অন্তঃপুর পর্ব-০৯

0
2

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৯.

“আমাকে সম্বন্ধী বানানোর ইচ্ছা হয়েছে শুনলাম?”
ঘাড়ে হাত পড়ায় চমকে তাকাল মারুফ। নিজের ধ্যানে হাঁটছিল। হঠাৎ কথায় কিছুটা থতমত খেয়ে গেছে বেচারা।
সাদমান হাত শক্ত করল।
“সত্যি নাকি?”
মারুফ এক পলক সাদমানের দিকে তাকাল। একই ব্যাচে তারা। তবে ডিপার্টমেন্ট আলাদা। কিছু কমন ফ্রেন্ড থাকায় সাদমানকে চেনে সে। আরো একটা কারণে চেনে।
“কে বলল?” প্রশ্ন করল মারুফ।
“কথা তো বাতাসের আগে পৌঁছে যায়। সত্যি কি না তাই বলো।”
“তোমরা আসলেই আপন ভাই বোন?”
“নকল মনে হলো কেন?”
“অনেকে বলে..”
“কি বলে?”
“তোমরা দেখতে একদম আলাদা।”
“আইডেন্টিকাল ছাড়াও যে টুইন হয় এটা তোমরা জানো না?” একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলো সাদমান। কিভাবে এসব কথা মানুষ জেনে যায়? অথচ সেটাই জানে না যেটা আসলেই তার জানা দরকার।
“আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না।” সাদমান বলল।
“কি বলছিলে যেন? ওহ! না আমি তো সেসব কিছু বলিনি। শুধু ওর খোঁজ নিয়েছিলাম।”
“কেন?” সাদমানের কণ্ঠের কাঠিন্যতা বোধ করি মারুফ টের পেল।
“এমনি। আফরিন ভাল মেয়ে। ওর সম্পর্কে খোঁজ নেয়া যাবে না?”
“যাবে। সব খোঁজ চাইলে আগে ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।”
“কি ফর্মালিটি?” মারুফের কপালে ভাঁজ পড়ল।
“বাবা মাকে বাসায় পাঠাতে হবে।”
মারুফ হেসে ফেলল, “আরে ধুর! বিয়ে টিয়ের কথা কে বলছে? আমি জাস্ট কিউরিসিটি থেকে খোঁজ নিয়েছি।”
“কারেকশন। মেসেজও করেছ। তারপর কি করবে? কিউরিসিটি থেকে?” ব্যাঙ্গ করে বলল সাদমান।
মারুফের মুখের হাসি মুছে গেল, “আফরিনের সাথে কথা বলা কি নিষেধ?”
“নাহ কথা বলা নিষেধ হবে কেন? ফ্রি তে মজা নেয়া নিষেধ। ইউ নো? আমার বোন সস্তা টাইপ মেয়ে মানুষ না। তাকে পেতে হলো বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে।”
“সাদমান তুমি ভুল বুঝছো। এখানে পাওয়া না পাওয়ার তো কিছু নেই। আমি জাস্ট ওকে হাই বলেছি। ফ্রেন্ড হওয়াও কি দোষের? নাকি ছেলে মেয়ে কখনও বন্ধু হতে পারে এই বাণীতে তুমিও বিশ্বাসী?”
সাদমান চমৎকার করে হাসল। নম্র কণ্ঠে বলল, “আমার বোনের ফ্রেন্ড আছে। ছেলে ফ্রেন্ড হিসেবে আমি আছি। আর কাউকে দরকার নেই। বুঝেছ? ভাল থেকো।” ঘাড়ে হাত রেখে বল সাদমান। উল্টো ঘুরতেই সৌজন্যতা মাখা হাসিটুকু মুছে গেল। মারুফের রেকর্ড খুব একটা ভাল না। চকচকে চেহারা, মিষ্টি কণ্ঠ আর রেজাল্ট নিয়ে এই পর্যন্ত বহু মেয়ের সাথেই ফ্রেন্ডশিপ করেছে। সেটা বলার মতো কিছু হতো না যদি না মারুফ নিজেই জিনিসটাকে অন্যদিকে নিয়ে যেত। প্রায় সব মেয়েদের সাথেই সে ফ্লার্টিং টোনে কথা বলে। যারা আগে থেকেই তাকে চেনে তারা গা না করলেও বেশীরভাগ মেয়েই গলে যায়। মারুফের সাথে দূরত্ব কমতে থাকে। যখন ভবিষ্যতের কথা বলে ঠিক তখনই মারুফের থেকে তারা জানতে পারে তাদের ভেতরে আসলে কোন বর্তমানই নেই। ভবিষ্যত তো বহুর দূরের বিষয়। মারুফের কথার ধারাই অমন। মেয়েদের সাথে মাইন্ড গেম খেলতে, কথার জালে ফাঁসিয়ে দূরত্ব কমাতে ভালবাসে। ঠিক যখন মেয়েটা রেসপন্স করো তখনই মারুফ আকাশ থেকে পড়ে। সাদমান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মেয়েরা কি আগে একটু খোজ খবর নেয় না? কেউ মিষ্টি করো দুটো কথা বললেই গলে যেতে হবে? সবাই যদিও একই ধরনের না তবুও এই কাতারের মেয়ে যেন দিন দিন বাড়ছে। আফরিন কয়েকদিন আগেই তাকে বলেছিল। মারুফ নাকি তাকে বেশ কয়েকটা মেসেজ করেছে। সাদমান বলেছিল রিপ্লাই না দিতে। যা বলার সে বলবে।

সোজা বাড়িতে চলে গেল সাদমান। আফরিন হাসপাতালে চলে গেছে। এখন একা একাই যাতায়াত করে। ভালোই। তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

_____________

আফরিনের ফিরতে একটু দেরি হল। একটা পোলো শার্ট কিনে এনেছে সে। এজন্যই দেরি হয়েছে। রিকশা থেকে নেমে দেখল সাদমান বাসার সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। সে এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কি করিস?”
“মশা মারছি।” গম্ভীর কণ্ঠে বলল সাদমান।
“মুড অফ কেন?”
“ভেতরে যা।”
“যাচ্ছি। আগে বলবি তো।”
“কিছুই বলব না। আমার কথার দাম থাকলে অবশ্যই বলতাম। নিজে ইনকাম করিস, নিজের টাকায় চলিস, ইচ্ছে হলে বাড়িতে দেরি করে আসিস। এদিকে মানুষ চিন্তায় মরল কি বাঁচল তাতে তোর কি?”
আফরিন হেসে ফেলল। তার দেরি দেখে এই ছেলে বাইরে ঘোরাঘুরি করছে? তবুও একটা ফোন দেবে না। ভাব দেখায় তার সাথে। হুহ!
“তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি। চল ভেতরে চল।”
“পরে যাব তুই যা।”
“আরে চল তো!” আফরিন সাদমানকে টেনে নিয়ে গেল।

ব্যাগ থেকে মেরুন রঙের শার্টটা বের করল আফরিন। সাদমান চোখ ছোট করে বলল, “কী উপলক্ষ্যে?”
“আমাকে যেন আর একা একা যেতে আসতে না হয় এই উপলক্ষ্যে।” আফরিন দাঁত বের করল।
“ঘুষ দিচ্ছিস?”
মাথা নাড়ল আফরিন, “হ্যাঁ।” নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “তুই আমার উপর এখনও রাগ করে আছিস। আমার একটা প্ল্যান আছে। এজন্যই চাকরি করাটা দরকার।”
“কী প্ল্যান?”
আফরিন সাদমানের দিকে তাকাল। সবটা শুনে সাদমান দ্বিধায় পড়ে গেল। আফরিনকে কি বকা উচিত না?

________________

জাফর অনিককেই বলেছে। গাড়িতে রাফি আর অনিকের কথাবার্তা যতটুকু শুনেছে তাতে অনিক রাফিকে বিয়ে দেয়ার জন্য পাঁচ পায়ে খাড়া। আর রাফি পারলে অনিককে এজন্য খু-নই করে ফেলে। ফলে সেই কাজে নিজেকে জড়াতে জাফর ভয় পাচ্ছে। তার চেয়ে অনিককে বলাই সবদিক দিয়ে নিরাপদ। উৎসাহী লোকটাও একটা কাজ পাবে আর দাদীর আদেশও তাকে অমান্য করতে হবে না।

অনিক শুনে জাফরের ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “সাবাশ জাফর! এতদিনে একটা কাজের মতো কাজ করেছ। এই না হলে মালিকের প্রতি ভালবাসা!”
জাফর ইতস্তত হেসে বলল, “স্যার দাদী বলেছে আসলে।”
“যেই বলুক! তোমার স্যারের একটা হিল্লে হলেই তোমার রাস্তা ক্লিয়ার। নয়তো ঐ ব্যাটা নিজেও বিয়ে করবে না তোমাকেও করতে দেবে না। তাই নামাজ পড়ে ওর জন্য দোয়া করবে বুঝেছো? আরেকজনের পাতে দই চাইলেই না মানুষ তোমারটাও দেখবে!” অনিক চোখ টিপ দিল। পরপরই গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “দিল্লির লাড্ডু। খেলেও পস্তাতে হবে, না খেলেও পস্তাতে হবে। খেয়ে পস্তানোই ভাল না?”
“জি।” জাফর মাথা নাড়ল।
“তবে আমি কিন্তু পস্তাচ্ছি না জাফর। বুঝেছ?”
জাফর মাথা নাড়ল। এই লোকটা বেশি কথা বলে।

অনিক একদিনেই অনেকটা খোঁজ বের করে ফেলল। দেরি না করে সেদিনই রুমিলা বেগমের সাথে দেখা করতে চলে গেল। পেটের ভেতর কথা চেপে রাখাটা কষ্টের। তাও আবার বিয়ের খবর।

রুমিলা অনিককে দেখেই খুশি হলেন।
“তোমার বউটা কই? ছানা পোনারা কই?”
“বউ বাড়িতে দাদীমা। ওদের আনিনি।”
“আনোনি কেন? ওদের আনার কথা আলাদা করে বলে দিতে হবে?”
“ছোট মেয়েটা অসুস্থ দাদী। ঠান্ডা কাশি হয়েছে। এজন্য আসেনি। পরেরবার আসবে ইনশাআল্লাহ্।”
অসুখের কথা শুনে রুমিলার হাসিতে চিড় ধরল।
“ছোট মানুষ। দেখে শুনে রাখবা। আল্লাহ ভরসা। বলো এবার কি খোঁজ আনছো।”
অনিক নড়েচড়ে বসল।
“মেয়ের নাম আফরিন। মহিলা কলেজের ঐদিকে বাসা। মেয়ের যমজ আরেকটা ভাই আছে। মেয়েটা ছোট। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। বাবা একটা হাই স্কুলে চাকরি করে। মা গৃহিণী। এই তো। ওহ! ওখানে নিজেদের বাড়ি। দাদা বাড়ি নানা বাড়ি এই শহরেই।”
রুমিলা মাথা নাড়লেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “চুলে পাক ধরছে দাদা। সারাজীবনের অভিজ্ঞতায় জানি এসব কিছু এত গুরুত্বপূর্ণ না। তুমি তো আসল খবরই বললো না।”
“কী দাদী?” অনিক ভাবল। কি মিস করেছে সে?
“মেয়ের স্বভাব চরিত্র কেমন? আমার চোখে তেমন দোষ দেখি নাই। তাও একটু খোজ খবর কর। এখন তো ছেলেমেয়েরা বিয়ের আগেই বিয়ে উসুল করে ফেলে। আমার নাতি জমজম কূপের পানি না। কমতি ওরও আছে। কিন্তু এইদিক থেকে সে একদম একশোয় একশ। কি বলো?”
“জি দাদী। আমি খোঁজ নিবো। কিন্তু আঙ্কেল আন্টিকে বলবেন না?”
“ওদের বলা না বলা সমান। মেয়ে পছন্দ হইলে তখন জানাবো। বাপ মা থাকতেও যদি না যায় তাহলে তো ওরা মেয়ে দিবে না।”
অনিক ইতস্তত করছিল। রুমিলা বললেন, “কী বলবা বলো।”
“দাদী রাফি তো একদমই বিয়ে করতে চায় না।”
রুমিলা নিশ্বাস ছাড়লেন, “এমন যদি হইত ও কাউকে পছন্দ করে এজন্য বিয়ে করতে চায় না তাহলে আমি জোর করতাম না। কিন্তু ও বিয়ে করতে চায় না ভয়ে। সংসার নাকি হবে না। নিজের বাপ মাকে দেখে ওর বিতৃষ্ণা হয়ে গেছে। তাই জন্যই তো ভাল একটা মেয়ে দরকার। যে ওর এই ভুল ভাঙাবে।”
অনিক মাথা নাড়ল। সে আফরিনের সম্পর্কে আরও খোঁজ খবর নেবে।

________________

সাঈদদের এই দলের কোন প্যাটার্ন নেই। মিল একটাই। এরা সবাই বেদে পাড়ার ছেলেমেয়ে। এছাড়া বয়স একেকজনের একেকরকম। সেজন্য আফরিন গড়পড়তা সবাই যেন অক্ষর জ্ঞানটা শেখে সেভাবে এগিয়ে গেছে। এখন সবাই বাংলা পড়তে পারে। টাকার হিসাব করতে পারে। ওদের চলার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আফরিন চেয়েছিল ওদের স্কুলে ভর্তি করতে। সেটা সম্ভব না। এতো জনের ব্যয় বহন করার সামর্থ্য আফরিনের নেই। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোকে এভাবে ছেড়ে দিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। বেদে পাড়ার তিন ভাগের এক ভাগ এরা। বাকিরা আসেনি সম্ভবত ভরসা করতে না পেরে। টিপ টপ হয়ে চলা ভদ্রমানুষগুলোকে তার খুব একটা ভরসা করতে পারে না।

আফরিনের চিন্তার অবসান ঘটাতেই যেন আফসানা কথাটা তুললেন।
কুরবানীর আগে আগে তারা বছরের হিসাব করে যাকাত দিয়ে দেন। প্রতিবার দেয়া হয় না। মাঝে মাঝে। এবার যাকাতের পরিমাণটা বেশি। ঠিক কীভাবে, কাকে দিলে এর সঠিক ব্যবহার হবে সেটা নিয়েই শলা পরামর্শ করতে বসেছিল চারজন।

মোশাররফ বললেন, “প্রতিবার যেখানে দাও সেখানে দিলেই তো হয়।”
“আগের বার যাদের দিয়েছিলাম তাদের দরকার ছিল। এবার শুনেছি ঐ বাড়ির ছেলেটা কাজ করছে। কষ্ট করে হলেও চলছে। আর বারবার দিলে যদি এই আশায় ওরা থাকে তাহলে তো কাজে গতি পাবে না।”
“তাহলে কি করবে?*”
“এজন্যই তো তোমাদের ডাকলাম। বলো কি করব?”
সাদমান বলল, “কত টাকা হয়? হিসাব করেছ?”
“হ্যাঁ। ছাপ্পান্ন হাজার ছয়শ তেতাল্লিশ। সাতশই দিয়ে দেব।”
“এত!” আফরিন চোখ বড় করল।
“আরে আমাদের দুজনের একসাথে।” মোশাররফের দিকে ইশারা করে বললেন আফসানা। আফরিন স্বাভাবিক হলো।
“ওহ।”
“একটা কাজ করা যেতে পারে।” সাদমান বলল।
“কী?” আফসানা ছেলের দিকে তাকালেন।
“রিনি যেই বাচ্চাগুলোকে পড়ায় ওদের পড়া তো মনে হয় শেষ। তাই না?” আফরিনের দিকে তাকাল সাদমান।
আফরিন বিষণ্ণ চেহারায় মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ।”
“ওদের পারিবারিক যেই ঐতিহ্য তাতে ছেলেগুলো কয়েক দিনেই বসে যাবে। আর মেয়েদের বাইরে বের করে দেবে।” কেউ কিছু বলল না। সাদমানের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করল সবাই।
“ওদের যদি টাকাটা দেয়া যায় তাহলে মে বি ভাল হবে।”
“কীভাবে?”
“ওরা ভাড়া থাকে না?” আফরিনকে জিজ্ঞেস করল সাদমান।
“হ্যাঁ।”
“ঘরের পুরুষেরা হয় নেশা করে জুয়া খেলে নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। মেয়েরা যেই কাজ করে তাতে যা হয় সেটা না হওয়ারই সমান। এই টাকায় বাচ্চাগুলোকে যদি একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া যায় তাহলে সেটা ওদের জন্য ফলপ্রসূ হবে।”
“কী কাজ করবে?” মোশাররফ হোসেনের গলায় কৌতূহল।
সাদমান একটু ভেবে বলল, “একটা ফুড ভ্যান দেয়া যেতে পারে। ওরা স্কুল কলেজের সামনে বসল। কাজটা কন্টিনিউয়াস থাকা দরকার”
আফরিন হাততালি দিয়ে উঠল, “দারুন হবে!”
আফসানা হাসল।
“আচ্ছা তুমি একবার ইমাম সাহেবের কাছে শুনে নিও।”
“ঠিকাছে।” মোশাররফ হোসেন বললেন।
আফরিন হাসি হাসি মুখে সাদমানের হাত ধরল, “থ্যাংক ইউ!”

~চলমান~