#অন্তঃকলহ
#ইসরাত_জাহান_এশা
#শেষ_পার্ট
আন্নি মলিন মুখে সজীবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবে তাহলে সজীবের আর থাকা হলো না? মনে মনে এই ভয়টায় পাচ্ছিল আন্নি এরকম আরো কয়েকবার সজীবকে কোনো না কোনো অযুহাত দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়৷
এদিকে সজীব বাড়িতে গিয়ে দেখে তার মা দরজার সিরির উপর বসে বসে পান চিবাচ্ছেন।
___মা তোমার কি হয়েছে। বীথি ফোন দিয়ে বলল অসুস্থ তুমি।
___ মায়ের প্রতি কি তোর খেয়াল আছেরে বাপ। রাত থেকে প্রেশার হাই হয়ে গেছে। একটুও ঘুমাতে পারিনি মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রানটা চলে গেলো। তুই কি আর এসব বুঝবি।
___প্রেশার তো তোমার প্রায় প্রায়ই হয়। কতদিন পর শশুর বাড়ি গেলাম এত তারাহুরো করে না ডাকলেও পারতে। আমি কিভাবে আসছি জানো? তোমার অসুস্থতার কথা শুনে এক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়াইনি।
___ভুল হয়ে গেছে বাপ।তোরে না দেখলে শান্তি পাই না যে। তোকে দেখে আমার কি যে শান্তি লাগছে। তোর বউটা বুঝলা না। ননদের সাথে হিংসা করে তোকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে সেই বাপের বাড়িতে গেলোই৷ বুঝি না আমি সবকিছু হলো কাজ না করার বাহানা।
___মা বাদ দেও না এসব কথা। কথা বললেই কথা বাড়ে। আর ওর পেট কতবড় হইছে দেখছ? এ সময় কাজ করতে গিয়ে ও হাপিয়ে যায় ও বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত রেষ্ট করুক।
___তাহলে তুই বউ আর বাড়ি আনবি না? এই অসুস্থ মা কে খাটাবি?
___তুমি খাটবে কেনো? আমি কাজের লোকের ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।
___ কাজের লোকের হাতে খাবার আ্যাহ আবার মাস শেষে কতগুলো টাকা বেতন দিতে হবে।
___ কি করবা মানাই নাও।
___ আচ্ছা কি আর করার তোরা যা ভালো বুঝো, মা বললে মায়ের কথা যে শুনবি সেই যুগ কি আর আছে। যাকগে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা কর,তারপর অফিসে যা।
___ না মা অফিসে যাব না ছুটি নিয়েছি দুইদিনের আন্নির কাছে যেতে হবে। ভাবছি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব৷
আলিয়া বেগম ছেলের কথা শুনে ভিতরে কষ্ট পেলেও আর কথা বাড়ায় না। কারন উনি জানেন এখন ছেলেকে কিছু বললেই হিতে বিপরীত হবে।
সজীব নাস্তা শেষ করে আবারো আন্নিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেন।
___মা আমি গেলাম। নিজের খেয়াল রেখো বিথীর খেয়াল রেখো। টেনশন করে নিজের শরীর খারাপ করো না।
সজীব আসার পথে ডাক্তারের সিরিয়াল ঠিক করে। আন্নির জন্য নানা রকম ফল,ফ্রুটস আন্নির পছন্দের জিনিস নিয়ে আসে। সাথে এ সময় পড়ার জন্য আরাম দায়ক কিছু কাপড় চোপড়।
সজীবকে দেখে আন্নি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে।
___কিরে তাকিয়ে আছো কেনো?
___সত্যি তুমি আসছ! নাকি আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি? আবার সাথে ভ্যান ভর্তি বাজার।
___মশকারি করনা না তো। দুপুরের খাবার রেডি করো গিয়ে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। আর হ্যাঁ সন্ধায় ডাক্তারের চেকাপে যাবো।
আন্নি সজীবের কথা শুনে বলে ইয়া আল্লাহ! এটা কি সত্যি আমার স্বামী?বাচ্চাটার উসিলায় তুমি যে আমার দোয়া কবুল করছ তোমার কাছে শুকরিয়া
আন্নি সজীব কে খাবার দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে মায়ের কি অবস্থা?
___ ভালোই আছেন। প্রেশার বেরে গেছিলো।
___আচ্ছা একটা কথা বলি রাগ করো না। জাস্ট জানার জন্য। তোমার মাঝে হটাৎ এমন পরিবর্তন মানে আমি যত তোমাকে দেখছি ততই অবিশ্বাস হচ্ছে।
___ জানিনা কি হয়েছে কিন্তু কালকে থেকে আমার ভিতরে অপরাধ বোধ কাজ করছে। আমার অনাগত সন্তানের মায়া আমাকে যেনো এক সুন্দর অনুভূতি দিচ্ছে। আমি কখনো এমন মিস্টি অনুভূতি অনুভব করেনি। বার বার আমার মনে হচ্ছে আমার স্ত্রী যার সাথে একই ঘরে পাঁচ পাঁচটি বছর সংসার করে যাচ্ছি। যার পেটে আমার ওরস জাত সন্তান তার এক কাপ দুধ খাওয়া নিয়ে এতো কথা তৈরি হতে পারে?
সে কি এতোদিনে এককাপ দুধ খাওয়ার অধিকার অর্জন করতে পারেনি?
আন্নি সজীবের কথা শুনে কান্না করে উঠে আমি কখনো কল্পনাও করিনি আমার জীবনে এমন একটা দিন আসবে। আমার স্বামী আমাকে নিজে থেকে বুঝতে পারবে।
___বাদ দাও আমারই ভুল ছিল তোমার নিরবতাকে আমি ভেবেছিলাম সবই ঠিক আছে কিন্তু যা হয়েছে সেটা আমার কল্পনার বাইরে৷ তবে যাই হোক মায়ের সামনে ওনার বিরুদ্ধে আমি যেতে পারব না।উনি যতদিন বেঁচে আছেন উনি ওনার মত থাকুক যা খুশি করুক কোনো অশান্তি চাই না। তোমার সমস্যা হলে আমাকে বলবে। কিন্তু আমি যেন এমন কোনো কম্পেলেন শুনি না৷ যেখানে মা, বাবার তর্কাতর্কি হয় তাদের থেকে আমাকে আলাদা হতে হয়। অনাগত সন্তানের ভালোর মন্দের জন্য সুস্থ পরিবেশ দেওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করব।
___ তুমি চিন্তা করো না৷ আমি পাঁচ বছরে কোনো কম্পেলেইন তোমাকে করিনি পরবর্তীতেও করব না। কিন্তু আমার বাচ্চার জন্য যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পিছ পা হব না৷
___ঠিক আছে।
সন্ধ্যার পরে আন্নি আর সজীব ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার জানায় বাচ্চা সুস্থ আছে। তবে ব্লাড কম এর জন্য ব্লাডের ইনজেকশন পুশ করতে হবে। আর রক্ত হয় এমন সব খাবার খেতে হবে। সাথে এই আয়রন, ক্যালসিয়াম এগুলো যেনো কোনো ভাবে বাদ না যায়।
___আচ্ছা, ডাক্তার সাহেব ছেলে হবে না মেয়ে হবে?
___এটা তো বলা নিষেধ,
___ তবুও বলেন প্রথম বাচ্চা তো পিতা হিসাবে জানার প্রবল আগ্রহ।
___ আপনার কন্যা সন্তান হবে ইনশাআল্লাহ।
___আলহামদুলিল্লাহ ।
পাশ থেকে আন্নি বলে খুশি তুমি?
___অবশ্যই! কেনো নয়,আল্লাহ দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বাবা হওয়ার খুশি অনুভব করাচ্ছেন। এটাই অনেক বড় কিছু, সন্তান যাই হোক সুস্থ হলেই হবে।
সজীব চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আলিয়া বেগম কে ফোন দিয়ে বলেন মা আলহামদুলিল্লাহ আমাদের ঘরে কন্যা সন্তান আসবে।
___কি মেয়ে বাচ্চা?
___ কেনো তুমি খুশি না মা?
___ না না খুশি, খুশি।তা তুই বাড়ি আসবি না?
___কালকে আসব। রাখি এখন নিজের খেয়াল রেখো।
এভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে যায় সজীব আন্নিকে মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায় প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়ে যায়।মাঝখানে শাশুড়ী ননদের সাথেও সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।আন্নির যখন সারে নয় মাস তখন আলিয়া বেগম আন্নির কাছে ফোন দিয়ে বলেন সেই তো মেয়ে সন্তাননি হবে আবার লাফাতে লাফাতে সিজার করতে ঢুকে পরো না৷ তোমার যে অবস্থা ন্যাকামির তো শেষ নেই। আরাম করার জন্য সংসার ফেলে বাপের বাড়িতে উঠছ। আমার ছেলের মাথা তো পুরাই খাইছ। আমি যেনো শুনিনা সিজার লাগবে সিজারের মানুষ বেশি কাজ কাম করতে পারে না৷ এমনিতেই তুমি বাবার বাড়িতে যাওয়ায় এক্সট্রা লোক রেখে কাজ করিয়ে অনেক পয়সা খরচ হচ্ছে।
___ মা ইচ্ছে করে কি সিজার করে কেউ? যদি আল্লাহর রহমতে সব ঠিক থাকে তাহলে তো আর সিজারে যাব না।
___ তোমার যে আরামের শরীর তুমি নাচতে নাচতে সিজারে যাবে।
আন্নি আর কথা বাড়ায় না। পাঁচ ছয় দিনের মাথায়ই আন্নির ডেলিভারি পেইন শুরু হয়। সজীব শুনে আলিয়া বেগমকে সাথে নিয়ে আন্নিদের বাসায় আসে। সজীব চায় আন্নিকে হসপিটাল নিতে। কিন্তু আলিয়া বেগম ছেলেকে ধমক দিয়ে বলেন ব্যাথা তো উঠেই গেছে এখন আর হসপিটাল নিয়ে কি হবে? এখানেই হয়ে যাবে এতো অস্থির হস না৷ আমরা আছি না।
আন্নির শাশুড়ীর কথা মত অপেক্ষা করতে করতে পুরো একদিন কেটে যায় কিন্তু বাচ্চা ডেলিভারি হয়না। আন্নির অবস্থাও ক্রমশ দুর্বলের দিকে।
আন্নির মা মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলেন অনেক হয়েছে কি শুরু করছেন আপনারা? আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চান এখখুনি ডাক্তারের কাছে নিবো। আপনাদের আমার মেয়ের অবস্থা দেখে খারাপ নাই লাগতে পারে কিন্তু আমি মা হয়ে মেয়েকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে যেতে দেখতে পারছি না।
___কি যে বলেন বেয়ান ব্যাথা তো আছে হয়ে যাবে বাচ্চা। হসপিটাল নিলেই সিজার করাবে।
সজীব তৎক্ষনাৎ বলে উঠে সিজার হলে হবে আরো অপেক্ষা করলে মা ও শিশুর ক্ষতি হতে পারে। এখুনি হসপিটাল যাব আর অপেক্ষা করা যাবে না।
আলিয়া বেগম দেখেন কেউ আর ওনার কথার গুরুত্ব দিচ্ছে না।তাই উনিও আর কিছু বলেন না।
সরকারি হসপিটালে নেওয়ার সাথে সাথে আন্নিকে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো হয় সাথে ব্যাথা বাড়ানোর ইনজেকশন। ডাক্তার বলেন ব্যাথা উঠছে একদিন হয়ে গেছে আপনারা এখন এসেছেন?হসপিটালে আসতে আরেকটু দেড়ি হলে মা বাচ্চা দুজনকে বাচাঁনো রিক্স হয়ে যেতো। বাচ্চার ওয়েট বেশি নরমালে আসবে তবে সাইড কাটতে হবে। আর রোগী প্রচুর দুর্বল হয়ে গেছে। প্রায় ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে আন্নির ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। তবে আন্নির অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায় ফিস্টুলা দেখা দেয়।যা আন্নির প্রাইভেট পার্ট ছিড়ে যাওয়ার কারনে মলদ্বার এবং মুত্রনালীর মধ্যে একটা রাস্তা তৈরি হয়ে যায়।
আন্নির জন্য এমন একটি সময় ছিল একটি মেয়ের জীবনে প্রসবের তিক্ত অভিজ্ঞতা কখনো ভুলতে পারবে না।যখনি আন্নি ওয়াসরুমে যেত ব্যাথা প্রতিবার চিৎকার করে কান্না করত। মনে হচ্ছে প্রান বের হয়ে গেলেই বেশি শান্তি পাইত।
প্রায় পনেরো দিন আন্নি এভাবে যন্ত্রণার মধ্যে যায়৷ তবে দুই মাসের মধ্যে আন্নি আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে উঠে। আন্নির শাশুড়ী আন্নিকে বাড়িতে আসার জন্য চাপ দিতে থাকে। আন্নিও সুস্থ হওয়াতে বাড়িতে চলে যায়। আবারো শুরু হয় বাচ্চা নিয়ে সংসারের সংগ্রাম তবে এবার সজীবও চেষ্টা করে আন্নির কষ্ট যেনো কম হয়। কিন্তু মায়ের কোনো কিছু তেমন ভাবে প্রতিবাদ করে না। সজীব সব সময় আন্নিকে বলে কি করবে মা তো সহ্য করে নাও।
দেখতে দেখতে বিথীর ডেলিভারি ডেইট ওভার হয়ে যায় কিন্তু ব্যাথা আর উঠে না। ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার বলেন বাচ্চা ভিতরে নার পেচিয়ে উল্টে আছে ইমিডিয়েট সি-সেকশনে যেতে হবে। সিজারের মাধ্যমে বিথীর ছেলে হয় কিন্তু অনেক অসুস্থ সাথে সাথে বেবীকে এনআইসিউতে রাখা হয়। পনেরো দিনের দোর ঝোপের পর বিথীর বাচ্চাটা সুস্থ হয়। যা আন্নির কাছে রাখা হয় আন্নি বাচ্চাকে নিজের দুধ খাওয়ায়।কিন্তু বিথীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয় সেলাইয়ের জায়গা বার বার ইনফেকশন হয়ে পরে। যার কারনে আলিয়া বেগমের দুই মাসের মতো মেয়ের সাথে হসপিটালে থাকতে হয়। তারপর অনেক শর্ত দিয়ে ডাক্তার বাড়িতে পাঠায়। বিথীকে খুব ছয়-সাত মাস রেস্টে রাখা হয়। মেয়ের এমন অবস্থায় আলিয়া বেগম খুবি ভেংগে পরেন। শারীরিক ভাবেও দূর্বল হয়ে পড়েন।
আলিয়া বেগম আন্নিকে গিয়ে বলে তোমার কারনেই আজ এতোদূর তুমি আমার মেয়েকে অনেক হিংসা করতে। তোমার বদ-নজরে আমার মেয়েটা এতো কষ্ট পাচ্ছে। খুশি তো তুমি এবার?
আন্নি অসহায়ের মত মুখ করে আলিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মুহুর্তে কোনো উত্তর নেই আন্নির কাছে।
(সমাপ্ত)