অন্তঃপুর পর্ব-১১

0
3

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
১১.

আফরিনকে অনিক খারাপ ভাবতে না চাইলেও ঘটকের কথায় মনে একটা দোটানায় তৈরি হয়েছে। অবশ্যই সেটা নেতিবাচক। ফলে রুমিলা বেগমও আর এগিয়ে যেতে চাননি। এই ক্ষণে নাবিলার সম্ভ্রমের প্রশ্নে এই ভাই বোনের সাহসী অবস্থান তাকে ধন্দে ফেলে দিয়েছে। অনিক সিদ্ধান্ত নিল সে আরেকটু খতিয়ে দেখবে। দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে আফরিন কেন নাবিলার ঘটনায় সম্পৃক্ত হলো? কারণ তো একটা আছেই। এই পৃথিবীতে কারণ ছাড়া কি কখনোই কিছু হয়?

চল্লিশ মিনিটের মাথায় রাফির ডাক পড়ল। কিছুক্ষণ পর তিনজনই বেরিয়ে এল।
রাফি সাদমানকে ইতস্তত করে বলল, “আপনাদের এই ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। আসলে বিষয়টাই এমন হয়েছে যে..”
সাদমান রাফিকে থামিয়ে দিল। এই লোকের উপর্যুপরি বিনয়ে তার নিজেরই বিব্রত লাগছে।
“এভাবে বলার মানে নেই। আমার বোন হলে তো আমি ফেলে আসতে পারতাম না।”
রাফি কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল। আফরিন আড় চোখে তাকাল। এই কথাটা তাকে বলার সময় কখনোই মুখে আসে না।

মাসুদকে যেদিন কোর্টে ওঠানো হবে সেদিন সাদমান এবং আফরিনের স্টেটমেন্ট চাওয়া হয়েছে। আফরিন ভেবেছিল সাদমান গাইগুই করবে। তাকে অবাক করে দিয়ে এক বাক্যে রাজি হয়ে গেছে সাদমান।

“কী হয়েছে রে তোর?” সন্দেহী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আফরিন।
“কী হবে?” সাদমান হেলমেট পরল।
“মনে তো হল স্টেটমেন্ট দেয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলি। যত নাটক সব আমার সাথেই।” আফরিন মুখ বাঁকাল।
বাইকে উঠে সাদমান বলল, “বাবা মাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম। সেজন্য দূরে থাকতে চেয়েছি। উল্টো দেখলাম ওদের শতভাগ সমর্থন আছে। তাহলে আর পিছিয়ে যাব কেন? যাই একবার কোর্টে। ভাল মানুষটার চেহারাটা চিনে আসি।”
আফরিন উঠে বসল বাইক স্টার্ট দিল সাদমান।

অনিক রাফির গা ঘেষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “তোর গাড়িটা আমাকে দিবি?”
“কেন?” রাফি ভুরু কুচকে তাকাল।
“কাজ আছে। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য দে।”
“আমি অফিসে যাব কীভাবে?”
“একটা সিএনজি ডেকে চলে যা। গাড়িটা একটু ধার চাইছি বলে ভাব দেখাচ্ছিস?” বিরক্ত কণ্ঠে বলল অনিক।
“যা যা। আর যা-ই করিস অকাজ করিস না।”
“দেখা যাবে।” অনিক আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “ঐ বাইককে ফলো করো জাফর। কুইক!”
জাফর বেচারা থতমত খেয়ে গেছে। ফলো করার কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে।
“জি?”
“আরে ভাই তুই গাড়ি চালা। ঐ বাইক যেদিকে যায় সেদিকে যা।”
জাফর গাড়ি চালাতে শুরু করল। রাফি বিরক্ত হয়ে দেখল তার গাড়িটা চলে যাচ্ছে। কপালে আড়াআড়ি করে হাত দেখে সে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল চাতক পাখির মতো। একটা সিএনজির আশায়।

জাফরের জীবনে এই অভিজ্ঞতা নতুন। ফলো করতে যেয়ে সাদমানের বাইকের আগে চলে যাচ্ছে সে। অভ্যাস বলে কথা। ঠিকঠাক মতো ওদের পেছনে থাকতে পারছে না। সে ঢোক গিলে বলল, “স্যার ওরা কি নাবিলা ম্যাডামের আসামী?”
“আরে না! ওরা নাবিলা ম্যাডামকে হেল্প করেছে ঐদিন। উদ্ধার করেছে।”
“তাহলে আমরা ওদের পিছু নিচ্ছি কেন?”
“কপাল জাফর কপাল! তোমার স্যারের বিয়ে দেয়ার জন্য এখন আমাকে গোয়েন্দাগিরি শুরু করতে হয়েছে। বাই দ্যা ওয়ে! যাই হয়ে যাক না কেন তুমি কিন্তু রাফিকে এসব কিছু বলবে না! জাফর থেকে মীরজাফর হয়ে যেও না ভাই!”
জাফর সামনে তাকাল। চাকরি স্থায়িত্ব নিয়ে তার ভয় হচ্ছে। ঘামের একটা সূক্ষ্ম ধারা কপাল থেকে নেমে এসেছে। স্যারের এই বন্ধুর পাল্লায় পড়ে আর কি কি করতে হবে আল্লাহই জানেন।

সাদমান একটু ঘুরে স্কুলের সামনে গেল। গতকাল শুক্রবারে ফুড ভ্যানের উদ্বোধন হয়েছে শিশুপার্কের সামনে। তারা সেখানে ছিল। আজ ওদের স্কুলের সামনে থাকার কথা। কাছাকাছি পৌঁছাতেই দেখা গেল সবুজ রঙের চকচকে গাড়িটা। গাড়ির পুরো টাকা শোধ করা হয়নি। কিছু বাদ আছে। মোশাররফ হোসেন সঞ্চয় থেকে কিছু টাকা এক করে দিয়েছেন। সাদমান বলে দিয়েছে বাকি টাকা ফেরত দিয়ে দিতে। তাই শুনে আফরিন বলেছিল, “এটা না বললে কি হতো?”
“যাকাতের টাকা ওদের অধিকার কিন্তু আরেকজনের সঞ্চয়ের টাকা না। আর ওরা যেন মনে না করে আমরা ওদের দান করেছি। যাকাত তো দান না। প্রথম দিকে কাজের গুরুত্ব থাকবে। জোশ নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু দিন গড়াতেই যখন আলসেমি জেঁকে ধরবে তখন যেন মাথায় থাকে ওদের কাছে কেউ টাকা পায়। ওদের বাড়ির যেই পরিবেশ লাইনে রাখতে হলে একটু টাইট দিতেই হবে।” আফরিন আর কিছু বলতে পারেনি। সাদমান সবসময় তার চেয়ে এগিয়ে চিন্তা করে।

খুব ভিড় না হলেও দোকান ফাঁকা পড়ছিল না। একজন দুজন থাকছিল। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে সাদমান এগিয়ে গেল। আফরিনকে বলল, “চল একটা আইসক্রিম খেয়ে আসি।”
বাচ্চারা তাদের দেখেই হৈ চৈ শুরু করে দিল। কয়েক রকম খাবার অফার করলে সাদমান বলল, “পকেটে টাকা নেই। দুটো আইসক্রিম দাও।”
সাঈদ কোনোভাবেই টাকা নেবে না। সাদমান শান্ত কণ্ঠে বলল, “ভাগের ব্যবসা করছ। টাকা তো তোমার একার না। নিজের ব্যবসা যখন করবে তখন হাড়ি হাড়ি ফ্রি দিলেও দায় থাকবে না।”
সাঈদ চুপচাপ টাকা নিল। আফরিনের মনে হল সাঈদের বয়স যেন হুট করেই কয়েক বছর বেড়ে গেছে। দায়িত্বের ভার বোধহয় এতটাই!

বিশ মিনিটের মাথায় তারা চলে গেলে অনিক গাড়ি থেকে নেমে ফুড ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল। দুর থেকেই বুঝতে পেরেছে বাচ্চাগুলোর সাথে আফরিন, সাদমানের ভাল খাতির আছে। কাজেই ওদের কাছে কিছু তথ্য পাওয়া যেতেই পারে। অনিক বিড়বিড় করল, “যেখানেই দেখো ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমুল্য রতন।”

অনিক একটা বার্গার অর্ডার দিয়ে সামনে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মাঝেই সাঈদ বার্গার দিয়ে দিল। অনিক খেতে খেতে বলল, “তোমাদের গাড়িটা সুন্দর।”
সাঈদ চমৎকার করে হাসল।
“আপা পছন্দ করেছে।”
“আপা কে?” স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করল অনিক।
“আমাদের একজন বড় আপা আছে।” সাঈদের চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ।
কি মনে করে অনিক বলল, “এই মাত্র যে গেল সে নাকি? তোমরা হৈ চৈ করছিলে।”
“আপনি দেখেছেন? ঐটাই আমার আপা। আমাদের সবার আপা।” সাঈদের মুখটা ঝলমল করে উঠল। অনিক এক মেঘ ঘনিয়ে আসা আকাশের নিচে এমন উজ্জ্বল আলো দেখে অবাক হল।
“তোমাদের কাছে খুব স্পেশাল মনে হচ্ছে?” পিরিচ সরিয়ে পানি খেল অনিক।
“অনেক! আমাদের এই গাড়ি তো আপাই কিনে দিয়েছে। আমাদের পড়াশোনা শিখিয়েছে।” গড়গড় করে সব বলতে শুরু করল সাঈদ। পারলে সে চিৎকার করে পৃথিবীর সবাইকে বলে, তার একটা আপা আছে।
সাঈদ খানিকক্ষণের জন্য তার ঘাড়ের গুরুভার ভুলে বাচ্চা হয়ে গেল। চিন্তার দল মাথা থেকে সরে গিয়ে সেখান মিলমিশ করে মিছিল করতে শুরু করল স্মৃতিরা। বুকে চাপানো আফরিনের প্রতি ভালোবাসার পসরা সে মেলে ধরল অনিকের সামনে। অনিক চুপ করে রইল। ক্ষণে ক্ষণে চমকাল। মুগ্ধ হয়ে শুনল সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, মনুষ্য জাতির এক জনের গল্প।

⁠。。。。。。。。。

অনিক বাড়িতে এসে স্ত্রী বিথীর সাথে সবটা শেয়ার করল। বিথী শুনে শান্ত কণ্ঠে বলল, “তুমি কি আরেকটু খোঁজ নিতে পারো?”
“কেমন খোঁজ?”
“মেয়েটার ভার্সিটিতে।”
“হ্যাঁ সে তো জেবার কাছেই পাওয়া যাবে।” জেবা অনিকের চাচাত বোন। সেও একই ভার্সিটির ছাত্রী।
“এত বড় ভার্সিটি। ডিপার্টমেন্ট নিশ্চয়ই এক না? খোঁজ খবর করতে তো সময় লাগবে। একটু খতিয়ে দেখ।”
“তারপর?” অনিক জিজ্ঞেস করল।
“তারপর মানে?”
“তারপর কি করবে?”
বিথী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কি যেন ভাবল। তারপর বলল, “মেয়েটার ক্যারেকটার আমি কিছুটা গেস করছি। গেস দিয়ে কাজ চালানো যায় না। ওর চলন বলন সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল বলতে পারবে ওর বন্ধু বান্ধব। সেখান থেকে পজিটিভ রিভিউ পেলে আমার মনে হয় আগানো উচিত। জন্ম সংক্রান্ত কোন বিষয়ে তো মেয়েটার নিয়ন্ত্রণ নেই। যেটায় আছে সেটায় কেমন নিয়ন্ত্রণ করছে এটাই মুখ্য বিষয়।”
অনিক ভাবুক স্বরে বলল, “দাদীমা কী মানবে?”
“নাবিলার কথা শুনলে এক্ষুণি মানবে।” বিথী হাসল। তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস।
“বলছ?”
“আলবৎ!”
“ফোন করে দেখি তাহলে।”
জাফর তখন বাড়িতে ছিল না। ফিরল সন্ধ্যার পর। তখন অনিক বাইরে। ফলে ঐদিন আর কথাবার্তা হল না। দিন দুই পরে জেবা যখন মোটামুটি আফরিনের সব রেকর্ড ঘেঁটে ফেলেছে তখন রুমিলা বেগমের সাথে অনিকের কথা হল। নাবিলাকে এই মেয়ে ঐ সময়ে সাহায্য করেছে শুনে রুমিলা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। অতঃপর ধীর কণ্ঠে বললেন, “তুমি কি মেয়েটার সাথে আমার একবার দেখা করাইতে পারবা? আমার বাড়ির বউ না হোক তাও ওর মাথায় আমি একটু হাত রাখতে চাই। আমার নাতনিরে যে বাঁচাইছে তার কাছে তো আমি আজীবনের ঋণী।”

~চলমান~