অন্তঃকলহ পর্ব-০১

0
1

#অন্তঃকলহ
#ইসরাত_জাহান_এশা
#পার্ট_০১

তোমার সাহস কি করে হয়? আমার মেয়ের জন্য এনে রাখা দূধ থেকে তুমি দূধ পান করো? বাবা মা কি কোনো দিন গরুর দুধ খাওয়ানি? মেয়েটা আমার প্রেগন্যান্ট ওর এখন পুষ্টির প্রয়োজন তুমি কি ভাবে ওর জন্য আনা দুধ থেকে গ্লাস ভরে দুধ খেলে? এভাবে চুরি করে খেলে পেটে যেইটা আছে ওটাও চোর হবে।
___ আম্মা কথা বার্তা ঠিক করে বলেন। আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে একটাও বাজে কথা মুখেও আনবেন না৷ অনেক সহ্য করেছি আপনাদের অত্যাচার। আপনার মেয়ে পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট আপনার মেয়ের পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন আর আমি আট মাসের প্রেগন্যান্ট আমার পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন নাই? আর বাবা মার কথা বলছেন বাবা মা তো নিয়ে যেতে চায় সেই বাবু পেটে আসা থেকে কিন্তু আপনি আমাকে যেতে দিবেন না৷ আপনার মেয়েকে এখানে এনে রাখছেন যত্ন করার জন্য আমি চলে গেলে রান্নাবান্না কে সামলাবে। আপনার মেয়ের রেস্টের প্রয়োজন আমার নেই?
,আন্নি ছোট বেলা থেকে খুব চুপচাপ মেয়ে তাই কখনো ভালো মন্দ নিয়ে অভি্যোগ তোলেনি।চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে কথা গুলো শেষ করে আন্নি।
___কি? তোমার মুখে এতো বড় কথা? এতো সাহস হয়েছে তোমার? আজ ছেলে আসুক বাড়িতে আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
___ কি করবেন এই অবস্থায় ছেলেকে দিয়ে মার খাওয়াবেন?
আলিয়া বেগম রাগে অকথ্য ভাষায় আন্নি এবং আন্নির অনাগত বাচ্চাকে গালাগালি ও অভিশাপ দিতে দিতে বাকি দুধটুকু গ্লাসে ভরে মেয়ে বিথীর ঘরে নিয়ে যায়।
___দেখ দেখ তোর ভাইয়ের বউ তোর জন্য রাখা দুধ থেকে সব দুধ খেয়ে ফেলছে।
___ তাহলে এই দুধ কই পেলে?
___ পাতিলে ছিলো এইটুকুই বার্তি যে একটু থাকত তোর খাওয়ার পর থাকত আমি খেতাম। সেটা তোর ভাবি খাইছে।
কথাটা শুনে বিথী খুব রাগ নিয়ে বলে ঘরে দিন দিন কাল সাপ পুসতেছো? একটু দুধের লোভ সামলাতে পারে না।

বিথী কথাটা জোরে বলাতে সেটা আন্নির কান পর্যন্ত চলে আসে। আন্নি কথাটা শুনে নিরবে কান্না শুরু করে। কি করেনি এদের জন্য?বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছে আসার পর থেকে রান্না বান্না থেকে ঘরের সব কাজ আমি করেছি তার বিনিময়ে সন্মান তো পায়নি অবহেলা আর অবজ্ঞা। একটি সন্তানের জন্য কত কথা শুনেছি কিন্তু আজ যখন আমার বাচ্চা আসতে চলেছে তারা তখনও আমার সাথে একই ব্যবহার করছে। আচ্ছা বাচ্চা হওয়ার পরেও কি এমন আচরণ এমন বৈষম্য বাচ্চার সাথে করবে? তখন কি নিজের বাচ্চার থেকে আমার স্বামীর কাছে তার বোনের বাচ্চা বেশি আপন হবে?
এসব ভেবে কাঁদতে কাঁদতে আন্নি ঘুমিয়ে পড়ে। রাত সারে নয়টা সজিব রুমে প্রবেশ করে বলে কি হয়েছে এতো তারাতারি ঘুমিয়ে গেছো? বিথী অসুস্থ ওকে খাবার ঠিকঠাক মত দিয়েছ?
আন্নি চোখ ডলতে ডলতে বলে ওর যত্ন নেওয়ার জন্য তো তোমার মা আছে তুমি আছো।
___তবুও তুমি ওর ভাবি ওর প্রতি কি তোমার কোনো দায়িত্ব নাই?
___সবার প্রতি কি সব দায়িত্ব আমার? আমার প্রতি কি তোমাদের কোনো দায়িত্ব নেই?
___কিসব জাতা কথা শুরু করছ?
___যাতা কথা কি বলছি? আমিও তো প্রেগন্যান্ট তুমি আমাকে তো সারাদিনে একবারো জিজ্ঞেস করো না আমি কেমন আছি? কিছু খেতে মন চায় কিনা? কিছু আনতে বললে বলো মনে থাকে না। টাকা থাকে না। কিন্তু বোনের বেলায় সব কিছু মনে থাকে আচ্ছা আমার বেলায় কি তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?
___ তোমার মন ভর্তি হিংসা। মন পরিস্কার করো আমার বোনের সাথে হিংসামি করে আমার কাছে ভালো হতে পারবে না। যাও উঠে আমার জন্য ভাত বারো খিদা পেয়েছে।

আন্নি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সজীবের জন্য ভাত বারতে যায়। সজীব একলোকমা ভাত মুখে দিবে ঠিক তখন আলিয়া বেগম কাছে এসে বলে। হায়রে পুত কি মেয়ে আনছো ঘরে। খাইয়ে পড়িয়ে কাল সাপ পুতেছি ঘরে। তোর অসুস্থ বোনটার জন্য আনা দুধ তোর বউ খেয়ে ফেলছে। হায় রে আমার মেয়েটাকে কত হিংসা করে।
সজীব কথাটা শুনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আন্নির দিকে তাকায়। আর বলে এসব কি আন্নি?কথা সত্য?
___হুমম সত্যি আমার অনেক দুধ খেতে ইচ্ছে করছিল তাই আমি একটি কাপে দুধ ঢেলে খেয়েছি।
___তোমার এতো লোভ কেনো আন্নি? জিবনে কি দুধ চোখে দেখো নায়। আমার অসুস্থ বোন ওর এখন পুষ্টির প্রয়োজন। তুমি ছি আমি ভাবতেও পারি না।
___আমিও তো প্রেগন্যান্ট আমার কি পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন নাই? ডাক্তারি চেকাপের প্রয়োজন নাই? যত্নের প্রয়োজন নাই? আমি চাই বাবার বাড়ি যেতে আমার আর রান্নাবান্না করতে ভালো লাগে না। আমার শরীর চলে না আর।
আলিয়া বেগম ততক্ষণাত বলে উঠে নাহ আমরা বাচ্চার মা হই নাই। আমরা বাচ্চা পেটে থাকতে কাজ করি নাই?ছেলে মেয়ে দুইটা যে হইছে কত কাজ করেছি তার হিসেব নেই। তোমার মত সারাদিন খাই খাই নাই।
___ আমি খাই খাই করি? আগের কথা বাদ দিলাম প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে দুধ,ডিম,মাছ, কিছু কি আমার সামনে দিছেন? তিন চার মাসের সময় খাবারে গন্ধ পেতাম খেতে পারতাম না।আবার যা খেতাম বমি করে ফেলে দিতাম।তাও কখনো আমার পছন্দ অনুযায়ী খাবার দেওয়ার চেষ্টা করছেন? প্রেগন্যান্ট তো আপনার মেয়েও তো আপনার মেয়েকে আপনি বাড়িতে নিয়ে আসছেন যত্ন করার জন্য আমার মা যখন নিতে চায় আপনি কেনো যেতে দেন না? আপনার মেয়ের যত্নের প্রয়োজন। ঘরের বউয়ের যত্ননের প্রয়োজন নেই। ঘরের বউরা অসুস্থ হয় না?
___আন্নি বেশি হয়ে যাচ্ছে,চুপ করো মায়ের সাথে এভাবে তর্ক করে কথা বলবে না। আর মানুষ এসব শুনলে কি ভাববে? এই অবস্থায় তুমি আমাকে গায়ে হাত তুলতে বাধ্য করো না।
___ হ্যাঁ, আমি বললে বেশি হয়ে যায়? তোমার সন্তান আমার পেটে তোমার কি একদিনও মনে হয়নি আমার সন্তানের পুষ্টির প্রয়োজন আমার স্ত্রী পুষ্টিকর খাবার খেলেই আমার সন্তান পুষ্টি পাবে? তোমার সন্তানের জন্য তোমার কি একটুও মায়া হয় না? মামা হবে সেই আনন্দে বোনের সেবা যত্ন নিচ্ছ, বাবা হবে সেই আনন্দ হয়না? এর জন্য আল্লাহ হয়ত এতোদিন আমাকে সন্তান দেয়নি কারন ও পৃথিবীতে আসার আগেই বৈষম্যের শিকার হবে।
তোমার মা আবার বলেন সন্তান অসুস্থ হলে আমার রক্তের সমস্যা তাই হবে। তোমার বোনকে এই পাচঁ মাসে কতবার চেকাপ করিয়েছ? আর এই আট মাসে নিজের সন্তান পেটের মধ্যে কেমন আছে জানার চেষ্টাও করোনি। তোমার বোন বলে দুধের লোভ আমি সামলাতে পারি না। তোমার বোন তো রেগুলার দুধ পান করে কই একদিন তো বলেনি ভাবি তুমিও তো অসুস্থ আজ দুধটুকু তুমি খাও। এমন সময় গেছে দুধ পঁচে গেছে খেতে পারেনা দেখে তাও আমাকে দেয়নি। এই যে দেখো আজকে মাছ রান্না হয়েছে দুপুরে আমি ভাত খেতে পারিনি তাই মাছ খায়নি ভাবছি খুদা লাগলে খাবো। সন্ধ্যায় ভাত খেতে এসে আমার খুব দুধ খেতে ইচ্ছে করে। তাই কাপে একটু দুধ ঢেলে খাই। এতেই তোমার মা আমাকে অনেক গালাগালি করেন। অনাগত বাচ্চাকে অভিশাপ দিয়েছেন৷ এখন দেখো ওনারা জানে আমি মাছ খায়নি তাও আমার জন্য এইটুকু মাছ রেখেছ। এই যে পাঁচ বছরের সংসার জীবন যাই হয়ে যাক আমি কখনো কি তোমার কাছে অভিযোগ করেছি? বলতে পারবে কখনো খাবার নিয়ে ঝগড়াঝাটি করেছি?বাচ্চা হয়না তা নিয়েওনকম যাতনা দাওনি, কম কথা শুনিনি। তুমি কখনো এসবের খোজ নেওনি। অনেক মানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আমার বাচ্চাকে মানিয়ে নিতে বলতে পারব না। এটা আমার শত সাধনার বাচ্চা। রবের দেওয়া আমার প্রতি বিশেষ নেয়ামত।
হাস্যকর বিষয় এটাই যে তোমার টাকার কেনা ডিম,দুধ,ফল তোমার বউ বা সন্তান কিছুই পায়না। আর তুমিও চাওনা তোমার সন্তান ভালো থাকুক।তার চেয়ে বরং আমি চলে যাচ্ছি আমার সন্তান নিয়ে। তুমি তোমার বোনের দিকে খেয়াল রাখো। এবং বোনের সন্তান কে মানুষ করো।
এটা বলে আন্নি কান্না করতে করতে রুমে যায়। এবং ওর মা কে ফোন দেয় সকালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

সজীব চুপ করে চেয়ারের উপর বসে আছে।খাবার আর গলা দিয়ে নামে না। সজীবের মা বলে তুই খেয়ে ওঠ আর তোর বউ সত্যি যদি ঘর থেকে বের হয় আমি কিন্তু আর ঘরে তুলব না।
___ মা তুমি এখন এখান থেকে যাও।আন্নি আমার বউ ওর বিষয়টা আমিই দেখব তোমাদের থেকে যেনো কোনো কথা আমি না শুনি।

সজীব খাবার রেখেই রুমে যায়। খুব লাউডলি বলে তোমার ব্যাগ পত্র যা আছে সব গুছিয়ে নেও৷ এখনি তোমার বাবার বাসায় যাবে।
___এতোটাও নির্দয় হয়েও না। সকাল হলে আমার মা এসে নিয়ে যাবে। বাচ্চার জন্য চিন্তা করে আমাকে রাতটুকু সময় দাও তোমাদের আর কষ্ট দিব না৷ রাত এখন সারে দশটা বাজে দয়া করো।
___দশ মিনিট সময় দিচ্ছি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে রেডি হও পরে যা লাগে আমি গিয়ে দিয়ে আসব। আমি গাড়ি খবর দিচ্ছি তুমি রেডি হও।
আন্নি ভয়ে ভয়ে কাপর গুছিয়ে রেডি হয়ে নেয়। আন্নি আবারো বলে চলে যাবো তো বলছিলাম তাই বলে রাতেই তারিয়ে দিবেন।

সজীব প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলে চুপ! এতক্ষণ অনেক কথা শুনেছি আর কিছু শুনতে চাই না। মা কোথায় আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি তুমি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াও। সজীব আলিয়া বেগমের কাছে গিয়ে বলে মা ঘরে এতো অশান্তি আমার ভালো লাগে না৷ আমি এখনি আন্নিকে দিয়ে আসতে যাচ্ছি।
___আমরা কি করলাম তোর বউয়ের চোপা দেখছিস?তোর বোনকে ও হিংসা করে চলে।
___ হইছে যাই হোক আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আমি কোনো অশান্তি চাই না৷

সজীব আন্নিকে নিয়ে শশুর বাড়িতে পৌঁছে আন্নির মাকে বলে এই নিন আপনার মেয়ে। দিয়ে গেলাম মেয়ের পেটে আমার সন্তান যতটুকু পারেন যত্নে রাখবেন। আন্নির মা বলেন তাই বলে তুমি মেয়েকে নিয়ে এতো রাতে আসবে? পোয়াতি মেয়ে রাস্তায় বসে নজর লাগলে? সকালে গিয়ে আমি নিয়ে আসতাম।
___আল্লাহ ভরসা। আসার সময় শরীর বন্ধ করে নিয়ে এসেছি। আমার মনে হয়নি এই অবস্থায় আপনার মেয়েকে আমাদের বাড়িতে রাখতে।
কিছুক্ষন পরে আলিয়া বেগম সজীবকে ফোন দিয়ে বলে কিরে পৌঁছে গেছিস?
___হ্যাঁ।
___গাড়ি তো রিজার্ভ নিয়েছিস ঐ গাড়িতে তুই এসে পরিস। থাকার দরকার নেই।
___নাহ আমি এখানে দুই দিন থাকব। আমার এখানে কিছু কাজ আছে শেষ করে বাড়িতে যাব। তুমি চিন্তা করো না।
আন্নি সজীবের থাকার কথা শুনে থ হয়ে আছে। সজীব এটা কি বলছে ও সত্যি থাকবে এখানে? তাও আবার মায়ের অনুমতি ছাড়া? দুইবছর ধরে তো আমাদের এখানে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিল।
আন্নি খুশি হয়ে বলে সত্যি তুমি এখানে দুইদিন থাকবা?
___কেনো সমস্যা হবে তোমাদের?
___ না মানে বিশ্বাস করতে পারছি না।
___হ্যাঁ, থাকব প্রয়োজনে বেশিও থাকতে পারি।মাঝে মধ্যে এসে তোমাকে দেখে যাব।
আন্নি সজীবকে জড়িয়ে ধরে বলে সত্যি আমি ভাবি নাই তোমার মনে এমনটা ছিল আমি ভেবেছিলাম তুমি রাগ করে আমাকে রেখে যাচ্ছ।

___যাইহোক আমাকে কিছু খেতে দাও। না খেয়ে চলে এসছি।
এদিকে আন্নির মা জামাই অনেকদিন পর বাসায় আসায় ঝটপট নাস্তা তৈরি করে ফেলেন। সেগুলোই আন্নির ছোট ভাই সামনে এনে দেয়।
ওদিকে আলিয়া বেগম চিন্তায় এপাশ ওপাশ করছেন ছেলে কেনো বউ নিয়ে শশুর বাড়িতে চলে গেল? ছেলেকে আবার যাদুটোনা করে কিনা৷ আবার কালকে থেকে এতো কাজ কিভাবে কি সামলাবেন। ওনার মাথায় কাজ করছে না৷

সকাল সকাল সজীবের ফোনে বীথি কল দেয়।ভাইয়া তুমি তারাতাড়ি বাসায় আসো। মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তারাতাড়ি আসো।
সজীব তড়িঘড়ি করে বাড়ি উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷আন্নি মলিন মুখে সজীবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবে তাহলে সজীবের আর থাকা হলো না___<_____ চলবে_____.