অন্তঃপুর পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
2

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৩৪.

ঘরের অবস্থা বেহাল। আলমারি থেকে একটা কাপড় বের করতে যেয়ে আরো তিন চারটা ছড়িয়ে পড়ছে। সেগুলো প্রথমে ভাঁজ করেননি মাহমুদ। কিন্তু বিছানায় জামা কাপড়ের স্তুপ হয়ে যাওয়ার পর বাধ্য হয়েই সেসব গোছাতে হলো।
গোছাতে যেয়ে আরেক ঝামেলায় পড়লেন তিনি। একটা পোশাকও ইস্ত্রি করা নেই। ভাঁজ এলোমেলো হয়ে আছে। সুন্দর করে গোছাতে পারছেন না তিনি। কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন মাপ মতো ভাঁজ হলো না তখন দলা করেই আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখলেন।
বিপত্তি বাঁধল পরেরবার আলমারি খোলার সময়। মনেই ছিল না ভেতরে কাপড় চোপড় দলা পাকানো আছে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। পুরো কাপড়ের স্তুপ তার গায়ের উপরে পড়ল এবং আচমকা ঘটনায় তাল সামলাতে না পেরে তিনি নিজেও মেঝের উপরে পড়ে গেলেন।

কাপড়ের ভার এমন নয় যে মাহমুদ সরিয়ে উঠতে পারবেন না। কিন্তু তিনি উঠলেন না। ওভাবেই বসে রইলেন।
গতকাল রাতে দেরি করে ফিরেছেন তিনি। আগের আড্ডাগুলোয় আর যান না। তার টাকা না দেবার চিন্তা। তার উপরে যারা তার উপরে হা-ম-লা করল তাদের সাথে আবার একই আসরে বসার মানে হয় না। ভবঘুরের মতো এদিক ওদিক ঘুরে দশটার পর বাড়িতে ফিরেছেন।
রাত দশটা খুব দেরি না হলেও ঘরবাড়ি অন্ধকার করে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। পেটে ক্ষুধা নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘরে গেলেন তিনি। আর তারপরই থমকে গেলেন। আসিফা নেই। কাজেই তার খাবারও নেই। আসিফা কথা শোনাত বটে কিন্তু তার খাবার সবসময় ঘরে এনে রাখত। নিচে তিনি খুব কমই খেতেন।
নিচে গিয়ে আশপাশে কিছুক্ষণ ঘুরলেন মাহমুদ। তিতলি নেই। রাফির বউকেও ডাকা যাচ্ছে না। ক্ষুধা নিয়েই ঘুমিয়ে গেলেন।
আজ বাড়িতে তাড়াতাড়ি এসেছিলেন খাওয়ার জন্যই। কিন্তু তাকে আশাহত করে আজও সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সাড়ে আটটায় সবাই ঘুমিয়ে গেছে? মাহমুদের অবাক লাগল। তার চেয়েও কষ্টের বিষয় আজ রাতটাও না খেয়ে কাটাতে হবে।
অতঃপর জামাকাপড়ের এই ঝামেলা। মনে হতে পারে কিছুই না। কিন্তু পেটে ক্ষুধা নিয়ে মাহমুদের কাছে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় ঝামেলা এখন কাপড় গোছানোই মনে হচ্ছে।

আস্তে ধীরে উঠলেন মাহমুদ। লাইট বন্ধ করে বিছানায় পিঠ লাগলেন। মুহূর্তেই মনে হলো পুরো বিছানায় বালি ছিটানো। তাড়াতাড়ি উঠে লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু কোথাও খুঁজে পেলেন না। আসিফা যাওয়ার পর থেকে এই ঘর নিশ্চয়ই কেউ গোছায় না। ঘর গোছানোর কাজ আসিফাই করত।
উপায় না পেয়ে চাদর উঠিয়ে ম্যাট্রেসের উপরেই শুয়ে পড়লেন মাহমুদ। তাতেও খুব আরাম পেলেন না। পুরোনো ম্যাট্রেসের আশ উঠে নখের সাথে, চামড়ার সাথে বাঁধছে। বিছানা ছেড়ে বালিশ নিয়ে ফ্লোরে চলে গেলেন তিনি। আশপাশে কেউ নেই। এই বিশাল অট্টালিকার বিলাসবহুল এক রুমে তিনি শুধু একটু শোয়ার জন্য যু-দ্ধ করে চলেছেন। নিজেকে চূড়ান্ত পর্যায়ের অসহায় মনে হল মাহমুদের। এই মুহূর্তে আসিফা থাকলে কী সুবিধাই না হত! এই সবকিছুর বিনিময়ে দুটো কড়া কথা শোনালেও চুপচাপ শুনে নিতেন তিনি। অসহায় অবস্থায় এমন কাজ করার কথা তিনি ভাবলেন যেটা ইহজীবনে কখনোই করেননি।

_________________

শ্বশুরকে দেখে আফরিনের মায়াই লাগছে। লোকটা একেবারে ছন্নছাড়া। এতদিন যে বউ কতকিছু করেছে টেরটুকু পাননি। এক্ষণে এসে অকূল পাথারে পড়েছেন। রাফির কড়া নির্দেশ, বাবার সাথে আগের মতো ব্যবহার করতে হবে। দরকার হয় আগের চেয়েও কিছুটা বেশি এড়িয়ে চলতে হবে। আফরিন অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শ্বশুরের অসহায় মুখ দেখে ঘরে গেল। রাফির কাছে বলল, “শুধু খাবারটাই দিয়ে আসি।”
“না।”
“একটা মানুষকে কতদিন না খাইয়ে রাখবেন? কালকে রাতেও বাবা খাননি।”
“এত দরদ দেখাবে না তো! এক বেলা ভাত না খেলে মানুষ ম-রে যায় না। তাকে বুঝতে হবে তিনি যাকে তালাক দিতে চেয়েছেন সেই মানুষটার অবদান তার জীবনে ঠিক কতখানি। বুঝে শুনে তালাক দিকে দেবেন।”
আফরিন চুপ করে রইল। রাফি কঠিন কণ্ঠে কথা বললে তার খারাপ লাগে।
রাফি আফরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে নিশ্বাস ছাড়ল। বলল, “সারা দুনিয়ার চিন্তা না করে ঘুমাও।”
“আপনার কথা শুনে তো মনে হয় আপনি মায়ের পক্ষে।”
“আমি কারোর পক্ষেই না। সংসার ভাঙার পক্ষেও না। ঝগড়া করলেও সারা জীবন তাদের একসাথে দেখে বড় হয়েছি। ভবিষ্যতে আমার ছেলেমেয়ে তাদের দাদা দাদীকে একসাথে পাবে না এটা আমি চাই না।”
রাফির কণ্ঠে মন খারাপের সুর।
আফরিন বলল, “মা কিন্তু খুব অনুশোচনায় ভোগেন। আপনাদের তিনজনের কাছেই।”
“অনুশোচনা করলেই কী? আমার মন মস্তিষ্কে বিশ্রী দাম্পত্যের যেই ছাপ পড়েছে সেটা তারা দূর করতে পারবে?”
“একটা মানুষ ভুল বুঝলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিৎ না? মা প্রতিদিন রাতে আপনাকে দেখে যেত। বিয়ের পরও আমি দেখেছি।”
“আমি জানি।”
“জানেন!” অবাক হয়ে বলল আফরিন।
“আমার ঘুম এতও ভারী না।”
“বলুন তাহলে উনি কেন এখানে এসে এসে বসে থাকতেন? আর আপনি মায়ের সাথে ভাল করে একটু কথাও বলেন না।”
রাফি আরেক দিকে মুখ ঘোরালো। নিচু কণ্ঠে বলল, “কথা না বলে বলে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন চাইলেও হুট করে কিছু বলতে পারি না।”
“চেষ্টা করবেন। বাবাকেই দেখুন। যা কিছুই করুক না কেন দাদীমার সাথে কিন্তু নিয়ম করে কথা বলত।”
দাদীমার প্রসঙ্গ আসতেই রাফি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“ছোট থেকে নিজের বাবা মায়ের সাথে সুন্দর সম্পর্ক পেয়েছ তো এজন্য এত সহজে বলতে পারছ। আমার বাবা মা তো থেকেও ছিল না। তোমার যদি এমন হত বাবা মা নেই তাহলে আমাকে ভাল করে বুঝতে। দুদিনের অনুতাপ আমার পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের দীর্ঘ সময়টা ফিরিয়ে দিতে পারবে?” মলিন হেসে বলল রাফি। আফরিন কেনই যেন হাসতে পারল না। উল্টো আর কিছু বললও না।
_________________

দোতলায় একটা গেস্ট রুম আছে। সেখানে সচরাচর কেউ থাকে না। অনেক মেহমান এলে তবেই থাকে
রাফির বিয়ের সময় ছিল। ফলে বহুদিনের জমা ধুলোবালি থেকে আসিফা রেহাই পেয়েছেন।

রাফি তাকে নিজে থেকেই এসব কিছু করতে বলেছে। মাহমুদকে বলেছে তিনি চলে গেছেন। ভুল কিছু বলেনি। তিনি তো নিজের ঘর ছেড়ে চলেই এসেছেন। এত বছর ছেলেটা তার কাছে কিছু চেয়েছে। তিনি কীভাবে না করতেন? সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেছেন। মাহমুদ নিজের ঘরের খবরই ঠিকমতো বলতে পারবে না। এখানে যে একটা গেস্ট রুম আছে সেটাও বোধহয় জানে না। সেখানে আসিফা লুকিয়ে থাকতে পারেন এটা তার ভাবনার বাইরে। রাফির ধারণা এতে নাকি মাহমুদ তার জীবনে আসিফার উপস্থিতি বুঝবেন। কে জানে? রাফি, নাবিলা যদি তাকে থেকে যেতে বলে তাহলে অসহ্য ঝগড়া করা লোকটার সাথে তিনি থেকে যাবেন।

এই ঘরে আসার পর একটু খারাপ লাগছিল। বারান্দা থেকে ফুলগাছগুলো দেখা যায় না। ওগুলো বাড়ির পেছনের দিকে। এই ঘরটা রাফির ঘরের পাশেই। রাস্তার দিকে। ফলে গাড়ি ছাড়া আর কিছু দেখতে পারবেন না ভেবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু রাতে শোয়ার সময় নাবিলাকে দেখে অবাক হলেন। সচরাচর প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে এবং মা হয় একে অপরের ব্যক্তিগত ডায়েরি। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে সমীকরণ উল্টো। ফলে মেয়েকে এই ঘরে আসতে দেখে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক।
নাবিলা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “ভাইয়া বলল তোমার সাথে থাকতে।”
আসিফার মনটা আপ্লুত হলো। ছেলেটা তার কথা ভাবছে। নাবিলাও সমর্থন করছে। কতকাল বাদে মেয়েকে পাশে নিয়ে শুলেন আসিফা বলতে পারবেন না। আনন্দে তার ইচ্ছে করছিল মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। সেটা না পারলেও মেয়ের গায়ে হাত উঠিয়ে দিলেন। ভান ধরলেন এমন যেন তিনি গভীর ঘুমে। নাবিলা একটু আগেও নড়ছিল। সে হাতটা সরিয়ে দেয় নাকি সেটাই বুঝতে চাইলেন আসিফা।
দু তিন মিনিট পেরিয়ে গেলেও নাবিলা কিছু করল না। আসিফা একটু আশকারা পেলেন।
“নাবিলা? ঘুমিয়েছ?”
নাবিলা এক ডাকেই মায়ের দিকে ঘুরল।
“না।”
নাবিলার মাঝে কোনো জড়তা নেই। আসিফার কি যে ভাল লাগল! হাতটা তিনি আরো ভাল করে রাখলেন।
“তুমি নাকি আফরিনের ফুড ভ্যানে কাজ করছ?”
“ভাবির না। ঐ ছেলেমেয়েদের। গিয়েছিলাম কয়েকদিন। দাদীমা মা-রা যাওয়ার পর আর যাইনি।”
“ওহ। দাদীমাকে খুব ভালবাসতে?”
“খুব। আমার চেয়েও বেশি ভাইয়া। ভাইয়া যে কি কাঁদছিল!” নাবিলার চোখ ভিজে গেল।
“আমি মরে গেলেও তোমরা এভাবে কাঁদবে?” আসিফা কেমন অন্যমনস্ক কণ্ঠে বললেন। নাবিল চুপ করে রইল। উত্তর দিল না।
আসিফা নাবিলার হাত ধরলেন। ভেজা কণ্ঠে বললেন, “আমাকে মাফ করবে মা? তোমাদের সাথে খুব অন্যায় করেছি। তোমরা যদি পা ধরে মাফ চাইতে বল রায় ধরব।”
“ছিঃ ছিঃ! এসব কি কথা।”
“আমি তোমাদের মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। তোমরা আমার উপরে রেগে থাকতেই পার।” আসিফা চোখ মুছলেন, “আচ্ছা মাফ না করো একটু কথাবার্তা বোলো। তাহলেই হবে। মন খারাপ হলে যেমন তোমরা দাদীমার কাছে যেতে, তার সাথে কথা বলতে এমন করে আমার সাথে বলতে পারবে না?”
উদগ্রীব হয়ে নাবিলার উত্তরের অপেক্ষা করলেন আসিফা। নাবিলা বলল, “পারব।”
“সত্যি!”
“হ্যাঁ।” নাবিলার কণ্ঠে কোনো জড়তা নেই। গত কয়েক বছর ধরে আসিফা যে কেমন অনুতাপে ভুগতেন নাবিলা দেখেছে। নিজের মাকে এভাবে দেখতে কারই বা ভাল লাগে? নাবিলা নিজের ডান হাতটা মায়ের গায়ের উপরে তুলে দিল। আসিফা বললেন, “রাফি বলবে?”
নাবিলা একটু সময় নিল, “ভাইয়ার কথা বলতে পারি না। তাছাড়া এখন তো ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাবি আছে।”
“ঠিকই তো ঠিকই তো।”
“তুমি ঘুমাও মা। এত চিন্তা কোরো না।”
আসিফা ঘুমালেন আরো পরে। মনে হলো ছেলেটাকে আর তিনি কোনোদিনই ফিরে পাবেন না।
_________________

আজ সকালে বাবার মুখটা দেখে সত্যি বলতে রাফিরও মায়া লেগেছে। মাহমুদের চোখে মুখে সবসময় বেপরোয়া এক ভাব লক্ষ্য করা যায়। এই দুনিয়ায় কার কী হলো তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। সেই লোকটাই কয়েক দিনের ব্যবধানে কেমন হয় গেছে। রাফি নিজেকে শক্ত করল। মাহমুদকে জীবন বুঝতে হবে। এই বয়সে এসেও এমন খামখেয়ালীপনা চলবে না।

অফিসে পুরোনো অনেক কাগজপত্র জমা হয়েছিল। সেগুলো দেখে শুনে সরিয়ে রাখছিল একজন। রাফি অদরকারি ফাইলগুলো আলাদা করে দিয়েছে। ওগুলো স্টোররুমে জমা হবে। বাকিগুলো এখানে গুছিয়ে রাখা হবে। কাগজের দিকে নজর থাকলেও তার চিন্তায় চলছিল বাবা মায়ের সংকটাপন্ন দাম্পত্য। যত যাই হোক না কেন এতদিন দুজন একসাথে তো ছিল। ছেলেমেয়েদের কথা বলে এড়িয়ে গেছে রাফি। সে কি নিজেই সহ্য করতে পারবে বাবা মা আলাদা হয়ে গেলে?

“স্যার এইটা কি লাগবে?”
স্টাফ লোকটা একটা খাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাফির ভুরু কুচকে এল। অফিশিয়াল খাম তো এভাবে লেবেল ছাড়া দেয়া হয় না। বাঁশপাতা খামটার গায়ে কিছুই লেখা নেই। কী ছিল ওটায়?
“মুখ খোলা?”
“না স্যার বন্ধ।”
“দেখি দাও।”

খাম খুলল রাফি। হাতে লেখা দু পাতার একটা চিঠি বেরিয়ে এল। তার কপালের ভাঁজ আরো খানিকটা গাঢ় হলো। এমন চিঠি তাকে কে দিতে পারে?

গুটি গুটি অক্ষরে বাংলা লেখা। পড়তে বেশি সময় লাগল না। প্রথমবার পড়ে শেষ করার পর রাফির মনে হল সে কিছুই বোঝেনি। আবার পড়ল। আবার। পুরো চিঠি জুড়ে কেবল একটা লাইনই তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকল।
“বলা বাহুল্য আমার আপন পিতা মাতার কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি।”
_________________

রাফি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছিল আফরিনের কাছে সরি বলার ইচ্ছে নিয়ে। কিন্তু ডাইনিং রুমে ঢুকতেই ইচ্ছেটা মাটিচাপা পড়ে গেল।
আফরিন নিজেও হতবাক। আজই সাতটার সময় আসতে হলো? সকালেই তো বলল আসতে দেরি হবে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।

বিকেলবেলা শাশুড়ি আফরিনকে ডেকে পাঠালেন। বিব্রত মুখে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, “ঐ লোকটা কি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে? একা একা তো একটা কিচ্ছু করে না। নিজেকে জমিদার ভাবে। কিছুই মনে হয় খাচ্ছে না। আজকে রাফি আসার আগে আগে তুমি একটু খাইয়ে দেবে বৌমা? রুই মাছ পেঁয়াজ দিয়ে একটু ভুনা করে দিলেই এক প্লেট খেয়ে ফেলবে।”
বিরক্তি নিয়ে শুরু করলেও আকুতি দিয়ে শেষ করেছেন আসিফা। আফরিনের ভেতরে ভেতরে আনন্দ হল। রাফির বুদ্ধিটা কাজে দিয়েছে। আনন্দ চেপে রেখে সে বলল, “ঠিকাছে মা।”
সেই অনুযায়ী বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে রুই মাছ ভুনা করেছে আফরিন। সন্ধেবেলা মাহমুদ ডাইনিংয়ে ঘুরছিলেন। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা। আগে দুপুরে বাইরে খেতেন। ইদানিং খাওয়ার সময় চলে আসেন। আফরিন মানুষটার একাকীত্ব বুঝতে পারে।
মাহমুদ ইতস্তত করে তার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন, “ইয়ে.. আসিফা কি একেবারে চলে গেছে?”
আফরিন এমনভাবে তাকিয়ে থাকল যে মাহমুদের মনে হল প্রশ্নটা খুব বোকা বোকা হয়ে গেছে। নিজে নিজেই বিড়বিড় করলেন, “চলেই তো যাবে। চলেই তো যাবে।”
মাহমুদ চলে যাচ্ছিলেন। আফরিন পেছন থেকে ডেকে বলল, “বাবা খেয়ে যান।”
একবার বলতেই বসে পড়লেন মাহমুদ। তবে খেতে যেয়েও নাকানিচুবানি খেলেন।
ভাতের সাথে কাঁচা লবণ খাওয়া তার অভ্যেস। আফরিন তা জানে না। মাহমুদ ছেলের বউয়ের কাছে মুখ ফুটে চাইলেন না। একটা কাঁচা মরিচ ভাতের সাথে ডলে না খেলে তার ভাল লাগে না। আজকে সেটাও নেই। মাছটা মনে হয় ভেজে নেয়নি আফরিন। মাহমুদের কাছে একটু কেমন যেন গন্ধ লাগল। অথচ এসবের কিছুই কখনও আসিফাকে বলে দিতে হয়নি। হোটেলে খেলে লবণ, মরিচ চেয়ে নিয়ে খান। কিন্তু আজকে কেন যেন চাইতে ইচ্ছে করল না। হঠাৎ করেই মনে হল আসিফা নেই। প্রকৃতপক্ষেই নেই।

এই খাওয়ানোর দৃশ্যটাই দেখে ফেলল রাফি। আগেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পালিয়ে যাওয়ার উপায় কই?
রাফি শক্ত চোখে আফরিনের দিকে তাকালে আফরিন সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিল। রাফি মাহমুদের কাছে যেয়ে বলল, “নোটিশ রেডি করেছেন?”
মাহমুদ সহসাই ধরতে পারলেন না। “হ্যাঁ?”
“নোটিশ। ডিভোর্সের নোটিশ।”
“এখনো করিনি।”
“তাড়াতাড়ি করুন। যে কাজ করতেই হবে সেটা ঝুলিয়ে রাখার মানে হয় না।”
আফরিন বড় বড় চোখে তাকাল। কি নিষ্ঠুর! বিপরীতে কটমট করে তাকাল রাফি।
“টাকাটার কী ব্যবস্থা করলে?” নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মাহমুদ। আশ্চর্য! আসিফা থাকতে তো এত হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয়নি। আজ হঠাৎ করে নিজেকে একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এরা তার কেউ না।
“কোন টাকা?” রাফি বুঝতে পারল না।
“ঐ নয় লাখ।”
“দিয়ে দিয়েছি। কেস করলে তো আপনার নামেও উল্টো হবে। দয়া করে এই জুয়া খেলা এবার বন্ধ করুন। আর খেলতে চাইলে নিজের টাকা নিজে শোধ করবেন। আমি আর পারব না।”
আফরিন রাফির হাত চেপে ধরলো। চাপা কণ্ঠে বলল, “কীভাবে কথা বলছেন!”
“তুমি একদম চুপ কর! একটা কথাও বলবে না।”
আফরিন একদম শান্ত হয়ে গেল।

এক প্রকার ছুটে ঘরে চলে গেল রাফি। ঠিক এভাবেই মাহমুদ একদিন আসিফাকে ধমক দিয়েছিলেন। সে খাচ্ছিল। তার সামনেই। রাফির মন চাইলো নিজের দুগালে দুটো থাপ্পড় দিতে। না চাইতেও সে একই কাজ করছে। বারবার বারবার।

আফরিন ঘরে এল পনের মিনিট পর। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “এখনও কাপড় পাল্টাননি কেন?”
এই যে আফরিন কথা ধরে রাখে না, সাথে সাথেই স্বাভাবিক হয়ে যায়, একটু চোটপাট পর্যন্ত করে না এতে রাফির অপরাধবোধ আরো বেড়ে যায়।
সে আফরিনকে বলল, “বসো।”
আফরিন বাধ্য স্ত্রীর মতো বসল।
“তোমার চিঠিটা পড়লাম।”
“কোন চিঠি?” আফরিনের কপালে ভাঁজ পড়ল।
“বিয়ের আগে যেটা দিয়েছিলে।”
আফরিন অবাক হলো, “এতদিনে পড়লেন! তখন পড়েননি কেন?”
রাফি উত্তর দিল না। অপছন্দের মানুষের চিঠি পড়বে না ভেবে ফেলে রেখেছিল। এটা কি এখন বলা উচিত হবে?
তার বদলে বলল, “তুমি না বললে আমি কিন্তু সত্যিই বুঝতাম না।”
আফরিন হাসল।
রাফি বলল, “তোমার আফসোস হয়?”
“কীসের আফসোস?”
“নিজের মা বাবা না থাকার।”
“তাহলে মোশাররফ হোসেন, আফসানা ইসলাম কে?”
রাফি আফরিনের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। কথা বলা চোখ দুটোর দিকে।
আফরিন বলল, “সবাই এক জোড়া বাবা মা পায়। শ্বশুর শাশুড়ি সবাই একসাথে পায় না। সেখানে আমি তিন জোড়া পেয়েছি। যারা নেই তারাও আমার মধ্যে আছে।” চমৎকার করে হাসল আফরিন।
রাফি বলল, “আমাকে একটা হেল্প করো।”
“কেমন হেল্প?”
“রাগ করে তোমাকে যেন আমি উল্টাপাল্টা কিছু না বলি। রাগের মাথায় কাজের যেয়ে অকাজের কথাই বেশি আসে। সেগুলো বলে তোমাকে যেন আমি কষ্ট না দিই।”
আফরিন বেশ কিছুক্ষণ ভাবল। রাফি আফরিনের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁট দুটো চেপে, বা দিকে একটু বাঁকা করে, চোখ ছোট ছোট করে আফরিন ভাবছে। তাকে কি সত্যিই এত সুন্দর লাগছে?
“একটা কাজ করা যায়।”
“কী কাজ?”
“একটা ডায়েরি বানাব। আপনার যখন রাগ হবে আপনি একদম চুপ করে যাবেন। টোটালি সাইলেন্ট মুডে চলে যাবেন। খুব কষ্ট হলেও একটা কথাও বলবেন না। তারপর রাগের ধরন অনুযায়ী এক, দুই ঘণ্টা অথবা সিরিয়াস কিছু হলে পরেরদিন সেই ডায়েরিতে আমার কোন কোন ব্যবহার বা কথা আপনার ভাল লাগেনি সেটা লিখবেন। তারপর আমি সেটা পড়ে নিজেকে শুধরে নেয়ার চেষ্টা করব। মাঝে কিছু সময় গ্যাপ নিলে আপনার মাথা ঠাণ্ডা হবে। তখন ঠান্ডা মাথায় প্রকৃত অবস্থা ভাবতে পারবেন। বলার সময় যেটা বলি লেখার সময় আমরা কিন্তু সেই অতিরিক্ত কথা লিখি না। তখন দেখবেন যেই জিনিসের জন্য রাগ হয়েছিল লেখার সময় অত কারণ খুঁজে পাবেন না। মনে হবে এত ছোট কারণে কেউ রাগ করে?”
রাফি আফরিনকে টেনে ধরল। তাল হারিয়ে আফরিন রাফির গায়ের উপরে পড়ে গেল।
“আঃ!”
“এত দারুন বুদ্ধি কোথায় পেলে?”
“আল্লাহ দিলেন।”
“তোমার রাগ হলে কী করবে?”
“আমিও একই পদ্ধতি ফলো করব। ডায়েরির প্রথম অর্ধেক আপনার শেষ অর্ধেক আমার।”
রাফি ফিসফি করে বলল, “সরি!”
_________________

সেদিন রাতে মাহমুদ ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন এই পুরো বাড়িতে তিনি একা। আর একটা মানুষও নেই। প্রচণ্ড পিপাসায় তিনি ছটফট করছেন। কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। গলা থেকে র-ক্ত বেরিয়ে আসছে তাও তিনি কিছু করতে পারছেন না।
সে সময় কোত্থেকে আসিফা এলেন। মাহমুদ খুব কষ্ট করে বললেন, “আমাকে একটু পানি খাওয়াও।”
“কেন খাওয়াব? আমাকে না তুমি তালাক দেবে? কিচ্ছু খাওয়াব না তোমাকে।”
“তোমার পায়ে পড়ি। আমাকে একটু পানি খাওয়াও।”
“তোমার জন্য বাপের বাড়িতে আমার মাথা হেট হয়েছে। সবাই জানে আসিফার বর অকর্মা, জুয়াড়ি। আমাকে ডাকে জুয়াড়ির বউ। তুমি আমাকে জীবনে একটু সম্মান দিয়েছ? তোমাকে কক্ষনো আমি পানি খাওয়াব না।” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন আসিফা।
মাহমুদের মনে হলো তার জীবনের অন্তিম সময় চলে এসেছে। তিনি পানির অভাবেই মা-রা যাবেন। বুক থেকে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। নিঃশ্বাসে টান উঠেছে। আসিফা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আর একটু, আর একটু সময় গেলেই তিনি চোখ বন্ধ করে ফেলতেন। ঠিক তক্ষুনি আসিফা কোত্থেকে আবার উদয় হলো। তাকে ধরে উঠিয়ে পানি খাওয়াল। রাগী গলায় বলল, “জীবনে সম্মান দিয়েছ আমাকে? একটুও সম্মান দিয়েছ?”
মাহমুদ অদ্ভুত চোখে দেখলেন আসিফাকে দেখাচ্ছে সাতাশ বছর আগের তরুণী আসিফার মতো। যাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন।

ধড়ফড় করে উঠে বসলেন মাহমুদ। পুরো শরীর ঘেমে গেছে। আসলেই তৃষ্ণায় গলা, বুক শুকিয়ে গেছে। তিনি ঝিম মেরে বসে রইলেন। বিছানার পাশের টেবিলে জগ ভরতি পানি। এতদিন ছিল না। কে রেখে গেছে কে জানে? মাহমুদ হাত বাড়িয়ে পানি নিলেন না। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় বসে রইলেন বাকিটা রাত।

পরদিন সকালে রাফি যখন অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলো মাহমুদ প্রায় উড়ে এলেন তার কাছে। তার দুচোখে দুঃস্বপ্নের ভয়, রাত জাগা কাল দাগ। অস্থির কণ্ঠে তিনি বললেন, “আমি আসিফার সাথে দেখা করতে যাব।”
“কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল রাফি।
“আমি ওকে তালাক দেব না।”
রাফির ভেতরটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তবু শক্ত কণ্ঠে বলল, “আপনার ইচ্ছেতেই সব হবে? মা যদি তালাক চায়?”
“দরকার হলে আমি ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব।”
“আপনি অবশ্যই তালাক দেবেন।” দৃঢ় কন্ঠে বলল রাফি। আফরিন অবাক হলো। এই দৃঢ়তার মানে কী?
এই কয়েকদিনের জমানো ক্ষোভ, বিরক্তি, একাকীত্ব, অসহায়ত্ব সব মাহমুদের গলা থেকে এক যোগে চিৎকার হয়ে বেরিয়ে এল।
“মরে গেলেও আমি আসিফাকে তালাক দেব না! দেব না! দেব না! দেব না!”
ঢলে পড়ে যেতে গেলেই তাকে কেউ আঁকড়ে ধরল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তাকালেন মাহমুদ। আসিফা বিরক্ত কণ্ঠে বলেলন, “সবসময় এমন চিৎকার না করলে ভাল লাগে না?” লোকটার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। মুখের হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আসিফার বুকটা হু হু করে উঠল।
মাহমুদ এক মুহূর্ত সময় নিলেন। তারপরই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। স্ত্রীর দুহাত ধরে বললেন, “আমাকে মাফ করে দাও আসিফা!” তার কণ্ঠের আকুতি ছুঁয়ে গেল রাফিকেও। চোখে জল নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। আসিফা ঘর ভরতি সামনে বিব্রত বোধ করছেন। এই লোকটার কোনোদিনই আক্কেল জ্ঞান হবে না।

তিতলি চিৎকার শুনে ছুটে এসেছিল আসিফার সাথেই। আফরিনের হাত ঝাপটে ধরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে বলল, “দাদীমা দেখতে পারল না ভাবি। মানুষের বুদ্ধি এত দেরিতে হয় কেন?”
আফরিন ঝাপসা চোখে তাকাল রাফির দিকে। আশ্চর্য! লোকটাকে কি দারুন সুন্দর লাগছে!

পরিশিষ্টঃ
ডায়েরিটা অধরাই রয়ে গেছে। রাফি ভেজা তোয়ালে বিছানায় রাখলেই আফরিন রেগে যায়। কিন্তু ডায়েরিতে লেখার সময় মনে হয় সারাদিন খেটে খুঁটে এসে লোকটা আর কত দিকে খেয়াল রাখবে? একটু নাহয় বিছানাই ভিজল। সে চাদর পাল্টে ফেলবে।
রাফি লিখতে গেলে মনে হয় পুরোটা দিন এই ঘরের পেছনেই আফরিন সময় দেয়। সে এসেই যদি জিনিসপত্র এলোমেলো করা শুরু করে তাহলে বকা দেয় একশবার অনুমোদিত।
ফলে ডায়েরির প্রথম ভাগ এবং শেষ ভাগ কোনোটাতেই কলমের কালি পড়েনি। দাগ না নিয়েই স্মৃতি বহন করে চলেছে ডায়েরিটা।
এখনো দোতলা থেকে চিৎকার ভেসে আসে। কেবল আসিফার একার। মাহমুদ লোকটা দিনদিন অলসের চূড়ান্ত হচ্ছে। চিৎকার করে একটা কথা না বলা পর্যন্ত তার কানে ঢোকে না।
মিহাদের রাগ পুরোপুরি না কমলেও কিছুটা কমেছে। সে কিছু কিছু বাক্য বলতে পারে। যেমন, “তিতলিকে বিয়ে দিয়ে দাও। নাবিলাকে বিয়ে দিয়ে দাও। ওরা আমাকে হিংসা করে।”
মিহাদকে ধরে বেঁধে কিছু করানো যায় না। তাই আফরিন অন্য উপায় অবলম্বন করেছে। মিহাদ যতক্ষণ জেগে থাকে ওর আশপাশে সাউন্ড বক্সে কুরআন তিলাওয়াত চালু করে রাখে আফরিন। ছেলেটা আনমনেই বিড়বিড় করে পড়ে। একদিন আফরিন শুনতে শুনতে খেয়াল করলো প্রথম আট পারা মিহাদের মুখস্থ। সেদিন যে কতক্ষন তাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিল আফরিন! লোকে বলে মিহাদ মানসিকভাবে অসুস্থ। মানসিকভাবে সুস্থ ক’টা লোক কুরআনের প্রথম আট পারা মুখস্থ করতে পেরেছে?
নাবিলার জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। পছন্দ হলে যেকোনো সময় বিয়ে হয়ে যাবে।
তিতলি চারদিকে তাকায়। তার বুকের ভেতরের আফসোসটা চোকারের মতো গলায় ঝুলে থাকে। সবই তো হলো। হাসি কুঞ্জে হাসি এল। কিন্তু হাসির মানুষটাই দেখতে পেল না। এই আফসোস কী দিয়ে মেটাবে সে? ডাইনিং রুম ভরতি হাসিখুশি মানুষের দিকে তাকায় সে। ধরা গলায় বিড়বিড় করে বলে, “দাদীমা? ও দাদীমা!”

সমাপ্ত।