার গান, আপনার এক্টিং, আপনার সবকিছু আউট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড। প্লিজ স্যার একটি ছবি তুলি।”
“অফকোর্স।” জোহান হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায়। তারা কিছু সেলফি তোলার পর মেয়েটি মায়াকে অনুরোধ করে, “ম্যাম প্লিজ আমাদের একটি ছবি তুলে দিন।”
মায়া কাজ করছিলো। কিন্তু মেয়েটার এভাবে বলা দেখে সে মানা করতে পারে না। উঠে দাঁড়ায় ছবি তুলতে। মায়া বলে, “একটু কাছাকাছি আসেন, যেন ফ্রেমে ভালোভাবে ফিট হয়।”
জোহান মেয়েটার কাছে যেতেই তার যেন দম আটকে আসে। সে বুকের বা পাশে হাত রেখে টলে পড়ে জোহানের উপর। জোহান ভয় পেয়ে তাকে ধরে নেয়, “আপনি ঠিক আছেন?”
এমন সময় আরেকটা ওয়েটার এসে ধরে তাকে, “তুমি ঠিক আছো তো?”
মেয়েটা চোখ বন্ধ রেখেই বলে, “জোহান আমাকে ধরে… আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি স্বপ্ন দেখছি। দেখো তো আমি কী বেঁচে আছি না’কি? না’কি মরার পর স্বর্গে এসেছি।”
মায়া বলে, “ডোন্ট ওয়ারি মরো নি তাতো কনফার্ম। স্বর্গে উনাকে পাবে বলে সন্দেহ।”
জোহান তার দিকে ছোট দৃষ্টি করে তাকায়। যেন কথাটা তার ভীষণ বিরক্তিকর লেগেছে। মায়া ফোনটা টেবিলের উপর রেখে বলে, “এত ড্রামা সহ্য করার মতো বেতনও আমাকে দেওয়া হয় না।” আর সে উঠে চলে যায়।

প্রেজেন্টেশন শেষ হয়। মায়ার প্রেজেন্টেশন শুনে সকলে হাততালি দেয়। সকলেরই পছন্দ হয়। সামনের কোম্পানি একসাথে কাজ করতেও রাজি হয়ে যায়। খাবার খাওয়া শেষে আকস্মিকভাবে ওয়েটার একটি কেক নিয়ে আসে। রেড ভেলভেট কেক। উপরে লেখা, “Happy birthday misty”। সে রাগের সাথে দেখল ওয়াহেদকে। এটা তারই কাজ। কিন্তু ব্যাপারটা তার মোটেও পছন্দ হয় না। এখন আর তার জন্মদিন করা পছন্দ নয়। যে কোন উৎসবই তার কাছে বিরক্তিকর।
কেক এ নাম দেখে খালেকুজ্জামান জিজ্ঞেস করলেন, ” এই মিষ্টি কে?”
“মায়া…” ওয়াহেদ উওর দেয়, “ওর ডাক নাম মিষ্টি।”
“দেখতেও একদম মিষ্টির মতো তো। হ্যাপি বার্থডে মিস মায়া।”

তার বাবার কেক দেখে মনে পড়ে আজ মায়ার জন্মদিন সে ভুলেই গিয়েছিল। সে মায়াকে বলে, “আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আজকের দিনটা। কিন্তু চিন্তা করো না আগামীকাল তোমার জন্য দামী কোনো গহনা নিয়ে আসব। এক মিনিট ওমরের বাবা কল দিচ্ছে তাকে সুখবরটা দিয়ে আসি।” বলেই সে চলে যায়। তার যাওয়া দেখে মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, “আমার কোনো গহনা লাগতো না, কেবল তুমি আমার মাথায় হাত রেখে একটু দোয়া করে দিলেও হতো। কিন্তু তোমার কাছে আমার থেকে অন্য মানুষরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
সে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় এই রেস্টুরেন্টের দিকে। আর তার কানে ভাসে কিছু বাক্য….
‘সরি মিষ্টি আমি এই বিয়ে করতে পারব না। আমি অন্যকাওকে ভালোবাসি।’
‘তোর মতো মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা ঢের ভালো।’
‘তুমি ওয়াহেদকে দোষারোপ করতে পারো? তোমার মতো মেয়েকে কোন ছেলে ভালোবাসবে?’
কথাগুলো মনে করতেই তার বুকে চিনচিন ব্যাথা হলো। দুঃখভরা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে।

মায়া কেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সকলে এই টেবিলের আশেপাশে ঘেরা করে দাঁড়িয়ে আছে। মামার বাবার আসার অপেক্ষা। সে আসলে কেক কাটা হবে। তারপর সবাই চলে যাবে নিজ নিজ বাড়িতে। জোহান তার কাছে এসে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার কাছে যেতেই ওয়াহেদ তার কাঁধে হাত রাখে। জোহান পিছনে তাকানো তাকে বলে, “হ্যালো মিস্টার জোহান, আমরা কি দুই মিনিট কথা বলতে পারি?”
জোহান সম্মতি দেয়। তার সাথে যায় এক কোণায়।
“বলুন, কী বলবেন?” জোহান জিজ্ঞেস করে।
“দেখুন আমি আপনার এবং আমার কারো সময় নষ্ট করব না। মিষ্টির বাবা অথবা আমার পছন্দ না যে আপনি আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করেছেন। এটা মিষ্টির জেদ ছিলো। আংকেলের কারণটা আমি জানিনা কিন্তু আপনার হিস্ট্রি দেখে আমি চাই না আপনি ওর আশেপাশে থাকুন। এখন এই কোম্পানিতে কাজ করছেন, করুন। ওর আশেপাশে বেশি দেখা গেলে আমার আপনাকে এখান থেকে বের করতে বেশি সময় লাগবে না।”
জোহান হেসে তার পকেটে হাত ঢুকায়, “স্ট্রেঞ্জ… আপনি উনার সাথে বিয়ে ভেঙে নিজের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওর সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর আমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছেন? আসলে ব্যাপারটা ঠিক আমার মাথায় ঢুকছে না।”
“এতকিছু আপনার মাথা ঢুকানোও লাগবে না। যাস্ট এতটুকু বুঝে নিন যে ওর থেকে আপনাকে দূরে থাকতে হবে।”
জোহান হেসে তার দিকে এক পা এগোয়। এরপর মুখটা গম্ভীর করে বলে, “উনার আশে পাশে থাকারও কোনো ইনটেনশন ছিল না আমার। কিন্তু এই ধমকের পর জানতে ইচ্ছা করছে উনার আশেপাশে ঘুরঘুর করলে আপনি কী করতে পারবেন?” বলে মায়ার দিকে তাকায় সে।
ওয়াহেদ রেগে যায়। সে জোহানের মুখের সামনে আঙুল তুলে বলে, “আপনাকে আমি…” থেমে যায় সেখানেই। জোহানের কথাটা শুনে, “হোয়াট দ্যা হেল।” সে মায়ার দিকে ছুটে যায়।
তাকে দেখে সে-ও তাকায় মায়ার দিকে। চমকে উঠে। সেও এগোয় মায়ার প্রান্তে।

মায়া কেকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় তার পাশে এসে দাঁড়ায় খালেকুজ্জামান। সবাই তখন কথা বলতে ব্যস্ত। খালেক সাহেব তখন মায়ার পাশে দাঁড়িয়ে তার কানের কাছে এসে বলে, “দেখলেন মিস মায়া আপনাকে কত বড় মুনাফা করিয়ে দিলাম। যদি চান এমন অনেক মুনাফা করাতে পারি। পরিবর্তে কেবল আমাকে খুশি করাতে হবে। আপনি রাজি হলে আমি অন্য হোটেলে আপনার এবং আমার জন্য একটা রুম বুক করতে পারি। এখন এত সাফল্য আপনি কীভাবে পেয়েছেন তাতো সবাই বুঝে। আপনার তো জানা উচিত নিজের ক্লায়েন্টদের কীভাবে খুশি রাখতে হয়। আমাকেও একটু খুশি করে দিন।”
আচমকায় মায়া অনুভব করে তার দেহে কারও হাত লেগেছে। পুরুষের অনিচ্ছুক ছোঁয়া। তার চোখ বড়বড় হয়ে যায় শিউরে উঠে সে। বরফের মতো জমে যায়। তার দেহের শিরায় শিরায় ঘিনঘিন করতে শুরু করে। তার হাত টেবিলে ছিলো। হাতটা একটু এগিয়ে কেকের পাশে রাখা ছুড়িটা মুঠোবন্দী করে মুহূর্তে জনাব খালেকের দিকে আঘাত করে। ছুড়ির কোণাটা যেয়ে থামে একদম তার চোখের মণির সামনে।
জোহান এবং ওয়াহেদ তার দিকে এগিয়ে আসছিল। তারা নিজের জায়গাতে থেমে যায়।

গলা ফাঁটা চিৎকার করে জনাব খালেব। ভয়ে তার বুকের ভেতর কাঁপছে। সে থরথরে কাঁপছে। জান যেন গলায় আটকে এসেছে তার। সে ঢোক গিলছে। তার চিৎকার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তাদের উপর। লুসির এসিস্ট্যান্ট বিস্মিত গলায় বলল, “হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুয়িং!”
“বিশেষ কিছু না। কিছুক্ষণ পূর্বে উনি আমাকে যখন ছুঁয়েছিল তখন আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল তা বুঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু ব্যর্থ আমি। কারণ উনার ভয় লাগছে, নিজের দেহর প্রতি ঘৃণা লাগছে না। উনার মতে আমি মেয়ে বলে এই সাফল্যের পর্যায়ে নিজেকে বিলিয়ে এসেছি। তাই উনাকেও খুশি করতে বলেছিল। নিজেরা সাফল্য পেলে তা পরিশ্রমের পরিণাম আর নারীরা একটু সাফল্য অর্জন করলে মনে হয় পুরুষের সাথে শুয়ে বেরিয়েছে। আপনার বসও তো নারী উনাকে এই অফার করেন নি কেন?”
সে ছুড়িটা ফেলে সেখান থেকে হাঁটতে শুরু করে। তার যাওয়া দেখেই খালেক দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করে। সকলের এভাবে তাকানো দেখে আবার লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।

মায়া কিছু একটা ভেবে থেমে যায়। ব্লেজার খুলে নেয়। তা মেঝেতে ফেলে শার্টের হাতা কণুই পর্যন্ত ফোল্ড করতে করতে এগোয় আবার খালেকের দিকে। বলে, “খুব হোটেলে রুম নেবার ইচ্ছা ছিলো আপনার তাই না? হোটেল না কিন্তু হাস্পাতালে রুম ঠিকই বুক করতে পারেন।” বলতে না বলতেই সে খপ করে খালেকের হাত ধরে ঘুরে এসে তার কণুই দিয়ে তার পেটে আঘাত করে। এক আঘাতেই যেন জান বের হয়ে যায় তার। কিন্তু সে এখানেই থামে না। তার মাথা ধরে একের পর এক টেবিলে মারতে থাকে। কেক এও মারে। অবশেষে একবারে হাওয়াতে উঠিয়ে ছুঁড়ে মারে মেঝেতে। তারপর একটি টিস্যু নিয়ে হাত পরিষ্কার করতে করতে বলে, “আমার চাচার বয়সের আপনি। তাই কমে ছেড়ে দিলাম। ক্যারাটেতে রেড বেল্ট আমি। আমার বয়সী থাকলে আপনার কি অবস্থা করতাম ভাবতেও পারতেন না।”
সে হাতে তার জ্যাকেট নিয়ে বাহিরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। এতক্ষণ সম্পূর্ণ রুম নিঃস্ব ছিলো, একদম চুপচাপ। হঠাৎ তালির গর্জন শুরু হলো। কিন্তু মায়া সেদিকে তোয়াক্কা না করে হাঁটতে থাকে।

জোহান তার এই রূপ দেখে হা করে তাকিয়ে ছিল। তালির গর্জনে তার ধ্যান ভাঙে। জোহান দৌড়ে যায় তার পিছনে। তার পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলে, “ইম্প্রেশিভ, আপনি তো দেখছিল ফুল লেডি দাবাং। আমি দূর থেকে আপনাকে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে দেখে দ্রুত গেলাম সাহায্যের জন্য। এখন দেখি আপনার সাথে পাঙ্গা নিলে তাদের সাহায্যের দরকার।”
আড়চোখে মায়া দেখে আবার তার দিকে, “আবার আমাকে বিরক্তি করতে সাথে যাবেন?”
“এখন আমি তো গাড়ি আনি নি। আর সেলিব্রিটি মানুষ সিকিউরিটি তো লাগবে। আপনার একটু আগের রূপ দেখে আমি আপনার সাথে নিশ্চিন্তে ঘুরতে পাড়ব।”
মায়া বিরক্তি বোধ করে। কিন্তু কিছু বলে যায়। তার বাইক বের করে বের হয়ে যায়।

মায়ার বাবা ফোনে কথা শেষে ভেতরে এসে সম্পূর্ণ মহলের পরিবর্তন দেখে অবাকই হয়। ভরা মহলটা কিছু মুহূর্তে খালি হলো কী করে? সাথে সব এদিক-ওদিক পরে আছে কেন? সে খালেকুজ্জামানকে নিচে এমন করুণ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে। তাকে টেনে উঠায়, “আরে খালেক সাহেব আপনার কি হয়েছে? ঠিক আছেন তো?”
“কী হয়েছে? আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন কি হয়েছে? হায় আমার কোমর, আমার হাত, আমার পুরা শরীর। আমাকে আলু ভেবে ভর্তা করে দিলো আপনার মেয়ে।”
“বলেন কি মায়া এমন করেছে? আপনি চিন্তা করবেন না। ও আপনার থেকে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু আপনি দয়া করে আমাদের কাজটা ক্যান্সেল করেন না।”
“কাজ? ভুলে যান। এই জীবনে আর আমাদের একসাথে কোনো কাজ হবে না। অন্য কোনো কোম্পানির সাথেও কাজ হতে দিব না। চেয়ার দেন, চেয়ার দেন আমি বসবো।”
মায়ার বাবা একটি চেয়ার টেনে দিলো। এমন সময় ওয়াহেদকে দেখে মায়ার বাবা ডাক দিলেন। আসার পর বললেন, “ওয়াহেদ বাবা দেখো না মায়া আবার এক কান্ড ঘটিয়েছে। এখন খালেক সাহেব বলছে আমাদের সাথে কাজ করবেন না।”
“তিনি কাজ করবেন না? আমি নিজেই কাজ হতে দিব না।”
“এ’কি বলছ? তোমার বাবা জানলে ভীষণ রাগ করবেন। আর উনি এমন কী করেছে যে মায়া এমন করুণভাবে মেরেছে তাকে?”
মুখ দিয়েই কথাটা বের হচ্ছিল না ওয়াহেদের। সে মাথা নিচু করে নিলো। কিন্তু যখন খালেদের করণীয়র দৃশ্য তার চোখে ভাসলো তখন তার হাত মুঠোবন্দী হয়ে যায়। চোয়াল হয়ে যায় শক্ত। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” আপনার সামনে বলতেও লজ্জা করছে এমন কাজ করেছে উনি আপনার মেয়ের সাথে। আর এই লোক মিষ্টির সাথে যা করেছে তার বিনিময়ে পাওয়াটা কমই হয়ে গেছে।” বলে একটা জোরে ঘুষি দিলো সে খালেদের মুখে। সাথে সাথে সে চেয়ার থেকে নিচে পড়ে গেল।
.
.
হাওয়ার বেগে ছুটে যাচ্ছে মায়ার বাইক। বাতাসে উড়ছে তার ছোট ছোট চুল যা জোহানকে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। জোহান বলল, “আপনার চুলগুলো হয়তো একেবারে ছেটে ফেলুন, নাহয় লম্বা করে বেঁধে রাখুন। খুব যন্ত্রণা করছে।”
“আপনার কী প্রতিদিন আমার বাইকে উঠার মতলব আছে না’কি?”
“আইডিয়াটা ঠিক মন্দ না। আপনি বাইক খুব ভালো চালাতে জানেন।”
জোহান দেখল মায়া তার এপার্টমেন্টের সামনে এসে থামিয়েছে বাইকটি। ঢোকার সময় এলাকার ওয়াচম্যান তাকে সালামও দিয়েছিল। বাইক থেকে নেমে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি আমার এড্রেস কীভাবে জানলেন? আর ওয়াচম্যান আপনাকে কীভাবে চিনে? ওয়েট আপনি আমাকে ফলো করছেন না তো? ওয়াহেদ যে আমাকে ওয়ার্নিং দিলো তা বোধহয় আপনার না, আমার সেফটির জন্যই দিয়েছে। কারণ আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনার কারও সেফটি প্রয়োজন। আহা আমিই লোকটাকে ভুল বুঝছিলাম।” সে খুব ভাবুক কন্ঠে বলে।
মায়া বিরক্তির সুরে বলে, “আপনার বিল্ডিংয়ের সামনের বিল্ডিংয়েই আমার বাসা। আপনি এসেছেন এখানে দুইমাসও হবে না। আমি এই জায়গায় ছয়মাস ধরে থাকছি। নিজের চেহারা দেখুন আগে। আসছে তাকে ফলো করতে।”
“দেখুন যত যাই বলুন না কেন, চেহেরা নিয়ে কিছু বলবেন না। দেশের অর্ধেক মেয়ে এই চেহেরার উপর মরে। আজ দেখলেন না?”
“সবাই পাগলের দল। পাবনায় সিটের কমতি পড়ছিল বলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
যখন তার কথার উত্তর দিবে এর আগে তার মা’য়ের কল আসে। সে কল ধরে বলে, “মা আমি বাসার সামনে। এক্ষুণি আসছি।”
“তুই তো আসবিই। সাথে মায়াকেও নিয়ে আয়।”
“মায়াকে!” জোহান অবাক হয়ে তাকায় মায়ার দিকে। তারপর নিজের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকায়। তার মা বারান্দায় দাঁড়ানো। হাত নাড়ছে তাদের দেখে। তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না, “মা তুমি মায়াকে কীভাবে চিনো?”
উওর দেয় মায়া, “আপনি তো সকাল সকাল শুয়ে পড়ে ঘুমান তখন আপনার মা হাঁটতে বের হয় আর আমি জগিং এ। সেখানেই দেখা।”
“আপনি আমার মা’কে চিনেন?”
মায়া গভীর নিশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে, “ইডিয়ট এতক্ষণ পড়েও এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। ”
তার মা ফোন থেকে বলে, “ওকে নিয়ে আয় না বাবা। আমি প্রতিদিন বলি। কাজের কথা বলে এড়িয়ে যায়। আজ তোর সাথে আছে নিয়ে আয়। আমি মজার রান্না করে খাওয়াবো। ভারী মিষ্টি মেয়ে।”
“মিষ্টি মেয়ে আর উনি?” জোহানের চোখদুটো বড় হয়ে যায়। সে একটু দূরে সরে ফিসফিস করে বলে, “রাক্ষুসি মা, একদম রাক্ষুসি। একে ঘরে আনা লাগবে না।”
মায়া পিছন থেকে বলে, “আমি সব শুনছি।”
“অন্যের কথা শুনতে হয় না, জানেন না?”
“আর অন্যকে নিয়ে বাজে বকতে হয় না, আপনি জানেন না?”

মা আবদারের সুরে বলে, “বাবা ওকে একবার নিয়ে আয় না। আমার খুব শখ ওকে কিছু রান্না করে খাওয়ানোর।”
জোহান এবার হার মানে। মা’য়ের এমন কন্ঠ শুনে মানা করে কীভাবে? সে বলে, “ঠিকাছে। আনছি।”
‘আনছি’ বলে তো দিলো। কিন্তু মায়াকে মানানোর যুদ্ধে সে জয়ী হবে কী করে?”
.
.
ফোন বাজছে। একের পর এক কল এসেই যাচ্ছে। সুরভি পাশে বসে থাকা সত্ত্বেও কল ধরছে না। আহনাফ তার সাথে কথা বলার জন্য বারবার তাকে কল দেয়। এখনো হয়তো আননোওন নাম্বার থেকে দিচ্ছে। একের পর এক কল বেজেই চলেছে। একসময় সে বিরক্ত হয়ে কলটা ধরে। রাগান্বিত সুরে বলে, “এখন কী দরকার কল দিচ্ছেন কেন?”
ফোনের ওই পাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠটি আহানাফের না। চেনা-অচেনা কন্ঠ, “এত সময় লাগে কল ধরতে? এতবার কল তো আমি বড় কোনো নেতাকেও দেই যা আপনাকে দিতে হয়েছে।”
সে বুঝতে পারে লোকটি আর কেউ না, অভ্র।
বিরক্তির সুরে বলে, “বলুন কী চাই?”
“আপনি আমাকে কী দিতে পারবেন যে আপনার কাছে চাইব?”
“পেঁচানো কথা বলার জন্য কল দিয়েছেন?”
“আপনাকে একটা উপহারের কথা জানানোর জন্য কল দিয়েছি।”
“দেখুন মিস্টার অভদ্র, আমার কাছে আপনার কথা শোনার মতো সময় এবং মেজাজ কোনোটাই নেই। কল রাখছি।”
“আহা মিস সুরভী লক্ষ্মীমেয়ের মতো কথা শুনুন, নাহলে পড়ে প্রায়শ্চিত্ত করেও লাভ হবে না।”
সুরভি ফোন রাখতে যেয়েও এই কথাটা শুনে থেমে যায়। কানের কাছে ফোন এনে শুনে অভ্রর বলা কথা, “আমি আগামীকাল রাত আটটার পর বাসায় থাকব। দশটায় আমার ঘুমানোর সময়। মাঝখানে দুইঘন্টা সময় আপনার ক্ষমা চাওয়ার।”
“ক্ষমা চাইব? আরও আপনার কাছে? দশটায় ঘুমাবেন না? তখন স্বপ্ন দেখেন।”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ পাওয়া যায়, “মিস সুরভি আপনি নিজেকে খুব চালাক ভাবেন বুঝেলেন? অথচ আপনি খুব বোকা একটি মেয়ে। নাহলে মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে আমার মতো নেতাকে ক্ষেপানোর সাহস রাখে? আমি শুনেছি মধ্যবিত্ত পরিবাগুলো তাদের অর্থ এবং সম্মান খুব সামলে রাখে। আপনি একবার ভাবুন যদি হঠাৎ করে আপনার পরিবারের দুইটাই হারাতে হয় তখন কী করবেন?”
কথাটা শুনে চমকে উঠে সুরভি। কিছু মুহূর্তে স্তব্ধ থেকে জিজ্ঞেস করে, “কী…কী বলছেন আপনি? মানেটা কী আপনার কথার?”
“কিছু সময়েই জেনে যাবেন। আগামীকাল রাত আটটা থেকে দশটা মনে রাখবেন।”
“হ্যালো…হ্যালো অভদ্র…হ্যালো…”
কল কেটে গেল। সে আবার কল করলে মোবাইল বন্ধ পায়। এমন সময় বাহিরের রুম থেকে শব্দ শোনা যায়। সুরভির বুকের ভেতর এবার ভয় ভয় করতে শুরু হয়। অভ্র সত্যিই তার কোনো সমস্যা তৈরী করল না তো?

চলবে….

[দয়া করে ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্প নিয়ে মন্তব্য জানাবেন। ভালো অথবা খারাপ।]