অন্তঃপুর পর্ব-২৭+২৮

0
2

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২৭.

শুক্রবার বলে পোলাও রান্নার আয়োজন করেছে আফরিন। তিতলি মহা উৎসাহে তাকে সাহায্য করছে। রোস্টের মাংস মেরিনেট করতে করতে আফরিন বলল, “নাবিলা আপুকে ডেকে আনো তো তিতলি।”
“আপা তো আসতে চায় না।”
“তুমি যেয়ে বলো আমি একটু আসতে বলেছি।”
তিতলি গেল। নাবিলা সহসাই এল না। তবে বড় ভাইয়ের স্ত্রীর ডাক উপেক্ষাও করতে পারল না। কিছুক্ষণ পরই তাকে রান্নাঘরের দরজায় দেখা গেল।
আফরিন হেসে বলল, “কেমন আছেন আপু?”
“ভাল।”
“একটা জিনিস খেতে ডাকলাম আপনাকে।”
“আমার একটুও খেতে ইচ্ছা করছে না।” বিব্রত মুখে বলল নাবিলা।
এই খবর খেতে আপনাকে মুখ খুলতে হবে না। মিহাদের সাথে বসে থাকলেই হবে।”
মিহাদ দরজার কাছে রোদের ভেতরে বসে আছে। নাবিলার কৌতূহলী চেহারার দিকে তাকিয়ে আফরিন হেসে বলল, “একটু আলোতে বসুন। সারাদিন অন্ধকারে থাকেন। ভিটামিন ডি পাবেন কীভাবে? আমাদের সাথে থাকতে কি খারাপ লাগবে?”
“না।” নাবিলা মাথা নেড়ে মিহাদের কাছে যেয়ে বসল। খাতায় কি যেন আঁকিবুঁকি করছে। মাথায় হাত দিতেই ঝট করে মাথাটা সরিয়ে নিল মিহাদ। নাবিলা চুপচাপ বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর আফরিনকে বলল, “রোস্ট রান্না করছ নাকি?”
“জি আপু।”
নাবিলার কৌতূহল দেখে আফরিন বলল, “একটু টেস্ট করে যান আপু। কিছু মিস গেল কি না।”
আফরিন ভেবেছিল নাবিলা না করবে। তাকে উঠে আসতে দেখে একই সাথে বিস্মিত এবং আনন্দিত হল সে।
নাবিলা বলল, “ঠিক আছে। সাথে কী হবে?”
“পোলাও।”
“পোলাওয়ে বাদাম দিও না। ভাইয়া বাদাম খায় না।”
“কিশমিশ?”
“ওটা দিতে পার। পোলাওয়ে পানি একটু কম দিয়ে দুধ দিও। ফ্লেভার, কালার দুটোই ভাল আসবে। তিতলি দুধ আছে না? আফরিনকে দাও।”
আফরিন খুশি হল, “আচ্ছা।”
নাবিলা চলে যাচ্ছিল। আফরিন বলল, “আপনি এখানেই থাকুন আপু। আমি রান্নায় তেমন এক্সপার্ট না।”
নাবিলা মিহাদের সাথেই বসল। কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, “ফুড ভ্যানের বিষয়টা কি? ভাইয়ার কাছে শুনলাম।”
আফরিন মুখ খোলার আগেই তিতলি মহা আনন্দে এগিয়ে এল। পটপট করে সে নিজেই সব বলতে শুরু করল।
নাবিলা চমৎকার হেসে বলল, “দারুন আইডিয়া তো।”
আফরিন কি ভেবে বলল, “চলুন আপু একদিন যেয়ে দেখে আসি। যাবেন?”
“যাওয়া যায়।”

দুপুর বেলা সবাইকে পেলেও শ্বশুরকে পাওয়া যাবে না আফরিন জানত। কালে ভদ্রে তাকে বাড়িতে দেখা যায়। রান্না শেষে সে যখন গোসলের জন্য যাচ্ছে তখনই মাহমুদকে দেখল। বেরিয়ে যাচ্ছে। আফরিন আচমকাই ডাক দিল।
“বাবা!” ডাকতে বেশ অস্বস্তি হলো। মাহমুদের সাথে সে কতবার কথা বলেছে হাতে গুনতে পারবে।
মাহমুদ দাঁড়ালেন। আফরিন কাছে যেয়ে বলল, “আজকে কি আপনার বাইরে কাজ আছে?”
“আছে কিছু।”
“একটু তাড়াতাড়ি আসবেন বাবা? দুপুরে সবাই একসাথে খেতাম।”
মাহমুদ এক পলক আফরিনের চেহারার দিকে তাকালেন। আসিফা বহু বছর যাবত এই আবদারটা আর করে না। করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আসিফার বোধহয় আর ইচ্ছেও করে না তার সাথে খাওয়া দাওয়া করতে। কি মনে করে তিনি বললেন, “আসবো।”
আফরিন খুশি মনে গোসলে গেল। খেয়াল করল না মাহমুদ পথ পাল্টেছেন। বাইরে যাওয়ার বদলে ঘরে চলে গেছেন।

দুপুরটা রাফির জন্য যথেষ্ট চমকদার ছিল। ডাইনিং টেবিলের আট চেয়ারের কোনোটাই ফাঁকা নেই। বাকি সবগুলো ভরে গেছে। দাদীমা ঘরেই খাওয়া দাওয়া সারেন। তাকেও ডাইনিংয়ে নিয়ে এসেছে আফরিন। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হল মাহমুদ। নিজের বাড়িতে তার অবস্থা চিড়িয়াখানার প্রাণীর মতো। সবাই গোল গোল চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে।
আসিফা মিহাদকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলেন। রুমিলা রাফির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “তুই বউয়ের দিকে তাকাস ক্যান ছোড়া? বিয়ে করব না করব না করে তো খুব নাচ দিলা! এখন তাকাও ক্যান? তুই তাকাবি তোর পাঠা বাপ মার দিকে।”

দুপুরটা ছিল রাফির কাছে স্বপ্নের মতো। এমন স্বপ্ন সে রোজ দেখে এসেছে। শুনে এসেছে বন্ধুদের কাছে। পরিবারের সবাই নাকি একসাথে খায়, গল্প করে। এই সবই তার কাছে রূপকথার মতো। সেই রূপকথা আজ তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। যার মাধ্যমে জীবন্ত হয়েছে তার কাছে আজীবন ঋণী থাকবে রাফি। আফরিনের ক্লান্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই দোলাচলে থাকা রাফি সিদ্ধান্তের কিনারা পেয়ে গেল। বুঝে গেল তাকে ঠিক কী করতে হবে।

দুদিন পর আফরিনের সাথে ফুড ভ্যান দেখতে গেল নাবিলা। ঘুরে টুরে বলল, “রান্নাবান্না করে কে?”
“একজন শেফ রেখেছিলাম। সে অন্য জায়গায় কাজ পেয়েছে। এখন আরেকজন খুঁজছি।”
পুরো দল, কাজ সবকিছু দেখে শুনে নাবিলা বলল, “আফরিন?”
“জি আপু?”
“আমি টুকটাক রান্না পারি। আমাকে রাখবে?”
নাবিলার চোখে কৌতূহল সাথে আশা। আফরিন অবাক হলো। মুখে হ্যাঁ এসেই গিয়েছিল। পরক্ষনেই ইতস্তত করে বলল, “আপু ওরা সবাই একদম ছোট। সেভাবে ট্রেইন্ড না।”
“বুঝতে পারছি। আমি কয়েক বছর আগে একটা রান্নার কোর্স করেছিলাম। বিদেশি কিছু আইটেম শিখিয়েছিল। তুমি বললে ওদের শিখিয়ে দেব।”
আফরিন উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে নাবিলার হাত ধরল, “সত্যি আপু! আপনার ভাই কিছু বলবে না তো?”
“বলার কথা না। তবুও আমি কথা বলব।”
সেদিনই রাফির সাথে কথা বলল নাবিলা। সাথে এটাও বলল, “জায়গাটা আমার কাছে পারফেক্ট মনে হচ্ছে না। স্কুলের বাচ্চারা বেশি বাজেটের জিনিসপত্র খাবে না। ফুচকা, ঝালমুড়ি এই পর্যন্তই ওদের পকেট মানি। প্লেস চেঞ্জ করা দরকার।”
“তুই ওখানে কাজ করবি?”
নাবিলা হাসল, “ভেতরে থাকব। রান্না বান্না দেখিয়ে দেব। বেচাকেনায় আমি নেই।”
রাফির নিমরাজি ভাবকে হ্যাঁ ধরে পরদিনই নাবিলা চলে গেল। আফরিনকে জানিয়ে জায়গা চেঞ্জ করে পার্কের সামনে গাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো।
প্রথম দিন যেয়েই নাবিলা বুঝতে পারল আগের শেফ টাকা পয়সা প্রচুর নয় ছয় করেছে। পকেট ভরতেই কেটে পড়েছে। সাঈদ হালকা বুঝলেও কাউকে বলার মতো যথেষ্ট প্রমাণ পায়নি বলে সাহস করতে পারেনি। নাবিলা একটা মেন্যু কার্ড বানাল। লো বাজেট দিয়েই শুরু করা যাক। হাতে কিছু টাকা রাখা দরকার।

প্রথমদিন খুব জাঁকজমক বেচাকেনা না হলেও একেবারে অল্পও হলো না। প্রতিদিনের গড়ে বিক্রি আগের চেয়ে বেড়ে গেল। লাভটা হাতে হাতে বোঝা না গেলেও দিন শেষে খরচের তালিকা মেলালে স্পষ্ট ধরা দিত।

__________________

মিহাদকে বোঝার চেষ্টা করছে আফরিন। ছলে বলে ওকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যায় না। চুপচাপ বসে কিউব নাড়াচাড়া করতেই সে বেশি পছন্দ করে। আফরিন একবার চেষ্টা করেছিল ওকে লেখা শেখানোর জন্য। পারেনি। মিহাদের হাত অস্বাভাবিকভাবে কাঁপে। ছোটখাট কাজ সে করতে পারে না। দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। রাগটা খুব বেশি। কী থেকে কীসে রাগ করে ফেলে আফরিন প্রথমদিকে ধরতেই পারেনি। রাগ প্রকাশের মাধ্যমটাও ভয়াবহ। হাতের কাছে যেটা পায় সেটাই ছুঁড়ে মারে। সেজন্য আফরিন আশপাশে ভারী কিছু রাখে না। কিউব বা বলের বারিতে নিশ্চয়ই খুব বেশি আঘাত লাগবে না।
মিহাদের সাথে প্রচুর কথা বলে আফরিন। তার জবাবে মিহাদ একটা কি দুটো কথা বলে। ওর মুখের জড়তা কাটেনি। মাঝে মাঝেই কথা বলতে চেয়েও পারে না। জিহ্বায় আটকে যায়। আফরিন চেষ্টা করছে মুখের জড়তাটা দুর করার। তাহলে অন্তত কিছু না কিছু বলতে পারবে।

আফরিন একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে। রাফি একেবারেই দাদীমার সাথে কথা বলে না। খোঁজ খবর নে তিতলির মাধ্যমে। কাজ করায় জাফরকে দিয়ে। জিনিসটা তার কাছে খুব দৃষ্টিকটু লাগল। যেই দাদীমার কোলে চড়ে মানুষ হয়েছে তার সাথে এমন দুরত্ব থাকবে কেন? সরাসরি রাফিকেই চার্জ করল সে।
“আপনি দাদীমার সাথে কথা বলেন না কেন?”
সেদিন দুপুরে একসাথে খাওয়ার পর রাফির খুব লোভ হয়েছিল। ভেবেছিল এর পর প্রতিটা ভোজন সভাই বোধহয় এমন হবে। তা হয়নি। মাহমুদ ঐ এক বেলার জন্যই বাড়িতে ছিলেন। আসিফাও ঘর ছেড়ে বের হননি। রাতের খাবার রাফির জন্য আবার একলাই হয়ে গেছে। তাও ভাল আফরিন সামনে থাকে।
খাওয়ার সময়ই আফরিন তাকে প্রশ্নটা করল। সে জবাব দেয়ার আগেই বলল, “আপনার রাগ আমার সাথে। দাদীমা কী করেছে?”
“আপনার সাথে আমার রাগ থাকবে কেন?”
“আপনি নাকি বিয়ে করতে চাননি?”
“দাদীমা জোর করেছে।”
“যাই হোক। যেটা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। উনি বৃদ্ধ একজন মানুষ। এমনিতেই এই সময়টা হীনম্মন্যতায় কাটান। ছেলে, ছেলের বউয়ের সাথে কথাবার্তা নেই। আপনিও যদি এমন করেন তাহলে তো দাদীমা অপরাধবোধেই শেষ হয়ে যাবেন।”
রাফি চুপ করে বসে রইল। আফরিন বলল, “খেয়েই দেখা করতে যাবেন। এসব ছেলেমানুষী ভাল লাগে না।”
রাফি নিজেও বুঝতে পারছিল কাজটা ঠিক হচ্ছে না। সব ভুল কাজের বেড়াজালে সে নিজেকে আলাদা করে ফেলেছে। যেদিকে তাকায় সেদিকেই কোনো না কোনো ভুল। দাদীমার সাথে কি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছে সে?

রুমিলা ঘর অন্ধকার করে বসে ছিলেন। রাফি লাইট জ্বেলে তার কাছে গেল। পাশে বসে বলল, “কেমন আছো দাদীমা?”
রুমিলা রাফিকে দেখলেন। আচমকাই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। রাফি দাদীর হাত ধরল। অন্যায় অনেক বেশি হয়ে গেছে। আর বাড়তে দেয়া যাবে না।

~চলমান~

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২৮.

ছুটা বুয়া দুজন আসে বেশ সকাল সকাল। তিন বেলার রান্নার দায়িত্ব তাদের। ঘরবাড়ি যিনি পরিষ্কার করেন তিনি আসেন বেলা করে।
আফরিন চেষ্টা করে সকালে বুয়া দুজন আসার আগেই দাদীমার ঘর ছেড়ে বের হতে। সকালের রান্না মাঝে মাঝে করলেও নিয়মিত করা হয় না। যেদিন পরীক্ষা অথবা ক্লাসের প্রেশার থাকে সেদিন বুয়াদের নির্দেশ দিয়ে সে আশপাশে থাকার চেষ্টা করে। এতে বুয়া দুজন যে খুব একটা খুশি হন না সেটাও সে বোঝে। তাতে তার বরঞ্চ সুবিধাই হয়। এই দুজনকে নিয়েই তিতলির সাবধানবাণী যে সত্যি এটা বুঝতেও তার সময় লাগেনি। একেবারেই ধমকা ধমকি বা বিচারের দিকে যায়নি আফরিন। নীরবেই বুঝিয়ে দিয়েছে এমন করলে ঠিক কী হতে পারে। চাকরি হারানোর ভয় না থাকলেও তাদের জেল হাজতের ভয় আছে।
এই ক্ষোভকে পুঁজি করে ঝাল মেটানোর জন্য তারা আফরিনের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকিঝুঁকি দেয়া শুরু করেছে। আফরিন যে দাদীর ঘরে থাকে এটাও তারা জানে। এই বাড়ির সকলের সামনে বিষয়টা খুব বিব্রতকর না হলেও এই দুজনের সামনে আফরিন লজ্জা পায়। কেননা একদিন ওরা সরাসরিই জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনে থাকবেন উপরে। সক্কাল সক্কাল নিচে কি করেন?”
আফরিন কথা ঘোরানোর জন্য বলেছিল, “দাদীমার কাছে গিয়েছিলাম।”
“থাক আমাদের কাছে আর কী লুকাইবেন? বড়লোক মানুষের কাজকাম! বউয়ের কদর নাই।” আরেকজন বলেছিল। চুপচাপ শুনেছে আফরিন। চাইলে এই দুজনকে ছাঁটাই করে দেয়া যায়। কিন্তু এমন পটু দুজন মানুষ পাওয়াও কষ্টের। তাছাড়া তারা মিথ্যে তো কিছু বলেনি। এই ভাবনাটাই আফরিনের সকল উচ্ছ্বাস মিইয়ে দেয়।

আজ ক্লাস নেই। সকালে রাফির জামা কাপড় বের করে দেয়ার সময় দেখেছিল পুরো ঘরে কাগজ পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। মনে হয় মিটিং আছে। না খেয়েই চলে গেছে রাফি।
সে চলে গেলে আফরিন ঐ ঘরে যায়। ছড়ানো কাগজ তুলে একসাথে রাখে। বিছানা গোছায়, ঘর ঝাড়ু দেয়। ফার্নিচারগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। নিমিষেই তার মনটা ভার হয়ে আসে। নিজেকে মেরুদণ্ডহীন মনে হয়। এক মন বলে রাফির সামনে কথাটা তুলুক। কিছু একটা নিশ্চয়ই বলবে। আরেক মন মুহূর্তেই সেই প্রস্তাবে ভেটো দেয়। ঠিক কতবার বেহায়া হবে সে?

অনিক দুদিন পরপর ফোন দিয়ে আপডেট শোনে। রাফি ইনিয়ে বিনিয়ে হাবিজাবি কথা বলে। বলতে পারে না আসলে কোনও আপডেট নেই। সব আগের জায়গায় আটকে আছে। কী করবে সেটা বুঝতে পারলেও কীভাবে করবে সেটা কোনোভাবেই মাথায় আসছে না। অনিক শুনলে জুতো হাতে সোজা তার কাছে চলে আসবে। অপূর্ন ইচ্ছেটা পূর্ণ করবে। সমস্যাটা এমনই যে দাদীমার কাছে বলতেও লজ্জা হয়। দেখতে খুব সামান্য। কিন্তু নিজের চারপাশে যেই কাটাকুটির দেয়াল রাফি তুলে রেখেছে তাতে খুব সামান্য কাজটাই এভারেস্ট জয়ের মতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক কীভাবে আফরিনকে তার ঘরে নিয়ে আসবে রাফি?

কাজ টাজ গুছিয়ে আফরিনের হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল রাফি। সেদিন তো শুনেছিল সাতটা পর্যন্ত ডিউটি। এখন বাজে সাড়ে ছয়টা। যেতে যেতেই আধা ঘন্টা পার হয়ে যাবে। আফরিনকে আনতে গেলে কি সে খুশি হবে না? হওয়ারই তো কথা। রাফি গাড়ি নিয়ে ছুটল হাসপাতালের দিকে।

সাতটা, সাড়ে সাতটা বেজে গেলেও আফরিনের দেখা মিলল না। তাকে চমকে দেয়ার জন্য একদম হাসপাতালের গেট বরাবর দাঁড়িয়ে ছিল রাফি। হঠাৎ করে তাকে দেখে আফরিন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে এটা দেখার জন্য সে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছে। এজন্যই ফোনও দেয়নি। কিন্তু এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও যখন মেয়েটার দেখা মিলল না তখন ফোন বের করল রাফি।
আফরিন পড়তে বসেছিল। মিহাদ দাদীমার পায়ের কাছে বসে আছে। দাদীমা ঘুমাচ্ছে। সামনে ফোন ভাইব্রেট করলে আফরিন দেখল রাফি ফোন দিয়েছে। এই লোক তাকে ফোন দিয়েছে! চূড়ান্ত বিস্ময়ের বিষয়। আফরিন ফোন হাতে বেরিয়ে গেল।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনার আর কতক্ষন লাগবে?”
আফরিনের কপালে ভাঁজ পড়ল, “কীসের কতক্ষন লাগবে?”
“বের হবেন কখন?”
“কোত্থেকে?”
“অদ্ভুত! হাসপাতাল থেকে।”
“আমি তো বাসায়।”
রাফি অবাক কণ্ঠে বলল, “আমি এক ঘন্টা ধরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি কখন বের হলেন?”
আফরিন হতাশ নিশ্বাস ছাড়ল। যখন চাকরি করত তখন এই লোক জানতোই না যে সে চাকরি করে। এখন যখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছে তখন যেয়ে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেলুকাস!

“আমি হাসপাতালে যাইনি। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।”
“কবে!”
“কিছুদিন আগে।”
কী বলা উচিত রাফি বুঝল না। ভাল করতে যেয়ে আরো ঘোট পাকিয়ে ফেলেছে। নিজের মাথায় একটা গাট্টা মারতে ইচ্ছে করছে।
“আচ্ছা।”
আফরিন বলল, “আপনি আমাকে রিসিভ করতে গেছেন শুনে ভাল লাগল। আমার কপালে নেই তাই মিস করে গেলাম।”
লজ্জার চূড়ান্ত হওয়ার পর ফোন কাঁটল রাফি।
“গাধা!” নিজেকেই নিজে ধমক দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। এর চেয়ে অফিসে বসে ঝিমানো ভাল ছিল। অন্তত আফরিনের মুখোমুখি হতে লজ্জা লাগত না।

অস্বস্তিতে গাট হয়ে থেকেও কীভাবে কীভাবে দাদীমার ঘরে চলে এসেছে রাফি বলতে পারবে না। আফরিন খাটে বসে কিছু একটা লিখছে। বহুক্ষণ আগে বাঁধা খোপা দুর্বল হয়ে গেছে। ঝুঁকে থাকার কারণে খোপা এলিয়ে ডান ঘাড়ে চলে এসেছে। চুল তো চুল, যত্ন না নিলে যেকোনো বাঁধন দুর্বল হতে সময় নেয় মাত্র কিছুক্ষণ।
রাফি গলা খাঁকারি দিয়ে দাদীমার কাছে যেয়ে বসল। রুমিলা উঠে বসলেন। নাতির হাঁটার গতি তার দিকে অথচ চোখ আরেক দিকে। মনে মনে হাসলেন তিনি।
“কেমন আছো দাদীমা?” আফরিন এক পলক তাকিয়ে ফের খাতায় মনোযোগ দিল। বোকার হদ্দ এক লোক তার কপালে জুটেছে। বড়লোক মানুষ এমন বোকা হয়!
“আছি ভাল। তুই কেমন আছিস?”
“ভাল। তোমার ওষুধপত্র সব আছে তো?” রুমিলার পায়ের কাছে বসল রাফি। আফরিন এত মনোযোগ দিয়ে কী লিখছে?
“আছে। তোর কি ঘাড়ে কিছু হইছে?”
“না তো।”
“চোখে?”
“সব ঠিক আছে।”
“তা কথা বলছিস আমার সাথে। তোর ঘাড়, মাথা, চোখ সব আরেক দিকে ক্যান?”
রাফি হকচকিয়ে ঘাড় ঘোরাল। আমতা আমতা করে বলল, “আশপাশ দেখলাম। সব ঠিকঠাক আছে নাকি। হে হে।”
রুমিলাও পাল্টা হাসলেন, “হে হে।”
রাফি গলা খাঁকারি দিয়ে আফরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এভাবে লিখলে তো ঘাড় ব্যাথা করবে। টেবিলে বসে লিখবেন।”
“এই ঘরে টেবিল নেই।” লিখতে লিখতেই উত্তর দিল আফরিন।
“আমার ঘরে আছে। ওটা ইউজ করতে পারেন।”
রুমিলা বললেন, “আরে কত বড় ডাইনিং টেবিল আছে ওখানে বসলেই তো হয়। ওর ঘর তো অনেক দূরে।”
“ঠিক বলেছেন দাদীমা।” আফরিন বই খাতা গুছিয়ে ডাইনিংয়ে চলে গেল। রাফি হতাশ চোখে আফরিনের প্রস্থান দেখল। রুমিলা রাফির চেয়েও বেশি হতাশ কণ্ঠে বললেন, “তোর বুদ্ধি হবে কবে?”
“জি দাদীমা?”
“আট চেয়ারের ডাইনিং থাকতে ও সিঁড়ি ভেঙে উপরে যাবে কোন দুঃখে? গাঁধার বাচ্চা গাঁধা!” মনে মনে শতেক ধমক দিলেন রুমিলা। বউকে কীভাবে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে এটুকু বুদ্ধি নেই। ভাত খায় না, গরুর ঘাস খায়। সাথে সাথেই মত পাল্টালেন। ঘাস খেলেও কাজ হত। চিটা খায় চিটা।
রাফি ইতস্তত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। রুমিলা খ্যাক করে বললেন, “যা! সর! আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ!”
রাফি দ্রুত ঘর থেকে বের হল। দাদীমা হঠাৎ এত রাগলেন কেন কে জানে।
উপরে উঠতে উঠতে ডাইনিং টেবিলে পড়তে থাকা আফরিনকে দেখল রাফি। চেয়ারে পা তুলে আরাম করে বসে আছে। তার তো আরাম লাগছে না। কেন?

নোট করতে করতে খাতা ফুরিয়ে গেছে। খুঁজে খুঁজে হয়রান হল আফরিন। আর একটা খাতাও নেই। রাফির ঘর গোছানোর সময় কিছু কাগজ দেখেছিল। তার কাছে চাওয়া যেতে করে। এদিক ওদিক চিন্তা না করে রাফির কাছে চলে গেল সে। আপাতত নোট করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

রাফি কেবলই ল্যাপটপ খুলেছে। তখনই আফরিন দরজায় নক করল, “আসব?”
রাফি এক প্রকার লাফিয়ে দরজার সামনে এল, “আসুন।”
“আমার খাতাটা ফুরিয়ে গেছে। এক্সট্রা খাতাও নেই। আপনার কাছে নোটপ্যাড বা কাগজ আছে?”
রাফি চিন্তিত কণ্ঠে বলল, “ঠিক বলতে পারছি না। খুঁজে দেখতে হবে।”
আফরিন বলল, “সকালে ঘর গোছানোর সময় কিছু সাদা কাগজ দেখেছিলাম। আপনার দরকার না হলে ওখান থেকে চার পাঁচটা দিলেই চলবে।”
“আছে নাকি? আমার খেয়াল নেই। আপনি যেহেতু গুছিয়েছেন তাহলে নিয়ে নিন।”
আফরিন পরিচিত ভঙ্গিতে টেবিলে সাজানো কাগজের স্তূপ থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে নিল। সেই মুহূর্তে তার ফোন বেজে উঠল। সাদমান ফোন দিয়েছে। নোটের কিছু তথ্য দেয়ার জন্য। আফরিনই বলেছিল ফোন দিতে। সে ফোন রিসিভ করে চেয়ারে বসে পড়ল। কালকে নাকি সারপ্রাইজ টেস্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নাকেমুখে সব পড়তে হবে এখন।
“হ্যাঁ সাদ। দ্রুত বল।”
ফোন লাউড স্পিকারে রেখে ঘষঘষ করে লিখতে শুরু করল আফরিন। রাফি অবাক হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার বিস্মিত চোখ চেয়ারে বসা আফরিনের দিকে। আফরিন তার ঘরে এসে বসেছে। কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য!
দরজা খোলাই থাকবে নাকি বন্ধ করবে এই নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল রাফি। মিনিট দুয়েক চিন্তা করেও যখন কোন সমাধান পেল না তখন একটু আগে দাদীমার দেয়া উপাধি স্মরণ করে বিছানায় ফিরে এল। দরজা খোলাই রইলো।
প্রায় বিশ মিনিট পর ফোন কাটল আফরিন। পাশে তাকাতেই রাফিকে দেখল। ল্যাপটপ টেপাটিপি করছে। বিব্রত ভঙ্গিতে সে বলল, “সরি। লাউড স্পিকারে এতক্ষন কথা বলছিলাম। একদমই খেয়াল ছিল না। কালকে একটা পরীক্ষা আছে তো! ভেরি সরি।” খাতা হাতে উঠে দাঁড়াল আফরিন।
রাফি তড়িঘড়ি করে বলল, “কোন সমস্যা নেই।”
“থ্যাংক য়্যু।” হাসি মুখে বলে দরজার দিকে চলে গেল আফরিন। রাফি বারবার বলল, “রিনি আপনি এখানেই থাকুন। এই টেবিলেই পড়াশোনা করুন। আমার চেয়ারে পা তুলে বেশি আরাম। ঐ ডাইনিংয়ের শক্ত চেয়ারে বসার দরকার নেই।”
কথাগুলো কণ্ঠনালির কাছে এসে আটকে রইল। ঠোঁট ফুঁড়ে বের হতে পারল না। আফরিন বেরিয়ে গেল রাফির ঘর থেকে।

~চলমান~