অন্তঃপুর পর্ব-১৮

0
223

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
১৮.

রাফির চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। সে কোথায় গিয়েছিল কাউকে বলেনি। বলার মতো তেমন কিছুই না। বাড়ি থেকে পনের মিনিটের দুরত্বে একটা বিশাল বটগাছ আছে। তার চারিপাশে শান বাঁধানো। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই ঐ বটগাছের পাশের চায়ের দোকান খোলা থাকে। সত্তরের নিচে বয়স এমন কাউকেই সেখানে দেখা যায় না। দোকানদারের নিজেরও বাহাত্তর বছর বয়স। রাফি ওখানেই গিয়েছিল। ভেবেছিল অন্যদিন যেই আলাপ শুনে মেজাজ গরম হয়ে যায় আজকে যদি সেই আলাপ শুনে মনোযোগ অন্যদিকে যায় তাহলে একটু শান্তি পাওয়া যাবে।
তেমন কিছুই হল না। সবাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। আজ বুড়োগুলো পারিবারিক আলোচন শুরু করেছে। কে কবে বিয়ে করেছে, বিয়ে করে কি লাভ হয়েছে কি ক্ষতি হয়েছে এই নিয়ে গবেষণা চলছে। মেজাজ ঘুরে যাওয়ার বদলে আরো বেশি বিগড়ে গেল। সাথে ফ্রিতে জুটেছে বটগাছের এক ইঞ্চি সাইজের মশার কামড়। রাফির অবস্থা পুরোই নাজেহাল।
বাড়িতে ঢুকে আফরিনকে দেখে সেদিকে আর গেলই না রাফি। সোজা ঘরে যেয়ে দরজা আটকে নিজেকে এই কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইল। এতে তার শত্রুদের সুবিধাই হল।
ঘর অন্ধকার ছিল। তাই ফুল দিয়ে সাজানো ঘরটা তাকে দেখতে হল না। দেখে যে রাফি খুশি হত না এটা বোঝা কষ্টের না।
ঘরের ফার্নিচার এদিক ওদিক করা হয়েছে সাজানোর সুবিধার্থে। এসব রাফির অজানা। ফলে আলমারিটা যে ওপাশ থেকে সরিয়ে দরজার পাশে এনে রাখা হয়েছে সেটা না জেনেই পা বাড়িয়েছে রাফি। জায়গাটা ফাঁকা ছিল। ধাক্কা খাওয়ার কোন কথা না থাকলেও রাফি আলমারির সাথে শক্ত একটা ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।
ডান পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলের নখটা মনে হয় উল্টেই গেছে। রাফি চুপ করে বসে রইল। একটু পেছাতেই বিছানা পিঠে ঠেকল। রাফি মাথা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে ফেলল সাথে সাথে।

রাফি জানে সবাই তার উপরে বিরক্ত। বিশেষ করে দাদীমা। দাদীমার অনুরোধ সে রাখেনি। সেটা যখন আদেশে পরিণত হয়েছে তখনও না। তার ঊনত্রিশ বছরের জীবনে এমন কখনোই হয়নি। দাদীমার আদেশ, অনুরোধ সবটাই তার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই একটা জায়গায় এসেই সে আটকে গেছে। অনিক তার উপরে বিরক্ত হয়ে আছে। মুখে না বললেও রাফি বোঝে। সুস্থ সবল পুরুষ মানুষ। বিয়ে করবে, সংসার করবে এমনই সবার চাওয়া। তার মনের ভেতরটা কেউ কেন বুঝতে চাইছে না?

রাফি ভাবল ঘুমিয়ে যাবে। এসব ভাবলেই মাথা ব্যাথা করে। কিন্তু ঘুমাতে পারল না। চোখের পাতায় ধরা দিল ফেলে আসা শৈশব।

এক বিকেলের কথা। তখন তার বয়স পাঁচ হবে হয়ত। কাঁচের একটা শোপিস দিয়ে রাফি খেলছিল তার এক বন্ধুর সাথে। নামটা যেন কি ছিল? মনে আসছে না।
শোপিসটা রাফির খুব পছন্দের ছিল। ভেতরে একটা সাদা রঙের বাড়ি ছিল। শোপিসটা ঘোরালে বাড়িটাও ঘুরত। ওটার দিকে তাকিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারত সে। চমৎকার ঐ জিনিসটা কিনে দিয়েছিল তার হোম টিউটর। সেটা তখনও মাকে দেখানো হয়নি। খেলার এক পর্যায়ে কোত্থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে এল। ছোট্ট রাফির বুঝতে অসুবিধা হল না তার বাবা মা আবার ঝগড়া করছে। কিছুক্ষণ পর মা বেরিয়ে এলে রাফি দৌড়ে গেল শোপিস হাতে নিয়ে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, “মা দেখ কি সুন্দর! মিস…”
তার পরের কথাগুলো আর বলতে পারেনি সে। আসিফা লাথি দিয়ে সেই শোপিসটা ভেঙে ফেলেছেন। রাফি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভাঙা শোপিসের টুকরোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়েছিল সে বোধহয় মায়ের নিজের ছেলে না। লজ্জায় বন্ধুর দিকে তাকাতে পারেনি সে। মা ছেলেটার সামনে লাথি দিল। ছিঃ! কি লজ্জা! রাফি সেদিন কাঁদেনি। তার এত পছন্দের শোপিস যে মা লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলতে পারেন এই নির্মম সত্যিটা বুঝতেই তার বয়স বেড়ে গিয়েছিল।

আর একদিনের ঘটনা। মাহমুদ গেছেন রাফিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে। তখন সে ক্লাস ফোরের ছাত্র। এমনিতে ড্রাইভারের সাথে যাতায়াত করলেও সেদিন কোন এক কারনে বাবা তাকে আনতে গিয়েছিল। গাড়িতে মা ফোন দিল। দুই একটা কথা বলার পরই বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল মাহমুদ। রাফির ছোট্ট প্রাণটা কেঁপে উঠল। গাড়ি চালাতে চালাতে মায়ের সাথে ঝগড়া শুরু করল বাবা। বিশ্রী গালি দিতে শুরু করল। একটু পর কি মনে হল কে জানে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে রাফিকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল বাবা। স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রাফি দাঁড়িয়ে রইল। আশপাশে ভীতু চোখে তাকিয়ে রাস্তার পাশের বন্ধ দোকানের ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়াল। টানা এক ঘন্টা কান্নাকাটির পর তার চোখের পানি শুকিয়ে গেল। বাবা ফিরে এলো না। অবস্থা এমন হল সামনে দিয়ে মানুষ যাতায়াত করতে দেখলেও রাফির ভয় হচ্ছিল আবার মানুষ না দেখলেও ভয় হচ্ছিল।
রাফির চোখের পানি শুকিয়ে গেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলেও কেউ তাকে নিতে এল না।
সন্ধ্যার কিছু আগে দাদা এলেন হন্তদন্ত হয়ে। ছো মেরে তাকে কোলে নিয়ে বললেন, “কারো ফোন নিয়ে ফোন দিবা না দাদা!”
রাফির বিশ্বাস হয়ে গেল দোষটা তারই। বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া করে মাঝ রাস্তায় তাকে ফেলে অন্য কোথাও চলে যাবেন এটাই বোধহয় স্বাভাবিক।
সেই ঘটনার পর রাফির কঠিন জ্বর এল। সুস্থ হয়ে ওঠার পর আর কখনোই সে বাবা মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়ার আবদার করল না।

এভাবেই অসংখ্য স্মৃতি দিয়ে তার এই জীবন গড়ে উঠেছে। সেগুলো সুখ স্মৃতি নাকি দুঃখ সেই অঙ্ক রাফি কষতে চায় না। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পায় ভরা স্কুলের মাঠে মাহমুদ ক্লাস নাইনের রাফিকে চড় মা-রছেন। শক্ত মুখে বলছেন, “যেমন মা তেমন ছেলে!” তার বন্ধুরা বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে। এত বড় ছেলে বাবার হাতে মা-র খায় নাকি!
বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে যেত না রাফি। বাবার সাথে ঝগড়া করে মা তাকে বকতেন বন্ধুদের সামনে। ওরা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করত, “তোর মা বাবা শত্রু নাকি?”
রাফি চুপ করে থাকত। কাউকে কিছু বলতে পারত না। একসময় বন্ধুদের সাথে কথা বলা কমিয়ে দিল। সম্পর্ক মলিন হতে হতে অস্তিত্বহীন হয়ে গেল।
রাফির মনে আছে ছোট্ট নাবিলাকে মা মা-রতে গিয়েছিল বাবার কাছে যাওয়ার আবদার করেছিল বলে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে রাফি মা-র খেয়েছিল। আসিফার দেয়া ধাক্কায় কাঁচের টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে গলার কাছে কেটে গিয়েছিল। সেই কাটা দাগটা এখনো আছে।

রাফির নিজের ওপর মায়া হয়। আঁধার ঘরে একলা বসে সেই স্মৃতিগুলো হা-না-দার বাহিনীর মতো আ-ক্র-মণ করে। রাফির মনে হয় কোন এক উপায়ে টাইম মেশিন দিয়ে সে ছোট্ট রাফির কাছে যায় যার শোপিস মা লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলেছেন। যাকে মাঝ রাস্তায় বাবা ফেলে গেছেন। যাকে ভরা মাঠে বাবা চড় মে-রে-ছেন। যাকে বন্ধুদের সামনে মা হাসির পাত্র বানিয়েছেন। সেই রাফির কাছে যেয়ে তাকে কোলে নিয়ে, বুকে চেপে সে বলে “এই তো আমি আছি। ভয় কীসের!”

রাফির চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নখটা বোধহয় ম-রেই গেছে।

__________________

বিয়ের সাজটা নিজেকেই বিদ্রুপ করছিল। তাই গরমের নাম করে তার থেকে নিজেকে রেহাই দিল আফরিন। নিজেকে নিজের কাছে জোকার বলে মনে হচ্ছে। যাকে ঘিরে পুরো সার্কাস চলছে।
বাথরুম থেকে বের হতেই রুমিলার মুখোমুখি হল আফরিন। বৃদ্ধা শক্ত মুখ করে বসে আছেন। ঘটনায় তার কি অবদান সেটাই এখনও বুঝতে পারছে না আফরিন। ফলে সে কি শাস্তি পাবে নাকি সেটাও ঠাহর করতে পারছে না।

“ক্ষুধা লেগেছে ভাবি?” মেয়েটা শুনল। আফরিন মন করতে পেরেছে ওকে কোথায় দেখেছে। কিন্তু ঐ পার্কে ও কীভাবে গেল বুঝতে পারছে না।
“ভাবি?” আবার ডাকল তিতলি।
“না।” যার সদ্য বিবাহিত বর তাকে ফেলে ঘরের দুয়ার দিয়েছে তার ক্ষুধা লাগাটা অসুন্দর বৈ কি।
“আমার সামনে বসো বউ।” রুমিলা ডাকলেন। তার কন্ঠ ভঙ্গুর। চেহারার সাথে কণ্ঠ মিলছে না। আফরিন ধীর পায়ে বিছানায় বসল। দাদী শাশুড়ির মুখোমুখি।
রুমিলা হা করে নিশ্বাস নিলেন। আফরিনের দুই নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললেন, “আমার নাতির উপরে রাগ করছ?”
আফরিন উত্তর দিতে পারল না। রাগ করার অধিকার জন্মানোর আগেই লোকটা দুজনের মাঝে দেয়াল বসিয়ে দিয়েছে। এমন মানুষের উপরে কি একটা সইয়ের ভিত্তিতে রাগ করা যায়?
“তিতলি তুই যা।” মেয়েটা চলে গেল। আফরিন তার নাম জানতে পারল। তিতলি।
রুমিলা আফরিনের দিকে তাকালেন। কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। থতমত খেয়ে গেল আফরিন।
“আমার নাতির উপরে রাগ করো না বউ। আমার নাতি সারাজীবন দুঃখ পেয়ে আসছে। বুদ্ধি হয়ে থেকেই বাপ মা-র ঝগড়া দেখছে। একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করে সব রাগ ওর উপরে ঝাড়ছে। আমার ছোট্ট নাতি বাপ মার ভালবাসা পায় নাই বউ। ও বিয়ে করেছে চাপে পড়ে।”
হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন রুমিলা। আফরিন কাঠ হয়ে বসে রইল। রুমিলা একে একে সব বললেন। সব। আফরিন নীরবে সব শুনল। থেকে থেকেই রাফির চোখজোড়া ভেসে উঠল চোখের পাতায়। বিয়ের প্রথমদিন ঘর ভরতি মানুষের সামনে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য লোকটার উপরে কঠিন রাগ হওয়া উচিত। নববধূ মাত্রই জানে সে কি বিশ্রী অপমান! অথচ মস্তিষ্কের সাথে চরম বিরোধিতা করে মন ঐ লোকটার জন্য এক বুক মায়ার জন্ম দিল। সেই মায়া ভিজিয়ে দিল চোখ। আফরিন বহু শাসন করেও তাদের আটকে রাখতে পারল না। বিয়ের প্রথম দিনই তার সাথে রুক্ষ ব্যবহার করা লোকটার জন্য অশ্রুরা গাল ভিজিয়ে একাকার দিল।

~চলমান~