#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৭.
ধীর পায়ে নাবিলার ঘরের সামনে দাঁড়ালেন আসিফা। জড়তার প্রাচীর এত বড় হয়েছে যে সেটা টপকে দরজায় কড়া নাড়াটাও এভারেস্ট জয়ের মতো কঠিন মনে হচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন আসিফা। কয়েকবার দরজার গায়ে হাত ছুঁইয়েও ফেরত নিয়ে এলেন। ভেতরে জন্ম নেয়া স্তব্ধতা তাকে স্থির করে দিল। ঠিক কবে নিজের পেটের মেয়ের সাথে এত দূরত্ব তৈরি হয়েছ তার!
তিতলি পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। নিচ থেকেই দেখেছে আসিফা নাবিলার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় বিশ মিনিট যাবত। কি মনে করে আসিফার সামনে যেয়ে টুক করে দরজায় কড়া নাড়ল। আসিফা চমকে গেলেন। খানিকটা লজ্জাও পেলেন বোধহয়। মা হয়ে তিনি যেই কাজটা পারেননি সেটা বাড়ির খাদেমা পেরে গেলো। এই বাড়িতে তার অবস্থান ঠিক কোথায়?
মিনিট খানেক পেরিয়ে গেলেও নাবিলার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তিতলি মিনমিন করে বলল, “খালাম্মা আপনি ভিতরে যান। দরজা খোলাই আছে।”
“নাবিলা তো কিছু বলল না।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিতলি বলল, “আপা ইদানিং কিছুই বলে না খালাম্মা। সবসময় চুপ করে থাকে।”
আসিফার বুকটা হু হু করে উঠলো। দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে গেলো। আসিফার চোখের সামনে স্পষ্ট হল ঘুটঘুটে অন্ধকারের রাজ্য। তিতলি আস্তে করে সরে গেল। তার গন্তব্য নিচ তলার কোনার ঘর।
“নাবিলা?” ঢোক গিললেন আসিফা। নাবিলা ঠিক কোথায় আছে বুঝতে পারলেন না। এই ভর দুপুরে ঘর এভাবে অন্ধকার করেছে কিভাবে? দরজা, জানালার ফাঁক দিয়েও কি নাবিলার ঘরে একটু আলো উঁকি দেয় না? মাথা উঁচু করে চারপাশে তাকিয়েও একটা ঘুলঘুলি পেলেন না আসিফা। মনে পড়ল এসির জন্য কোনো ঘরেই ঘুলঘুলি দেয়া হয়নি।
দেয়ালে হাতড়ে হাতড়ে সুইচবার্ড পেলেন আসিফা। লাইট জ্বালাতেই ঘরটা চোখের সামনে স্পষ্ট হলো। আসিফার মনে হল ঘরের চেহারা অনেকটা পাল্টে গেছে। ফার্নিচারের ডেকোরেশন আগে এমন ছিল না। ড্রেসিং টেবিলটা জানালার পাশে ছিল, টু সিটের একটা সোফা ছিল। সোফাটা নেই। ড্রেসিং টেবিল বিপরীতের দেয়ালে খাটের পাশে চলে গেছে।
বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল নাবিলা। কপালের উপরে ডান হাত রাখা।
আসিফার মনে পড়ল না নাবিলা আগে ঠিক কিভাবে ঘুমাতো। এভাবেই? ঠিক কতদিন নাবিলাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেননি তিনি?
“নাবিলা?” নাবিলার পাশে বসে মাথায় হাত রাখলেন আসিফা। নাবিলার চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। পরক্ষনেই ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ পেলেন আসিফা। নাবিলা ঘুমাচ্ছে।
নাবিলার গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখজোড়া দেখে আসিফার বুক ভেঙে কান্না এলো। মেয়েটার গায়ের রং ছোট থেকেই হলুদ ফর্সা। তবে এখন চামড়ায় কেমন কালচে একটা ছাপ এসেছে। এটা কি রোদে পোড়া রং নাকি মায়ের অযত্নের ছাপ আসিফা বুঝতে পারলেন না।
নাবিলার উপর দিয়ে যাওয়া সদ্য ঝড়ের কথা মনে পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি। মুখে হাত দিয়ে শব্দ থামালেন। নাবিলার মুখজুড়ে এলোপাথারি চুমু দিলেন। অগোছালো ভঙ্গিতে ঘুমন্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের বুকে জন্ম নেয়া অনুশোচনার আগুনে একটু পানি ঢালতে চাইলেন। কতটুকু সফল হলেন সেটা স্পষ্ট না হলেও নাবিলা কাত হল। বাম কাত হয়ে ডান হাত রাখলো মায়ের কোলের উপর। অজান্তেই। যক্ষের ধনের মতো সেই হাতটা আঁকড়ে ধরলেন আসিফা। ভেজা চোখে চুমু খেলেন সেখানেও।
সাইয়েদ মাহমুদকে তিনি নিজেই পছন্দ করেছিলেন। একই কলেজে পড়াশোনা করতেন দুজন। মাহমুদ তখন থেকেই তাকে পছন্দ করতেন। কয়েকবার বিষয়টা জানিয়েছেন। শেষমেষ আসিফা সাড়া দেন। সুদর্শন, সামাজিকভাবে পরিবারের অবস্থানও বেশ ভালো। না করার কোনো কারণ খুঁজে পাননি আসিফা। বছর তিনেকের মাথায় মাহমুদ বাড়িতে প্রস্তাব পাঠালে দুই পরিবারের কথা বার্তার মাধ্যমেই সম্পর্ক এগিয়ে যায়। ততদিনে তাদের মনের যোগসূত্র বেশ অনেকটাই মজবুত হয়েছে।
আসিফার এই ভুলটা ভাঙলো বিয়ের এক মাসের মধ্যেই। নিত্য দু ঘন্টা দেখা মানুষটার সাথে চব্বিশ ঘণ্টা দেখা স্বামী মাহমুদকে মেলাতে কষ্ট হলো আসিফার। বিয়ের আগে মাহমুদের কাজ নিয়ে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করতেন না তিনি। সাইয়েদ গ্রুপের বিশাল ব্যবসার কথা শহরের কে-ই না জানে। একমাত্র ছেলে হিসেবে যে পরবর্তী মালিক সে সেটা তো কাউকে বলে দিতে হবে না। কাজ বাদ দিয়ে তার সাথে দেখা করা মাহমুদকে তখন ঠিক যতটা ভালো লাগত, পরবর্তীতে কাজ বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকা মাহমুদকে ঠিক ততটাই অসহ্য লাগতে শুরু করল। লোকটা খায়, ঘুমায়, সারাদিন ঘরের ভেতর বসে থাকে। বাইরে পা দেয় শুধুমাত্র আড্ডার জন্য। বাবার থেকে হাত পেতে মাস শেষে টাকা নেয়। লজ্জায় আসিফার মাথাটা নত হয়ে আসত। আবদার তো দূরের কথা প্রয়োজনীয় জিনিসের কথাই মাহমুদকে বলতে পারতেন না তিনি। এভাবেই মনের যোগসূত্রটা আস্তে আস্তে ভঙ্গুর হয়ে গেল। যেটা গড়ে উঠেছিল ভিত্তিহীনভাবেই।
নিত্য অশান্তি ঘরের নিয়ম হয়ে গেল। আসিফা মাঝে মাঝে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেন। সংসারে মনোমালিন্য হয়। তাই বলে মনোমালিন্যই কি সংসার হতে পারে? তার বাবা মাও বেশ কয়েকবার বলেছিল চলে যেতে। শেষমেষ নিজেকে যখন বিচ্ছেদের জন্য প্রস্তুত করলেন তখন পেলেন রাফির আগমনের সংবাদ। সেটা সু না দু ছিল ঠাহর করতে পারলেন না। যে জায়গা ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন সেখানেই থাকতে হলো। অনিচ্ছায়। রাফিকে নিয়ে মাহমুদের মাঝেও আলাদা কোনো উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। তার দৈনন্দিন রুটিনেও কোন পরিবর্তন এল না। শাশুড়ির ধমকেও মাহমুদ তাকে রুটিন চেকআপের জন্য সময় দিতে পারত না। কখনও বাবা, কখনও শ্বশুরের সাথে ডাক্তারের কাছে যেতেন আসিফা। প্রথমবার মা হওয়ার কোন উত্তেজনাই তার মাঝে কাজ করেনি। মাঝে মাঝে এও মনে হয়েছে এই ছেলেটার জন্যই তিনি আটকে গেছেন। এই মনোমালিন্যের সংসারে। ফলে রাফি প্রথম সন্তান হিসেবে বাবা মায়ের খেলনা হতে পারেনি। দাদা দাদীর কাছেই বেড়ে উঠেছে। ফলে বাবা মায়ের সাথে তার সম্পর্কটা যেন একটু দূরের।
পরবর্তীতে আরো দুটো সন্তানের জননী হলেও দাম্পত্য কলহ ততদিনে আসিফাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে। মনের শান্তি হারিয়ে এই সংসারটা তখন তার কাছে বোঝায় পরিণত হয়েছে। শেকড় গভীরে চলে গেছে বলেই এই পলিতে থেকে যাওয়া। যাতে তিনি ক্রমশই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন।
ছেলেমেয়ের সাথে যতদিনে নিজের দূরত্বটা বুঝতে পারলেন ততদিনে দুজনই বড় হয়ে গেছে। মিহাদ কেবল কোলে। রাফি নিজেই নাবিলা আর মিহাদকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। নামে মাত্র মা হয়ে তিনি ঘরের শো পিসে পরিণত হয়েছেন।
দিনে দিনে সংসারের অবস্থা আরো করুন হলো। শ্বশুরের মৃত্যুর পর তখন ব্যবসার হাল ধরেছেন মাহমুদ। আসিফা দু চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলেন। তিনি বুঝলেন অচিরেই এই পরিবার পথে বসবে।
রাফির ব্যবসার দিকে কোনো ঝোঁক ছিল না। শুরু থেকেই সে নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু পরিবারের ভরাডুবির সময় নিজের স্বপ্ন ভুলে গিয়ে ব্যবসায় ঢুকলো সে। আর তারপর থেকেই আরো বেশি অনুভূতিহীন হয়ে গেল। আসিফার মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি এই বাড়িতে কয়েকটা পাথরের সাথে থাকেন। নিজে তো পাথর হয়েছেন আরো আগেই।
ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে নাবিলার মুখের দিকে তাকালেন আসিফা। ছেলে মেয়েগুলোর সাথে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ার আরেকটা সুযোগ যদি পাওয়া যেত!
বুকে আফসোস নিয়েই বেরিয়ে গেলেন আসিফা। নাবিলা জানতেও পারল না দুঃস্বপ্নের মাঝে, জ্বরের ঘোরে যেই মানুষটাকে সে সবার আগে ডাকে সে তার পাশে বসে কতটা সময় কাটিয়ে গেল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নাবিলা অনুভব করার সুযোগটুকুও পেল না। হায়!
_______________
“দাদী! ওঠো ওঠো!”
শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় বেজায় বিরক্ত হলেন রুমিলা। চোখ মুখ কুচকে আরেক দিকে ঘুরলেন। তিতলি বলল, “রাফি ভাই কিন্তু এক্ষণই আসবে। ঘুমায় থাকতে দেখলে তোমারেই বকবে। আমি বলব একশ বার ডাক দিছি।”
রুমিলা উঠে বসলেন, “আমার শান্তি তোদের দেখতে ইচ্ছা করে না?”
“না।” দাঁত বের করে বলল তিতলি।
“বেদ্দপ! ধর আমারে!”
তিতলি রুমিলাকে ধরে ওঠালো। পায়ের ব্যাথা ইদানিং বেড়েছে। এই কথাটা নিজে নিজেই কয়েকবার আওড়েছেন রুমিলা। বেয়াদব তিতলি ঠিক সেটা রাফির কানে তুলে দিয়েছে। রাফি পাগল হয়ে গেছে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুই না ফুটিয়ে থামবে না। তার শান্তি কেউ দেখতে পারে না।
রাফি আধা ঘণ্টার মাঝে বাড়িতে এলো। সোজা দোতলায় উঠে নাবিলার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল। কোন সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকলো। ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে বিছানার কাছে গেল। নাবিলার মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে হাতের প্যাকেটটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে দিল। খুব দোয়া করল যেন নাবিলা প্যাকেটটা একবার খুলে দেখে। গত কয়েকদিন যাবৎ দুপুরের পর একবার বাড়িতে এসে নাবিলার পছন্দের কোন একটা খাবার রেখে যায়। এই আশায় হয়তো নাবিলা খুশি হবে। খাওয়া তো দূরের কথা নাবিলা প্যাকেট খুলেই দেখে না। রাতে ফিরে এসে সেই খাবার ডাস্টবিনে ফেলে রাফি। সাথে নিজের দীর্ঘশ্বাস।
দোতলা থেকে ছুটল নিচে। দাদীর ঘরে যেয়ে হুলুস্থূল বাঁধালো।
“দাদীমা এখনও গোছাওনি কেন? তোমাকে দেখিয়ে আমি আবার অফিসে যাবো। দেরি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি!”
“হ আমি তো ইঞ্জিন। ধাক্কা দিলেই জোরে চলে।” গজগজ করে বললেন রুমিলা। রাফি বুঝল দাদীর মেজাজ চড়ে আছে। তিতলির থেকে সরিয়ে নিজের কাছে এনে বলল, “আচ্ছা আস্তে আস্তেই কর। আমি বসছি।”
রাফি সত্যি সত্যিই বসল। তারপরই বুঝতে পারল নিজের ক্লান্তিটা। দুপুরে খাওয়া হয়নি। শরীর টা ভেঙে আসতে চাইছে।
নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে রুমিলার চোখ দুটো ভরে এলো। এই ছেলেটা পুরো সংসারটা একা টেনে যাচ্ছে। আর ওকে দেখারই কেউ নেই। তিনি অনুভব করলেন রাফির বিয়ে দেয়া দরকার। বিয়ের নাম শুনলেই এই ছেলে যেভাবে দশ হাত লাফ দেয় তাতে কাজটা কঠিন না দুঃসাধ্যই বটে। তবু দিনশেষে একটা নিজের মানুষ তো দরকার। ওর বাপ মা তো নিজেরা ঝগড়া করেই সময় পায় না। ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করবে কখন। রুমিলা নিজেকে প্রস্তুত করলেন। যা করার তাকেই করতে হবে।
রুমিলার গোছাতে আরো আধা ঘণ্টা লাগল। রাফির চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। শরীরটা একটু বিছানার স্পর্শ চাইছিল। সেসব ইচ্ছে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে রাফি বের হলো। গাড়িতে উঠে জাফরের জন্য মায়া হলো। ছেলেটা তার জন্য একটু বিশ্রাম নেয়ারও সময় পায় না। সেই সকাল থেকেই তার সাথে ছুটছে। রাফি ভাবলো আরেকজন ড্রাইভার রাখবে। দিন অর্ধেক করে দুজন ডিউটি করবে।
অ্যাপয়েনমেন্ট আগেই নেয়া ছিল। নাম্বারটা শুধু বললেই হবে। রিসিপশনে যেয়ে অপরিচিত একজনকে দেখল রাফি। আগেরজন বয়স্ক ছিলেন। রাফির সাথে বেশ ভাল পরিচয় ছিল। এই জনকে নতুন দেখছে। নতুন এসেছে বোধহয়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো রুমিলাকে আরেকবার দেখার জন্য। জাফরের সাথে বসে আছে। কিছু একটা মনে পড়ায় ধা করে সামনে ঘুরল রাফি। এই মেয়েটার চোখ দুটো এত চেনা লাগছে কেন! কোথাও কি দেখেছে? খুব চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না। একবার মুখটা ওঠালে হত। মাস্কের আড়ালে চেহারা ঢাকা থাকলেও চোখ জোড়া ভালোভাবে দেখা যেত। অথচ মেয়ে তো মুখ নামিয়ে কম্পিউটারে খট খট করে যাচ্ছে। এদিকে তাকানোর কোন লক্ষণ নেই। রাফি মস্তিষ্কে চাপ দিল। উহ! কোথায় দেখেছে এই চোখ দুটো?
~চলমান~