অন্তঃপুর পর্ব-৩২

0
2

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৩২.

আসিফা সব খবরই শুনেছেন। শুনে শান্ত ভঙ্গিতে ছেলের সাথে হাসপাতালে গেছেন। রুমিলাকে ভর্তি করা হয়েছে। নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

রাফির নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। চোখ বন্ধ করে রুমিলার হাসি মুখটা মনে করতে চাইল সে। পারল না। অজ্ঞান রুমিলার অসহায় চেহারা চোখে ভাসছে। কোনোভাবেই সরছে না। রাফি এই মুখটা মনে রাখতে চায় না।

রুমিলাকে ইমার্জেন্সিতে ঢোকানোর পর ডাক্তাররা কী কী যে করল রাফি বলতে পারবে না। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ছুটছিল সে। আসিফা ছেলের হাত ধরে বললেন, “বসো।”
রাফির মনে হলো এই আদেশ মানা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। ওয়েটিং রুমের সাজানো চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল সে।

অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেল। কারো কোনো খোঁজ নেই। রাত কত হয়েছে রাফি জানে না। সে কাঁদতে চাইছে। কিন্তু কান্না আসছে না। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। পাশাপাশি বসে থাকলেও এই পুরোটা সময়ে জুড়ে মায়ের সাথে কোনো কথাই হলো না তার। নিজেকে মনে হলো মাতাল, নেশাগ্রস্থ।

আড়াইটার দিকে চেম্বার থেকে এক ডাক্তারকে ছুটে আসতে দেখলেন আসিফা। এই ডাক্তার রুমিলাকে ভর্তি করানোর সময় ছিলেন না। রাফি চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়ে গিয়েছে কী? আসিফার কেমন ভয় ভয় লাগল। নিশুতি রাত সেই ভয়কে আরো খানিকটা আশকারা দিল।
কম্পনরত কণ্ঠে তিনি ছেলেকে ডাকলেন, “রাফি! এই রাফি!”
রাফি জেগেই ছিল। এক ডাকেই চোখ খুলল সে। আসিফা বললেন, “এক ডাক্তার দৌঁড়ে ঢুকল। কী হলো?”
রাফি এক প্রকার ছুটে গেল দরজার সামনে। ভেতরে কী হচ্ছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। উপরের দিকের ছোট্ট কাঁচটাও কেমন ঘোলা ঘোলা। শুধু সাদা সাদা কাপড় দেখা যাচ্ছে। বিড়বিড় করে দোয়া করতে শুরু করল রাফি। এই মানুষটা সুস্থভাবে ফিরে আসুক। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। অজানা আশঙ্কা আর তীব্র ভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাফি।

নাবিলা একটু পরপরই ফোন দিচ্ছিল। শেষবার আসিফা বললেন, “ডাক্তার এখনও কিছু বলেনি। বললে জানাবো। তোমরা ঘুমাও।”
বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে আছে অথচ মাহমুদ একবার ফোন করার সময় পায়নি। আসিফার এত ঘৃণা হলো! মনে হলো এই মানুষটার সাথে তালাক হয়ে গেলেই সে বেঁচে যাবে।

ডাক্তারের ছুটোছুটি, রাফির দোয়া, আসিফার ভয় কোনোটাই নির্ধারিত সময়কে পেছাতে পারল না। তিনটা বাজার চার মিনিট আগে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। তার দেহভঙ্গি দেখে কিছু আন্দাজ করার উপায় নেই। রাফির চোখে এখন সেই প্রখরতাও নেই। আছে কেবল খরা। একটা সুসংবাদের বৃষ্টির জন্য যে মুখিয়ে আছে।

বৃষ্টি নামল না। হলো বজ্রপাত। ডাক্তার জানালেন রুমিলার হার্ট রাপচার হয়েছে। হৃদপিণ্ডের দুর্বল পেশী ছিঁড়ে গেছে। রাফি অবুঝ কন্ঠে প্রশ্ন করল, “দাদীমার কি জ্ঞান ফিরেছে?” ওসব কঠিন কথা সে বুঝতে পারল না। বুঝতে চায়ও না। সে শুধু উষ্ণ ঘ্রাণের, সফেদ শাড়ির ঐ কোলটুকু চায়।
ডাক্তার বুঝলেন একটু ভুল হয়ে গেছে। এই ভাষা তাদের জানার কথা নয়। ততক্ষণে আসিফাও রাফির পাশে দাঁড়িয়েছেন। চোখে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছেন ডাক্তারের দিকে।
ডাক্তার আশপাশে তাকালেন। রুম ফাঁকা। মধ্যরাতে ভিড় হওয়ার কথাও নয়। ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমি দুঃখিত আপনাকে একটা কঠিন খবর জানাতে হচ্ছে। আপনার দাদীমা মা-রা গেছেন।”

রাফি কয়েকবার পলক ফেলল। মস্তিষ্ক কথাটা বোঝেনি অথচ চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। ঢোক গিলল সে। ডাক্তার ততক্ষণে চলে গেছে।
আসিফা খুব চেষ্টা করছেন শব্দ না করার জন্য। যতটা না কষ্ট হচ্ছে শাশুড়ির জন্য তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে রাফির মুখের দিকে তাকালে।
তাদের দুজনকে রুমে ঢুকতে দেয়া হলো। রুমিলা শান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। ঢোকার সময় টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে একটা বক্স ফেলে দিল রাফি। শুনশান নীরবতায় বিকট শব্দ হলো। অথচ রুমিলা উঠলেন না। দাদীমার ঘুম তো এমন নয়। তার পাশে কেউ নিশ্বাস ফেললেও সে জেগে যায়।
রাফি দাদীমা কাছে এল। মাথায় হাত রাখল। সব চুলও পাকেনি। কাঁচাপাকা চুল মিশে আছে একে অপরের সাথে। রাফি কম্পনরত কণ্ঠে বলল, “ও দাদীমা?”
আর কিছু বলতে পারল না সে। তার হাঁটু ভেঙে এল। মেঝেতে পড়ে গেল শক্ত সামর্থ দেহটা। চাদরের এক কোনা দিয়ে ঝুলতে থাকা রুমিলার শাড়ির কোনা মুঠোয় ভরল রাফি। কী যেন গিট দেয়া। আলমারির চাবি। রাফি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, “ও দাদীমা!”

_________________

দিন কয়েক আগেই মোশাররফ আর আফসানা উমরা করতে গেছেন। তাদের সাথে দেখা করেছে আফরিন। সাদমান বাড়িতে একা থাকে। তাই হঠাৎ করে যেয়েও কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো না আফরিনকে। সাদমান কেবল একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “সব ঠিক আছে?” যদিও রিনির মুখ দেখেই সে বুঝেছে সব ঠিক নেই।
আফরিন কেবল বলেছিল, “আছে।”
সাদমান আর ঘাটাল না। স্বামী স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হতেই পারে। অদরকারে সেখানে নাক গলানো উচিত না ভেবে ওকে একা ছেড়ে দিয়েছে। দরকার হলে নিজে থেকে এসেই বলবে।

ঘণ্টা না পেরুতেই কাঁদতে কাঁদতে সাদমানের কাছে হাজির হলো আফরিন। ঘড়িতে তখন রাত আটটা। নাবিলা ফোন দিয়েছিল। দাদীমা হার্ট অ্যাটাক করেছেন। সাদমান তখনই বোনকে নিয়ে রওনা হলো।

ঘরে ঢুকে দেখল তিতলি মেঝেতে বসে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে। আফরিন তার কাছে এগিয়ে গেল।
“নাবিলা আপু কই?”
“জানি না।” আফরিনকে দেখে কান্নাটা বাড়ল। “দাদীমার কী যেন হয়েছে।”
“ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্। তোমার খালু কোথায়?”
“বাড়িতে নাই।”
তিতলিকে স্বান্তনা দিলেও আফরিন নিজেই ভয় পাচ্ছিল। বয়স্ক মানুষ এই ধকল কীভাবে সামলে উঠবেন কে জানে। আজ বিকেলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়াটা নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল মনে হলো আফরিনের। গতকালই রাফি বলেছিল বাবা মায়ের ঝগড়া দেখলে সে ট্রমাটাইজড হয়ে যায়। কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারে না। ঐ অবস্থায় সে কীভাবে রাফিকে একা ফেলে যেতে পারল? হাজার বকাঝকা করলেও তো আফরিনের উচিত ছিল তার পাশে থাকা। আফরিন সিদ্ধান্ত নিল হাসপাতালে যেয়েই আগে রাফির কাছে সরি বলবে।

সাদমানকে সাথে নিয়ে আফরিন হাসপাতালে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মিহাদ এসে আফরিনকে দেখে অস্থির হয়ে গেছে। হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে। বাঁধো বাঁধো কণ্ঠে বলছে, “এসেছ কেন? যাও। যাও!”
চিৎকার করে উঠছে মিহাদ।
সাদমান বোনকে আগলে নিল। অবাক হয়ে বলল, “সবসময় এমন করে?”
“না। ওকে না বলে চলে গিয়েছি তো এজন্য এমন করছে।”
“থামবে কীভাবে?”
“একাই থামবে।”
“তুই ঘরে ঢুকে বসে থাক।”
“তাহলে আরো বেশি চিৎকার করবে। একবার ওকে ধরতে পারলেই হবে।”
সাদমান এই প্রথম এমন ভয় পাচ্ছে। কাঁচের গ্লাস, কাঠের বল যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে মিহাদ। বেকায়দায় লাগলেই আর রক্ষে নেই। সে আফরিনকে নিজের পেছনে লুকিয়ে ফেলল। এ তো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও নয়। বোঝাবে কীভাবে?
আফরিনকে নিজের পেছনে নিয়েই ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল সাদমান। মিহাদের চোখদুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। তার হাতে এখন সোফার কুশন। কাজেই তাকে ধরার এটাই মোক্ষম সুযোগ।

সাদমান হঠাৎ করে বলল, “ওটা কী?”
মিহাদ মোটেও আরেক দিকে দৃষ্টি সরাল না। কৌশল কাজে না লাগায় এবার সাদমান চোখের পলকে মিহাদকে জড়িয়ে ধরল। মিহাদ সাথে সাথে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল। আফরিন এসে বলল, “সরি মিহাদ। আর তোমাকে না বলে যাব না। সরি।”
ঝাপটে ধরল আফরিন। মিহাদ ধীরে ধীরে শান্ত হলো বটে। তবে আফরিনকে ছাড়ল না। হাজার বুঝিয়েও আফরিন ওড়নাটা ছাড়াতে পারল না। ফলে তার আর হাসপাতালে যাওয়া হলো না। বোনকে এভাবে রেখে সাদমানও যাওয়ার ভরসা পেল না।

নাবিলা বারান্দায় বসে ছিল। আজ ঘরের দরজা খোলা। আফরিন আসার পর সে উপরে উঠে এসেছে। বাড়ির মানুষদের নিয়ে চিন্তা নেই। হাসপাতালের মানুষটা কেমন আছে আল্লাহ জানেন। একটু পরপর ফোন দিচ্ছিল সে। নতুন কোনো খবর নেই। একই কথা বলছেন আসিফা। তাই নাবিলা আর ফোন দিল না। অবস্থার উন্নতি হলে নিশ্চয়ই তাকে ফোন করে জানাবে।

হাসি কুঞ্জে নির্ঘুম একটা রাত কেটে গেল। মাহমুদ সবার সাথে বাক্যালাপ করে অস্থিরতা প্রকাশ করতে না পারলেও ঘরে বসে ছটফট করছিলেন। একবার মনে হলো হাসপাতালে চলে যান। ওখানে আসিফা আছে শুনে আর গেলেন না। দেখা যাচ্ছে সেখানেও তাকে দুকথা শুনিয়ে দিচ্ছে।

আকাশের অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছিল। চারটা বেজেছে। আর কিছুক্ষণ পরই ফজরের আজান হবে। ঠিক সেসময় একটা অ্যাম্বুলেন্সকে হাসি কুঞ্জের দিকে আসতে দেখা গেল। বারান্দা থেকে গাড়িটার দিকে দৃষ্টি যেতেই নাবিলার বুক ধ্বক করে উঠল। মনে হলো তার কানের কাছে বিকট শব্দে বিউগল বাজছে।

সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল আফরিন। শব্দ শুনে ধড়ফড় করে উঠল সে। গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখল আকাশে মেঘ জমেছে। ঘন কাল। সাদা অ্যাম্বুলেন্স থেকে একটা স্ট্রেচার নামানো হচ্ছে। অবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আফরিন।

অপেক্ষার শেষ করে রুমিলা ফিরলেন। অন্য নাম নিয়ে। সবার উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে। তারপর..তারপর খুব ঝড় শুরু হলো। পূবের ঝড়ো বাতাসে গাছপালা হেলে পড়ল। আফরিন দেখল বর্ষীয়ান একটা গাছ তার গভীরে ছড়িয়ে যাওয়া শিকড় উপড়ে মাটিতে পড়ে গেছে। উপরের দিকে তাকাল আফরিন। পাতায় পাতায় আকাশটা সাজানো থাকত। আজ সেই জায়গাটা ফাঁকা। কখনও মনেই হয়নি ঐ নাম না জানা, অতি সাধারণ গাছটা না থাকলে আকাশকেও এত খালি খালি মনে হবে।

সময় গড়াতেই লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল হাসি কুঞ্জ। নিচ তলার গলির মতো লম্বা বারান্দা পেরিয়ে কোনার ছোট্ট ঘরের বেলকুনি থেকে ভেসে এল একটা সুর। ঐ বারান্দার যেই চেয়ারে রুমিলা সবসময় বসে থাকতেন, কুরআন পড়তেন। সেটা ফাঁকা নেই। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, মানসিক ভারসাম্যহীন একটা ছেলে টু বাই টু কিউব হাতে ঐ চেয়ারে বসে বসে গুনগুন করে সুর করে বলছে,

يس. وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ. إِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ. عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

~চলমান~