অন্তর্ভেদী পর্ব-০২

0
1

#অন্তর্ভেদী
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_২

অস্পষ্ট ভাবে বললাম,
-“আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?

অনয় আমার কথা বুঝলেন কি না বুঝতে পারলাম না। ড.অনয়কে দেখে আমি যতটা না চমকেছি ততটাই বিষ্মিত হয়েছি। আমি ছিটকে সরে আসতে চাইলাম। পরে যেতে নিলে অনয় আমাকে ধরে ফেললেন। শায়না তখন আমার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে। আমি ওকে পাত্তা দিলাম না। আবারও চেষ্টা করলাম অনয়ের থেকে সরে আসার। তবে তিনি নাছোরবান্দা। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন,

-“মিলি শান্ত হয়ে দাঁড়ান। খেয়ে ফেলছি না আমি আপনাকে। হুশ”

আমি কিছু বলতে নিয়ে ছিলাম তিনি বলতে দিলেন না। আমাকে চুপ করালেন। অনয় শায়নাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনাদের রিসোর্টের নাম?”

শায়না নাম বললেই তিনি জানালেন তিনিও একই রিসোর্টে উঠেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি পারবো কি না হেঁটে যেতে। আমি ঝাপসা দেখলেও তাকে বললাম পারবো। অনয় শায়নাকে বললেন আমাকে ধরে নিয়ে আসতে। দু কদম যেতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো। অনয় আমাদের পেছনেই ছিলেন। তিনি শায়নাকে সরে যেতে বলে আমায় কোলে তুলে নিলেন। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। লোকটা অভদ্র হলেও সাহায্যকারী। অনয় ধন্যবাদ পাওয়ার প্রাপ্য হলেও আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম না। অনয় আমাকে কটেজে দিয়ে গেলেন। শায়না অবশ্য তাকে ধন্যবাদ বলেছে। আমি ধন্যবাদ দেইনি। অনয় যেতেই শায়না প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলল। আমি তাকে পুরোটা বললাম।

-“সব শুনলাম, মানলামও। তবে উনি তোর নাম মনে কীভাবে রাখলো। দিনে তো কত পেশেন্ট আসা যাওয়া করে। তার মাঝে তোর নাম কীভাবে মনে রাখলো?”

শায়না তো ঠিকই বলেছে। দিনে কত মানুষ ডাক্তার দেখাতে যায়। তার মাঝে অনয় আমার নাম বা আমাকে কিভাবে মনে রাখলেন? আসলেই ভাবার বিষয়। অনয় কি আমায় পছন্দ করেন? ধ্যাত আমিও না কি ভাবছি। মানবিকতার খাতিরে সবটা করেছেন তিনি। ঘন্টাখানেক যেতেই অনয় ওষুধ দিয়ে গেলেন। আমি তখন বারান্দায় বসে রাতের সাজেক দেখছি। শায়নার হাতে ওষুধের এক পাতা ধরিয়ে আমায় দিতে বলেন। শায়না এসে আমায় ওষুধ দিয়ে বলল,
-“মিলি এই লোকের মতিগতি সুবিধার লাগছে না। তোকে এতোটা পথ কোলে তুলে আনলো এখন আবার সেধে ওষুধ ও দিচ্ছে। এগুলো কেমন একটা লাগছে না?”

আমি মাথা নাড়ালাম। বোঝালাম আমারও সুবিধার ঠেকছে না। সে রাতে আর দেখা হলো না আমাদের। আমি আর শায়না রাতে বের হয়ে ছিলাম রিসোর্টে হাঁটতে। আর স্মৃতি হিসেবে ক্যাপচার করছিলাম। অর্ধেক রাত কেটেছিলো দু’জনের গল্পে। পরদিন খুব সকালে উঠতে হলো। ভোরে উঠার কারণ সূর্যদ্বয় দেখা। আজ আকাশে সূর্য উঠেছে তার সম্পূর্ণ তেজ নিয়ে। আমরা সকালের নাস্তা সেরেই কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই। কংলাক পাহাড়ে উঠার সাথে সাথেই চোখে পরলো আশেপাশের মেঘে ঢাকা পাহাড় গুলো। আমি চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির এই নিস্তব্ধতা উপভোগ করছিলাম। আমাদের লুসাই গ্রামে দেখা হলো অনয়ের সাথে। তিনিও ঘুরতে এসেছেন। আমি তাকালাম না। শায়না অবশ্য ভদ্রতার খাতিরে কথা বলেছে।

অনয় আমার দিকে এগিয়ে এসে বলেন,
-“আপনার শরীর ঠিক আছে এখন? মাইগ্রেনে ব্যাথা উঠেছিলো আর?

আমি ছোট করে উত্তর দিলাম ঠিক আছি। আমাদের আর কথা হয়নি। ঘুরলাম বেশ আনন্দ করে। শায়নার সাথে জমিয়ে আড্ডা আর ঘুরাফেরা করে বেশ ভালো কাটলো সাজেক ভ্যালির দিনগুলো। আমরা তিন দিন থেকে ছিলাম। ড.অনয়কে আর দেখিনি। তিনি বোধ হয় চলে গিয়েছিলেন। সাজেক ট্যুরটা এবার আমার বেশ ভালো কেটেছে। শায়না না থাকলে বোধ হয় এতো ভালো কাটতো না আমার সাজেকের তিন দিন।

৩.

বাড়িতে ফিরতেই আব্বুর নানা প্রশ্নে জর্জরিত হলাম। আমি দু একটার জবাব দিলেও আব্বুর মন ভরেনি। ক্লান্ত হয়ে সে দিন আর দরজা খুলিনি। ড.অনয় যাওয়ার আগে আমাকে বলে এসেছিলেন যেনো সাজেক থেকে ফিরেই তার কাছে যাই। আমি ফেরার তিনদিন পর শারমিনকে নিয়ে আবারও গেলাম ড.অনয়ের চেম্বারে। আজ ভীর নেই। আধা ঘন্টাতেই আমার সিরিয়াল এলো। আমি শারমিনকে নিলাম না আজ। বাইরে অপেক্ষা করিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। অনয় মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখছে। আমি সামনে বসলাম তার। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। আমি প্রথম দিনের ন্যায় বললাম ম্যাইগ্রেনে সমস্যা। তিনি তাকালেন। আমিও তাকিয়ে আছি। তিনি সব কিছু বুঝে ওষুধ লিখলেন। আমাদের অতিরিক্ত কোনো কথা হলো না। আমি বের হলাম শারমিন আমাকে প্রশ্ন করলেও একটার ও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না।

বাড়ি ফিরতেই আব্বু আমাকে ডাকলেন বসার ঘরে। আমি তখন মাত্র ফ্রেশ হয়ে শুয়ে ছিলাম। এক প্রকার বিরক্ত নিয়েই গেলাম। আব্বুর ডাকা মানে হয় ছেলে দেখো না হয় বকাবকি। এসবে আমি অভ্যস্ত হলেও আজ শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। তবুও উঠে গেলাম। আব্বু তখন গম্ভীর মুখে সোফাতে বসে আছেন। আমাকে দেখে নড়েচড়ে বসে বললেন,

-“তুমি আমাকে মিথ্যা কেনো বলেছিলে মিলি?”
-“কি মিথ্যা বলেছি আব্বু?”
আব্বু এবার চেতে উঠলেন। রাগী কন্ঠে বললেন,“তুমি আমায় বলেছো সাজেক যাচ্ছো অফিস থেকে অথচ তুমি সাত দিনের ছুটি নিয়ে শায়নার সাথে গিয়েছো। মিথ্যা কেনো বলেছিলে?”
আমি ভয় পেলাম না। স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালাম,
-“সত্য বললে তুমি যেতে দিতে?”

আব্বু কথা বাড়ালেন না। হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। আমি হাসলাম। আব্বু যে আমার উপর প্রচন্ড চেতেছে তা বুঝতে আমার সমস্যা হলো না।
পরদিন আব্বু কাউকে না জানিয়ে উধাও হলেন। এমনকি আম্মুও জানে না আব্বু কোথায়! চিন্তায় পরে গেলাম। আত্নীয় স্বজন সবার বাড়িতে খোঁজ নিলাম, কেউ জানে না আব্বু কোথায়। কাউকে না জানিয়েই তিনি গিয়েছেন। চিন্তায় আম্মু কান্না কাটি শুরু করেছেন। আমারও বেশ চিন্তা হচ্ছে।

৪.

আব্বু বাড়িতে ফিরলো গুনে গুনে চারদিন পর। এসেই হুমকি দিয়েছে এবারের পাত্র যদি রিজেক্ট করি তাহলে সে সারা জীবনের জন্য গায়েব হবে। আমি পাত্তা দিলাম না। তবে আব্বু এবার নাছোড়বান্দা। এবার আমাকে পাত্র পক্ষের সামনে বসিয়েই ছাড়বেন। পরের শুক্রবার ঠিকই আব্বু আমাকে পাত্র পক্ষের সামনে বসানোর তোড়জোড় শুরু করলেন। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম। আম্মু আমায় শাড়ি পরিয়ে দিলো। যদিও আমি শাড়ি পরতে জানি। শায়না শারমিন দু’জনই আসলো। শায়না আমায় জোরজবরদস্তি করে সাজিয়ে ছেড়েছে। পাত্র পক্ষ আসলো বিকালে। আমি মোটেও যেতে রাজি নই পাত্রের সামনে।

আব্বু আমার রুমে এসে বললেন,
-“তুমি কি আমার মান সম্মান নষ্ট করতে চাইছো?
-“তুমি কি আমার কাছে একবার শুনেছো কিছু? আমার তো পছন্দ ও থাকতে পারে তাই নয় কি?”
আব্বু মুখ বাকিয়ে বললেন,“তোমার পছন্দ তো ওই পাহাড় আর কি? পছন্দ থাকতে এতোদিন বিয়ে করে সংসার পাততে। এখানে বসে থাকতে না”

অপমানে আমার মুখ ছোট হলো। কিছু বলার মতো ভাষা পেলাম না। এক প্রকার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় পাত্র পক্ষের সামনে বসতে হলো। আমি চোখ তুলে তাকায়নি। পাত্রকে দেখারও প্রয়োজন মনে করিনি। কেনো করবো? আমার তো ইচ্ছেই নেই বিয়ে করার। একদমই ইচ্ছে নেই। বসার ঘরে উপস্থিত ছিলো হয়তো সাত আটজন। আমি কারো দিকে না তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বসে আছি। মেজাজও খারাপ হচ্ছে।

একজন মহিলা বললেন,“ভাইজান মেয়ে আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছে। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলি?”

আমার তো এবার মেজাজ এতোটাই খারাপ হলো আমি উঠে যেতে চাইলাম। তবুও আব্বুর মান সম্মান রক্ষার জন্য উঠলাম না। আব্বু শায়নাকে বলল আমাকে ঘরে নিয়ে যেতে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার দ্বারা বিয়ে হবে না। কিছুতেই হবে না। শারমিন কিছু বলতে চাইছিলো তবে শায়না বাঁধা দিলো। আমি পাত্তা দিলাম না। এখন প্রয়োজন শাড়ি চেঞ্জ করা। দুটোকে বের করে দিলাম ঘর থেকে। দরজা আটকানোর আগে শায়না আমাকল বলল,

-“পাত্রকে দেখেছিস মিলি?”

আমি মুখের উপর দরজা বন্ধ করে চিল্লিয়ে বললাম,“নাহ! দেখার প্রয়োজন নেই। এবারও রিজেক্ট করবো”

শাড়ি খুলে সালোয়ার কামিজ জড়ালাম গায়ে। বিছানায় পা উঠিয়ে বসে শায়নার আনা খাবারগুলো খাচ্ছি। পাত্র পক্ষ এখনো আছে কি না সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। হঠাৎই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। শায়না আর শারমিন এসেছে ভেবে রূক্ষ কন্ঠে বলে উঠলাম,
-“উফফ জ্বালাস না তো তোরা। বিরক্ত লাগছে আমার। যা এখান থেকে।”

ওপর পাশ থেকে আব্বুর গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসলো।“দরজা খুলে মিলি কথা আছে”

আমি ইচ্ছা না থাকা শর্তেও দরজা খুললাম। আমাকে এ অবস্থা দেখে আব্বু বলল,
-“শাড়ি কোথায়? সেলোয়ার-কামিজ পরেছো কেনো?”
-“বিরক্ত লাগছিলো তাই খুলেছি। কি বলতে এসেছো বলো”

-“তোমার এই রাগ কমাও আগে। শ্বশুর বাড়ির কেউ এই রাগকে পাত্তাও দিবে না মিলি। এসব তামাশা বন্ধ করো। শারমিন পাত্রকে ছাদে নিয়ে গিয়েছে। পাত্র আলাদা কথা বলতে চায় তোমার সাথে ছাদে যাও”
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,“আমি যাবো না”
-“মিলি তামাশা বাদ দাও। অপেক্ষা করছে ছেলেটা। যাও”

অনিচ্ছা নিয়ে গেলাম ছাদে। ভদ্রলোক উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে সোজা বলতে শুরু করলাম,
-“দেখুন বিয়েটা আমি করতে পারবো না। আমার পক্ষে সম্ভব নয় বিয়েটা করা। আপনি বিয়েটা ভেঙে দিন।”

#চলবে