#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৩৩.
ঝড় থেমেছে আরো আগেই। তবে বৃষ্টিটা থামেনি। বোবা বৃষ্টি হচ্ছে। নিঃশব্দে, খুব ধীরে মাটিতে পড়ে নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দিচ্ছে জলবিন্দু। গাছের পাতায় তাদের শোরগোল নেই, বজ্রপাতের দাপট নেই। আকাশটা কেবল কালো। অনাড়ম্বর, জাঁকজমক এক বোবা বৃষ্টি পুরো হাসি কুঞ্জে ঝরছে নির্ঝর নৈঃশব্দ্য কলতানে।
নিকটাত্মীয়রা দায়িত্ব পালন করে বিদায় নিয়েছে। চমৎকার সব স্বান্তনার বুলি আঘাতের মলম হিসেবে দিয়ে গেছে। কিন্তু হায়! স্বান্তনা কি হারিয়ে যাওয়া মানুষের বিকল্প হতে পারে?
রুমিলা বেগম এ বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছেন নিজের নামটা সহই। হাসি কুঞ্জে আর রুমিলা বেগম নেই। তিনি আছেন আধ শুকনো মাটির ঢিবিতে গর্ত করে খোড়া এপিটাফে।
রাফির একেকবার মনে হয় সেই এপিটাফটা এনে মাথার উপরে দিয়ে রাখুক। এই ঝড়, তুফান তার সহ্য হচ্ছে না। রোদের তীর্যক তীক্ষ্ম বেগুনী আলোকরশ্মি সরাসরি তার দিকে যাচ্ছে। আগে তো কখনও এমন হয়নি! ওজন স্তরটা ঠিক কবে এভাবে নিঃশেষ হয়ে গেল?
আফরিন ঘরে ঢুকল নিঃশব্দে। এক মর্মভেদী যন্ত্রণা, অনুতাপ তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব শখ করে, যত্ন করে সাজানো নিজের ঘরটা সে নিজেই ভেঙে ফেলেছে।
কী হত সেদিন রাফির কথায় রাগ করে না চলে গেলে? যদি লোকটার কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিত? যদি দাদীমার কাছে যেয়ে শক্ত একটা নালিশ করত? যদি…
রাফি বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। একটা হাত কপালে রাখা। চোখ দুটো ঢেকে রেখেছে। আফরিন তার পাশে যেয়ে বসল। এই কয়েকদিনেই লোকটার মুখ শুকিয়ে গেছে। আফরিন কেঁদে ফেলল। সাথে সাথেই মুখে হাত চাপা দিল। রাতে তো রাফি ঘুমায় না। এখন ঘুমাচ্ছে। সে বিরক্ত করতে চায় না।
আফরিনের কান্না কমল না। মন চাইছে টাইম মেশিনে করে সে ফিরে যাক দাদীমার কাছে। তার শাড়ির আঁচল ধরে নালিশ করে বলুক, “দাদীমা! আপনার গাধা নাতি আমাকে চলে যেতে বলেছে।”
আফরিন উঠল। বুক ব্যাথা করছে। ক্রমেই সেই ব্যাথা গলায় উঠে আসছে।
“বসো রিনি।”
ভেজা চোখে আফরিন দেখল রাফি উঠে বসেছে। সে বলল, “আপনি ঘুমান।”
“ঘুমাচ্ছিলাম না। বসো।”
আফরিন বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ব্যাথাটা ঝড়ো হাওয়ার মতো বুক থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অবশেষে সে বের হলো। আফরিনকে ছিটকে ফেলে দিল রাফির বুকে। আফরিন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কেন আমি ওইদিন চলে গেলাম? কেন দাদীমার কাছে আরেকটু থাকলাম না?”
রাফি আফরিনকে আগলে নিল। আফরিনের মাথায় নিজের থুতনি ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইল শূন্য দেয়ালে।
আফরিন আরো কী কী যেন বলছে। রাফি বুঝতে পারছে না। বোঝার চেষ্টাও করছে না। সে ব্যস্ত চোখে মজবুত বাঁধ বসাতে। কিন্তু হায়! শক্ত চোয়াল কি আঁখির বর্ষণ থামাতে পারে?
বহুক্ষণ পর আফরিন থামল। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখমুখ ফুলে গেছে। রাফি তার মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, “খেয়েছ?”
“না।”
“রান্না হয়নি?”
“হয়েছে। বুয়ারা করেছে।”
“চলো।”
“খাব না।”
“ইচ্ছে না হলেও খেতে হবে। তুমি না খেলে নাবিলা, মিহাদ, তিতলি কেউ খাবে না। তাই চাও?”
আফরিন উঠে দাঁড়াল। মনে হলো তার কাঁধে কেউ এক মণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। বিয়ের সময় তো এমন মনে হয়নি। দায়িত্ব তো সে তখন থেকেই নিয়েছে। আসলেই কি তাই?
মিহাদকে খাওয়াতে যেয়ে আফরিনের অনুশোচনা হলো। মিহাদ কখনও ধীর স্থির হয়ে খায় না। আজ চুপচাপ অনেকটা খেল। কেউ নিশ্চয়ই ওকে একটু খাওয়ায়নি। তার আর রাফির কাছে ছাড়া তো আর কারো কাছে খায়ও না।
তিতলির জ্বর এসেছে। মিহাদকে খাইয়ে তিতলির কাছে গেল আফরিন। কাঁথা গায়ে দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে।
“তিতলি! এই তিতলি?”
তিতলি কথা বলল না। আফরিন কপালে হাত দিল। একশ এক দুই হবে।
“তিতলি? শুনছ?”
“দাদীমা?” তিতলি চোখ বন্ধ করেই বিড়বিড় করল। আফরিনের চোখ জল জম গেল। আজকাল এত অল্পেই যে চোখে পানি আসে!
“ওঠ তিতলি। খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও।”
“দাদীমা কই ভাবি?” লাল চোখ দুটোয় নির্মম প্রশ্নের ভিড়।
“দাদীমা তো নেই তিতলি।”
তিতলি চোখ বন্ধ করল। খানিকক্ষণ পর বালিশের তলা থেকে মুঠো করে বের করল একটা হালকা ওজনের সোনার চোকার। উঠতে গেলে আফরিন তাকে সাহায্য করল। তিতলি ভাঙা কণ্ঠে বলল, “বুড়ি তো আমাকে ফাঁসায় দিয়ে গেছে ভাবি। আপনি বিকালে যখন চলে গেলেন তার একটু আগেই দাদীমা আমাকে এইটা দিয়েছে। বলেছে তোর মা, দাদী কেউ তো নাই। বিয়ের সময় কে তোরে গয়না দিবে? আমি একটা দিয়ে গেলাম। শ্বশুরবাড়িতে আমার নাম করবি। ভুলেও যেন বলবি না বাপের বাড়ি থেকে খালি হাতে পাঠাইছে।” তিতলি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। আবার বলল, “আপনারে তো দেখাইতে পারলাম না ভাবি। তার আগেই আপনি চলে গেলেন। মানুষ তো ভাববে আমি চুরি করছি। আল্লাহর কসম ভাবি আমি চুরি করি নাই। মিহাদ ভাই সামনে ছিল। তার কথা কে ধরে? আপনি আমারে এমনি না দিলেও কিনে নিতে দিয়েন। এই বাড়ির বেতন তো আমার সবই ধরা। কিছুই খরচ করি নাই। আরো দরকার হয় ধার করব। এইটা আমারে দিবেন ভাবি? দাদী আর কই পাব?”
আফরিন তিতলির জ্বরতপ্ত শরীরটা জড়িয়ে ধরল। তার স্তিমিত হয়ে যাওয়া বুকের ব্যাথাটা আবার ফিরে এসেছে।
“কসম করতে হবে না তিতলি। আমি জানি তুমি চুরি করনি। নিজের ঘরে কে চুরি করে?”
তিতলির মনের ভয়টা যেন দূর হল। চোকারটা আফরিনের হাতে দিয়ে বলল, “আপনার কাছে রাখেন ভাবি। যত্ন করে রাখেন।”
আফরিন তিতলিকে খাবার খাওয়ালো। ওষুধ খাওয়ালো। শান্ত হয়েই খেল তিতলি। থেকে থেকে কেবল বিড়বিড় করল।
“বুড়ি আমারে ঋণী করে গেছে। এই ঋণ আমি শোধ করব কী দিয়ে?”
চলে আসার সময় আফরিন শুনতে পেল তিতলি বলছে, “আমার মেয়ের নাম রুমিলা রাখলে ঋণ শোধ হবে না ভাবি?”
আফরিনের কাছে এর উত্তর নেই। সে কিছুই বলতে পারল না।
___________________
রাফি নিজে নিজেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনিকের সাথে পরামর্শ করেছে। সে দ্বিমত করেনি। কিন্তু আফরিন ভয় পাচ্ছে। তার ধারণা এভাবে কাজ হবে না। না হলে আর কোনো উপায় নেই। কাজেই রিস্কটা রাফি নিতে চায়।
রুমিলা মা-রা যাওয়ার চার দিন পর সন্ধেবেলা মাহমুদের কাছে গেল রাফি।
রুমিলা যে মারা যেতে পারে এটাই মাহমুদ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার ধারণা ছিল তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন মা তাকে কথা শুনিয়েই যাবেন। এটা সেটা নিয়ে ধমক দিবেন। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন আর মা থাকবে না এটা তিনি কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না।
না মানলেও রুমিলা মারা গেছেন। নিজের কান্ধে মায়ের খাটিয়া নিয়েছে মাহমুদ। নিজের হাতে মাটি দিয়েছে। ভ্রম তো এতদূর যায় না।
আর তারপর থেকেই কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। আসিফা এই চারদিন এই ঘরে থাকলেও তার সাথে একটা কথা বলেনি। না বলাই স্বাভাবিক। যাকে তালাক দিতে চেয়েছেন সে কথাবার্তা না বলে কিছুই যাওয়া আসার কথা না। কিন্তু মাহমুদ আবিষ্কার করলেন কথা বলার একটা মানুষ তার নেই। ছেলেমেয়েদের জন্মের পর আজ পর্যন্ত তাদের কী অবস্থা মাহমুদকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যাবেন না। তিনি কেবল তিন ছেলেমেয়ের চেহারাটাই চেনেন। আর কিছু না। মা তাকে ধমক দিলেও দুটো কথা বলত। সেও নেই। আসিফা প্রথমে ভালভাবেই কথা শুরু করত। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন সব কথা ঝগড়ায় পরিণত হয়ে যেত। তবুও তো দুটো কথা হত!
আজ চারদিন যাবৎ মাহমুদ অদ্ভুত অস্থিরতায় ভুগছেন। দুটো কথা বলার অস্থিরতা।
তার অস্থিরতাকে বাড়াতে অথবা কমাতেই রাফি এল। সচরাচর সে এই ঘরে আসে না। আজ আসতে হল। দরজায় নক করল মাহমুদ খুলে দিলেন। ছেলেকে দেখে অবাকই হলেন তিনি।
রাফি ভেতরে ঢুকল না। দরজায় দাঁড়িয়েই বলল, “আপনি ডিভোর্সের বিষয়ে কথা বলতে বলেছিলেন। কথা বলেছি। মায়ের কাছে এবং চেয়ারম্যানের কাছে মৌখিক অথবা লিখিতভাবে আপনি একটা নোটিশ পাঠাবেন। তিন মাস সময় দেয়া হবে সমঝোতার জন্য। আপনাদের হয়তো ডাকবে। জাস্ট ইগনোর করবেন তাহলেই হল। তারপর রেজিস্ট্রেশন করলেই হবে। আপনি একটা নোটিশ বানিয়ে ফেলুন। নাকি আমি বানিয়ে দেব?”
মাহমুদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সব তার ইচ্ছে মতোই হচ্ছে। কিন্তু এত দ্রুত যে তিনি তাল মেলাতে পারছেন না।
“এখনি?”
রাফি বলেই ফেলছিল যাকে তালাক দেবেন ভাবছেন তার সাথে আরো দুইদিন কেন থাকবেন? কিন্তু বলল, “জি। আমি যাচ্ছি। কোনো দরকার হলে বলবেন।”
মাহমুদ রাফিকে পেছন থেকে ডাকলেন, “তোমার মা কোথায়?”
রাফি এক পলক বাবার দিকে তাকাল, “চলে গেছে।”
মাহমুদ বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। কখন চলে গেছে? তাকে একবার বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। জিনিস পত্রও তো কিছু নিয়ে যায়নি। সবার শেষে মাহমুদের যেই কথাটা মনে হলো সেটা হল এত তাড়াতাড়ি!
রাফি নিচে নেমে তিতলিকে বলল, “মায়ের খাবারটা দিয়ে আসিস।”
“দিয়ে এসেছি।”
আফরিনকে বলল, “নাবিলা কোথায়?”
“আপুর ঘরেই।”
“ওকে বল মায়ের সাথে যেয়ে থাকতে।”
“ঠিকাছে।” আফরিন মাথা নাড়ল।
মাহমুদ অস্থির হয়ে এলেন মায়ের ঘরে। ভেবেছিলেন ঘর থাকবে বন্ধ। কিন্তু দেখলেন দরজা খোলা। তিতলি বিছানা ঝাড়ু দিচ্ছে আর মিহাদ পাশে দাঁড়িয়ে কিউব মেলাচ্ছে।
মাহমুদ জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কে থাকবে?”
“মিহাদ ভাই তো এখানেই থাকে।” তিতলি উত্তর দিল।
বিছানা গোছান হলে মিহাদ উঠে বসল। আফরিন এসে মিহাদের সাথে একবার দেখা করে গেল।
মিহাদ বিড়বিড় করে কী যেন পড়ছিল। মাহমুদ কান পেতে শুনলেন। অবাক হয়ে তিতলিকে বললেন, “ও কি কুরআন পড়তে পারে নাকি?”
“জি খালু। পারে।”
“কীভাবে শিখল?”
“দাদীমা কুরআন পড়ার সময় তার পায়ের কাছে বসে থাকত। তার কাছে শুনে শুনে শিখছে।”
মাহমুদ খেয়াল করলেন। অবিকল তার মায়ের সুর। যেই সুরে অনেক অনেক বছর আগে তার ঘুম ভাঙত। অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন মাহমুদ।
তিনি আরো অবাক হতেন যদি বুঝতে পারতেন মিহাদ কী পড়ছে। অথচ তিনি সেটা বুঝলেন না।
وَمَن يَعْمَلْ سُوٓءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُۥ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ ٱللَّهَ يَجِدِ ٱللَّهَ غَفُورًا رَّحِيمًا
“যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করে অথবা নিজের প্রতি জুলুম করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু পাবে।”
(৪:১১০)
~চলমান~