অন্তঃপুরের দহন পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0
289

#অন্তঃপুরের_দহন (পর্ব-২৪)

#আরশিয়া_জান্নাত

হ্যালো অন্তরা কি হয়েছে বলবি তো, এভাবে কাঁদছিস কেন? আমর কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে,,,

অন্তরা কান্নার তোপে হিচকি তুলতে তুলতে বললো, পাখি উনি স্ট্রোক করেছেন। উনার অবস্থা ভালো না,,

নাহিদ ভাইয়ের কথা বলছিস?

হুম।

তুই এখন কি ঠিক করেছিস? যাবি ওখানে?

আমার কিছু ভালো লাগছেনা পাখি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কি করবো বল তো?

পাখি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, যে আমাদের ভালোবাসে, দোষগুণ মেনে নিয়েই ভালোবাসে। তাকে কখনো পায়ে ঠেলতে নেই ময়না। নাহিদ ভাই তোকে কতটা ভালোবাসেন তা আমরা সবাই জানি। তুই নিজের সাথে ঘটা দূর্ঘটনার জের ধরে সবচেয়ে বেশি কষ্ট কাকে দিয়েছিস জানিস? নাহিদ ভাইকে। আমার মনে হয় তোর উনার কাছে যাওয়া উচিত। উনি তোর শোকেই এমন ভুগছেন,

আমি কি করবো বল? সে অনেক মহান পাখি। আমার মতো অপবিত্র মেয়ে সে ডিজার্ভ করেনা।আমি তাকে অনেক ভালোবাসি পাখি আর ভালোবাসি বলেই নিজেকে ঘৃণা লাগে।

তুই ভুল ভাবনাতে আছিস। উনার কাছে তুই আগের অন্তরাই আছিস। আর কিছুই তার মনে দাগ কাটেনি। তুই জানিস যখন তুই হসপিটালে ছিলি আমরা তার অনুপস্থিতি দেখে কত কি ভেবেছিলাম। কিন্তু সে আমাদের অনুমান ভুল প্রমাণ করেছে। দিনরাত শুধু বলেছে তোকে ভালো রাখতে। তোর পাশে থাকতে।
যতো রাত তুই নির্ঘুম ছিলি তার চেয়ে অধিক রাত ভাইয়া নির্ঘুম কাটিয়েছে। তোর বন্ধ দরজার সামনে বসে কত চোখের পানি ফেলেছে তুই জানিস না। তবুও তোকে জোর করে নি, তুই ভালো থাক এটাই তার কাছে মুখ্য। এখন তুই ই বল এমন মানুষের বিপদের দিনে তোর উপস্থিতি কেমন প্রভাব ফেলবে? উনি তোকে Peace of mind বলে। তুই আর দেরি না করে চলে যা। আঙ্কেল আন্টি যখন তোকে সঙ্গে নিতে চাইছে অমত করিস না আর।

অন্তরা চোখ মুছে বলল, হ্যাঁ আমি যাবো। আমার যেতেই হবে।

পাখি ম্লান হেসে মনে মনে বলল, আল্লাহ আমার বান্ধবীটার জীবনটায় এবার সুখ দাও। নাহিদ ভাইয়ার যেন কোনো ক্ষতি না হয়,,,

নাহিদের যখন জ্ঞান ফিরলো সে দেখল একটা নারীমূর্তি তার বেডের পাশে হেড ডাউন করে বসে আছে, নাহিদের মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। নিউইয়র্কে অন্তরা আসবে কোত্থেকে? সে কি অন্তরার কল্পনাতে এতোটাই বিভোর যে হসপিটালেও অন্তরাকে দেখছে!
অন্তরা মাথা তুলে চাইলো নাহিদের দিকে, কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে রাখা মেয়েটাকে দেখে নাহিদের বুক খাঁ খাঁ করে উঠল যেন। আহারে অন্তরা তোমার কান্না দেখে দেখে এমন হাল হয়েছে, আমার ইমাজিনেও তুমি কাঁদছো? সেই যে বহুদিন আগে হাসি দেখেছিলাম সেটা বুঝি মরার পরো দেখা হবেনা।

অন্তরা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, কান্নার শব্দে নাহিদ হকচকিয়ে উঠলো। সত্যিই অন্তরা এসেছে, কি করে সম্ভব?

অন্তরা নাহিদে হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এ কি হাল করেছেন আপনি? এভাবে কেউ হসপিটালে পড়ে থাকে? নিজের প্রতি এতো অবহেলা আপনার? একটাবার ভাবলেন না আপনার কিছু হলে আমার কি হতো? এতো সেলফিশ আপনি!

নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলল, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি আত্ম*হননের চেষ্টা করেছিলাম! অসুখ বিসুখ তো মানুষের হবেই নাকি?

না হবে না। আপনিই যেচে অসুখ এনেছেন। সব দোষ আপনার।

নাহিদ মুচকি হাসলো। এই মুহূর্তে কেউ যদি তাকে গলায় ছুরি ধরেও বলে অন্তরা তাকে ভালোবাসেনা, ও বিশ্বাস করবেনা। এই মেয়ে শুধু নাহিদকেই ভালোবাসে আর কাউকে না,, একদমই না।


ওমর কল করে বলল, মা আন্টিরা চাইছেন এখানেই বিয়েটা সেরে ফেলতে, তুমি কি বলো?

ওনারা যা ভালো মনে করেন তাই করুক। তুই তো আছিস ই ওখানে। সবটা সামলে আয়।

তুমি চাইলে দেশে ফিরে,,

সে পরে দেখা যাবে, দেশে আসলে বড় করে অনুষ্ঠান করবো। এখন ছেলেটার মন শান্ত করতে হলেও বিয়েটা পড়া।

আচ্ছা।

শামীমা শোকরানার নামায আদায় করলেন। যাক অবশেষে অন্তরার মন ফিরল।

বিয়ের যাবতীয় ফর্মালিটিস ভিডিও কনফারেন্সে পাখি, আরোহী সহ কাছের সকলেই দেখলো। পাখি আর আরোহী মুখে হাসি আর চোখে জল নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল। অবশেষে এই দুজনের সন্ধি ঘটলো! শামীমা একটু পরপর চোখের পানি মুছছেন, তাইয়্যেবা তাকে জড়িয়ে রেখে সেও কাঁদছে। মনসুরা খালাও বলে উঠলেন, আল্লাহ আমাগো মাইয়াডারে সুখী করুন।
এতকিছুর মাঝে একজনকে খুব মনে পড়ছে অন্তরার। হ্যাঁ তাঁর বাবা অনীল! যে মানুষটার জহুরী চোখ নাহিদকে খুঁজে বের করেছিল তার জন্য। তিনি তার মেয়ের জন্য সেরা মানুষকেই পছন্দ করেছিলেন। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে খুশি তিনিই হতেন। বাবার কথা মনে পড়তেই চোখের কোণটা ভরে এলো তার। নাহিদ রুগ্ন ধীর গলায় বললো, আজকেই যত পারো কেঁদে নাও। এটাই শেষ কান্না হোক। আজকের পর কান্না তোমার জন্য নিষিদ্ধ এই আমি বলে দিলাম।
অন্তরা নাহিদকে জড়িয়ে ধরে ম্লান হাসলো।

পরিশিষ্ট:ওমরের উন্মুক্ত বুকের প্রতিটি ক্ষততে চুমু খাওয়া তাইয়্যেবার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ওমর হেসে বলে রোজ তোমার এই কাজটা করতে হয় কেন বলো তো?
তাইয়্যেবা তার বুকে নাক ঘষে বলে, তুমি আমার আমানতে ঘৃণায় যে আচড় কেটেছ, ক্ষতবিক্ষত করেছ। সবটা আমি ভালোবাসার স্পর্শে মুছে ফেলার চেষ্টা করি। আমার মনে হয় এতে তোমার বিষন্নতা শুষে নিচ্ছি। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম কত কষ্ট পেয়েছি জানো? সেদিনই পণ করেছি এই মানুষটাকে আমি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালোবাসবো। তার কষ্টের প্রতিটা কণার অংশীদার হবো।
ওমর তাইয়্যেবাকে পাশ ফিরিয়ে শোয়ালো। তাইয়্যেবার মুখের উপর থেকে এলোকেশ সরিয়ে বললো, আমার বুকে উথাল পাতাল ঝড় তোলার শব্দগুচ্ছ কোথায় পাও তুমি বলবে?
তাইয়্যেবা ওমরকে টেনে বুকের মাঝে রেখে বললো, এই যে এখান থেকে।
ওমর গভীর করে শ্বাস নিলো, দুজনের নিঃশ্বাস গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। ওমর নতুন করে আবারো হারিয়ে গেল তাইয়্যেবার মাঝে।

দাদীমা দাদীমা, ফুপ্পী কখন আসবে বলো তো? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।

শামীমা রান্নার তদারকি করতে করতে বললো, এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। একটু শান্ত হয়ে বস তো।

ওহী অস্থিরভাবে এ ঘর ও ঘর পায়চারী করতে লাগল। ওমর মেয়ের অস্থিরতা টের পেয়ে বললো, কি হলো আমার ছোট মায়ের? ফুপ্পীর অপেক্ষায় আছে বুঝি?

আর বলো না বাবাই, ফুপ্পী আসবে এটাতে যতোটা মজা লাগছে তার চেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে এইটুকু বাবুটাকে কোলে নিয়ে আসতে পারবে তো? তুমি তো জানো না বাবাই বাচ্চা কোলে নেওয়া কত্ত কঠিন।

ওমর মেয়ের মুখের সিরিয়াস ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল। কত রাজ্যের চিন্তা উনার যেন একদম পাকা বুড়ি। ওহী চোখ বড় বড় করে বলল, বাবাই আমি চিন্তায় মরে যাচ্ছি আর তুমি হাসছো?

ওমর ওহীকে কোলে তুলে বললো, তোমার ফুপ্পী আর নাহিদ আঙ্কেল আছে তো সাথে। উনারা ঠিক তোমার বাবু ভাইয়াকে সাবধানে আনবেন।
তখনই অন্তরা আর নাহিদ বাড়িতে প্রবেশ করলো। ওহী দৌড়ে গিয়ে ফুপ্পীকে জড়িয়ে ধরলো। কতক্ষণ লাগে তোমাদের বাপু? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি, বয়স হচ্ছে তো নাকি? এতো চিন্তা নেওয়া যায়? আম্মু, দাদীমা কোথায় তোমরা। দেখো আমার ভাইয়া এসে গেছে।

অন্তরা হেসে ওহীর গালে চুমু খেয়ে বলল, আমার আম্মুটাকে অপেক্ষা করানোর জন্য এত্তগুলো সরি।

ওহী অন্তরার গলা জড়িয়ে বললো, সরি বলতে হবেনা ফুপ্পী, আমার ভাইয়াকে এনেছ এতেই আমি অনেক খুশি। আঙ্কেল বসো না সোফায় ভাইয়াকে দেখি,, নাহিদ সোফায় বসে বাবুটাকে দেখালো। ওহী আলতো করে চুমু খেয়ে বললো, আমার ভাইয়া। আমার টুকুটুকু পুকুপুকু ভাইয়া। ভাইয়া দেখো আপু আছি না এদিকে, তাকাও,,

ওর বাচ্চামো দেখে সবাই হাসতে লাগলো।

#সমাপ্ত