#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২.
মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আসিফা আর মাহমুদের এই ঝগড়া, চিৎকার চেঁচামেচি নিত্যকার ঘটনা। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখে যাচ্ছে সে। তবু আজও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। আজও পারেনি বিষয়টাকে মেনে নিতে, স্বাভাবিক ভাবতে। ফলে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই সেই ঘটনা তার নতুন দিনের শুরুটায় যেন এক পোচ কালি মেখে দিলো। রাফি চোখ বন্ধ করলো। এসব কি তার দৃষ্টির আড়ালে হতে পারে না?
গাড়িটা অনেক্ষন যাবৎ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একবার পেছন ফিরে রাস্তাটা দেখল রাফি। পেছনে ফাঁকা হলেও সামনেই এই জ্যাম কবে যে ছাড়বে তার ঠিক নেই। একবার ঘড়ি দেখে সে ড্রাইভারকে বলল, “জাফর গাড়ি ঘোরাও। মিহাদকে দেখে আসি।”
রাফির চেয়ে কয়েক বছরের ছোট যুবক জাফর সাথে সাথেই আশপাশ দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললো। দ্রুত ঢুকে গেলো হাতের ডানে চলে যাওয়া বাইপাস রাস্তায়। ছুটলো মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত কেয়ার সেন্টারে।
。。。。。。。。。
পাঁচতলা এই ভবনের পুরোটা জুড়েই “রোদ্দুর” এর অফিস। তাদের কাজ মূলত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে। আবাসিক, অনাবাসিক দুই সিস্টেমই চালু আছে। ফলে অনেকেই এখানে বাচ্চাকে রেখে যান। অনেকে আবার শুধু স্কুল হিসেবে ব্যবহার করেন।
মিহাদ এখানকার সার্বক্ষণিক বাসিন্দা। শরীরের বয়স চৌদ্দ হলেও মন, মস্তিষ্ক পাঁচের পেরুতে পারেনি। ফলে উভয়ের সাংখ্যিক ভারসাম্যহীনতার ফলস্বরূপ তার বেশিরভাগ কাজ উল্টোপাল্টা ধরনের। জিনিসটা প্রথম ধরা পড়ে তার আট বছর বয়সে। আসিফা এবং মাহমুদ নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে সবসময়ই অখুশি ছিলেন। সম্পর্কের নকশাটা একটা জায়গায় এসে এলোমেলো হয়ে গেছে। নাবিলা, মিহাদ জন্ম নিয়েছে এসবের মাঝেই। সুসম্পর্ক কভু থেকে থাকলেও সেটা রাফির স্মৃতিতে নেই। তার আট বছর পর নাবিলার জন্ম এবং তারও সাত বছর পর মিহাদের। টানাপোড়েনের সম্পর্কের দেয়াল দুজনকে এমন যাঁতাকলে পিষ্ট করেছে যে দুজনেই সন্তানদের থেকে বহু দূরে সরে গেছে। রাফি চুপচাপ হয়ে গেছে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই। বোনকে সামলাতে শেখার পর থেকে তাকেও নিজের কাছে রাখতে শুরু করেছে। বাবা মায়ের যু’দ্ধের মাঝে থাকতে দেয়নি। কিন্তু মিহাদের বেলায় সব নিয়ম উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে। উদাসীন অভিভাবক দুজন সময় পেরিয়ে যাওয়ার তিন বছর বাদে বুঝতে পেরেছে তাদের ছোট ছেলে তখনও পাঁচের মায়া ছাড়তে পারেনি। বহু ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয় নি। জন্ম উপহারকে সঙ্গী করেই তাকে নয় বছর বয়সে এখানে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছে। যতোটা না মিহাদের জন্য তার চেয়ে বেশি বাড়ির মানুষের জন্য। চোখের আড়াল করে বিবেকের দংশন থেকে বাঁচার এক খুয়ের প্রচেষ্টা। ওর জন্য কিছু তো করেছি!
রাফি আরেকবার তাগাদা দিল। মিহাদকে ডেকেছে আরো অনেকক্ষণ আগেই। ছেলেটা এখনো আসেনি। রাফি নিশ্বাস ছাড়ল। সে কখনোই চায়নি ভাইকে নিজের থেকে এত দূরে রাখতে। বাবা মা বলেছে এতে নাকি মিহাদের ভালো হবে। সেই ভালোর জন্য তাকিয়ে থাকলেও এ পর্যন্ত চোখ পড়ার মতো কিছু দেখেনি রাফি। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে মিহাদের মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন দশটা কথার একটা উত্তর দেয় সে। সেই ছোট্ট বেলার মতো আর কথার ফুলঝুরি ছোটায় না। শিষ্টাচার শিখছে বোধহয়। কে জানে!
“তোমার ভাই ডাকছে। যাও যাও!”
কন্ঠ শুনে ঘুরে তাকালো রাফি। দেখা গেলো মিহাদকে। এক সপ্তাহের অদর্শনে মনে হচ্ছে ছেলেটা আরও লম্বা হয়েছে। ছেলেটা যেন ধেই ধেই করে বড় হয়ে যাচ্ছে।
মিহাদ এক পলক ভাইয়ের দিকে তাকালো। পরপরই চোখ নামিয়ে নিলো। তার চোখের ভাষা বুঝলো না রাফি।
“কেমন আছিস?” রাফি জিজ্ঞেস করলো।
মিহাদ কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ সামনের চেয়ারে বসলো। হাঁটার ভঙ্গিতে প্রকাশ পেলো অনিচ্ছা।
রাফি মিহাদের মাথায় হাত রাখতেই মাথা সরিয়ে ফেলল সে। রাফি রেগে গেলো, “অভদ্রের মতো আচরণ করছিস কেন!”
মিহাদ ভুরু কুঁচকে উষ্ণ চোখে তাকালো। রাফি দেখলো মিহাদের নাকের ডগা ফুলে উঠেছে। হেসে ফেলল সে। নরম কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে?”
মিহাদ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইলো। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ধবধবে সাদা টাইলসের উপরে।
“কথা বলবি না?”
মিহাদ এক ঝটকায় নিজের হাত থেকে ভাইয়ের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিলো। মুঠোয় থাকা তিন বাই তিনের রুবিক্স কিউবটা ছিটকে চলে গেলো ঘরের কোনায়। লাল সেন্টারের প্লাস্টিক খুলে গেল। বাঁধো বাঁধো কণ্ঠে মিহাদ বলল, “না না। বলব না। কে তুমি? কে কে? আমার কাছে এসেছ কেন?”
রাফি চুপ করলো। মিহাদ রাগ করেছে।
“এই এক সপ্তাহ অনেক ব্যস্ত ছিলাম। সত্যি বলছি।”
মিহাদ তাকালো না। তার ফোস ফোস নিশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কেবল।
“ভুল হয়ে গেছে মিহাদ। আর হবে না।” বিগলিত কণ্ঠে বলল রাফি। মিহাদ তবুও তাকালো না। রাফির বুকটা হু হু করে উঠলো। বাবার কথা মনে হলে তার মনটা বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। সারাদিন আড্ডা দিতে ব্যস্ত থাকে। বাড়িতে এসে মায়ের সাথে ঝগড়া করে। বাবা বেরিয়ে গেলে সেই ঝগড়া নিয়ে মা একাই গজগজ করেন। দুজনের কারোরই মাথায় নেই তাদের মমতার অভাবে মিহাদের ছেলেবেলা ঠিক কিভাবে কেটে যাচ্ছে।
রাফি এগিয়ে গেলো। দু’কানে হাত রেখে বলল,
“প্রমিস মিহাদ আর এতো দেরি করবো না।”
মিহাদ মাথা নিচু করেই আড়চোখে একবার দেখলো। রাফির সাথে চোখাচোখি হলে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। রাফি ঘরের কোনা থেকে রুবিক্স কিউব উঠিয়ে খুলে যাওয়া সেন্টার লাগিয়ে মিহাদের হাতে দিলো। সেটা নিলেও কিছু বলল না মিহাদ। রাফি বলল, “কথা বলবি না?”
“বুক ডন দিলে কথা বলব। পাঁচটা পাঁচটা বুক ডন দিতে হবে।” আঙ্গুলের কড় গুণে দেখালো মিহাদ। রাফি হেসে ফেললো। পরনের কোর্ট খুলে চেয়ারে রেখে বলল, “এক্ষুণি ইওর অনার!”
সাথে সাথেই পাঁচবার পুশ আপ করলো রাফি। মিহাদ খিলখিল করে হাসলো। সেই হাসি দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো রাফি। তার বাবা মা এসব কিছুই দেখলো না। তাদের চোখের আড়ালেই বড় হয়ে গেল মিহাদ। সত্যিই কি বড়?
মিহাদের চুলগুলো ঘাড় ছুঁয়েছে। সেগুলো নেড়েচেড়ে বলল, “কাটিস নি কেন?”
মিহাদ উত্তর দিলো না। কিউব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
রাফি ভাইয়ের মুখ ঘুরিয়ে ঘাড় নেড়েচেড়ে দেখলো। কোথাও কোনো দাগ না পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। তার কেবলই ভয় হয় মিহাদের বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে এরা না তাকে আবার মেরে বসে। যদিও এগুলো নিয়ম বিরুদ্ধ। তেমন বলেও সে শিশু নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিতে দুবার ভাববে না। কিন্তু তাতেই বা কি? মিহাদের শরীরে স্পর্শ করা ব্যাথা কি সে ফেরত নিতে পারবে? রাফির বড় দুশ্চিন্তা হয়।
“নাবিলা?” কিউব মেলাতে মেলাতেই বলল মিহাদ।
“ভালো আছে। বাসায় যাবি একদিন?”
“না না!” ঘন ঘন মাথা নাড়ল মিহাদ।
আগে মিহাদ সবার কথাই শুনত। বাবা, মা, দাদীমা, নাবিলা। কমতে কমতে এখন সেটা নাবিলায় এসে পৌঁছেছে। কি মনে করে রাফি বলল, “নাবিলা তোকে দেখতে আসে?”
মিহাদ কিউবে ব্যস্ত থেকেই ডানে বামে মাথা নাড়ল। রাফি মাথা নিচু করলো। যেদিকেই সে তাকায় সেদিকেই নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। পকেট ভরতি টাকা দিয়ে কিছুই করতে পারেনি। ব্যর্থতা শুধু সেই টাকার আড়ালে চাপা দিতে পেরেছে।
“শোনো শোনো!” রাফির কোর্টের কোনা ধরে টান দিলো মিহাদ। “আমাকে তিন কোনা একটা কিউব কিন দিতে হবে। এই যে এমন তিন কোনা। তিন কোনা।” হাত দিয়ে দেখালো সে।
রাফি বলল, “নাম কি?”
“নাম? নাম?” মিহাদের কপালে ভাঁজ পড়ল।
“নাম বলতে না পারলে কিনে দেবো না।”
মিহাদের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। ফিসফিস করে সে বলল, “কিনে দিও? নাম শিখবো। নাম শিখবো।”
রাফি ভাইয়ের মাথায় হাত রাখলো, “পিরামিক্স।”
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো মিহাদ, “পিরামিক্স?”
“তিন কোনা কিউবের নাম।”
মিহাদের মুখ চকচক করে উঠলো। বিড়বিড় করে সে বলতে থাকলো, “পিরামিক্স। পিরামিক্স।”
ঘড়ির দিকে তাকালো রাফি। মিহাদের কাঁধে হাত রেখে বলল, “থাক গেলাম।”
সে দাঁড়ালে মিহাদও দাঁড়ালো। হুট করেই ঝাপিয়ে পড়ল রাফির বুকে। রাফি পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। তখনই খেয়াল করলো মিহাদের মাথা তার কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মিহাদ ফিসফিস করে বলছে, “আসবে? আসবে?”
রাফি শক্ত করে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো, “আসবো।” কিন্তু হায়! সে যদি জানত ভবিষ্যত কতটা জটিল!
______________________
বড় ফুপু এসেছেন। তিনি আসা মানেই এক সপ্তাহের কমে যাবেন না। আফরিনের জন্য বিষয়টা খুবই আতঙ্কের। কারণ ভদ্রমহিলা আফরিনকে দেখতে পারেন না। কেন পারেন না এটা আফরিন জানে। বাড়ির সবাই জানে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার নেই। মানুষের মনে জোর করে তো আর নিজের জন্য ভালোবাসা ঢোকানো যায় না।
তাই আফরিন দুয়ার বন্ধ করে ঘরে ঘাপটি মেরে আছে। বড় ফুপু তাকে কিছু বললেই মায়ের মুখটা শুকিয়ে যায়। তাই সে অনেকক্ষণ যাবৎ এই গুহায় স্বেচ্ছা বন্দীত্ব গ্রহণ করেছে। তবে ঠিক কতক্ষন এখান থাকতে পারবে সেটা নিশ্চিত নয়। কারণ বুদ্ধিটা বড় ফুপুর সামনে খুবই দুর্বল। হঠাৎ একটু জোর গলা শুনে দৌঁড়ে দরজার কাছে গেলো আফরিন। খুলতে যেয়েও কি মন করে কেবল দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলো।
~
“আমার বোনের নামে কোনো কথা আমি শুনবো না বড় ফুপু।” শক্ত কণ্ঠে বলল সাদমান।
বড় ফুপু মুখ বাকালেন, “বোন বোন যে করিস! যখন সম্পত্তি চাইবে দিবি?”
“অবশ্যই।”
“আমার সাথে এভাবে শক্ত করে কথা বলবি না সাদমান! কোথাকার কোন মেয়ের জন্য নিজের ফুপুর সাথে এমন করছিস!”
সাদমান ধৈর্য হারালো, “তেইশ বছর ধরে ও আমাদের সাথে থাকে ফুপু! তারপরও?”
“থাকুক। তাতে কি রক্ত পাল্টায়? আমি নিশ্চিত ওর রক্ত ভালো না। নাহলে এমন ভাগ্য হবে কেন?”
“ফুপু আপনি আমার গুরুজন। কষ্ট পেলে মাফ করবেন। কিন্তু আফরিনের নামে একটা বাজে কথা আমি সহ্য করব না। ও আমার নিজের বোন এই সত্যি আপনি কখনও পাল্টাতে পারবেন না। পারলে ওর সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। না পারলে চুপ থাকবেন। আমি শুনতে চাই না আমার বোনের সাথে কেউ কোনো ধরনের বাজে কথা বলেছেন।” বড় ফুপু মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। গটগট করে হেঁটে আফরিনের ঘরের সামনে গেলো সাদমান। দরজায় কড়া নাড়ল। গুনে গুনে তিন মিনিট পর দরজা খুলল আফরিন। সাদমান ধমক দিয়ে বলল, “এমন বেয়াদবি কোত্থেকে শিখেছিস! বাড়িতে মানুষ আসলে সামনে যেয়ে সালাম দিতে হয় জানিস না? বের হ ঘর থেকে!” সাদমান চলে গেলো। আফরিনের ভেজা চোখ কি সহজেই উপেক্ষা করতে পারে সে!
চোখ মুছে বের হলো আফরিন। ডাইনিংয়ে আসতেই বড় ফুপুর আগে মায়ের মুখের দিকে চোখ পড়ল। অপলক তাকিয়ে আছেন আফসানা। আফরিন একবার বড় ফুপুর মুখের দিকে তাকালো। মা-কে কি বলেছেন উনি?
বড় ফুপুর মন জয় করার জন্য আফরিন সিদ্ধান্ত নিলো আজকে ভার্সিটিতে যাবে না। সাদমানের থেকেই সব নোট নেয়া যাবে। আজকে সে বাড়ির সব কাজ করবে।
~
দুপুরে খেতে বসে আফরিন উৎসুক হয়ে বড় ফুপুর দিকে তাকিয়ে রইলো। এই আশায় তিনি খেয়ে একটু প্রশংসা করবেন। তার আশায় এক বালতি পানি ঢেলে প্রথম লোকমা মুখে দিয়েই মুখ বাঁকিয়ে ফেললেন বড় ফুপু। কণ্ঠে বিতৃষ্ণা নিয়ে বললেন, “এহ! একটুও লবণ হয়নি।”
আফরিন শুকনো মুখে লবণ আনতে গেলো। অথচ বড় ফুপু একবারও লবণ নিলেন না। আফসানা বললেন, “তুইও বস।” মায়ের পাশেই বসলো আফরিন।
বড় ফুপু সরাসরি আফরিনের সাথে কথা বলেন না। আফসানাকেই বললেন, “বিয়ে টিয়ের কথা ভেবেছ নাকি?”
আফসানা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, “ছেলে মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিতে হবে। ভাবাই আছে।”
বড় ফুপু মনে মনে রুষ্ট হলেন। এই মহিলা সবসময় তার সাথে ত্যারামি করে।
“তোমার মেয়ের জন্য আমার কাছে একটা সম্বন্ধ আছে।” বলে অপেক্ষা করছিলেন আফসানার উত্তরের জন্য। সে তেমন আগ্রহ না দেখালে তিনি নিজেই বললেন, “আমার ভাশুরের ছেলেটাকে চেন না? ওর কথাই বলছিলাম। ওদের তো টাকা পয়সার অভাব নেই। যেই ঐ বাড়ির বউ হবে একেবারে রাজরানী হয়ে থাকবে।”
আফসানা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। কোনরকমে বললেন, “আপা ঐ ছেলেটা নেশাখোর! মাদক বিক্রির অভিযোগে জেলও খেটেছে!”
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বড় ফুপু বললেন, “ঐসব কোনো বিষয় নাকি! কত আগের কথা। মানুষ ভুলেও গেছে।”
“এখন কি করে সে?” মায়ের এই প্রশ্নে আফরিনের আশার আলো নিভে যেতে চাইলো। ছেলেটাকে সে হাড়ে মাংসে চেনে। একবার সাদমানের হাতে উদুম কেলানি খেয়েছে তাকে বিরক্ত করার জন্য। ভাসা ভাসা শুনেছে ওর নামে নাকি রেপ কেসও আছে।
“ওর বাপের তো কাড়ি কাড়ি টাকা। শুধু শুধু কিছু করতে যাবে কেন?”
“আপা আপনার সম্মানেই এখন পর্যন্ত কথা বললাম। দয়া করে এই ধরনের কথা আর বলবেন না। আমার মেয়েকে আমি বানের জলে ভাসিয়ে দিতে চাই না।”
“আফসানা! এই মেয়েটার জন্যই তোমার শ্বশুর, শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছ। ভুলে যেও না। ওর মতো মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো সম্বন্ধ আর পাবে না।”
“না পেলে বিয়ে দেবো না। বিয়ে যে দিতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আফরিন ভাত নষ্ট করবি না!” আফরিন প্লেটে পানি ঢালতে যাচ্ছিল। শক্ত কণ্ঠে বললেন আফসানা। আফরিন বসে রইলো। সে আর খেতে পারছে না। বুকে ব্যাথা করছে।
“যা ইচ্ছা কর। ভেসে আসা একটা মেয়ের জন্য নিজেদের জীবন নষ্ট করতে চাইলে কে তোমাদের আটকাবে? আমার ভাশুরের ছেলের সাথে বিয়ে হলে রাজপ্রাসাদে থাকতে পারতো। ওকে তো সারাজীবন কান্নাকাটি করেই কাটাতে হবে। মাটির ঘরের থেকে নাহয় রাজপ্রাসাদে এসির নিচে বসেই কাঁদতো।” বড় ফুপু উঠে চলে গেলেন। আফসানা শান্ত ভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। কেন কাঁদবে তার মেয়ে? কোন অপরাধের শাস্তি হিসেবে?
~চলমান~
“তুমি আজকে এতো তাড়াতাড়ি এলে? দুপুরে বাসায় খেয়েছো?” প্রসঙ্গ ঘোরাতে জুঁই বলল।
“হ্যাঁ। মাথা ব্যাথা করছিলো তাই চলে এসেছি। তা আমাকে বাসায় দেখেই কি তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে নাকি? কি বলো বেলী!” হেসে উঠলেন জেসমিন। তবে তার কৌতুকে জুঁইয়ের হাসি পেলো না। সত্যি তো এটাই।
“তাই তো মনে হইতাছে।” বেলী ভাবুক কণ্ঠে বলল। প্লেটে অবশিষ্ট থাকা কয়েক দানা ভাত রেখেই উঠে পড়ছিল জুঁই। জেসমিন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “খাবার নষ্ট করা ভালো স্বভাব না জুঁই। একদিন বেরিয়ে দেখবে দুটো দানা ভাতের জন্য মনুষ কতো কষ্ট করে। খেয়ে ওঠো।”
জুঁই চুপচাপ প্লেট পরিষ্কার করে খেলো। জেসমিন উঠে চলে গেলে বেলী বলল, “আপা কিছু আকাম করছেন নাকি?”
পাতার মর্মর শুনেও চোরের মনে পুলিশের ভয় হয়। জুঁইয়ের হয়েছে সেই দশা। তার চেহারাটা রক্ত শূন্য হয়ে গেলো।
“কি আকাম করবো আবার?”
“আমি কি জানি?” কাঁধ শ্রাগ করে বলল বেলী। জেসমিন টেবিলে ফোন রেখে গিয়েছিলেন। টুং টাং করে সেটায় শব্দ হলো। জুঁই দেখলো স্ক্রিনে মেসেজের উপরে লেখা উঠেছে “UNMESH”। বেলী ফোন হাতে নিয়ে বলল, “খালাম্মা মেসেজ আইছে!”
জুঁই ফোন পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই সেটা জেসমিনের হাতে চলে গেলো। তিনি মাত্রই শুয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে বেলীকে বললেন, “কোম্পানি মেসেজ দেয় সারাদিন। এটা আবার দেখার কি আছে।” বললেও পাশ থেকে চশমাটা হাতে নিয়ে একবার স্ক্রিনে চোখ বোলালেন জেসমিন। উন্মেষের নামটা দেখতেই সোজা হয়ে উঠে বসলেন। সেখানে বলা হয়েছে জুঁই আজকের ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল। মেসেজটা পড়তে দেরি, জুঁইকে ডাকতে দেরি হলো না। জুঁই ডাইনিং রুমেই দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক শুনে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিলো সে। কিন্তু জুঁই তো ভুলেই বসেছে আজকাল মা বাবার সামনে সে কথা বলতে পারে না।
“আজকে কোচিংএ যাওনি?” জেসমিনের কণ্ঠের কঠোরতা টের পেলো জুঁই।
“হ্যাঁ গিয়েছিলাম।” উত্তর দিয়েই নিজেকে মনে মনে বলল একটু কনফিডেন্সের সাথে “গিয়েছিলাম তো আম্মু!” এটুকু বললেই তো পরিস্থিতিটা ঠান্ডা হয়ে যেতো। তার কম্পনরত কণ্ঠ লুকাতে চাওয়া কথাকে আরো সামনে নিয়ে আসছে।
“তাহলে ওরা মেসেজে বলছে কেনো যে তুমি অ্যাবসেন্ট?”
“কই দেখি?” সাহস করে এগিয়ে গেলো জুঁই। গৎবাঁধা লেখাটুকু বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ে বলল, “অনেক সময় এমন সমস্যা হয়।”
“এমন সিলি সমস্যার জন্য আজকের একজ্যামের নাম্বারটা যে এলো না! কালই ওদের কাছে যাবো আমি। খাতায় সব ঠিক থাকলে এই মেসেজ আসবে কেনো?” জেসমিন হাসানের রাগ দেখে জুঁই মনে মনে আতঙ্কিত হলো। তিনি যদি টের পান জুঁই পঁচিশে পাঁচটাও ঠিক করে লিখতে পারেনি তাহলে কি হবে!
পরদিন সত্যি সত্যিই জেসমিন জুঁইয়ের সাথে কোচিংএ গেলেন। সাত সকালে জেসমিনকে বের হতে দেখে শামসু মিয়া সিনা টান করে দাঁড়ালেন। জেসমিন হাসানকে তার বেজায় ভয়। আনোয়ারুল হককে দেখলে শামসু মিয়ার কাছে অতো কঠিন মানুষ মনে হয় না। কিন্তু জেসমিন হাসানের চেহারাটা তার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়। সবসময় কপালে দুটো ভাঁজ থাকে। কঠিনের উপরের জিনিস এই মহিলা। অতএব আজ আর শামসু মিয়ার পান খাওয়া হলো না। নিতান্ত ভদ্র মানুষের মতো গাড়ি চালাতে শুরু করলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে জেসমিন হাসান সব জায়গায় আলাদা সম্মান পেয়ে অভ্যস্ত। তবে কোচিং সেন্টারের সবাই মেডিকেল কেন্দ্রিক মানুষ। তাকে কেউ চেনে বলে মনে হলো না। বিষয়টা বুঝতে পেরে তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে আইডি কার্ডটা বের করে দেখালেন। দায়িত্বরত ছেলেটা সোজা হয়ে বসলো। একবার জেসমিন হাসানের কঠিন চেহারার দিকে তাকিয়ে পেছনে জুঁইয়ের দিকে তাকালো। মাফলারের আড়ালে জুঁই তার আতঙ্কিত চেহারা ঢেকে রেখেছে।
“কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“গতকাল আমার মেয়ে কোচিংএ এসেছে। পরীক্ষাও দিয়েছে। তাহলে মেসেজে ওকে অ্যবসেন্ট বলা হয়েছে কেনো?”
ছেলেটার কপালে ভাঁজ পড়ল, “মেসেজটা দেখি।”
মেসেজটা ওপেন করেই রেখেছিলেন জেসমিন হাসান। সাথে সাথেই দেখলেন। কপিউটারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছেলেটা বলল, “রোল আর রেজিস্ট্রেশনটা বলুন।”
যথেষ্ট স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো জুঁই। তবুও ক্ষীণ কম্পন রয়েই গেল।
ছেলেটা কয়েকবার চেষ্টা করলো। শেষে বলল, “নামটা বলুন তো।” তবুও পেলো না। পাওয়ার কথাও নয়। জুঁই তো সেদিন ভুল ইনফর্মেশন দিয়েছে। তার খাতা রেকর্ড হবে কিভাবে!
রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ছেলেটা। যাওয়ার আগে জুঁইয়ের ব্যাচ নাম্বার শুনে গেলো। পাঁচ মিনিটের আগেই এক বান্ডিল খাতা নিয়ে এলো। প্রায় পঞ্চাশটা খাতা। সবগুলোর রোল, রেজিস্ট্রশন চেক করে দুটো খাতা বের করে রাখলো। প্রথম খাতায় রোল ভুল হলেও রেজিস্ট্রেশন ঠিক আছে। ফলে কম্পিউটারে ডেটা চলে এলো। ঐ খাতার রেজাল্ট মেসেজ করা হয়েছে। বাকি খাতাটা জুঁইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছেলেটা বলল, “এটা আপনার?”
না করার কোনো সুযোগ নেই। মিথ্যা দিয়ে বোনা জাল, শেষ হতেই হবে। ধীর গতিতে মাথা নাড়ল জুঁই। ছেলেটা বলল, “ওএমআর তো ঠিকঠাক পূরণ করেননি। এভাবে ওভাররাইটিং করলে কম্পিউটার ডিটেক্ট করতে পারে না। দিনে কতো শত খাতা দেখতে হয়। তার মাঝে এমন খাতা খুঁজে তার মালিক খোঁজা অনেকটা সময়ের বিষয়। আগামীতে খেয়াল রাখবেন।”
জুঁইয়ের হাত থেকে খাতাটা টান মেরে নিয়ে নিলেন জেসমিন। তেরো বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। কোনটা শিক্ষার্থীর ইচ্ছাকৃত ভুল আর কোনটা অনিচ্ছাকৃত এটা বোঝার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তার চোখের আছে। এক দেখায়ই বুঝে ফেললেন পরবর্তীতে পূরণ করা বৃত্তগুলো ইচ্ছাকৃত। রোল রেজিস্ট্রেশনে ঠিক নাম্বারের বদলে ভুল নাম্বারের উপরেই কলমের কালি বেশি। অর্থাৎ এটাও ইচ্ছাকৃত। জুঁই এক পলক তাকিয়ে দেখলো জেসমিন হাসান তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তীক্ষ্ম, ঠান্ডা এক দৃষ্টিতে।
ক্লাস শুরু হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। জেসমিন হাসান চাপা কণ্ঠে বললেন, “আজ বাসায় আসো!”
চোখের সামনে পুরো দিনের সম্ভাব্য চিত্র দেখতে পেলো জুঁই।
চলবে।