#অন্তর্ভেদী
#লেখিকাঃইশা_আহমেদ
#শেষ_পর্ব
পরদিন অনয়ের ভীষণ জ্বর উঠলো। আমায় কল করে জানালেন অনয়ের মা। আমার অপরাধ বোধ হলো খুব। অনয়েরও দোষ আছে, তিনি বলতেই পারতেন বৃষ্টিতে ভিজলে তার জ্বর হয়। তিনি বললেন না, উল্টো আমায় নিয়ে ভিজলেন। প্রচন্ড মন খারাপ হলো আমার। বিয়ের আগে নাকি শ্বশুর বাড়ি যেতে হয় না। আমি সেসব মানলাম না। নিয়ম অনিয়ম ভেঙে ছুটলাম অনয়ের বাড়িতে। দরজা খুললেন অনয়ের মা। আমি সালাম দিলাম। যদিও হুতাশে চলে এসেছিলাম, তবে অনয়ের মাকে দেখে অস্বস্তি হলো। তিনি কিন্তু খুব মজার মানুষ। আমার আসাটা সহজ ভাবেই নিলেন। আমায় নিয়ে গল্প করলেন।
আমার অস্বস্তি ভাব দেখে হেসে ফেললেন। বললেন,
-“মিলি অস্বস্তি বোধ করো না তো। আমি তো তোমার আরেক মা। সহজ হও। তোমার বাড়ি এটা। আমার কিন্তু মেয়ে নেই মিলি, তুমিই আমার মেয়ে।”
তার এমন মিশুক স্বভাব আমায় মোটেও অস্বস্তিতে থাকতে দিলো না। সহজে মিশলাম। তিনি বুঝলেন আমি অনয়ের সাথে দেখা করতে চাইছি। আমাকে দেখিয়ে দিলেন অনয়ের ঘর। আমি অনয়ের রুমে ঢুকে বিষ্মিত হলাম। খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। যেনো কোনো মেয়ের রুম। অনয় কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছে। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। অনয় ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে বুঝতে পারলাম না। অনয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। হঠাৎ ই তিনি চোখ খুলে ফেললেন। আমি থতমত খেলাম। অনয়ের রক্তিম চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
আবারও বালিশে মাথা গুঁজে বললেন,
-“মিলি বড্ড জ্বালাচ্ছেন আপনি। আপনার অসুখ আমায় এই জ্বরের ঘোরেও তাড়া করে বেড়াচ্ছে।”
আমি হাসলাম। অনয়ের চুলে আবারও হাত বুলিয়ে দিলাম। অনয় আবার চোখ খুলে তাকালেন। এরপর তড়িৎ গতিতে উঠে বসলেন। যদিও অনয়কে খুব দুর্বল লাগছে। অনয় দুর্বল কন্ঠে বললেন,
-“মিলি আপনি কি সত্যি এসেছেন? নাকি কল্পনা আমার!”
আমি হাসতে হাসতে বললাম,“আমি সত্যই এসেছি বোকা ডাক্তার। আপনার তো খুব জ্বর। আমায় কেনো কাল রাতে বললেন না? আপনি কেনো বললেন না বৃষ্টিতে ভিজলে আপনার জ্বর হয়”
তিনি অসুস্থতার মাঝে হেসে বললেন,“আপনার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার লোভটা সামলাতে পারিনি মিলি তাই তো সব কিছু ভুলে আপনার সাথে বৃষ্টি বিলাস করেছি”
আমার মুখখানা গম্ভীর হলো। বললাম,
-“এখন ঠিক লাগছে?”
অনয় মাথা নাড়ালেন। আমি অধিকার দেখিয়ে কপাল ছুঁয়ে দেখলাম জ্বর আছে কি না। আশ্চর্য জনক হলেও অনয়ের শরীর এখন আগের ন্যায় উষ্ণ নয়। আমাকে অবাক হতে দেখে অনয় হাসলেন। আমি বিষ্মিত কন্ঠে শুধালাম,
-“এই কি হলো? আপনার না এতোক্ষণ জ্বর ছিলো। এখন আগের মতো গরম নেই শরীর। কি ভাবে সম্ভব?”
-“আপনার ছোঁয়াতেই আমার অর্ধেক জ্বর পালিয়েছে মিলি”
“সিনেমার ডায়লগ দিচ্ছেন?”
অনয় শব্দ করে হাসলেন। বললেন,“তা বলতে পারেন। আপনায় ইমপ্রেস করার জন্য ওই একটু আধটু সিনেমার ডাইলগ দেওয়াই যায়।”
থেমে আবারও বললেন,“এই তো কিছুক্ষণ আগেই ওষুধ খেয়েছি। জ্বর পরেছে এখন।”
আমি অনয়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। অনয়ের মা এসে আমায় নিয়ে গেলেন। পুরো বাড়ি ঘুরে দেখালেন। অনয়ের মা আমায় বললেন তিনি কোথায় কোথায় ঘুরেছেন, কি কি করেছেন! তিনি বই পড়ুয়া মানুষ। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র তার প্রিয়। অনয়ের মাকে আমার দারুন লেগেছে। এক কথায় তিনি প্রচন্ড ভালো মানুষ। সহজেই আপন করে নওতেন পারেন, মিশে যেতে পারেন আরেক জনের সাথে। যাওয়ার আগে অনয় রুম থেকে বের হলেন। আমায় নিচ অব্দি দিয়ে গিয়েছেন। যদিও আমি তাকে নিষেধ করেছি। তিনি শুনেননি। নাছোড়বান্দা লোক! শুনবে আর কি সে তো নিজের খেয়ালে থাকতে ব্যস্ত। না হয় কি কোনো বৃষ্টি ভিজলে জ্বর আসবে জেনেও বৃষ্টিতে ভিজে? এই পাগলের দ্বারাই সম্ভব।
–
দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। অনয়ের প্রেমে আমি তখন মজে গিয়েছি। অনয়ও বোধ হয় আমার প্রেমে পরেছেন, বোধ হয় কি লোকটা তো আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ভালোবেসে ফেলেছেন। শায়না আর শারমিন আমায় দেখলেই হেসে খোঁটা দেয়। আমি হাসি। আসলেই সেই অপছন্দের ডাক্তারটা এখন আমার মন মস্তিষ্ক সবটা জুড়ে বিরাজ করছে। আমার এক প্রকার অসুখেই পরিণত হয়েছে। আমি এই পঁচিশ বছর বয়সে এসেও নিজেকে সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া যুবতী মনে হচ্ছে। আমি আবেগকে সব সময় নিয়ন্ত্রণ করেছি। তবে অপর পাশের ব্যক্তিটা আমায় প্রতি নিয়ত তার ব্যবহারে মুগ্ধ করে তুলছে।
এই তো দুদিন আগে গভীর রাতে কল করে বললেন,
-“মিলি উঠুন। বারান্দায় আসুন তো।”
আমি ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,“কেনো কি হয়েছে?”
-“মিলি এতো প্রশ্ন কেনো করেন বলুন তো? আসতে বলেছি আসুন”
-“ওয়েট এক মিনিট আপনি কি আমার বাড়ির নিচে?”
আমি লাফিয়ে উঠে বসেছি। ঘুম আমার গায়েব। অনয় আমার প্রশ্নে শব্দ করে হাসলেন। বললেন,
-“আসুন আগে। আসলেই জানতে পারবেন কেনো ডাকছি। আসুন আসুন”
আমি এক প্রকার ছুটেই গেলাম বারান্দায়। নিচে তাকিয়ে খুঁজলাম তাকে। কোথাও না দেখে বললাম,
-“আপনায় তো দেখছি না”
অনয় হাসতে হাসতে বললেন,“আপনি এতো বোকা কেনো মিলি? আমি আমার রুমের বারান্দায় বসে আছি। আচ্ছা বাদ দিন। আকাশের দিকে তাকান, দেখুন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।”
আমি চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম,“আপনি আমায় এটা বলতে এই গভীর রাতে উঠিয়েছেন?”
-“মিলি চলুন চন্দ্র বিলাস করি। এক সঙ্গে তো এখন করতে পারবো না। আলাদাই করি। মিলি শুনুন, আমি না কেমন বাইশের যুবকে পরিণত হচ্ছি। আমার খুব প্রেম প্রেম পায় মিলি। কি করবো বলুন তো?”
মুখ বাকিয়ে বললাম,
“আধ বুড়ো হয়ে আপনার প্রেম পাচ্ছে?”
-“কি করবো মিলি আপনিই আমার জীবনে বড্ড দেরি করে আসলেন। আপনি ঠিক সময়ে আসলে এতো দিনে দু বাচ্চার বাপ হয়ে যেতাম”
আমি খিলখিল করে হেসেছিলাম। আমাদের প্রেম জমলো। দু’জনেই বুড়ো বয়সে প্রেম করছি। প্রেম করার বয়স দুজনেরই পেরিয়েছে। তবে দু’জন প্রেমে লবডঙ্কা মানুষ এক সঙ্গে হলে যা হয় আর কি! এই বুড়ো বয়সে প্রেম করছি আমরা। হা হা! আজ শপিং এ গিয়ে আরেক কান্ড। বেছে বেছে সব জিনিস কিনেছেন। যা প্রয়োজন নেই তাও নিয়েছেন। প্রয়োজনের থেকে বেশি কিনছেন। আমার চোখ রাঙানিতেও কাজ হয়নি।
–
বিয়ের দিনটা দেখতে দেখতে চলেই আসলো। সময় বহমান। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন অনয়ের সাথে আমার দেখা হলো, এই তো সেদিন শুরু হলো সবটা। আজ আমার প্রচুর নার্ভাস লাগছে। আব্বু আম্মু দু’জনেই খুব ব্যস্ত। ঘর ভর্তি মেহমান। আমি পার্লার থেকে সেজে বাড়ি এসেছি আধঘন্টা হলো। টুকটাক ফটো তোলা হলো। কাজিন, বন্ধু সবাই আশে পাশে থাকলেও আমার নার্ভাসনেস কমলো না। আমার নার্ভাসনেস কমাতে ম্যাজিকের মতো কল করলেন অনয়। আমি বারান্দায় আসলাম দরজা ভিরিয়ে। ফোন কানে দিতেই অনয় বললেন,
-“মিলি আর মাত্র কিছু মুহুর্ত তারপর আপনি আমার। একান্তই আমার”
থেমে আবারও বললেন,
“মিলি কথা বলছেন না কেনো? আপনি কি খুব নার্ভাস? নার্ভাস হয়েন না। আমি আছি তো। শুনুন মিলি আপনি কিন্তু যখন ইচ্ছে হবে চলে যাবেন নিজের বাড়িতে। দু’টোই আপনার বাড়ি মিলি। মিলি চিন্তা করা বন্ধ করুন মাইগ্রেনে ব্যাথা উঠতে পারে। বিয়ের দিন টা দয়া করে নষ্ট করবেন না”
অনয়ের আকুতি ভরা কন্ঠস্বর। আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। লোকটা পারেও। কল কাটলেন। তিনি জানালেন কিছুক্ষণ এর মাঝে আসছেন। আমায় চিন্তামুক্ত থাকতে বললেন। আমার চিন্তারাও কেমন হুট করে গায়েব হয়ে গেলো। এখন স্বস্তি অনুভব করছি। আব্বু আসলেন কবুল বলার কিছুক্ষণ আগে। আমায় জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললেন। আমি দিক বেদিক হারিয়ে ছোট বেলার মতো বুকে পরে কাঁদলাম। আমায় শান্তনা দিয়ে চলে গেলেন। কাজী আসলেন আমায় কবুল বলতে বললেন।
আমি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলেই ফেললাম ‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল’
একবার নয় তিনবার বললাম পর পর। কবুল বলার পর মুহুর্ত থেকেই আমি হলাম অনয় নামক ভদ্রলোকের মিসেস। মিস মিলি থেকে মিসেস মিলি!
বিয়ের পরে আমাদের কথা হলো গাড়িতে। আমি কিন্তু ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছি না বা অনয় আমায় শান্তনা দিচ্ছেন। আমরা দু’জন টুকটাক কথাবার্তা বললাম। বাড়িতে ফিরে ক্লান্ত থাকায় অনয়ের মা আমাকে অনয়ের রুমে পাঠালেন। নিজে এসে খাইয়ে দিলেন জোর করে। আমায় ফ্রেশ হয়ে নিতে বললেন। বিয়ের শাড়ি চেঞ্জ করে পরলাম লাল খয়েরী সুতি শাড়ি। অনয় আসলেন ঠিক রাত এগারোটায়। এসেই আমায় খপ করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি এতোটাই শকড হয়েছিলাম যে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনয় আমায় বুক থেকে তুলে বললেন,
-“মিলি আপনি এখন শুধু আমার। ঘুম থেকে উঠে আপনায় দেখবো, ঘুমানোর আগেও আপনায় দেখবো। ভেবে কি যে আনন্দ হচ্ছে।”
সে রাতে অনয় আমায় বুকে জড়িয়ে ঘুমালেন। আমিও তার বুকে ঘাপটি মেরে পরে রইলাম। অনয় বিয়ের পাঁচ দিনের দিন আমাকে নিয়ে ছুটলেন শ্রীমঙ্গলে। চা বাগানের সাথে পাহাড় অনুভব করতে। শ্রীমঙ্গলের একটা দিন। বৃষ্টিভেজা দিন। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে গেলাম দু’জন। সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আমার পরনে নীল রঙের পাড় বাধানো একটা শাড়ি। অনয়ও পরেছে নীল পাঞ্জাবি। দু’জন আসতে আসতেই অর্ধভেজা হলাম। আমি যদিও চাইনি বের হতে তবে অনয়ের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে। কতবার বললাম জ্বর আসবে। শুনলো কোথায়?
জলপ্রপাতের কাছে এসে আমায় এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
-“মিলি আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না আমি জানি কি না পাত্রী আপনি ছিলেন কি না?”
আমি মাথা নাড়ালাম। অনয় মৃদু হেসে বলল,“আপনাকে প্রথম দেখি আমার চেম্বারে। আমায় ভুল বসত রাগের বশে উল্টোপাল্টা বলে ফেললেন। আপনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি ছিলো জানি না তবে আমার অন্তরভেদ করলো। এরপর দ্বিতীয়বার দেখলাম সাজেকের রিসোর্টে। শাড়িতে ভিজতে। আমি ওই দিনই আপনার প্রেমে পরেছিলাম”
-“আপনি আমায় কিছু জানালেন না….”
অনয় আমার গালে হাত রাখলেন। চোখে চোখ রেখে বললেন,
-“আপনি আমার সুখ, আমার অসুখ। আমার ভালোবাসা। আপনায় আমি ভীষণ ভালোবাসি অন্তর্ভেদী!”
#সমাপ্ত