অনুরাগে সখি নিভৃতে যতনে পর্ব-০৫

0
2

#অনুরাগে_সখি_নিভৃতে_যতনে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৫
___________________________
আশহির বিছানায় গিয়ে বসলো।তারিনি ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলে আশহির গিয়ে তাকে ধরে ফেলল।আশহির দেখলো তারিনি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।সে তারিনিকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল।তারপরে সে ডাক্তারকে কল করলো।

কিছুক্ষণ পরে,
আশহির আর তারিনির রুমে বাড়ির সবাই উপস্থিত।মৌরিন দরজার কোণে দাঁড়িয়ে আছে।তারিনির জ্ঞান ফিরেছে।ডাক্তার সব চেক-আপ করে মৃদু হেসে বললো,

-“সব চেক-আপ করে তো মনে হচ্ছে উনি মা হতে চলেছেন।আমি একটা টেস্ট দিচ্ছি হাসপাতালে গিয়ে করিয়ে নিলে একেবারে শিওর হয়ে যাবেন।”

বাড়ির সবার মুখে হাসি ফুটলো।আশহির তো খুশিতে আত্মহারা!তারিনির মুখে হাসি ফুটলো কিন্তু সে পরক্ষণেই মুখ মলিন করে ফেলল।তার চোখ গেল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মৌরিনের দিকে।সে মুখে হাসির রেখা টেনে দাঁড়িয়ে আছে।তারিনি মনে মনে বললো,

-“এমন একটা খবরে এই মেয়ে হাসছে?ওর কি খারাপ লাগছে না!”

ডাক্তার চলে যেতে অহিদা বেগম এসে তারিনির পাশে বসে বললেন,

-“দেখ মা এমন একটা খুশির খবর পেলাম আমরা।আজকেই আমি তোকে নিয়ে হাসপাতালে যাবো।চেক-আপও করাবো আর ওই ডাক্তারের সাথে কথাও বললো!”

-“কিন্তু মা আমার কখন কি হয় তারই তো ঠিক নেই।আর এখন যদি এই খবরটা সত্যি হয় তাহলে তো সমস্যা হয়ে যাবে!”

অহিদা বেগম তারিনির মাথায় হাত রেখে বললো,

-“বললাম তো ডাক্তারের কাছে আজকেই যাবো।আর তোমার কিছু হবে না মা।আমার আল্লাহর উপর বিশ্বাস আছে।উনি তোমার মতো এতো ভালো মেয়ের সাথে এতো বড় অন্যায় করবেন না!”

আহমেদ সাহেব এসে তারিনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“দোয়া করি মা সব যেন ভালো হয়।”

কিছুক্ষণ পরে আহমেদ সাহেব এবং অহিদা বেগম রুম থেকে চলে গেলেন।তারিনি আর মৌরিনের চোখাচোখি হতে মৌরিন হাসি দিয়ে চলে গেল।অথৈ এসে তারিনিকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“কংগ্রাচুলেশনস ভাবি!”

তারিনি ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“এখনো কিন্তু শিওর না!”

-“আমার জন্য শিওরই!”

তারিনি অথৈয়ের কথা শুনে হেসে দিল।আশহির এসে অথৈয়ের পাশে দাঁড়াতে অথৈ বললো,

-“ভাইয়া যা অকাজ করার তো করেই ফেলেছিস এখন আর ভাবিকে কোনো কষ্ট দিস না।এটা তোর কাছে আমার রিকুয়েষ্ট!”

কথাগুলো বলে অথৈ রুম থেকে চলে গেল।তারিনি নিশ্বাস ফেলে বললো,

-“সবাই এখনো শিওর না হয়েই এতোটা এক্সাইটেড হয়ে গেল।”

আশহির ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“কেনো তুমি কি এক্সাইটেড না?”

-“এটা সত্যি হলে আমার মতো খুশি কেউ হবে না।তবে দুঃখও হচ্ছে একটা কথা ভেবে বাচ্চাটা বাবা-মা কাউকেই পাবে না।”

-“কি সব বলছো তুমি তারিনি?”

-“আমি কতদিন বাঁচবো তার কোনো ঠিক নেই।আর তুমি এখন অন্যজনের স্বামী।যদি মৌরিন আর তোমার বাচ্চা হয় তাহলে এমনিও আমার বাচ্চাটা অবহেলার পাত্রই হবে।”

-“প্লিজ তারিনি এইসব বলে আমার সব আনন্দ শেষ করে দিও না।”

-“আশহির সত্যিটা মেনে নেও।আমার বাচ্চাটার সাথে এমনটা হবে তা আমি ভালো করেই জানি।তাই তুমি এখন এইসব বুঝিও না আমাকে।”

আশহির আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল।

_______________
-“আপনার স্বামীর প্রথম স্ত্রীর বাচ্চা হবে এই খবর পেয়ে আপনি খুশি হচ্ছেন।এটা তো অবাক হওয়ার বিষয় মিসেস মৌরিন।”

ফরহাদের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে মৌরিন বললো,

-“স্যার এটা তো খুশি হওয়ার মতো খবরই।”

-“সতীনের বাচ্চা হবে শুনে কেউ খুশি হয়?”

-“উনাকে আমি সতীন ভাবি না।আর আমার তো উনার জন্য খারাপই লাগে।আমি এই কয়দিনে উনাকে যতদূর চিনেছি উনি অনেক ভালো একটা মেয়ে।তবে ওমন একটা লোক উনার স্বামী তা ভাবতেই আমি অবাক হই।উনারা নাকি আবার প্রেম করেই বিয়ে করেছেন!এমন একটা লোককে উনি ভালোবাসলেন কি করে কে জানে!”

মৌরিনের কথা শুনে মৃদু হেসে ফরহাদ বললো,

-“ভালোবাসা কখন,কিভাবে হয়ে যায় তা বোঝা সম্ভব না।আর মিস্টার আশহির মির্জা সবার কাছে এক বেশে আর উনার স্ত্রীর কাছে অন্য বেশে থাকেন কিনা কে বলতে পারে!তবে স্ত্রী বলা ভুল হবে কারণ আপনিও তো উনার স্ত্রীই।তাই উনাকে প্রথম স্ত্রী বলাটা ঠিক আই থিংক!”

মৌরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“একজন খু*নির আর কি বেশ হতে পারে!তার একমাত্র পরিচয় সে অপরাধী।আর তাকে তার অপরাধের শাস্তি পেতে হবে।আর স্যার প্লিজ আমাকে বার বার উনার স্ত্রী বলবেন না।নিজের প্রতি ঘৃণা কাজ করে।”

মৌরিন কথাগুলো বলে ফরহাদের কেবিন থেকে বের হয়ে চলে গেল।ফরহাদ হাত জোড়া বগলধাবা করে বললো,

-“মেয়েটা মনে হয় রেগে গেল।তবে রেগে গিয়ে কি হবে যেই সম্পর্ক নিজেই তৈরি করেছে তা না মানা কি এতোটাও সহজ!সারাজীবন তো আর সবটা এমন থাকবে না।কিছু পরিবর্তন তো অবশ্যই আসবে।”

কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফরহাদ।

_______________
ডাক্তারের মুখোমুখি বসে আছে অহিদা বেগম আর তারিনি।কিছুক্ষণ আগে প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্টটা হাতে এসেছে।আর তা পজিটিভ!খুশির খবরটা পেয়েই তারা হাজির হয়েছেন আশহিরের বলা ডাক্তারের কাছে।ডাক্তার সব রিপোর্ট চেক করে বললেন,

-“আমি একটা রিস্ক নিতে চাই।আমার বিশ্বাস মিসেস তারিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।”

ডাক্তারের কথা শুনে অহিদা বেগমের মুখে হাসি ফুটলো।তারিনি কিছুটা অবাক হলো।কারণ এতোদিন সে সব ডাক্তারের কাছে এক কথাই শুনেছে যে কিছু করা সম্ভব না তবে ইনিই একমাত্র ব্যতিক্রম কিছু বললেন।তারিনির চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।অহিদা বেগম তার কাঁধে হাত রাখলেন।তারিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,

কিন্তু ডাক্তার আমি তো প্রেগন্যান্ট!”

ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

-“খবরটা কবে পেয়েছেন?”

-“আজই স্যার!”

ডাক্তার নিশ্বাস ফেলে বললেন,

-“যাক তাহলে সমস্যা নেই।বেশিদিন হয়ে গেলে একটা রিস্ক ছিল।তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই আমি দুই তিন দিনের মধ্যেই অপারেশনটা করবো!আর বেশি চিন্তা করবেন না আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।”

ডাক্তারের কথায় যেন তারিনি একটা ভরসা পেল।সে যখন থেকে প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্টটা হাতে পেয়েছে তখন থেকে তার কেনো জানি বেঁচে থাকার আগ্রহ তৈরি হয়েছে।আর কিছু না হলেও তার অনাগত সন্তানের জন্য তাকে বাঁচতে হবে।

অহিদা বেগম মিষ্টির দোকানে গিয়ে কয়েক ধরনের মিষ্টি কিনলেন।বাড়িতে গিয়ে সবটা সবাইকে জানালেন।আশহির হাসি দিয়ে বললো,

-“আমি জানতাম তারিনি ঠিক হয়ে যাবে।আমাদের বাচ্চার জন্য তো ও-কে ঠিক হতেই হবে।”

তারিনি বিরক্তি নিয়ে বললো,

-“আশহির আমি জানি তুমি আমার অনাগত সন্তানের বাবা।তবে তোমাকে আমি একটা জিনিস ক্লিয়ার বলে দেই এই সন্তানের দায়িত্ব শুধু আমার।তুমি ওর কোনো দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখাবে না।আর হ্যাঁ আমি যদি অপারেশনটা হলে বেঁচে যাই আর আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারি তারপরে আমার প্রধান কাজ হবে তোমাকে ডিভোর্স দেওয়া!”

তারিনি কথাগুলো বলে তার রুমের দিকে চলে গেল।আশহির ঠায় তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।তার হাসি মুখ নিমিষেই মলিন হয়ে গেল।

-“তারিনি আমার সাথে এমন করতেছে?আমি আমার সন্তানের দায়িত্ব পর্যন্ত নিতে পারবো না?আর ও আমাকে ডিভোর্স দিবে কথাটা কিভাবে বলতে পারে!”

আহমেদ সাহেব চোয়াল শক্ত করে বললেন,

-“একশো বার বলতে পারে।তোমার মতো ছেলেকে ডিভোর্সই দেওয়া উচিত।বউ থাকতে অন্য মেয়েকে যে বিয়ে করে আনতে পারে সে আবার সন্তানের দায়িত্ব কি নিবে!”

আহমেদ সাহেব কথাগুলো বলে উনার রুমের দিকে চলে গেলেন।অহিদা বেগমও কিছু না বলে আহমেদ সাহেবের পিছু পিছু চলে গেলেন।আশহির আর সবটা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।বেসামাল ভাবে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ একটা বৃদ্ধ লোক সামনে আসায় সে উনাকে বাঁচাতে গিয়ে রাস্তার পাশের একটা গাছের সাথে গাড়ি লাগিয়ে দিল।সবটা তৎক্ষণাৎ ঘটায় আশহির তাল সামলাতে না পেরে মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারালো।কিছু মানুষজন তাকে গাড়ি থেকে বের করলো।

বাড়ি ফেরার পথে লোকজনের ভীর দেখায় মৌরিন সেদিকে এগিয়ে গেল।সে দেখলো কিছু লোক আশহিরকে সিএনজিতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার জ্ঞান নেই।তার কপাল দিয়ে রক্ত পড়ে চলেছে।মৌরিন তাদের সাথে হাসপাতালে গেল।ডাক্তার আশহিরকে দেখছে।তার জ্ঞান ফিরে এসেছে।ডাক্তার আশহিরের মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললো,

-“আজকে অল্পতেই রক্ষা পেয়েছেন।এভাবে গাড়ি চালাবেন না।একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।”

আশহির মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল।ডাক্তার মৌরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“উনি আপনার কে হন?”

মৌরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“ফ্রেন্ড!”

-“ফ্রেন্ডকে একটু সাবধানে থাকতে বলবেন।”

মৌরিন আশহিরকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে বললো,

-“আপনি রাজি থাকলে আমি ড্রাইভ করতে পারি।কারণ আপনার এই অবস্থায় ড্রাইভ করাটা ঠিক হবে না।”

-“আপনিই ড্রাইভ করুন।আমার পক্ষে এখন ড্রাইভ করা সম্ভব না।”

#চলবে……………….

[ভূল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]