অন্তঃপুর পর্ব-২৫+২৬

0
240

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২৫.

বিমর্ষ মনে বাড়ি ফিরল রাফি। তার মনটা ভার হয়ে আছে। ভেবেছিল অনিকের সাথে কথা বললে মনটা খানিক হালকা হবে। তেমন কিছুই হয়নি। অনিক তাকে রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিজেকে মাহমুদের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে বাবার রক্ত বেইমানি করেনি। করেছে সে নিজে। নিজের সাথে।
অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরল রাফি। আফরিনের সাথে কথা বলা উচিত। কী বলা উচিত? সে বুঝতে পারছে না। অনিকের কাছে ফোন দিয়ে লাভ নেই। অনিক বলেছে নিজের মাথায় যা আসে তাই করতে। রাফির মাথায় কিছু আসছে না। সে চিত হয়ে শুয়ে রইলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সে ওভাবেই রইলো।

রাফির সাথে একবার কথা বলা দরকার। সাঈদদের ফুড ভ্যানটা ভাল চলছে না। এই মাসে খুব লোকসান হয়েছে। ব্যবসা চালিয়ে নিতে হলে এখন বেশ কিছু টাকা লাগবে। এত টাকা আফরিনের পক্ষে দেয়া সম্ভব না। মোশাররফ হোসেনের কাছেও নেই যে চাইবে। রাফির কাছে চাইলে হয়তো না করবে না। কীভাবে চাইবে আফরিন বুঝতে পারছে না।

হাসপাতাল থেকে সে ফিরেছে সাতটায়। রাফিকে বাড়িতে দেখে অবাক হয়েছে আফরিন। তিতলিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছে, “তোমার ভাই বাসায় কেন?”
“জানি না তো ভাবি।”
“শরীর খারাপ নাকি?”
“বলতে পারলাম না। এসেই সোজা উপরে চলে গেছে।”
আফরিন চিন্তিত নজরে উপরে তাকাল। সে কী একবার উপরে যাবে?
চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকল আফরিন। উপরে যাওয়ার কথা মনে হলেই বিয়ের দিনের অপমানটা মনে পড়ে। একটা অপ্রকাশিত রাগ, চাপা ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
এক গ্লাস পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করল আফরিন। রাফি এই এক মাসে এত আগে কখনোই আসেনি। আজকে এসেছে তার মানে নিশ্চয়ই কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যা জানার উসিলায় ফুড ভ্যানের কথাটা একবার বলে দেখবে। সাহায্য চাইতে হলে গো ধরে থাকা যাবে না। করুন মুখ করে দাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
রুমে যেয়ে বোরখা খুলে হাত মুখ ধুয়ে নিল আফরিন। রুমিলা হঠাৎ বললেন, “বাবা মার সাথে কথাবার্তা হয় তো?”
“জি দাদীমা। পরশুদিন মায়ের সাথে কথা হয়েছে।”
“আজকে বলো নাই?”
“সময় পাইনি দাদীমা।” বিব্রত কণ্ঠে বলল আফরিন।
রুমিলা মাথা নেড়ে বললেন, “এমন বাপ মায়ের সাথে রোজ কথা বলতে হয়। নিয়ম করে কথা বলবা। ওদের প্রতি তোমার অনেক দায়িত্ব।”
আফরিন রুমিলার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। রুমিলা হেসে বললেন, “তোমার মা আমাকে সব বলেছে। কপাল গুণে মানুষ এমন বাপ না পয় নাতবৌ। খুব শুকরিয়া আদায় করবা।”
আফরিন উপর নিচ মাথা নাড়ল। মা কখন বলেছে? সে তো জানে না।

রাফির রুমের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আফরিন। ইতস্তত লাগছে। কোন জায়গা থেকে জড়তা, অস্বস্তি এসে তার চারপাশে মিছিল শুরু করেছে। অথচ নিয়মানুযায়ী এটাই তার ঘর হওয়ার কথা ছিল। তার সংসারের কেন্দ্রবিন্দু।
জড়তা ঠেলে দরজায় নক করল আফরিন। একবার, দুবার, কয়েকবার। রাফি কি ঘুমিয়েছে? সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
আফরিন চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো তখন রাফির কন্ঠ পাওয়া গেল।
“কে তিতলি? দরজা খোলা আছে।”
আফরিন ভেতরে ঢুকল। রাফি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। হাতে একটা বই।
“আপনি বোধহয় ব্যস্ত। আচ্ছা পরে আসবো।”
আফরিনকে দেখে এক প্রকার লাফ দিয়ে উঠে বসল রাফি।
“না ব্যস্ত না। আপনি আসুন।”
আফরিন ঢুকল। রাফি উপস্থিতিতে এই প্রথমবার। অস্বস্তি লাগছে তার।
“আপনার কাছে একটা ফেভার চাইতে এসেছি।” অস্বস্তি মাখা সুরেই বলল আফরিন।
রাফি আফরিনের দিকে তাকিয়ে ছিল অবাক হয়ে। ওভাবে ধমক দেয়ার পর এই মেয়ে তার সাথে কথা বলবে এটা ভাবনাতেই আসেনি।
“বলুন কেমন ফেভার। দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।”
আফরিন টেবিলের চেয়ার টেনে বসল। সরাসরি রাফির দিকে তাকাল না। ডান হাত দিয়ে বাম হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে ভাবল কীভাবে টাকার কথাটা বলবে।
“কালকে আমার সাথে এক জায়গায় একটু যাবেন?”
রাফির কাছে এসবই স্বপ্নের মতো লাগছে। আফরিন তার ঘরে এসেছে, তার সাথে কথা বলছে, আবার কোথাও যেতেও চাইছে। তার কি লটারি লেগে গেছে?
“আপনি যখন ফ্রি থাকবেন তখনই যাওয়া যাবে। তবে তিনটার আগে আগে।”
“বেশি দূরে?”
“না আমাদের বাড়ির ঐদিকে।”
“সকালে আমার একটা মিটিং ছিল। বিকেলে গেলে সুবিধা হত।”
“তখন তো আমি হাসপাতালে থাকবো।”
“হাসপাতালে কেন?” রাফির কপালে ভাঁজ পড়ল।
“তিনটা থেকে সাতটা আমার ডিউটি।” আফরিন হতাশ কণ্ঠে বলল। এই লোক ভুলে গেছে।
“আপনি হাসপাতালে এখনও যান?”
“জি।” আফরিনের ভাল লাগছিল না। স্ত্রী কোথায় যায়, কী করে এটুকুও এই লোক জানে না।
“আমি কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করি জানেন?”
রাফি থতমত খেল, “জানি।”
“সাব্জেক্ট জানেন?”
“না।”
“থাক আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আপনি মিটিং করুন।”
আফরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। সে বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। বিয়ের পর থেকেই এই লোকের উপর তার ঘন ঘন মেজাজ খারাপ হচ্ছে। অথচ মেজাজ ঠান্ডা রাখা তার বিশেষ একটা গুণ।
আফরিন উঠে দাঁড়াল। এই লোকের কোনো সাহায্য তার লাগবে না। দরকার হলে ভিক্ষা করে টাকার ব্যবস্থা করবে।
রাফি পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই আফরিন ধুপধাপ করে চলে যাচ্ছিল। হুড়মুড় করে উঠে আফরিনের হাত ধরল রাফি।
“আচ্ছা বিকেলে যাবো না। সকালে যেতে পারবেন? আটটার দিকে?”
হাতের দিকে তাকিয়ে রাফির দিকে তাকাল আফরিন। রাফি আমতা আমতা করে হাত ছেড়ে দিল। মনে হচ্ছে ঐ আগুনগরম চোখ দিয়ে তাকে ভস্ম করে দিতে চায় এই মেয়ে।
“পারবেন যেতে?” আস্তে আস্তে বলল রাফি।
আফরিন যেতে যেতে বলল, “রেডি থাকবেন।”
রাফির মনে হলো বোঝাবুঝির ক্ষমতা ওর শূন্যের কোঠার দিকে চলে যাচ্ছে। এই মেয়ে রাগল কেন সে এখনো বুঝতে পারছে না।

গাড়িতে উঠেই সবার আগে আফরিন যেই কথাটা বলল তা হলো, “মিহাদকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন। ওখানে ওর ন্যূনতম চিকিৎসা হয় না। ফাত্রামি করে মাস শেষে একগাদা টাকা হাতিয়ে নেয় শুধু জায়গাটা দেখিয়ে। কোন আক্কেলে ওকে এত বছর ওখানে রেখেছেন?”
স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে থতমত খেয়ে বসে রইল রাফি। হঠাৎ এই প্রসঙ্গ এল কেন? প্রশ্নটা দমিয়ে রাখতে পারল না সে।
“হঠাৎ এই প্রসঙ্গ এল কেন?”
“আপনাকে আমি বলেছিলাম ওর প্রোগ্রেস হচ্ছে কি না খোঁজ নিন। নিয়েছিলেন?”
“ইয়ে..সময় পাইনি।”
“সময় পাওয়া লাগবে না। দয়া করে ওকে যেয়ে নিয়ে আসবেন। এই সময়টুকুও যদি না পান তাহলে বলবেন আমি যেয়ে ওকে নিয়ে আসবো। জ্বরে পড়ে সারারাত কাতরায়। কাছে একটা মানুষ থাকতে পারে না এমন জেলখানায় কোনো চিকিৎসার দরকার নেই।”
আফরিনের রাগ দেখে রাফি জিজ্ঞেস করতে পারল না ও কবে মিহাদের কাছে গিয়েছিল।
কথা বলতে ভয় পাচ্ছিল রাফি। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “কোথায় যাব?”
“আমাদের বাড়ির রাস্তায়।”
মনে মনে নিজেকে কষে একটা চড় দিল রাফি। গতকালই তো বলেছিল। এমন ভুলোমনা কবে থেকে হয়ে গেল সে?
আফরিন পথ দেখিয়ে চিনিয়ে নিয়ে গেল। গাড়ি থেকে নামার আগে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “সরি। আপনি আমার সিনিয়র। আপনার সাথে এমন ব্যবহার করা আমার উচিত হয়নি। বেয়াদবি করে ফেলেছি। মাফ করে দিয়েন।”
আফরিনের চোটপাটে রাফি মোটেই বিরক্ত হয়নি। খারাপ লাগা তো দুর। কেউ অধিকার খাটিয়ে কথা বললে রাফির মোটেও খারাপ লাগে না। সেখানে সেই মানুষটা যদি আফরিন হয় তাহলে তো কথাই নেই। এই বেলায় এসে আফরিনের এমন সৌজন্যতা রাফির মনোকষ্টের কারণ হলো। তবুও সে মুখ ফুটে বলতে পারল না “আপনি আমার উপরে সারাদিন চোটপাট দেখালেও আমার বেয়াদবি মনে হবে না। বরং ভাল লাগবে।”
বলতে না পারা মানুষগুলোর কষ্টগুলো বেশি। তাদের বুকের ভেতর কথা জমে। জমতে জমতে পাথর হয়ে যায়। সেই পাথর বুকে নিয়েই তারা দিব্যি চলাফেরা করে। হাসিমুখে।

রাফির একটু অস্বস্তি লাগছে। এই ছেলেমেয়েগুলো তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। যখন থেকে শুনেছে সে আফরিনের বর তখন থেকে এই তাকাতাকি চলছে। এমন অস্বস্তি রাফি বিয়ের দিন হয়নি। সেদিন তো সে হুশেই ছিল না।

“আপার কী রং পছন্দ বলেন তো?”
নেতা গোছের ছেলেটা এগিয়ে এসেছে। ওকে দেখেই দলের লিডার বলে মনে হয়। রাফি আফরিনের দিকে তাকাল। ও দূরে আছে। আস্তে করে বলল, “জানি না।”
“মন খারাপ হলে আপা কী করে?”
“জানি না।”
“আমরা আপার কী হই?”
“জানি না।”
“কী জানেন আপনি?”
“জানি না।” বলেই থতমত খেয়ে গেল রাফি। জানি না জানি না বলতে বলতে এটাই ঠোঁটের আগায় ঝুলে গেছে। সমূহ সম্ভাবনা আছে আজকের মিটিংয়ের কোনো এক পর্যায়ে সে বলে ফেলবে জানি না। তখন অবস্থাটা কেমন হবে?
সাঈদ বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। লোকটাকে তার একটুও পছন্দ হয়নি। এক ইঞ্চিও না।

সবার সাথে কথা বলে আফরিন মোদ্দাকথায় এলো।
“আপনার কাছে আসলে কিছু টাকা ধার চাই। গত মাসে ওদের খুব লস হয়েছে। আবার শুরু করতে হলে টাকার দরকার। নাহলে একদম সব বন্ধ হয়ে যাবে। ওদের রুটি রুজি এখন থেকেই আসে।”
রাফিকে ভাবতে দেখে আফরিন বলল, “ওদের কাছে এই গাড়িটা ছাড়া জামানত দেয়ার মতোও কিছু নেই। টাইম টেবিল বেঁধে দিলে ওদের একটু কষ্ট হয়ে যাবে। আপনি যদি..”
“ওরা আপনার কী হয়?”
আফরিন পাঁচ সেকেন্ড সময় নিল, “স্টুডেন্ট। ওদের আমি পড়াতাম।”
রাফি আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
আফরিন বলল, “আপনি ওদের সাথে কন্ট্রাক্ট করে নিয়েন। একটা কাগজ বানিয়ে সই নিয়েন। বিষয়টা যেন ওরা হালকাভাবে না নেয়।”

রাফি সেদিনই খোঁজ খবর নিল। জানতে পারল আফরিন তাদের পড়াত। এই ফুড ভ্যানের পেছনেও তার এবং সাদমানের হাত আছে। তার বিস্ময়ের পারদ বাড়ল। সাথে বাড়ল মুগ্ধতা। বাড়িতে যেয়ে দেখতে পেল আফরিন মিহাদের সাথে খেলা করছে। মিহাদকে একেবারে নিয়ে এসেছে আফরিন?

~চলমান~

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২৬.

মিহাদের সাথে কতক্ষন খেলাধুলা করল রাফি। তার হাতে নতুন ধরনের কিউব। রাফি নেড়েচেড়ে বলল, “কে কিনে দিয়েছে?”
“রিনি।” মিহাদ আঙুল দিয়ে আফরিনের দিকে ইশারা করল। সে দাদীর ঘর থেকে ড্রয়িং রুমের দিকে আসছে।
রাফি ভুরু কুঁচকে তাকাল, “রিনি?” নিজের মনেই কয়েকবার আওড়াল সে। রিনি রিনি। আফরিনের চেয়ে এই নামটা ডাকা সহজ।
“এটার নাম কী?” রাফি জিজ্ঞেস করল।
মিহাদ কতক্ষন চুপ করে থেকে আফরিনের দিকে তাকাল।
আফরিন তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
কিউবটা তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল মিহাদ। আফরিন শব্দহীন ঠোঁট নাড়ল, “মিরর!”
খেলায় জিতে যাওয়ার মতো ঝলমল করে মিহাদ রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, “মিরর কিউব! মিরর কিউব!”
সব মেলানো থাকলে দেখতে আসলেই আয়নার মতো লাগে। কিন্তু উল্টোপাল্টা হয়ে গেলে একেবারে মাথা আউলা হয়ে যায়। রাফি দেখল তার ভাই, যাকে মানুষ বলে আউলা মাথা। সে খুব সহজেই উলোট পালোট হওয়া জিনিসটা সোজা করে ফেলছে। আর সে, যাকে মানুষ সুস্থ মস্তিষ্কের বলে জানে, সে জিনিসটা দেখতেই পারছে না। পৃথিবীর কি বিচিত্র নিয়ম! তবুও তার ভাই পাগল। প্রতিবন্ধী।

ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আফরিনের দিকে এগিয়ে দিল রাফি। আফরিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে বলল, “প্রুফ হিসেবে এই পেপারটা থাক। ক্যাশ দিলে ভাল হয় নাকি চেক?”
আফরিন নরম চোখে রাফির দিকে তাকাল। লোকটা মানবে সে জানত। এত তাড়াতাড়ি এটা ভাবেনি। সে আপ্লুত কণ্ঠে বলল, “থ্যাংক য়্যু।”
রাফি চুপচাপ শুনল। এই প্রথম তার সাথে নরম করে কথা বলছে আফরিন। সসবময় এভাবে বললে তো শুনতেই ভাল লাগে।
রাফি মাথা নাড়ল।
আফরিন বলল, “সাদ আপনার সঙ্গে কথা বলবে।”
“আচ্ছা।”
রাফি উঠে চলে গেল। একবার পিছু ফিরে তাকাল। মিহাদ উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে আফরিনকে কি কি যেন বলছে। মিরর কিউব দিয়ে ভাব করে ফেলেছে। ভালই।

রাতে আসিফা আফরিনের খোঁজে এলেন। আফরিন একটু চিন্তায় পড়ল। শাশুড়ির সাথে তার যোগাযোগ নেই বললেই চলে।
“আফরিন তোমাকে আমি ধন্যবাদ জানাতে এসেছি।” আফরিনের হাত ধরলেন আসিফা।
“কেন মা?”
“মিহাদকে নিয়ে আসার জন্য। আমি ওর মা অথচ ওর সাথে এমন সম্পর্ক করতে পারিনি যে অধিকার দেখিয়ে নিয়ে আসব। ছেলেটা আমার ছোটই থেকে গেছে। কোনোদিন বড় হবে না। দুনিয়ার সবার কাছে ক্ষমা চাইলেও ওর কাছে আমি ক্ষমা পাব না।”
“কাঁদবেন না মা।”
আফরিনের অস্বস্তি লাগছে। আসিফা কাঁদতে শুরু করেছেন। চাপা কান্না। সহজেই থামবে বলে মনে হচ্ছে না। আফরিনের মনে হলো এই কান্না আরো বাড়বে।
তার আন্দাজকে সঠিক প্রমাণিত করে আসিফা আফরিনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
“আমি মরে যাচ্ছি আফরিন। এই বাড়িতে আমি থাকি আসামীর মতো। সবার সামনে অপরাধীর মতো থাকতে হয়। কারো সাথে দুটো কথা বলতে পারি না। যার হাত ধরে এই বাড়িতে এসেছি তার সাথেই সম্পর্ক ভাল না। ছেলে মেয়েদের সামনে চোখ তুলে তাকাতে পারি না। এই জীবন নিয়ে আমি কি করব আফরিন?”
আফরিন হতভম্ব হয়ে গেল। আসিফা তাকে জড়িয়ে ধরবেন এমন সম্পর্ক সে আসিফার সাথে তৈরি করেনি। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে। মনের কোণে একটা অশ্রদ্ধা কাজ করছিল। এই মুহূর্তে সেজন্য নিজেকে অপরাধী মনে হলো আফরিনের। এই বাড়িতে সবচেয়ে একা এই মানুষটা। শ্বশুর তো বাইরে বাইরে ঘুরে আনন্দ ফুর্তি করছে। এই মানুষটার চারটা দেয়াল ছাড়া কেউ নেই।
আফরিন হঠাৎ করেই শাশুড়ি নামক মানুষটার জন্য অপরিমেয় মায়া অনুভব করল। পিঠে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলল, “আমার কাছে বলবেন মা। আমি শুনব আপনার সব কথা।”
আসিফা নিজেকে সামলে উঠলেন। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বললেন, “সরি আফরিন।”
আফরিন গুরুত্ব দিল না। মানুষটা খেই হারিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরেছে।
“তোমাকে বিরক্ত করলাম।”
“একদম না মা। আপনি আমার কাছে বলবেন যা মনে চায়।”
আসিফা কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে রইলেন। ফিসফিস করে যেন নিজের মতো করেই বললেন, “রাফি আর নাবিলার থেকে আমাকে ক্ষমা পাইয়ে দেবে?”
উত্তরের অপেক্ষা তিনি করলেন না। নিজের মতো করে চলে গেলেন। আফরিন পড়ে গেল কঠিন এক ধাঁধায়।

_________________

মিহাদ আফরিনের সাথে খুব যে কথা বলে তেমন না। কিন্তু আফরিন যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ তার সাথে সাথেই থাকে। রান্না করার সময়ও তার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। খেলে নিজের হাতের কিউব দিয়েই কিন্তু আফরিনের সাথেই তার থাকা চাই।

সকালে রুটি বানানোর সময় গলায় ঝোলানো ওড়নাটা অসাবধানতাবশত গ্যাসের চুলার উপর পড়ে গেল। আফরিনের মনোযোগ সিঙ্কের দিকে থাকায় এদিকে খেয়াল করেনি সে। মুহূর্তেই আগুন ধরে গেলে মিহাদ কোত্থেকে রিনি রিনি বলে চিৎকার করতে করতে এল। আফরিন তাকিয়ে চমকে গেল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। মিহাদ এসেই টান মেরে ওড়নাটা গলা থেকে সরিয়ে ফেলল। এক মুহূর্তের জন্য আফরিনের মনে হল মিহাদ আসলেই চৌদ্দ বছরের সুস্থ কিশোর। যে তাৎক্ষণিক বিপদে পদক্ষেপ নিতে পারে।
আফরিন কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আশপাশে আর কেউ ছিল না। বেখেয়ালে আরেকটু সময় পার হলে কি হত ভাবতেই গা শিউরে উঠল। নতুন আরেকটা ওড়না পড়ে রান্নাঘরে ঢুকতে চাইলেই মিহাদ তার হাত ধরল। আফরিন বলল, “রুটিগুলি ছেঁকে আসি।”
মিহাদ হাত ছাড়ল না। আফরিন বলল, “ছাড়ো মিহাদ। যাই আমি।”
মিহাদের এদিকে ধ্যান নেই। সে এক মনে মিরর কিউব মেলাচ্ছে। আফরিন হাত মুচড়ে ছড়িয়ে আনতেই জোরে একটা ধমক দিল মিহাদ।
“রিনি!”
চমকে উঠল আফরিন। কয়েক মুহূর্ত কেঁটে গেল স্বাভাবিক হতে। মিহাদ কিউব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বুদ্ধি মানুষের বলাতেই নেই। কি সুন্দর ঠিক ঠিক ভাইয়ের মতো করে ধমক দিল!
আফরিন হাঁফ ছেড়ে বলল, “তাহলে তিতলিকে একটা ডাক দিয়ে আসি।”
মিহাদ হাত ছেড়ে দিল। মেঝেতে বসে টু বাই টু কিউব টেনে নিল।

সেদিন বিকেলে বাঁধল বিপত্তি। ক্লাস, ডিউটি সেরে আসতে আসতে সাতটা সাড়ে সাতটা বেজে যায়। আজও ব্যতিক্রম হল না। ঘরে ঢুকতেই তিতলির কান্না মাখা চেহারাটা নজরে এল।
“কী হয়েছে তিতলি?”
আফরিনকে দেখে যেন হালে পানি পেল তিতলি। তার হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
“কী হয়েছে!” আফরিন বিস্মিত হল।
তিতলি বলল, “আজকে বিকালে মিহাদ ভাই বাগানের গাছ টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলছিল। আমি নিষেধ করলাম শুনল না। কয়েকবার বলেছি। তারপর টেনে ঘরে নিয়ে আসলাম। ভাল মানুষ ঘরে আসল। এসে হাতের কাছে যা পায় তাই আমার দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে। আমি দৌঁড়ে চলে গেছি। আমাকে না পেয়ে নিজেই নিজের গায়ে মারছে।”
“কী বলো!”
“ফ্লোরে রক্ত দেখছিলাম ভাবি। কিন্তু যাইতে সাহস করি নাই। খালাম্মাকে দেখেও মিহাদ ভাই ক্ষেপে যাচ্ছিল তাই কেউ যাই নাই।”
আফরিন ওভাবেই ছুটে মিহাদের ঘরে গেল। দরজা ভেতর থেকে আটকানো। আফরিন দুটো নিশ্বাস ছাড়ল। অস্থির হওয়া যাবে না।
“মিহাদ?” যথাসম্ভব নরম কণ্ঠে ডাকল আফরিন। কোনো উত্তর এল না। আফরিন আবার ডাকল।
“মিহাদ?” কোনো সাড়া নেই। আফরিন দিশেহারা বোধ করল। একটা কিউব দিয়ে ছেলেটার সাথে ভাব করে ফেলেছে ভাবাটা চরম ভুল হয়েছে। সেই রাতে মিহাদ দরজা খুলল না। রাফি এল বারোটার দিকে তাকেও কিছু বলতে পারল না আফরিন।
সারারাত নির্ঘুম থেকে ছটফট করল চিন্তায় অস্থির হয়ে। সকালের আলো ফুঁটতে না ফুঁটতেই নিচে নামল আফরিন। মিহাদের ঘরের দরজা খোলা। ভেতরের জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে। আশপাশে কোথাও মিহাদ নেই।
বাইরে বের হতেই তার দেখা মিলল। গতদিনের উপড়ানো গাছগুলো সে লাগানোর চেষ্টা করছে। আফরিন দৌঁড়ে তার কাছে গেল। হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
মিহাদ তাকিয়েই রইল। তার জন্য কেউ কাঁদছে এই বিষয়টা একেবারেই নতুন।
আফরিন নরম কণ্ঠে কথা বলতে ভুলে গেল। ভুলে গেল ছেলেটা বিশেষ।
“কত্ত বড় সাহস তোমার! ভাংচুর করো! তিতলিকে মেরেছ কেন? নিজের গায়ে মেরেছ। এসব কোত্থেকে শিখেছ?”
বকতে বকতে হাত পা উল্টে পাল্টে দেখল আফরিন। হাত এক জায়গায় সামান্য কেটেছে। টানতে টানতে ঘরে নিয়ে সেই জায়গায় ফার্স্ট এইড ব্যান্ড বেঁধে দিল।
“আর যেন এমন করতে না দেখি। মনে থাকবে?”
মিহাদ উত্তর দিল না। আফরিন হাত ঝাঁকি দিয়ে বলল, “কথা বলো বাদর ছেলে! মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
মিহাদের সামনে বসে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল আফরিন। এই সম্পর্কের আসন্ন ভবিষ্যত সে জানে না। অন্তত এটুকু জানে রাফিকে সে ছাড়বে না। ঐ লোক ছাড়তে চাইলেও না। এই মুহূর্তে আর্থিক সাহায্যের জন্য মোশাররফ হোসেনের মুখোমুখি হওয়া যায় না। না যায় রাফির কাছে চাওয়া। চাকরিটা দরকার ছিল। কিন্তু আফরিন সিদ্ধান্ত নিল সে কিছু সময়ের জন্য চাকরি ছেড়ে দেবে। ছোট্ট একটা পরীক্ষা করে দেখতে চায় সে। নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকার জন্য হলেও।

~চলমান~