#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব__১১
চন্দ্রের জীবনে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে।কোনোটা বিশ্রী রকমের খারাপ। কোনোটিই আবার মনে রাখার মতো ভালো।গত কয়েকদিন ধরেই স্পন্দন সারাক্ষণ ছায়ার মতো আগলে আগলে রেখেছে চন্দ্রকে। কোথাও মনের মধ্যে এক আকাশ পরিমাণ ভয় লুকিয়ে আছে স্পন্দনের চন্দ্রকে হারিয়ে ফেলার। আবার চন্দ্রের মনে প্রশ্নের পাহাড় জমে আছে স্পন্দনের জন্য। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে দুজন এখনো একসাথে রয়ে গেছে সৈয়দ বাড়িতে।
আজকে মিতুর গায়ে হলুদ। চন্দ্র বায়না ধরে বসে আছে সকাল সকাল যাবে বলে।স্পন্দনের এক কথা এতো ভিড়ের মধ্যে চন্দ্রকে একা ছেড়ে দিতে পারবে না। আবার কে কখন ছিনিয়ে নিয়ে যাবে চন্দ্রকে।তাই বিন্দু মাত্র রিস্ক নিতে চায় না স্পন্দন।দাদিমা এখন বেশ ভালো আছেন।মেয়ের ঘরের নাতনির বিয়ে তাই তাকে আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সৈয়দ মির্জা বেশ অনুতপ্ত। তবুও পরিবারের সবার থেকে এখনো দূরেই থাকেন। চন্দ্র ওর বড় আম্মুর কাছে গিয়ে বললো,
__বড় আম্মু? তোমার ছেলেকে বলো না আমাকে যেতে দিতে। আমি সত্যি বলছি গিয়ে কোনো উল্টাপাল্টা কাজ করবো না।
__চন্দ্র আমাকে বলে লাভ নেই মা।এই কয়দিন ধরে স্পন্দনকে দেখে এটুকু বুঝেছি যে নিজের সাথে রিস্ক নিলেও তোর জীবন নিয়ে একবিন্দুও ছাড় নেই। আমার ছেলেটাকে কি দিয়ে এভাবে বাঁধলি চন্দ্র?
__আমি আবার কি দিয়ে বাঁধবো?আর তাছাড়া আমার বয়েই গেছে ঐ গোমড়ামুখো হনুমানকে বেঁধে রাখতে।
হাসতে হাসতে বড় আম্মু বললেন,
__সে যাই হোক চন্দ্র। আমি ভীষণ খুশি রে।এই যে কিছুদিন আগেও ছেলেটার কেমন ছন্নছাড়া জীবন ছিলো। কেমন রংচটা ছিলো ওর পুরো জীবনটাই। আজকাল দেখলে মনে খুব শান্তি হয় রে চন্দ্র।ছেলেটা অবশেষে ঘরে ফিরলো। আম্মার কথা বিফলে যাইনি চন্দ্র।
__বাদ দাও তো তোমার ছেলের কথা।ওর আবার বিশ্বাস আছে নাকি?এই ভালো তো এই আবার খেপে আগুন। আমি বাপু আজও তোমার ছেলেকে চিনে উঠতে পারিনি।
__খুব পাকা পাকা কথা শিখেছিস ।তাইনা? আমি তোর শ্বাশুড়ি আম্মা ভুলে গেছিস?
__হ্যাঁ গেছি। তুমি আগেও আমার বড় আম্মু ছিলে এখনও তাই।এর মধ্যে তোমার ছেলেকে টানবে না বলে দিলাম।
স্পন্দন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,
__ঐ পাগলীটা তোমাকে কি বুঝাচ্ছে মা? নিশ্চয়ই আমার নাম ধরে উল্টাপাল্টা বলছে তোমার কাছে।
__আরে না বাবা। চন্দ্র আমার তেমন মেয়েই না। আমার লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে চন্দ্র।
চন্দ্র আহ্লাদে গদগদ হয়ে বড় আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো।তা দেখে স্পন্দন বললো,
__দেখেছো একটা ভালো কথা বলেছো তো তোমার মাথায় উঠে নাচতে শুরু করেছে।এতো মাথায় উঠিও না মা। এরপর নামাতে পারবেনা।
__দেখেছো বড় আম্মু।গোমড়ামুখোর হিংসা হচ্ছে।
__হিংসা আর এই স্পন্দন।যাস্ট সাটআপ চন্দ্র। এবার কিন্তু খুব বেশি বেশি বলছিস।কানের নিচে একটা পড়লেই বুঝতে পারবি এই স্পন্দন কে কি ও কত প্রকার?
__তোমার সামনে তোমার মেয়েকে ভয় দেখাচ্ছে বড় আম্মু। তুমি কিছু বলবা না?
__ঠিক তো।স্পন্দন আমার চন্দ্রকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলবি না বলে দিলাম।তাহলে কিন্তু এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে তোকে।
স্পন্দন হুহা করে হাসতে লাগলো।তা দেখে ওর মা বুকে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঠিক কতগুলো দিন পরে ছেলেটা এমন করে হাসছে।দেখেই মনটা জুড়িয়ে গেলো ওনার। চন্দ্রের জোর করাতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে স্পন্দন ওকে নিয়ে মিতুদের বাড়িতে গেলো।স্পন্দনের বাবা-মা পরে যাবেন বলে থেকে গেলেন।ও বাড়িতে গিয়েই চন্দ্র স্পন্দনকে রেখেই কাজিন দের সাথে চলে গেছে। চন্দ্রকে দেখেই মিতু জড়িয়ে ধরলো।নিরা বললো,
__চন্দ্র আপু? ভাইয়া তোমাকে আসতে দিলো অবশেষে?
__আরে দিবে না আবার। চন্দ্র চাইলে ঐ গোমড়ামুখোর ক্ষমতা আছে নাকি চন্দ্রকে আটকে রাখার?
__ওহ্,তাই বুঝি চন্দ্র?
__হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ।
বলেই পেছনে ফিরে দেখে স্পন্দন হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে খানিকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। চন্দ্র না পারছে দৌড়ে পালিয়ে যেতে আর না পারছে কিছু বলতে।তা দেখে স্পন্দন বললো,
__তা মিসেস্ স্পন্দন মির্জা সবাইকে বলি, আপনি এখানে আসার জন্য ঠিক কি কি করেছেন?
রেহান বললো,
__বলে দাও ভাইয়া।এতো সময় তো নিজেকে রাজরাণীর মতো ট্রিট করছিলো চন্দ্র।
__তুমি চুপ করো রেহান ভাইয়া।
__কেনো?ও কেনো চুপ করবে? আমার ও তো জানার অধিকার আছে যে আমার পিঠ পিছে আমাকে নিয়ে আমার বউ ঠিক কতটা গুনোগান করছে।
সিঁথি বললো,
__তোমাদের এই জামাই বউয়ের এপিসোড এখানেও থামাও প্লিজ। তোমাদের এসব শুনতে শুনতে আমাদের আজকে আর সাজতে হবে না দেখছি।
__ভাইয়া চলো তো এখান থেকে।এসব পেত্নীদের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো।
ওরা সবাই বেরিয়ে যেতেই চন্দ্র বললো,
__আমাকেও একটু সাজিয়ে দেনা তোরা।ঐ বেডার জন্য আমি তো সাজতেই পারিনি ঠিক মতো।
__খেপেছো চন্দ্র আপু? তোমাকে সাজাই আর ভাইয়া আমাদের খবর করে দিক আর কি।
__তোরা না আমার বোন।দেনা প্লিজ।
সবাই মিলে খুব সেজেছে।ছেলেরা হলুদ পাঞ্জাবী আর মেয়েরা হলুদ শাড়ি আর তাজা ফুলের গহনা। চন্দ্রকে দেখতে হলুদ পরীর মতো লাগছে।তা দেখে সিঁথি বললো,
__চন্দ্র আপু?স্পন্দন ভাইয়া তো আজকে তোমাকে চোখে হারাবে।আর মিতু আপু তোর বরটাকেও সামলে রাখিস।তোকে রেখে আবার আমাদের ভাবীপুর উপর লটকে না যায়।
সবাই মিলে একসাথে হেসে উঠলো। চন্দ্র মিতুকে নিয়ে স্টেজে যেতেই স্পন্দনের চোখ আটকে গেলো। মুগ্ধ নয়নে চন্দ্রকে দেখতে লাগলো।তা দেখে নিরা বললো,
__তখন যা বলেছিলাম চন্দ্র আপু।স্পন্দন ভাইয়ের অবস্থা একটু দেখো। বেচারার কেমন হাঁসফাঁস অবস্থা তার অপরূপ বউকে দেখে।না পারছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে আর না পারছে জড়িয়ে ধরে টুসঠাস চুমু খেতে। দেখে মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস আটকে বসে আছে বেচারা।যাও না যাও একটু কাছে গিয়ে দাঁড়াও।
__বেশি পেকেছিস কিন্তু নিরা।দিবো এক থা’প্পর।
সবাই হুহা করে হেসে হেসে মজা নিতে লাগলো।সবাই একে একে উঠে এসে মিতুকে হলুদ ছোঁয়াতে লাগলো। এরমধ্যে একবার চন্দ্রের সাথে স্পন্দনের চোখাচোখি হয়ে গেলো।স্পন্দন ইশারা করলো নিচে নামতে। কিন্তু চন্দ্র পাত্তা না দিয়ে ওর মতো ইনজয় করতে লাগলো। হঠাৎ করেই দিপ্ত এসে বললো,
__চন্দ্র আপু তোমাকে বড় আম্মু ডাকছে।
চন্দ্র এবার নিরুপায় হয়ে উঠে ধীরে ধীরে নিচের দিকে এলো। লোকজন পেরিয়ে চিলেকোঠার ঘরের দিকে যেতেই কেউ হেঁচকা টান দিয়ে ওকে টেনে নিলো। চন্দ্র ভয়ে চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই মুখ চেপে ধরলো একটা শক্ত হাত।আর একটা হাত পেছনে পিঠ মোড়া দিয়ে ধরে রাখা ।যে হাতটা ফাঁকা আছে সেটা দিয়ে ছিলোছিলি করতে লাগলো চন্দ্র।আর মুখ দিয়ে উমম্ উমম্ শব্দ করতে লাগলো। ধীরে ধীরে পেছনের হাতটার বাঁধন আলগা হয়ে চন্দ্রকে প্রসস্থ বুকের সাথে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কোমড় ছুঁয়ে দিলো।কোমড়ে ভেজা ভেজা ঠান্ডা কিছু লাগানো হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। চন্দ্র এখনো সমানে নড়াচড়া করতে চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু এমন শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। এদিকে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে চন্দ্র। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
__তুই যে এতো সুন্দর করে সেজেগুজে ঘুরছিস সবার সামনে এটা তার শাস্তি চন্দ্র। এমন সাজে তোকে শুধু স্পন্দন দেখবে।আর কেউ নয়। আজকের জন্য এটা ওয়ার্নিং ছিলো। এরপর আবার এমন হলে এর থেকেও বড় শাস্তি পেতে হবে চন্দ্র।
এরপর মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে দিতেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি অনুভব হলো চন্দ্রের। বুঝতে পারলো মুখে মখ লাগিয়ে কিছু মাখিয়ে দিয়েছে।এরপর ছেড়ে দিলো চন্দ্রকে। চন্দ্র যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এরপর মুখ ফুলিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললো,
__এসব কি স্পন্দন? আমি রিতিমত ভয় পেয়ে গেছিলাম। এভাবে কেউ টেনে আনে? আমি তো ভাবলাম আবার কে না কে?
__এই স্পন্দন থাকতে চন্দ্রের উপর একটা ফুলের টোকাও পড়বে না।অন্তত কেউ দিতে সাহস পাবে না চন্দ্র।
__কিন্তু আপনি এটা কি করলেন?
__কি করলাম?
__আমাকে এভাবে কেনো হলুদ মাখালেন? গায়ে হলুদ তো আপুর। এখন সবাই কি ভাববে বলুন আমাকে এভাবে ভুতের মতো দেখে।আর জিজ্ঞেস করলে আমি কি বলবো?
স্পন্দন দায়সারা ভাবে একটা ভঙ্গি করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো,
__আমি কি জানি চন্দ্র?
এরপর শিষ দিতে দিতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। চন্দ্র এখনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর ধীরে ধীরে উঁকি দিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। কাউকে না দেখে যেইনা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে ওমনি পেছন থেকে সিঁথি বললো,
__একি চন্দ্র আপু? তুমি ঐ চিলেকোঠার ঘরে কি করছিলা?আরে তোমার সারা গায়ে এভাবে হলুদ মাখানো কেনো?কে মাখিয়েছে?
__আ্ আমি সিঁথি।
__কেনো?
__স্ সখে।
বলেই এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লো চন্দ্র।আর সিঁথি বিজ্ঞের মতো চোখ মুখ কুঁচকে ভাবতে লাগলো,
__এ নিশ্চিত কিছু লুকাচ্ছে।বের করতে হচ্ছে তো।
#চলবে,,,,,,,
লেখায় ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।