#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-২৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★আজ প্রহর আর খুশির জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম দিন। সবচেয়ে বড়ো পরিক্ষার দিন। যার ফলাফল স্বরুপ প্রহর হয় ওর প্রাণভোমরাকে ফিরে পাবে, আর নাহলে…..। না না নাহলে বলতে কিছুই না। খুশি ফিরে আসবে। ওকে ফিরতেই হবে প্রহরের কাছে। এমনটাই দৃঢ় বিশ্বাস প্রহরের।মনে মনে যতই নিজেকে মজবুত রাখার চেষ্টা করুক তবুও খুশিকে হারানোর আতঙ্ক প্রহরকে বোধশক্তিহীন করে দিচ্ছে। ভেতরে চলছে তুমুল ঝড়।অন্তর আত্মা সব গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। কতক্ষণ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে জানা নেই প্রহরের। প্রতিটা ক্ষণ শুধু আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া চাইছে। ওর খুশি যেন ঠিক হয়ে যায়। গতকাল সারাটা রাত প্রহর একবারের জন্যও চোখের পলক এক করেনি। শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলো ওর হৃদহরণীকে। পারলে যেন বুকটা চিড়ে খুশিকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতো প্রহর। যাতে ওর প্রাণভোমরা টা কোথাও হারিয়ে না যায়। রাতের শেষভাগে জায়নামাজে বসেছিল প্রহর। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে সকাল পর্যন্ত শুধু দু হাত তুলে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে খুশির রোগমুক্তির দোয়া চেয়েছে।
আজ সকালে খুশিকে হসপিটালে আনা হয়েছে অপারেশনের জন্য। গতকাল রাতে ডক্টর ফোন করে বলেছিল নিউইয়র্কের ডক্টর নাকি চলে এসেছে। তারা আজই অপারেশন করবে। সেই অনুযায়ী সকালবেলা ওরা চলে আসে। খুশির পরিবার, জিদান সাহেব আর ফাহিমও এসেছে। আপাতত অপারেশনের পূর্ববর্তী কিছু পরিক্ষা নিরিক্ষা করে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রহর গিয়েছিল ডক্টরের সাথে কথা বলতে। অপারেশনের পূর্বে বন পেপারে সাইন চেয়েছে তারা। একটা কাগজে শুধু সাইন করাটা যে কতটা কঠিন কাজ হতে পারে তা আজ বুঝতে পেরেছে প্রহর। মনে হচ্ছিল কাগজে না, প্রহর ওর অস্তিত্বের ওপর কলম বসাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনরকমে সইটা করেই বেড়িয়ে আসে প্রহর। কেমন যেন শ্বাসরুদ্ধকর লাগছিল ওর। প্রহর দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে খুশির কেবিনের দিকে। খুশির কেবিনের সামনে আসতেই হঠাৎ দেখলো খুশির কেবিনের দরজায় সবাই ভীড় করেছে। দরজায় চাপড় মেরে খুশিকে ডাকছে। এই দৃশ্য দেখে আৎকে উঠলো প্রহর। দৌড়ে গেল দরজার কাছে। অস্থির কন্ঠে বললো।
–কি হয়েছে? দরজা বন্ধ কেন?
রাকিব হাসান চিন্তিত সুরে বলে উঠলেন।
–দেখনা বাবা খুশি সেই কখন থেকে ভেতর থেকে দরজা আটকে আছে। এত ডাকছি খুলছেই না। আমাদের ভয় লাগছে। মেয়েটার কিছু হলোনা নাতো?
প্রহরের অশান্ত মনের ঝড় এবার প্রলয় বয়ে আনলো। ভয়ার্ত অন্তর কেঁপে উঠল ওর। প্রহর দ্রুত দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে অস্থির হয়ে খুশিকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সারাশব্দ আসছে না। প্রহর আর না পেরে এবার দরজা ধাক্কিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছে। কয়েকবার গায়ের জোরে ধাক্কানোর ফলে সিটকানি টা খুলে গেল। দরজা খুলে দ্রুত বেগে ভেতরে ঢুকলো প্রহর। ভেতরে ঢুকে দেখলো খুশি বেডের ওপর উল্টো দিকে কাত হয়ে চাদরে মাথা ঢেকে গুটিশুটি হয়ে আছে। তবে চাদরের ওপর দিয়েও খুশির শরীরের মৃদু কাপুনি টের পাওয়া যাচ্ছে। খুশি যে চাদরের ভেতর কাঁদছে তা বুঝতে বাকি রইলো না প্রহরের। প্রহর খুশির পাশে বসে চাদর সরানোর চেষ্টা করে আদুরে গলায় বললো।
–দেখি কি হয়েছে আমার খুশিরাণী টার? আমাকে বলো প্লিজ? এভাবে মাথা ঢেকে কেন শুয়ে আছ? নিঃশ্বাস আটকে যাবেতো। দেখি সরাও তো।
কিন্তু খুশি চাদর কিছুতেই সরাতে দিচ্ছে না। দুই হাতে চাদর শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বিচলিত কন্ঠে বললো।
–না না একদমই না। চাদর সরাবে না প্লিজ। তুমি যাও এখান থেকে যাও। আমাকে দেখনা প্লিজ। আমি বের হতে পারবোনা। তুমি যাও প্লিজ যাও..
–কি হয়েছে সোনাটা? এমন কেন করছিস? আমাকে বলনা প্লিজ? আমার ভয় করছে খুশি। প্লিজ খোল এটা।
কথা বলতে বলতে একসময় প্রহর জোর খাটিয়ে চাদর টেনে সরিয়ে দিল। খুশির দিকে তাকাতেই বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো প্রহরের। বুঝতে পারলো খুশির এই আত্মগোপনের কারণ। চাদর সরানোর সাথে সাথেই খুশি দুই হাতে মাথা ঢেকে নিয়ে আরও গুটিশুটি হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–না…..না না তুমি দেখোনা। তোমার পায়ে পড়ছি তুমি চলে যাও এখান থেকে। আমাকে এই অবস্থায় দেখোনা। আমি মরে যাবো।
খুশির এই করুন অবস্থা দেখে প্রহর যেন হাজারো বার মরছে। আল্লাহ এতো কষ্ট কেন দিচ্ছে ওর খুশিকে? আর যে সহ্য হয়না। ওর সব কষ্ট আমার কেন হয়ে যায় না? অপারেশনের জন্য নার্স এসে খুশির চুল ফেলে নাড়া করে দিয়ে গেছে। সেজন্যই মেয়েটা এমন করছে। মেয়েটার তার চুলগুলো খুব প্রিয় ছিল। আর তারচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল প্রহরের কাছে। এলোমেলো চুলগুলো প্রহরের মুখের ওপর এসে যখন বাড়ি খেত তখন মনে হতো যেন শ্রাবণের মেঘগুলো এসে ওকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। খুশি যখন এটিটিউট দেখিয়ে চুলগুলো হাত দিয়ে ঝটকা মারতো তখন প্রহর যেন ফিদা হয়ে যেত।
খুশিকে এমতো অবস্থা দেখে খুশির মাও নিজের কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। মুখে আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। খুশি যাতে বুঝতে না পারে তাই দৌড়ে বাইরে চলে গেলেন তিনি। তার পিছে পিছে বাকিরাও চলে গেলেন। এইমুহূর্তে শুধু প্রহরই পারবে খুশিকে সামলাতে। তাই ওদের একা ছেড়ে বাকিরা বাইরে চলে গেলেন।
প্রহর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে খুশির হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরানোর চেষ্টা করে বললো।
–প্লিজ এমন করোনা সোনা। ঘোর আমার দিকে। একবার তাকাও প্লিজ।
খুশি কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–না না আমি ঘুরবোনা। তুমি যাও এখান থেকে প্লিজ। আমাকে দেখোনা এভাবে। এভাবে দেখলে তোমার ঘিন্না লাগবে।
প্রহর এবার জোর করে খুশিকে নিজের দিকে ঘুরালো। কাঁদতে কাঁদতে খুশির চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। প্রহর দুই হাতে খুশির মুখটা আগলে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে আবেগী কন্ঠে বললো।
–এই ময়না পাখি এমন করছিস কেন? একটু শান্ত হনা। তাকা আমার দিকে। একবার এই চোখে চোখ রেখে দেখ।
–আমি পারবোনা প্রহর। নিজেকে আমার বিবস্ত্র মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাকে বস্ত্রহীন করে দিয়েছে। যেখানে আমি নিজেই নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না। সেখানে তুমি কিভাবে দেখতে পারবে? আমাকে দেখলে তোমার ঘেন্না লাগবে। আমি সহ্য করতে পারবোনা। এরচেয়ে তো মরে গেলেও ভালো।
প্রহর এবার চোয়াল শক্ত করে ধমকের সুরে বললো।
–বাস অনেক হয়েছে। কি তখন থেকে আবোল তাবোল বলে যাচ্ছ? তুমি কি আমাকে এতটুকুই চিনেছ? তোমার প্রহরের ভালোবাসা কি এতটাই ঠুনকো? আমি কখনোই তোমার রুপের মোহে তোমাকে ভালোবাসিনি। তাহলে রুপ কমে গেলে ভালোবাসা কমে যাবে কেন? আর কে বলেছে তোমাকে এসব পঁচা কথা? তুমি আগেও আমার কাছে যা ছিলে এখনো তাই আছ আর ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। তোমার শারীরিক কোন পরিবর্তন আমার ভালোবাসার ওপর ভারি হতে পারবেনা। কখনোই না। তুমি যেমনই হও না কেন আমার কাছে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। আমার অপ্সরী। আমার খুশীরাণী। বুঝতে পেরেছ? আর কখনো এসব বাজে কথা বলবে না। আর এটাতো টেম্পোরারি করা হয়েছে। সবসময় কি আর এমনই থাকবে নাকি তুমি। অপারেশন হয়ে গেলে দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই আবারও আমার সেই কেশবতী কন্যার ঘনকালো কেশের বাহার ফিরে আসবে।
খুশি তাও কেঁদেই যাচ্ছে। প্রহর এবার বলে উঠলো।
–ঠিক আছে তোমার মাথায় চুল নেই এটাইতো সমস্যা? তাহলে এক কাজ করি। আমিও আজ নাড়া করে ফেলি। তখন দুজনেই একরকম হয়ে যাবো। তাহলে তো আর সমস্যা নেই তাইনা?
খুশি এবার চমকে উঠে বললো।
–এই না না খবরদার এমন করবেনা। তাহলে কিন্তু আমি তোমাকে কখনো মাফ করবোনা।
প্রহর মুচকি হাসলো। চোখ দিয়ে ঝড়ে পড়লো নোনাজল। খুশির কপালে সময় নিয়ে একটা গভীর চুমু খেয়ে বললো।
–তাহলে কান্না বন্ধ করো এখন। নাহলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই নাড়া করে ফেলবো। তখন তোমার টাকলা বরের সাথে থাকতে হবে কিন্তু।
খুশি অশ্রুসিক্ত চোখে হেঁসে দিয়ে প্রহরকে জড়িয়ে ধরলো।
__
অবশেষে সেই মুহূর্ত টা চলেই এলো। এখন সময় সকাল ১১টা। ১১-৩০ এ অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে খুশিকে। সবাই যেন কুকড়ে আছে। অপারেশনের আগে শেষবারের মতো খুশি সবার সাথে দেখা করতে চাইলো। সবার প্রথমে এলো খুশির মা বাবা। দুজনেরই চোখের পানি থামছেনা কিছুতেই। নিজের নারী ছেঁড়া ধন, কলিজার টুকরাকে তারা প্রাণভরে দেখছে। নাজানি আর এই মুখ দেখা তাদের নসিবে হবে কিনা। আজ সাহেলা বেগমের মতো শক্ত মনের মানুষও যেন সবচেয়ে বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছে। কেনই বা হবে না, সে যে মা। আর এক মায়ের বুকে সন্তান হারানোর ভয় যখন হানা দেয় তখন সব শক্ত দেয়ালই ভেঙে পড়ে। মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে বড়ো দুনিয়াতে আর কিছুই নেই। লোকে বলে সন্তান হারালে নাকি মায়ের কলিজায় ছিদ্র হয়ে যায়। সাহেলা বেগমেরও একই অনুভব হচ্ছে। মেয়ের সামনে আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না তার। রাকিব হাসান তাকে ধরে রাখছেন আর নিজেও চোখের পানি ঝাড়াচ্ছেন। তাদের মন চাচ্ছে আবারও সেই ছোটবেলার মতোই মেয়েটাকে বুকের মাঝে আগলে রাখুক।
খুশি হাত বাড়িয়ে ওর মা বাবাকে কাছে ডাকলো। ওরা খুশির কাছে এসে বসলো। খুশি ওর মা বাবার চোখের পানি মুছে দিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো।
–আরে আরে এতো কাঁদার কি আছে? মনে হচ্ছে আমি এখনই পরপারে চলে গেছি। আর আম্মু তোমাকে এভাবে কাঁদলে কিন্তু একদম মানায় না। তোমাকে তো রাগী ভাবেই মানায়। একবার আবারও সেই আগের মতো করে বকোনা আমাকে আম্মু। প্লিজ শুধু একবার।
সাহেলা বেগম আরও বেশি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তবুও খুশির মন রাখতে কোনরকমে বলে উঠলেন।
–এ এই উড়নচণ্ডী মেয়ে, একদম পালানোর চেষ্টা করবিনা। ভালোই ভালোই ফিরে আসবি। নাহলে কিন্তু তোকে আমি মার দিবো।
খুশি অশ্রুসিক্ত চোখে হেঁসে দিল। তারপর বাবা মা দুজনের হাত ধরে বললো।
–আম্মু বাবা তোমরা আমাকে প্রমিজ করো। আমার কিছু হয়ে গেলে তোমরা ভেঙে পড়বেনা। একজন আরেকজনের খেয়াল রাখবে।
–এমন করে বলিস না মা। তোর কিছু হবে না। তুই একদম ঠিক হয়ে যাবি দেখিস।
বাবা মায়ের সাথে দেখা শেষে এবার নিভান এলো খুশির কাছে। অশ্রু চোখে চেয়ে থেকে এগিয়ে এলো প্রানপ্রিয় বোনের কাছে। নিভানের কাছে তো ওর পৃথিবীই ছিল ওর আপু। আজ তার কিছু হয়ে গেলে নিভানও হয়তো বাঁচতে পারবেনা। নিভান খুশির সামনে এসে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো।
–আপু তোমার জন্য কিছু এনেছি আমি। দেখবে?
খুশি অশ্রুসিক্ত চোখে মুচকি হেসে বললো।
–হ্যাঁ দেখানা ভাই।
নিভান ওর হাতে থাকা আর্ট পেপার টা আস্তে করে উপরে তুলে ধরলো। পেপারে খুশির একটা হাস্যজ্বল মুখের ফুল স্কেচ আঁকানো। খুশি চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা। অশ্রুসজল চোখে তাকালো ছোট ভাইটার দিকে। কান্না জড়িত কন্ঠে বললো।
–অনেক সুন্দর হয়েছে বাবু। আমার বাবুটা একদিন অনেক বড়ো আর্টিস্ট হবে। আমাদের নাম উজ্জ্বল করবে তাইনা?
নিভান আর থাকতে পারলোনা। দৌড়ে এসে খুশিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–হ্যাঁ আপু আমি একদিন অনেক বড়ো আর্টিস্ট হবো। কিন্তু সেদিন আমার পুরস্কার হিসেবে তোমাকে চাই। আমি যখন কোন পুরস্কার পাবো সেখানে তোমার উপস্থিতি চাই। তুমি সবার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমার জন্য শিস বাজাবে,জোরে জোরে তালি বাজাবে। বলনা আপু তুমি থাকবেতো সেদিন?
খুশি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই থাকবো। আমার বাবুর জন্য চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে শিস বাজাবো। করতালিতে মুখরিত করে দিবো।
–প্রমিজ??
–পাক্কা প্রমিজ।
নিভানের পর এবার বেলি এলো খুশির কাছে। বাকি সবার মতো তারও একই অবস্থা। তিনিও অশ্রুসজল চোখে খুশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। তখনই ওখানে জিদান সাহেবও এলো। খুশিই আসতে বলেছিল তাকে। খুশি হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো জিদান সাহেব কে। জিদান সাহেব নিজের কান্না আটকে জোরপূর্বক হেসে খুশির সামনে এসে বললো।
–অনেক হয়েছে বৌমা। অসুখের বাহানায় অনেক আরাম করেছ। এসব তালবাহানা আর চলবেনা বুঝেছ। জলদি জলদি ঠিক হয়ে বাসায় এসে সব কাজকাম করতে হবে। নাহলে কিন্তু আমি বকা দিবো। যতই মজা করিনা কেন শশুর হিসেবে কিন্তু আমি অনেক স্ট্রিক্ট।
খুশি মুচকি হেঁসে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি স্ট্রিক্ট হলে আমি অ্যাঞ্জেলিনা জলি। এখন এসব ছাড়ুন। এখানে আসুন আপনার সাথে কিছু কথা আছে।
খুশি এক হাতে জিদান সাহেবর হাত ধরে, আরেক হাতে বেলির হাত ধরে বললো।
–আপনাদের দুজনের কাছে একটা ওয়াদা চাই আমি। আমার শেষ ইচ্ছাও বলতে পারেন। আমাকে কথা দিন আমার কথা রাখবেন।
জিদান সাহেব বললেন।
–হ্যাঁ মা অবশ্যই রাখবো। বলো কি চাই তোমার?
খুশি জিদান সাহেবের হাতের ওপর বেলির হাত রেখে বললো।
–আমাকে কথা দিন আপনারা দুজন মিলে একটা নতুন জীবন শুরু করবেন। আঙ্কেল, বেলি ফুপি আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আপনার জন্য আজও সে বিয়ে করেনি। আর আপনিও এখন একাই আছেন। যে ভালোবাসা তখন অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল। সেটা এখন পূরণ করবেন বলুন। আমার ফুপিকে বিয়ে করে তার হারানো ভালোবাসা ফিরিয়ে দিবেন। বলুন আমার কথা রাখবেন আপনারা।
বেলি চমকে উঠে বললো।
–খু খুশি কি বলছিস এসব? এটা হয়না মা। এখন আর এসব সম্ভব না।
তবে বেলিকে অবাক করে দিয়ে জিদান সাহেব অনায়াসে বলে উঠলেন।
–ঠিক আছে খুশি মা। তুমি যেমন চাও তেমনই হবে। তবে তোমাকেও প্রমিজ করতে হবে আমাদের বিয়েতে তোমাকে সবার আগে নাচতে হবে। বলো রাজি?
জিদান সাহেবের কথায় বেলি আরও বেশি চমকে গেল। তবে খুশি হাসিমুখে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ তাতো অবশ্যই। এটা আবার বলতে আছে নাকি।
এবার দেখা করার পালা এলো সেই ব্যাক্তির যার সামনে নিজেকে শক্ত রাখা সবচেয়ে কঠিন খুশির জন্য। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে মৃদু পায়ে কেবিনে ঢুকলো প্রহর। চোখ দুটো লাল টকটক করছে, মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। যেন কোন ধ্বংসাবশেষ নির্জীব প্রাণী। খুশি হাতের মুঠো শক্ত করে নিজেকে শক্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। ও ভেঙে পড়লে যে প্রহর আরও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। প্রহর আস্তে করে এসে খুশির পাশে বসলো। খুশির দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেল। খুশি চোখের ইশারায় প্রহরকে ঝুঁকতে বললো। প্রহর মাথা ঝুকালে খুশি প্রহরের কপালে চুমু একে দিল। খুশির পর প্রহরও খুশির কপালে চুমু একে দিল। খুশি এবার মুখ উঁচু করে প্রহরের অধরে নিজের অধর চেপে ধরলো। ওভাবেই কিছুসময় অতিবাহিত করলো দুজন। দুজনেরই চোখে বরষার বৃষ্টিধারা ঝড়ছে। এরপর খুশি অধর ছেড়ে বলে উঠলো।
–আমাকে প্রমিজ করো আমার যদি কিছু হ…..
খুশির কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রহর খুশির ঠোঁটের ওপর তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বললো।
–হুঁশশ,, তুমি যেটা বলতে চাইছ সেটা বলার চেষ্টাও করোনা। আমি তোমাকে কোন প্রমিজ করবোনা। কারণ প্রমিজ তুমি করবে। আর শুধু করবেনা সেটা করে দেখাবে। ফিরতে হবে তোমাকে। আমার কাছে ফিরবে তুমি। অবশ্যই অবশ্যই ফিরবে তুমি। তুমি হীনা প্রহরের কোন অস্তিত্ব নেই। তুমি আছ তো এই আমি আছি। নাহলে কিছুই নেই। তাই মনে রাখবে আমাকে ভালো রাখতে চাইলে তোমাকে ফিরতেই হবে। আর অন্য কোন উপায়ন্তর নেই।
প্রহর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো খুশিকে। খুশিও দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রহরকে। জানা নেই এই শান্তির আলিঙ্গন পাবে কিনা ও।
অতঃপর সেই সময় চলে এলো। খুশিকে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য নার্স আর ওয়ার্ড বয়রা এলো। খুশিকে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে যেখানে লাগলো। খুশি এখনো শক্ত করে প্রহরের হাত ধরে আছে। প্রহর খুশির হাত ধরে থেকেই ওর সাথে সাথে যাচ্ছে। প্রহরের মনে হচ্ছে ওর ভেতর থেকে কলিজাটা কেউ ধীরে ধীরে টেনে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। জানটা যেন বেড়িয়ে যাচ্ছে ওর। একসময় ওটির সামনে চলে আসলো ওরা। প্রহরকে আর খুশির সাথে থাকতে দিলোনা ওরা। ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গেল খুশিকে ওটির ভেতর। প্রহর অনুভূতি শূন্য হয়ে ধপ করে বসে পড়লো ওখানেই। ওর প্রাণভোমরা টাকি ফিরবে আবারও ওর কাছে?
সেই চার ঘন্টা ধরে খুশির অপারেশন চলছে। এখনো বের হয়নি ওরা। প্রতিটা মুহূর্ত যেন এক একটা যুগ মনে হচ্ছে প্রহরের কাছে। ওর ভেতর এখন কি চলছে তা কোন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ও বাস একটা অনুভূতি শূন্য পাথরের মতো দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। এই দেহে তখনই প্রাণ ফিরবে যখন খুশির কোন ভালো সংবাদ আসবে। খুশির মা বসে বসে শুধু তসবি টিপছেন আর দোয়াদরুদ পড়ছেন। নিভান কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। বাকিদেরও খুবই দূর্বিষহ অবস্থা।
অতঃপর ওটির লাল আলোটা বন্ধ হলো। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ডক্টর। প্রহর দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে ডক্টরের কাছে গিয়ে অস্থির কন্ঠে বললো।
–ড ডক্টর আ আমার খুশি কেমন আছে? ও ঠিক হয়ে গেছে তাইনা? আমি কি দেখা করতে পারি এখন? শুধু একটু দূর থেকে দেখবো।
ডক্টর মাথা নিচু করে মলিন সুরে বলে উঠলেন।
–অ্যাম সরি। উই ট্রাই আওয়ার বেস্ট। বাট ইটস নট সাকসেসফুল। সি ইজ নো মোর।
“” নো মোর”” বাচ এই একটা চারদিকে ধ্বনিত হতে লাগলো প্রহরের পুরো পৃথিবী মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। অনুভূতি শূন্য জীবন্ত লাশ হয়ে গেল ও। বোধশক্তিহীন হয়ে ধীরে ধীরে পেছাতে লাগলো ও। হঠাৎ পাশে ফিরে তাকালো প্রহর।এইতো খুশি দাঁড়িয়ে আছে।সাদা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে কি সুন্দর হাসিমুখে দেখছে ওকে। প্রহরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। প্রহর হাসিমুখে বললো।
–খুশি,, আমার খুশি…
খুশি মুচকি হেঁসে বলে উঠলো।
–আমি চলে যাচ্ছি প্রহর। ভালো থেক। নিজের খেয়াল রেখ।
খুশির কথায় প্রহরের ঠোঁটের হাসি বিলুপ্ত হয়ে গেল। খুশি হাত নেড়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো। প্রহর আতঙ্কিত হয়ে খুশিকে ধরার জন্য এগিয়ে যেতে যেতে বললো।
–নো নো নো, ইউ কান্ট গো খুশি। ইউ প্রমিজ মি খুশি। যেওনা প্লিজ.. খুশি, খুশি…
খুশি শুনলোনা। একসময় ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল সে। প্রহর এবার গগনবিদারী আর্তচিৎকার দিয়ে বললো।
—খুশিইইইইইইইই
চলবে……
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-২৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★খুশিইইইইই,,,,
চিৎকার করে ঠাস করে চোখ খুলে উঠে বসলো প্রহর। সারা শরীর অসম্ভব রকম কাঁপছে। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। কেমন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে পর।হাপাতে লাগলো, অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকালো ও। নিজেকে হসপিটালের একটা কেবিনে আবিস্কার করলো প্রহর। ও এখানে কি করছে? খুশি? আমার খুশি কোথায়? খুশি কি তাহলে… না না না কিছুতেই না। খুশিইই খুশিইই.. অস্থির হয়ে প্রহর নিচে নামার চেষ্টা করলো। তখনই হঠাৎ ফাহিম দৌড়ে এসে প্রহরকে ধরে বললো।
–প্রহর তো জ্ঞান ফিরেছে? ঠিক আছিস তুই?
–ঠিক আছি মানে? আমার আবার কি হবে?
–আরে খুশিকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তো তুইও ওখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলি। গত চার ঘন্টা যাবৎ তুই বেহুঁশই ছিলি।
–অ অজ্ঞান ছিলাম? তা তারমানে ওসব কি স্বপ্ন ছিল? খুশি? আমার খুশি? ফা ফাহিম আমার খুশি? খুশির অপারেশন??
ফাহিম স্বস্তিময় হাসির রেখা টেনে বললো।
–তোর বিশ্বাস জিতে গেছে প্রহর। খুশির অপারেশন সাকসেসফুল হয়ে গেছে। তোর খুশি আবারও ফিরে এসেছে তোর কাছে।
প্রহর অশ্রুসজল চোখে ফাহিমের দিকে। প্রহরের দেহে এবার প্রাণের সঞ্চালন হচ্ছে। খুশি ফিরেছে। আমার খুশি ফিরেছে আমার কাছে। প্রহরের আনন্দ যেন ধরছে না। প্রহর উঠে দাঁড়িয়ে বললো।
–ফাহিম আমি খুশির কাছে যাবো। কোথায় খুশি?
–খুশিকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। জ্ঞান ফেরার পর কেবিনে শিফট করবে।তখন দেখতে পারবি।
–না না আমি এখুনি দেখবো। দূর থেকে হলেও দেখবো। ওকে এক নজর না দেখলে নিঃশ্বাস নিতে পারবোনা আমি।
কথাটা বলেই প্রহর নিচে নেমে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে ছুটে গেল। ফাহিম আটকানোর চেষ্টা করেও পারলোনা। প্রহর বাইরে এসে দেখলো অবজারভেশন রুমের বাইরে করিডরে সবাই বসে আছে। প্রহরকে আসতে জিদান সাহেব এগিয়ে গেলেন ওর কাছে। প্রহর ওর বাবার দিকে তাকিয়ে অস্থির কন্ঠে বললো।
–বা বাবা আমার খুশি। খুশি কোথায়?
জিদান সাহেব ছেলেকে আস্বস্ত করে বললেন।
–ভয়ের কিছু নেই প্রহার। খুশি হলো ফাইটার। ঠিকই মৃত্যুকে ফাইট করে হারিয়ে দিয়েছে। আমাদের কথা রেখেছে ও। আমাদের খুশি মা এখন ঠিক আছে।
প্রহর অশ্রুসজল চোখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–আমি জানতাম বাবা আমার খুশি আমাকে ছেড়ে যেতেই পারে না। আল্লাহ আমাকে এতবড় শাস্তি দিবে না। বাবা খুশি কোথায়? আমি একবার ওকে দেখবো। প্লিজ বাবা।
–কিন্তু অবজারভেশন রুমে তো কাওকে যেতে দেয়না। কেবিনে শিফট করার পর দেখিস।
–না না আমি এখুনি দেখবো। শুধু দূর থেকে একবার দেখবো।
প্রহর অবজারভেশনের করিডরের দরজা ঢেলে ভেতরে ঢুকলো। সেখানে রিসিপশনে বসে থাকা নার্সরা প্রহরকে বাঁধা দিল ভেতরে ঢুকতে। তবে প্রহর কিছুই মানতে রাজি না। সে শুধু বারবার খুশিকে দেখার জেদ করে যাচ্ছে। অগত্যা আর না পেরে দূর থেকে দেখার পারমিশন দিলো ওকে। খুশির রুমের কাছে এসে দরজায় লাগানো কাচের ভেতর থেকে খুশিকে দেখলো প্রহর। সারা মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো জ্ঞানহীন খুশি শুয়ে আছে। প্রহরের চোখের বরষা অঝোর ধারায় বইছে। কাচের ওপর দিয়েই হাত বুলালো প্রহর। ওর ঝাঁসির রানি যুদ্ধ জয় করে ফিরেছে। আমার কাছে ফিরেছে। হৃদয়ের স্পনদ ফিরে পেয়েছে প্রহর। শেষ হয়েছে ওদের জীবনের কঠিন পরিক্ষা।
___
রাত ৮ টার দিকে জ্ঞান ফিরে আসে খুশির। ডক্টর এসে বলে গেলো সবাইকে। একটু পরে খুশিকে বেডে শিফট করা হবে। সবার মাঝে এক অপরিসীম প্রশান্তির লহর ছড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণ যতটুকু ভয়, চিন্তা কাজ করছিল। তারও লেশমাত্র অবকাশ রইলো না। সবার মুখে ফুটে উঠলো প্রাপ্তির হাসি।
কেবিনে শিফট করার পর খুশির মা বাবা আর নিভান পাঁচ মিনিটের জন্য একটু দেখা করে আসলো। কারন ডক্টর বলেছে বেশিক্ষণ রুগীর কাছে ভীড় করা যাবে না। বেশি কথা বললে খুশির সমস্যা হতে পারে । তাই ওরা অল্প কিছু সময়ের জন্য শুধু দেখে চলে আসলো। এরপর এলো প্রহর। দরজা খুলে মৃদুপায়ে ভেতরে ঢুকলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে খুশির পাশে টুলের ওপর বসলো। প্রহরের আভাস পেয়ে ভারি চোখের পলক দুটো ধীরে ধীরে খুলে তাকালো খুশি। পাশে তাকিয়ে দেখতে পেল ওর দিওয়ানা পাগলকে। মায়াময় চোখে তাকিয়ে হাসির রেখা আনলো ঠোঁটের কোনে। ব্যাস এতটুকুই যেন প্রহরের শরীর মনকে প্রশান্তির অথই সমুদ্রে ভাসানোর যথেষ্ট। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দাশ্রু। খুশির একহাতে স্যালাইন লাগানো। প্রহর খুশির অন্য হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। খুশির হাতের উল্টো পিঠে অধর ঠেকালো প্রহর। মাথা ঝুঁকিয়ে অধর ঠেকালো খুশির কপালে। আনন্দাশ্রু জমে গেল খুশির চোখের কোনে। তবে সেটা চোখের কোন বেয়ে নিচে পড়তে দিলোনা প্রহর।তার আগেই নিজের অধর দ্বারা শুষে নিলো সে। মায়াবী কন্ঠে বলে উঠলো।
–নো মোর টিয়ারস খুশিরাণী। ইট’স টাইম টু সেলিব্রেট ইউর ভিক্টোরি। অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ সুইটহার্ট।
খুশি মুচকি হেঁসে ভাঙা গলায় বললো।
— আই নো আই নো, আই অ্যাম সো শক্তিশালী। যমরাজ কে এক ঢিসুম মেরে কুপোকাত করে দিয়েছি ।
অশ্রু চোখেই হাসলো প্রহর। ব্যাস এভাবেই খুশি সারাজীবন ওর পাশে থাকুক। আর কিছু চাইনা ওর।
__
করিডরে একসারিতে লাগানো চেয়ার গুলোর একটাতে বসে আছে বেলি। সাহেলা বেগম ওকে বাসায় চলে যেতে বলেছিল। তবে খুশিকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না তার। তাই এখানেই বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই খুশির সাথে দেখা করে এসেছে। মেয়েটাকে ভালো হতে দেখে তার এখন স্বস্তি লাগছে। হঠাৎ একটা ধোঁয়া ওঠা গরম কফির ওয়ান টাইম কাপ কেউ ধরলো বেলির সামনে। বেলি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো জিদান সাহেব। বেলি সৌজন্যমূলক মৃদু হেসে বললো।
–আরে শুধু শুধু কেন কষ্ট করতে গেলে?
জিদান সাহেব বেলির পাশে বসে বলে উঠলেন।
–বারে এতে আমার কেন কষ্ট হতে যাবে? কফি কি আমি বানিয়েছি নাকি? কফি তো বানালো ক্যানটিনওয়ালা আমিতো শুধু নিয়ে এলাম। গরম গরম কফি টা খেয়ে নাও। শরীর মন ফ্রেশ হয়ে যাবে।
বেলি কফির কাপটা হাতে নিলো। জিদান সাহেবও তার নিজের কফিতে চুমুক দিলো। বেলি কফি খেতে খেতে ইতস্ততভাবে বলে উঠলো।
–জিদান তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।
–হ্যাঁ বলো,জিজ্ঞেস করার কি আছে?
–আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে তোমার খুশির কথা মানার কোন দরকার নেই। দেখ আমি জানি তুমি খুশির ওই অবস্থায় ওকে মানা করতে পারোনি। তাই ওর মন রাখতে রাজি হয়ে গেছ। তবে তোমার এসব করার দরকার নেই। আমি খুশিকে বুঝিয়ে বলবো। ও নিশ্চয় বুঝতে পারবে।
জিদান সাহেব বলে উঠলেন।
–আর আমি যদি বলি আমি আমার মনের ইচ্ছেতেই রাজি হয়েছি তাহলে?
বেলি চকিত দৃষ্টিতে তাকালো জিদান সাহেবের দিকে। জিদান সাহেব স্মিথ হেঁসে বললেন।
–হ্যাঁ বেলি, তুমি হয়তো ভাবছ আমি খুশির রাখতে বা তোমার ওপর দয়া করে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তবে এমন টা না। আমি আমার নিজের খুশিতেই রাজি হয়েছি। আসলে আমি উপলব্ধি করেছি জীবনে একটা যোগ্য সঙ্গিনীর খুবই প্রয়োজন। যার কাছে নিজের ভালো মন্দের কথা মন খুলে বলতে পারবো। কিংবা আমার না বলা কথাও সে বুঝে যাবে। জানো পাপিয়া আমার বউ হলেও ও কখনো আমার মনের কথা বুঝতে পারেনি। তবুও আমি কখনো ওর ওপর অভিযোগ করিনি। ভেবেছি সবাই তো আর এক হয়না। ও নাহয় একটু অন্যরকম। তবে ওর ওভাবে চলে যাওয়ার পর অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। নিজেকে কেমন ইডিয়ট মনে হচ্ছিল তখন আমার। কিন্তু আমি এই কষ্ট কারো সাথে শেয়ার করতে পারতাম না। কারণ তখন প্রহরকে সামলানোটাই আমার সবচেয়ে বড়ো প্রায়োরিটি ছিল। এভাবে নিজের অনুভূতি গুলো নিজের মাঝেই চেপে প্রহরকে মানুষ করা আর বিজনেসের ভেতর ডুবে থাকলাম। কিন্তু দিনশেষে ঠিকই নিজেকে খুব একা মনে হতো। মনে হতো কেউ একজন যদি থাকতো তাহলে তার কাঁধে মাথা রেখে নিজের সুখ দুঃখ শেয়ার করতে পারতাম।যদিও প্রহর বড়ো হবার পর থেকে আমাকে অনেক বার বিয়ে করতে বলেছে। তবে আমার মন চায়নি আর। কারণ একবারই মনমতো জীবনসঙ্গী বেছে নিতে ভুল করেছি। আবারও যদি সেই একই ভুল করি তাহলে কি হবে? আর সে যদি প্রহরকে আপন করে না নিতে পারে সেই ভয়ে কখনো সেই পথে পা বাড়াইনি। তবে একাকীত্ব এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়াই। আর এতো বছর পর তোমাকে দেখে কেন যেন মনে হলো তুমিই হয়তো আমার একাকীত্ব দূর করতে সাহায্য করতে পারবে। কারণ তোমার ভালো বন্ধু আমার আর কেউ নেই। তুমিই একমাত্র আমাকে ভালো ভাবে বুঝতে পারো। তাই খুশির কথায় আর দ্বিতীয় বার ভাবিনি আমি। তবে এটা একান্তই আমার ইচ্ছে। তুমি যদি মানা করতে চাও অনায়াসে করতে পারো। তোমার ওপর কোন চাপ নেই। তুমি যা ডিসিশন নিবে তাই হবে।
কথাগুলো বলে কফি শেষ করে উঠে গেল জিদান সাহেব। আর বেলি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। সত্যিই কি সে তার ভালোবাসার পূর্ণতা পেতে চলেছে।
__
এক সপ্তাহ পর খুশিকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ দিয়ে দিলো। এখন অনেক টা উন্নতি হয়েছে খুশির। মাথার ব্যাথাটাও অনেক কমে গেছে। বাসায় আনার পর থেকে প্রহর দিনরাত খুশির সেবায় নিয়জিত থাকে। এক মুহূর্তের জন্যেও খুশিকে একা ছাড়ে না। খাইয়ে দেওয়া, গোসল করানো,নিয়মিত মেডিসিন দেওয়া সহ যাবতীয় কাজই প্রহর নিজের হাতে করে। খুশিকে নিজের পায়ে এক পাও হাঁটতে দেয়না প্রহর। যেখানে যাবে খুশিকে কোলে নিয়ে যায়। যেন খুশি কোন ছোট বাচ্চা যাকে ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবে। এই অতিরিক্ত কেয়ারে খুশির মাঝে মধ্যে খুব বিরক্ত লাগ। সে বিরক্তির সুরে বলে,
–আরে এতো পুতুপুতু করার কি আছ? আমি কি নবজাতক শিশু নাকি আজব? এভাবে চলতে থাকলে তো আমি নিজের পায়ের বোধশক্তিই হারিয়ে ফেলবো। তখন সারাজীবন কাঁধে নিয়ে নিয়ে ঘুরো লেঙরা বউকে।
প্রহর তখন মুচকি হেঁসে বলে।
–ঘুরতে হয় ঘুরবো। তোমার তাতে কি? আমার বউকে আমি সারাজীবন কোলে কাঁধে নিয়েই ঘুরবো।
প্রহরের কথায় তখন আবার চোখ ভরে আসে খুশির। কেউ কাওকে এতটা কিভাবে ভালোবাসতে পারে? মন চায় তখন এই পাগলটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে।
দেখতে দেখতেই কেটে গেল আরও বিশটা দিন। খুশি এখন প্রায়ই সুস্থ। মাথার ব্যান্ডেজও খুলে দিয়েছে। মাথায় আবার নতুন করে চুল গজিয়েছে খুশির। এখন নিজে নিজেই চলাফেরা করে। যদিও প্রহর বেশি চলাফেরা করতে মানা করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। খুশিতো খুশিই। তাকে আবদ্ধ করে রাখা খুবই দুর্বোধ্য কাজ।
আজ খুশির অপারেশনের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। খুশি এখন অনেক টা সুস্থ হওয়ায় প্রহর আবার অফিস যাওয়া শুরু করেছে। খুশি হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রহর আর অফিসে যায়নি। এতদিন জিদান সাহেবই সবকিছু সামলেছেন। তবে এবার বাবাকে রেস্ট দিয়ে প্রহর আবারও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। যদিও বেশিসময় থাকে না সে। দ্রুত কাজ সেরে বাসায় চলে আসে সে। খুশির চিন্তা যে তাকে থাকতে দেয়না। ও জানে ও না থাকলে খুশি একটুও নিজের খেয়াল রাখে না। মেডিসিন গুলোও ঠিকমতো নেয় না। তাইতো খুশির কাছে না আসা পর্যন্ত ওর চিন্তার কমতি থাকে না।
সময় তখন রাত ১০ টা, প্রহর একটু ওর বাবার সাথে বিজনেসের ব্যাপারে কিছু আলাপ করতে গিয়েছিল। কথা শেষে সে ফিরে এলো ওর রুমে। রুমে এসে দেখলো খুশি রুমে নেই। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ দেখে বুঝলো খুশি ওয়াশরুমে গিয়েছে। প্রহর বেডের পাশে ছোট ল্যাম্প টেবিলের কাছে গিয়ে খুশির মেডিসিন গুলো চেক করতে লাগলো। ঠিকমতো মেডিসিন গুলো নিয়েছে নাকি তাই দেখছে। তখনই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে স্বাভাবিক ভাবেই পাশে ফির তাকালো প্রহর। আনমনে ফিরে তাকিয়ে আবারও মাথা ঘুরাতে নিলেই আটকে গেল তা। ধীরে ধীরে আবারও ফিরে তাকালো খুশির পানে।মুহূর্তেই থমকে গেল প্রহর। নির্বোধ নির্বিকার হয়ে গেল সে। চোখের পলক পড়তে আর হা হওয়া মুখটা চাপতে ভুলে গেল। ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আবেদনময়ী মহীয়সী রমনীকে দেখে হৃৎস্পন্দন কম্পন করা থামিয়ে দিল।
খুশি একটা শর্ট জিন্স আর স্লিভলেস সাদা শর্ট টিশার্ট পড়েছে, যার নিচে পেটের অর্ধভাগ দৃশ্যমান। টিশার্টের ওপরে লং একটা বুক কাটা জর্জেটের কটি পড়েছে। খুশির এই মাত্রাতিরিক্ত আবেদনময়ী রুপ প্রহরকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে।চোখের পর্দায় মাদকতা ছড়িয়ে পড়ছে। হাতের শক্তি হারিয়ে হাতে থাকা ঔষধ গুলো সব নিচে পড়ে গেল। এই শীতের মৌসুমেও যেন অতিরিক্ত গরমের প্রভাব অনুভব করছে প্রহর। গলা শুঁকিয়ে আসছে তার। খুশি ঠোঁটের কোনে আবেদনময়ী হাসি ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো প্রহরের কাছে। প্রহরের একেবারে কাছে এসে দুই হাতে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে বললো।
–কি হয়েছে মিঃ হাসব্যান্ড? মুখটা একটু চাপাও নাহলে মশাগুলো সব বিনা দাওয়াতে ঢুকে পড়বে।
প্রহর শুঁকনো ঢোক গিলে নিয়ে আমতাআমতা করে বললো।
–এ এসব কি খুশি? শীতের দিনে এমন কাপড়চোপড় কেউ পড়ে? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
খুশি আরও একটু বেশি আবেদনময়ী ভঙ্গিতে বললো।
–আচ্ছা তাই বুঝি? তাহলে এতো শীতের মাঝে তুমি ঘামছ কেন সুইটহার্ট?
কথাটা বলে খুশি ঠোঁট গোল করে প্রহরের মুখের ওপর ফু দিতে লাগলো। বেচারা প্রহরের অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে যাচ্ছে। খুশি ফু দেওয়া শেষে বললো।
–এখন ঠিক লাগছে? নাকি আরেকটু ঠান্ডা হাওয়া দিবো? গলাও শুঁকিয়ে গেছে নাকি? ঠোঁট দুটো শুষ্ক হয়ে গেছে। চলো এদের একটু সিক্ত করে দেই।
খুশি এবার প্রহরের অধর পানে এগুতে লাগলো।কিন্তু প্রহর খুশিকে থামিয়ে দিয়ে বললো।
–খুশি এক মিনিট, আমার কথা শোন। দেখ তুমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হওনি। এখুনি এসবের সময় হয়নি। এতে তোমার সমস্যা হতে পারে।
খুশি প্রহরের ঠোঁটের ওপর তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বললো।
–হুঁশশ অনেক হয়েছে। কি অসুস্থ অসুস্থ লাগিয়ে রেখেছ? অ্যাম নট ইউর পেশেন্ট। অ্যাম ইউর ডিয়ার ওয়াইফ। সো ট্রিট মি লাইক দ্যাট।
খুশি প্রহরের কপাল আর গালে আঙুল বোলাতে বোলাতে বললো।
–জানো কক্সবাজারে তোমার ওই ব্যাড বয় ইমেজ টা কিন্তু আমার হেব্বি লেগেছিল। জাস্ট কিলিং। কিন্তু এখানে এসে তুমি আবারও সেই আগের বোরিং নীতিবান হয়ে গেছ। আই ওয়ান্ট দ্যাট গাই।
–আমার কথাটা তো…
আর বলতে দিলোনা প্রহরকে। তার আগেই আলতো করে ধাক্কা দিয়ে প্রহরকে বেডে ফেলে দিলো। তারপর গিয়ে প্রহরের পেটের ওপর চড়ে বসলো খুশি। প্রহরের দুই হাতের মাঝে নিজের হাত ঢুকিয়ে বেডের সাথে আটকে ধরে বললো।
–আই ওয়ান্ট মাই লাবিডাবি হাসব্যান্ড রাইট নাও।
–দেখ খুশি সোনা বোঝার চেষ্টা করো তোমার কষ্ট হবে।
খুশি প্রহরের কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলো না। মাথা ঝুঁকিয়ে প্রহরের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে লো ভয়েসে বললো।
–এই কষ্ট সুখের কষ্ট। আমার কিছুই হবে না। সত্যিই বলছি। প্লিজ প্রহর…
প্রহরতো এমনিতেই খুশিতে নিমজ্জিত। তারওপর প্রিয়তমার এমন আবদার ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই ওর। আর শক্ত রাখতে পারলোনা নিজেকে। নেশায় ডুবে গেল সে নিজেও। তার নেশা আরও বাড়িয়ে দিলো খুশির কোমল অধরের ছোঁয়া। যা এই মুহূর্তে খুশি ওর গলা আর ঘাড় জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। খুশি প্রহরের শার্টের বোতাম খুলে গলা বুক জুড়ে অধরের স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাগল হয়ে যাচ্ছে প্রহর। দুই হাতে খুশির কোমড় জড়িয়ে ধরে খুশিকে নিচে নামিয়ে দিলো। নিজে খুশির ওপর ঝুঁকে খুশির সারামুখে অধরের স্পর্শ চিহ্ন এঁকে দিতে দিতে লাগলো। তারপর অধর মেশালো খুশির অধরে। খুশির অধরসুধাপান করতে লাগলো। খুশিও প্রহরের মাথার চুল খামচে ধরে নিজেকে ভাসিয়ে দিলো প্রহরের মাঝে। অধর ছেড়ে খুশির গলায় নেমে এলো প্রহর। গলা ঘাড়ে ভরিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার ছোঁয়ায়। কম্পন শুরু হয়ে গেছে খুশির মাঝে। প্রহর মাথা তুলে খুশির চোখে চোখ রেখে বললো ।
–খুশি আবারও বলছি তোমার কিন্তু কষ্ট হবে। তুমি বললে আমি এখনো থেমে যাবো।
খুশি কোন কিছু না বলে প্রহরের সাথে অধরযুগল মিলিয়ে নিলো। প্রহর খুশির জবাব পেয়ে গেল। তাই সে খুশিকে নিয়ে ডুব দিলো প্রেম সাওরের অথই সমুদ্রে। সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে হারালো দুজন স্বপ্নের রাজ্যে।
চলবে…….