অন্তহীন বসন্ত পর্ব-১৫+১৬

0
288

#অন্তহীন_বসন্ত~১৫
লিখা- Sidratul Muntaz

হেলেনের অসম্ভব মাথা ধরেছে। ব্যথায় মনে হচ্ছে ছিঁড়েই যাবে। আস্তো দু’টি তাঁরকাটা বুঝি কেউ ঠেসে মাথার দুইপাশে ভরে দিয়েছে। হেলেনের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে একবার যদি মাথাটা খুলে দেখা যেতো ভেতরে কি আছে!

নিশান্ত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না বুঝতে পারছে না। একবার ভাবল চলে যাবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যখনই ফিরে যেতে উদ্যত হলো ঠিক তখন ভেতর থেকে ডাক দিল হেলেন,” কিছু বলতে এসেছিলে নিশান্ত?”

নিশান্ত দাঁড়িয়ে গেল। হেলেন নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল,” ভেতরে এসো।”

নিশান্ত ভেতরে ঢুকল মাথা নিচু করে। সে একটু বিব্রতবোধ করছে কিন্তু কথাটা তাকে বলতেই হবে। হেলেন তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। নিশান্ত নিম্নস্বরে বলল,” মামী, একটা অনুরোধ করব।”

” বলো।”

নিশান্ত চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,” অবন্তীর সাথে তুমি একবার কথা বলো৷ সে সকাল থেকে কিছু খায়নি।”

হেলেন শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,” এটা বলতেই কি এসেছো?”

নিশান্ত অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” হ্যাঁ। আমি জানি এই ঘটনায় তুমি কষ্ট পেয়েছো৷ কিন্তু সবচেয়ে বেশি সাফার করছে অবন্তী। কারণ সে নির্দোষ। হারটা সে চুরি করেনি।”

হেলেন জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে অতি স্বাভাবিক স্বরে বলল,” জানি।”

” জানো?” নিশান্ত অবাক। হেলেন কিছুসময় চুপ করে থেকে বলল,” পুরো ব্যাপারটাই যে সাজানো সেটা আমি প্রথমেই ধরতে পেরেছিলাম। সানভী কিন্তু তোমার লাগেজ নিজ হাতে চেক করেনি। কিন্তু অবন্তীর হ্যান্ডব্যাগ চেক করার সময় সে নিজেই ব্যাগের চেইন খুলল। সবাইকে সামনে রেখে সে এমনভাবে ব্যাগটা ঝাঁকাচ্ছিল যেন হারটা সে নিজেই ওখানে রেখেছে। আর সেটা যে ওখানে পাওয়া যাবে এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত।”

নিশান্ত উচ্চগলায় বলল,” এক্সাক্টলি৷ সবকিছু আসলে একটা সাজানো নাটক।”

” এখন বলো, এগুলো তুমি কিভাবে বুঝলে?” হেলেন সরাসরি তাকাল নিশান্তর দিকে। নিশান্ত খানিক হকচকিয়ে বলল,” ধারণা করেছি।”

” উহুম। এটা তুমি এতো সহজে একা একা ধারণা করতে পারো না। নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে।”

“তুমিও তো একা একাই ধারণা করেছো।”

হেলেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আমার ধারণা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।”

” কি সেই যুক্তি? শুনি?” নিশান্ত মনোযোগী শ্রোতার মতো বসল। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে নেমেছে। হেলেন বলল,” আমার মনে হয় সানভী এই পুরো ঘটনাটা সাজিয়েছে আমাকে অপমান করার জন্য। অবন্তী আমার বোনের মেয়ে। সে যদি এই বাড়ি থেকে কিছু চুরি করে তাহলে নিঃসন্দেহে সেই দোষটা আমার ঘাঁড়ে এসে পড়বে। অনেকে হয়তো এটাও ভাবতে পারে যে কাজটা কর‍তে আমি তাকে শিখিয়ে দিয়েছি। ঠিক না?”

” হুম। কিন্তু এসব করে ছোটমামার কি লাভ? সে তোমাকে অপমান করতে চাইবে কেন?”

হেলেন চোখমুখ শক্ত করে বলল,” অতীতে আমার বোন নাজনীনের সাথে সানভীর বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিল। সেই বিয়ে একটা কারণে ভেঙে যায়।”

নিশান্ত এই পর্যায় কৌতুহল নিয়ে বলল,” হ্যাঁ আমরা সবাই শুনেছিলাম৷ বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু কেন ভেঙে গেছিল সেই কারণ আমরা কেউই জানতাম না। ”

হেলেন বলল,” সেই কারণটা আমিও জানি না। কিন্তু প্রথম দিকে বিয়েতে আমার মত ছিল না। সানভীকে বোনের জামাই হিসেবে আমার পছন্দ হয়নি৷ তাকে দেবর হিসেবেও আমি খুব একটা পছন্দ করি না। তাই সানভী মনে করে বিয়েটা আমার জন্যই ভেঙেছিল। সে হয়তো আমার উপর জমা রাগ অবন্তীর উপর দেখাচ্ছে।”

নিশান্ত প্রচন্ড ক্ষীপ্ত এবং বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” এটা কেমন কথা?”

” এছাড়া আর কি হবে তুমিই বলো? অবন্তী বাচ্চা মানুষ। তার সাথে সানভীর কোনো শত্রুতা থাকার কথা না। সে যা করছে সব আমার উপর জমানো ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ।”

” তাহলে তুমি কেন অবন্তীর সাথে মিসবিহেভ করছো? তোমার আচরণে সে আরও আপসেট হয়ে যাচ্ছে।”

” আমি আপাতত ওর সঙ্গে কথা বলব না। কিন্তু এমন ব্যবস্থা করব যাতে ও আর কখনও এই বাড়িতে না আসে।”

নিশান্ত হতভম্ব কণ্ঠে বলল,”এটা তো কোনো সমাধান না মামী। সবাই অবন্তীকে ভুল বুঝছে। আমাদের উচিৎ সবার ভুলটা ভেঙে দেওয়া।”

” আর সেটা কিভাবে সম্ভব? হারটা অবন্তীর ব্যাগেই পাওয়া গেছে। তাই এখানে আমাদের কিছু করার নেই। এখন আমরা যা-ই করি, কেউ আমাদের কথা আর বিশ্বাস করবে না।”

কুলসুম চা নিয়ে ঢুকল। নিশান্তকে বসে থাকতে দেখে সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। যেন কোনো ভূত দেখেছে৷ চা দেওয়ার সময় তার হাত কাঁপতে লাগল৷ হেলেন চা নিতে নিতে বলল,” মাথাটা অনেক ধরেছিল। থ্যাঙ্কিউ কুলসুম। চায়ে আদা দিয়েছিস তো?”

কুলসুম কোনো জবাব দিল না। সে তাকিয়ে আছে নিশান্তর দিকে। হেলেন ধমক দিয়ে ডাকল,” এ্যাই, কি হয়েছে তোর?”

” কিছু না ভাবী। কিছু কইছেন?”

” চায়ে আদা দিয়েছিস কি-না জিজ্ঞেস করছিলাম।”

” দিছি।”

নিশান্ত চোখের ইশারায় কুলসুমকে বাইরে যেতে বলল। কুলসুম ভয়ে ভয়ে চলে গেল। নিশান্ত উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,” মামী উঠি। আর তোমার ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে এই প্রবলেম খুব দ্রুত সলভ হবে।”

হেলেন হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বলল,” তাই নাকি?” তার হাসিতেই বোঝা গেল সে নিশান্তর কথা বিশ্বাস করেনি। হয়তো এই ব্যাপার নিয়ে সে খুব বেশি মাথাও ঘামাবে না।

নিশান্ত বাইরে এসে কুলসুমের হাত ধরে টেনে ব্যালকনি পর্যন্ত নিয়ে গেল। ভয়ে জবুথবু কুলসুম আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কি-না। নিশান্ত বলল,” যা করতে বললাম সেটা করেছো?”

কুলসুম কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” না। কেমনে করমু? সময়ই তো পাইলাম না।”

নিশান্ত রাগে দাঁতে দাঁত পিষল। হুমকি দেওয়ার মতো বলল,” যেটা বলেছি সেটা জলদি করো নাহলে সবাইকে বলে দিবো অবন্তীর ব্যাগে স্বর্ণের হার তুমি রেখেছো।”

কুলসুমের মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল। আজ সকালে পুরো ঘটনা জানার পর নিশান্ত সবার আগে কুলসুমের কাছে এসেছিল। গতরাতে টেবিল গোছানোর সময় কুলসুমের অস্বাভাবিক আচরণের প্রত্যক্ষদর্শী সে। সেখান থেকেই তার খটকা লাগে। সে কুলসুমকে জিজ্ঞেস করল,” হারটা তুমি কখন হারিয়েছো?”

” রাইতেই।”

” তাহলে রাতেই কেন সবাইকে জানাওনি?”

কুলসুম থতমত খেয়ে বলল,” হারাইছিল রাতেই। কিন্তু টের পাইছি সকালে।”

” মিথ্যা কথা। সবার সামনে তুমি বলেছো টেবিল গুছাতে গিয়ে হার খুঁজে পাওনি। তার মানে তুমি রাতেই জানতে হারটা হারিয়ে গেছে। এই ভয়ে তুমি কাঁচের প্লেটও ভেঙে ফেলেছিলে।”

কুলসুমের চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে কাঁদতে লাগল। নিশান্ত কোমল স্বরে বলল,” তুমি যদি সত্যি কথা বলো, তাহলে আমি তোমাকে কিছু করব না। কিন্তু মিথ্যা বললেই বিপদে পড়বে। তাই সত্যি কথা বলো কুলসুম।”

কুলসুম সবকিছু বিস্তারিতভাবে নিশান্তর কাছে স্বীকার করল। কিন্তু সানভী কি কারণে এসব করেছে তা কুলসুমও জানে না। নিশান্ত তাকে বলেছে সাভীর সাথে কথা বলে তার আসল উদ্দেশ্য খঁতিয়ে বের করতে। অবন্তীকে ফাঁসানোর পেছনে সানভীর মূল উদ্দেশ্য জানা গেলেই ব্যাপারটা বাড়ির সবাইকে বিশ্বাস করানো সহজ হবে। কিন্তু কুলসুম এখনও সানভীর সাথে কথা বলেনি। সে বলছে তার নাকি সময় হয়নি৷ কিন্তু নিশান্তর মনে হয় সে ইচ্ছে করেই যাচ্ছে না৷ সানভী নিশ্চয়ই তাকে এমন কিছুর ভয় দেখিয়েছে যে কারণে সে চুপসে আছে। নিশান্ত বলল,” ঠিকাছে, আপাতত ছোটমামার সাথে তোমার কথা বলার দরকার নেই। আমি তোমাকে নির্দিষ্ট সময় বলে দিবো। তখন তুমি তার ঘরে যাবে।”

” জ্বী আচ্ছা।”

নিশান্ত মনে মনে ঠিক করে রাখল সে কুলসুম আর সানভীর কথোপকথন রেকর্ড করবে। সবকিছু পরিকল্পনা করা হয়ে গেছে। এখন অবন্তীর সাথে দেখা করে আসা যাক। তার থেকেও অনেক কিছু জানার বাকি। নিশান্ত ছাদে উঠল। সানভী তখন ছাদেই ছিল। নিশান্তকে দেখেই ফূর্তিবাজ কণ্ঠে বলল,” কি অবস্থা ভাগিনা?”

নিশান্ত কোনো কথা না বলে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে পড়ল। খট করে দরজা আটকে দিল। আচমকা নিশান্তকে দেখে অবন্তী ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল। নিশান্ত ঢুকেই সর্বপ্রথম যে কথাটি বলল তা হলো,” ভয়ে পেও না৷ কথা দিচ্ছি, আমি সবকিছু ঠিক করে দিবো।”
অবন্তী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নিশান্ত জেরা করার ভঙ্গিতে বলল,” তার আগে তোমাকে সবকথা সত্যি বলতে হবে। সানভী মামার সাথে কি তোমার কখনও কোনো ঝামেলা হয়েছিল? এইযে তিনি এটা করলেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সেই কারণটা কি তুমি জানো?”

অবন্তী চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ল। জানে সে। নিশান্ত কাছে এসে তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,” আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তোমার কোনো দোষ নেই এটাও জানি। এখন তুমি আমাকে সব সত্যি কথা বলো।”

অবন্তীর চোখ থেকে টুপ করে আরও একফোঁটা জল গঁড়িয় পড়ল।

চলবে

#অন্তহীন_বসন্ত~১৬
লিখা- Sidratul Muntaz

মাথার উপর ঘটর ঘটর করে ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানে কোনো বাতাস নেই, শুধু শব্দ আছে। অবন্তী ক্রমশ ঘামছে। নিশান্ত বসে আছে ঠিক তার বরাবর; বিছানার উপর। অবন্তী বসছে না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যে কথাগুলো বলল তার সারমর্ম এমন- সানভীর সাথে নাজনীনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সেই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে সানভী অবন্তীকে দায়ী মনে করে। তাই সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অবন্তীর সাথে এসব করেছে।

অবন্তীর কথা নিশান্তর কাছে মোটেও যৌক্তিক মনে হলো না। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, হেলেনও কিছুক্ষণ আগে একই কথা বলেছিল। হেলেন নিজেকে দোষ দিচ্ছে। আর অবন্তীও নিজেকে দোষ দিচ্ছে। কিন্তু নিশান্ত একশো ভাগ নিশ্চিত এই ঘটনায় সবচেয়ে বড় দোষী সানভী।
হেলেন বা অবন্তী কেউই সেটা স্বীকার করছে না। অথবা এমন হতে পারে যে তারা বলতেই অস্বস্তিবোধ করছে।

নিশান্ত জিজ্ঞেস করল,” বিয়েটা কেন ভেঙে গেল?”

অবন্তী অপ্রতিভ স্বরে বলল,” আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম৷ এতো কিছু তো জানতাম না। শুধু শুনেছিলাম বিয়ে ভেঙে গেছে। এইটুকুই।”

অবন্তীর কথা-বার্তা শুনে নিশান্ত নিশ্চিত হয়ে গেল যে সে মিথ্যা বলছে। কিন্তু হেলেনের কথা শুনে নিশান্তর একবারও সেটা মনে হয়নি। হয়তো হেলেন যেটুকু জানে সেটুকুই বলেছে। কিন্তু অবন্তী অবশ্যই এমন কিছু জানে যা সে বলতে চাইছে না।

নিশান্ত বেশ ধৈর্য্য নিয়ে বলল,” দেখো অবন্তী, আমি জানি সানভী মামা এতো সামান্য কারণে এসব কান্ড করবে না। বিয়ে ভেঙেছে সেটা আরও ছয়বছর আগের ঘটনা। তার যদি কিছু করারই থাকতো তাহলে সে তখনি করতো। হঠাৎ এতোবছর পর কেন তার প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করবে? বোঝাও আমাকে!”

অবন্তী ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,” সেটা আমি কি করে জানব?”

নিশান্ত উঠে এসে অবন্তীর সামনে দাঁড়ালো। রাশভারী গলায় বলল,” তাকাও তো আমার দিকে।”

সে তাকাচ্ছে না৷ নিশান্ত জোর করে তার মুখ উপরে তুলে ধরল। অবন্তী বাধ্য হয়েই তাকাল নিশান্তর চোখের দিকে। অবন্তীর বিষণ্ণ চোখ দু’টি ফুলে লাল হয়ে আছে। অশ্রুতে গাল ভেজা। নিষ্প্রাণ মুখটি দেখে বড় বেশিই মায়া হলো নিশান্তর। হু হু করে উঠল পাজর। কয়েক মুহূর্ত পর নিশান্ত ধীর গলায় বলল,” কি লুকাচ্ছো আমার কাছে? আমি জানি বিয়ে ভাঙার পেছনে সানভী মামার বড় কোনো দোষ ছিল। আর সেটা তুমি জানো। কিন্তু বলছো না। আচ্ছা ওয়েট, আমাকেই অনুমান করতে দাও। সানভী মামা কি নাজনীন আন্টির সাথে কোনো মিসবিহেভ করেছিল?”

অবন্তী সঙ্গে সঙ্গে বলল,” একদম না৷ এরকম কিছুই না।”

” তাহলে বিয়ে কেন ভাঙল? কি হয়েছিল পরিষ্কার করে বলো।” অবন্তী নিশ্চুপ। কিভাবে ঘটনাটা বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আর বলাও কি ঠিক হবে? নিশান্ত না হয়ে যদি অন্যকেউ হতো তাহলে সে অনায়াসে বলে ফেলতে পারতো। কিন্তু নিশান্তকে এমন কথাগুলো সে কিভাবে বলবে? অবন্তী অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। নিশান্ত হতাশ গলায় বলল,” তুমি যদি এভাবেই মুখে সেলোটেপ লাগিয়ে রাখো তাহলে কিছুই সমাধান হবে না। আমি তোমাকে হেল্প করতে চাইছি অবন্তী। তাই প্লিজ তুমিও আমাকে হেল্প করো। আসল ঘটনা আমার জানা খুব দরকার।”

অবন্তী ইতস্তত করে বেশ অনেকক্ষণ পর বলল,” বিয়ে ভাঙার কারণ আমি তোমাকে বলতে পারব না। তবে আজকের এই ঘটনার সাথে বিয়ে ভাঙার কোনো সম্পর্ক নেই।”

” তাহলে কিসের সাথে সম্পর্ক আছে?”

অবন্তী অস্বস্তি মেশানো কণ্ঠে বলল,”একবার বাজারে আমি সানভী আঙ্কেলকে জুতো মা-রার কথা বলেছিলাম। উনি সেই অপমান সহ্য করতে পারেননি৷ তাই প্রতিশোধ নিতে আমাকেও অপদস্থ করতে চাইছেন। এটাই ঘটনা। ব্যস, আমি আর কিছু বলতে চাই না। আমাকে প্লিজ আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না।”

অবন্তী সরে গেল। বিছানায় গিয়ে বসল জড়সড় হয়ে। নিশান্ত দাঁড়িয়েই রইল। অবাক বিস্ময়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল অবন্তীকে। তার দৃষ্টি এলোমেলো। বার-বার ঢোক গিলছে। শরীর মৃদু কাঁপছে। অস্বস্তিতে নাকি ভয়ে? একটু পর থম ধরা গলায় নিশান্ত বলল,” তুমি সানভী মামাকে জুতো খুলে কেন মা-রতে যাবে? তিনি কি এমন করেছিলেন?”

অবন্তী এই পর্যায় খুব রেগে গেল। তুমুল গর্জন করে বলল,” আমি আর কিছু বলতে চাই না। এক কথা কয়বার বলব? প্লিজ এখান থেকে চলে যাও। আমার কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি একা থাকতে চাই। তুমি যদি এই বিষয়ে আর একটা প্রশ্ন করো তাহলে আমি ছাদ থেকে লাফ দিবো।”

নিশান্ত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এসব কি কথা? অবন্তী বাচ্চাদের মতো কেঁদে যাচ্ছে। তার অবস্থা দেখেই আন্দাজ করা যায় এমনকিছু হয়েছে যা সে ভাবতেও চায় না। বলা তো দূর! তাকে শান্ত করতে নিশান্ত তার পাশে বসল। নরম গলায় বলল,” পানি খাবে?”

অবন্তী হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ল। ছাদে কলের ব্যবস্থা ছিল। নিশান্ত একটা খালি বোতল উঠিয়ে সেটি ভালোমতো ধুঁয়ে পানি এনে দিল অবন্তীকে। অবন্তী এক নিঃশ্বাসে পুরো অর্ধেক বোতল খালি করে ফেলল। নিশান্ত ঠান্ডা গলায় বলল,” তুমি যেটা বলতে চাইছো না সেটা বলার জন্য আমি তোমাকে জোর করব না। ”

অবন্তী নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,” থ্যাংকস।”

সন্ধ্যায় পরিকল্পনা মতো কুলসুম সানভীর ঘরে গেল। অবন্তী যেটা বলতে চাইছে না সেটা সানভীর মুখ থেকেই বের করতে হবে। কিন্তু নিশান্তর মনে হচ্ছে, কুলসুম সানভীর পেট থেকে কথা বের করতে পারবে না। মেয়েটা বোকা ধরণের। আর সানভী খুব ধূর্ত। তাও চেষ্টা করতে হবে। সানভী খুব আরামে ইজিচেয়ারে বসে আছে। মনের সুখে শিষ বাজাচ্ছে। কুলসুম প্রবেশ করা মাত্রই সে পেছনে না তাকিয়ে বলল,” কি ব্যাপার কুলসুম? কেমন আছিস?”

কুলসুম মাথা নত করে বলল,” ভালো। ”

” কি বলতে চাস বল। দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিস।”

” যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিগামু খালি।”

সানভী সিগারেট ধরাতে ধরাতে গম্ভীর গলায় বলল,” কি কথা?”

” আপনি অবন্তী আপার লগে এমন ক্যান করলেন? সে আপনার কি ক্ষতি করছিল?”

সানভী হেসে উঠল। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে আমুদে কন্ঠে বলল,” অবন্তী আমার ক্ষতি করবে কেন? কি সুন্দর একটা ফুটফুটে মেয়ে। কত ভালোই না ভেবেছিলাম মেয়েটাকে। সুন্দর, মিষ্টি চেহারা। কিন্তু স্বভাবটাই খারাপ, চোর। স্বর্ণ দেখে লোভ সামলাতে পারল না। হাতসাফাই করে দিল। ছোটবেলায় মেয়েটা ভালোই ছিল। আমার মনে হয় হাতসাফাইয়ের বদভ্যাস্টা নতুন শিখেছে।’ ”

কুলসুম সানভীর কথা শুনে চমকালো। হতবিস্মিত সুরে বলল,” অবন্তী আপায় চুরি করল কখন? সব তো আপনার ষড়যন্ত্র। তারে ফাঁসাইলেন তো আপনে।”

সানভী জিভ কাটল। ভারী অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,” এসব কি বলছিস? ছি, ছি, ছি! আমি কি এরকম করতে পারি? আমাকে কি তোর অমানুষ মনে হয়? তওবা, তওবা। আমি কেন অবন্তীকে ফাঁসাবো?”

কুলসুমের দৃষ্টিতে ঘোর বিস্ময়। সানভী হাসিমুখে বলল,” এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? অবাক হচ্ছিস? হাহাহা! আচ্ছা, আমাকে কি তোর ছাগল মনে হয়? তুই এখানে কেন এসেছিস তা কি আমি জানি না? এই সামান্য বিষয় বোঝার বুদ্ধি আমার আছে। শুধু এটা না। ভাগিনা যে ক্যামেরা ফিট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে, আমি সেটাও জানি।”

এই কথা বলার সাথে সাথেই নিশান্তর হাত থেকে মোবাইল পড়ে গিয়ে শব্দ হলো। সানভী হাসতে হাসতে তাকাল সেদিকে। সিগারেটে টান দিতে দিতে উচ্চস্বরে বলল,” শোনো ভাগিনা, তোমার বয়স আমি বহু আগে পার করে আসছি। এসব সস্তা ট্রিক আমার উপর খাঁটিয়ে লাভ নেই। বেকার খাটনি। হাহাহা!”

সানভী এবার তাকাল কুলসুমের দিকে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। সানভী অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,” ভাগিনার কথা থাক। কিন্তু তুইও আমার বিশ্বাস নিয়ে এভাবে খেলতে পারলি কুলসুম? ছি, ছি, ছি! তোকে আমি নিজের মানুষ ভাবতাম।আচ্ছা যা, এবারের মতো মাফ করে দিলাম। আর কখনও এসব করিস না। বার-বার মাফ পাবি না কিন্তু। আমি হলাম ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ।”

সানভী সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। কুলসুম দৌড়ে পালিয়ে এলো। নিশান্ত রাগে অযথাই গাছের গোঁড়ায় লাথি মারল কয়েকটা। তার আরও সতর্ক থাকা উচিৎ ছিল।

সবকিছু শুনে অবন্তী কেঁদে ফেলল। সে জানতো কিছুই হবে না। ওই লোক একটা পিশাচ। নিশান্ত উত্তাপহীন গলায় বলল,” কান্নাটা অন্তত থামাও প্লিজ। আমি যখন বলেছি সব ঠিক করবো মানে অবশ্যই ঠিক করেই ছাড়ব।”

অবন্তী হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বলল,” কিছুই আর ঠিক হবে না৷ একটু পরেই আমার মা-বাবা চলে আসবে। তাদের সামনে পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। হেলেন খালামণির মতো তারাও আমাকে অবিশ্বাস করবে। ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাবে।”

অবন্তী কথা বলতে বলতে আরও একচোট কাঁদল। নিশান্ত তার কাছে এসে মাথায় হাত রাখল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” এসব কিছুই হবে না৷ এতো সোজা নাকি? পুলিশ তোমাকে ছুঁতেও পারবে না৷ আর কেউ তোমাকে বিশ্বাস না করলেও আমি সবসময় করবো৷ সবসময় তোমার পাশে থাকব। ভয় নেই।”

অবন্তী নিশান্তর হাতটি নিজের মাথা থেকে এনে গালে ছোঁয়ালো। স্বস্তিভরা কণ্ঠে বলল,” তুমি অনেক ভালো নিশান্ত।”

অবন্তীর গায়ে একটা সবুজ রঙের সেলোয়ার-কামিজ। অনেকক্ষণ কাঁদার কারণে ফরসা গালে লালচে আভা জমে উঠেছে। চোখ দু’টো ফুলে আছে। তাকে বিড়ালছানার মতো আদুরে দেখাচ্ছে। নিশান্ত তাকিয়ে রইল গাঢ় দৃষ্টিতে। অবন্তী অবাক হয়ে বলল,” কি ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

নিশান্ত আচ্ছন্নের মতো বলল,” তোমাকে সুন্দর লাগছে।”

অবন্তী অপ্র‍স্তুত হলো। নিশান্তর শ্যামলা,মায়ামুখ চেহারাটির দিকে তাকাতেই তার লালচে গাল আরও লালচে হলো। ওই ধারালো দু’টো চোখ তাকে কেমন খুঁটিয়ে দেখছে। কি গভীর সেই দৃষ্টি! অবন্তীর নিজেকে গুঁটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। নিশান্ত হঠাৎ বলল,” কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। কিন্তু অনেকদিন ধরেই বলতে চাচ্ছি।”

” কি?” অবন্তী ভ্রু কুচকালো। নিশান্ত অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। আমতা-আমতা করে বলল,” এখন বলা ঠিক হবে কি-না তাও জানি না৷ শুধু মনে হচ্ছে, বলতে না পারলে হয়তো নিঃশ্বাস আটকে ম-রেই যাবো আমি।”

অবন্তী বিস্মিত হয়ে শুধাল,” বলতে না পারলে নিশ্বাস আটকে ম-রেই যাবে তুমি? কি এমন জরুরী কথা শুনি?”

” অনেক জরুরী। আমার জীবনের থেকেও এই কথাটা অনেক বেশি জরুরী অবন্তী।” নিশান্ত মাথা নিচু করল। ভারী ও এলোমেলো তার নিঃশ্বাস। অবন্তী উতলা কণ্ঠে অনুরোধ করল,” তাহলে প্লিজ বলে ফেলো!”

” শিওর তুমি? সত্যি বলবো?” নিশান্ত একটু দ্বিধান্বিত। অবন্তী দৃঢ়তার সাথে জানাল,” হ্যাঁ বলবে। বলতেই হবে। না বললে তোমাকে যেতে দিবো না।”

নিশান্ত অবন্তীর হাত ধরল। অনেকটা কাছে এসে বিভোর-আবেশিত কণ্ঠে বলল,” তোমাকে দেখার পর থেকে আর কখনোই কিছু ভালো লাগেনি আমার। সৌন্দর্য্য কি বুঝতে শেখার পর থেকে তোমাকেই সর্বোচ্চ সুন্দর বলে জেনেছি সবসময়। তোমার মধ্যে সেই ভালো-লাগা পেয়েছি যা আর কখনও কোথাও পাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। অবন্তী, আমার শুধু তোমাকেই লাগবে। সবসময় লাগবে। সারাজীবন ধরে লাগবে। প্লিজ আমার হও। সবসময় আমাকে তোমার পাশে থাকতে দাও৷ আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর কিচ্ছু চাই না।”

কথাগুলো বলতে বলতে নিশান্ত অবন্তীর হাতে চুমু খেল উত্তালভাবে। তারপর অবন্তীকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মুখ গুঁজল। খুব কঠিন একটা কাজ শেষ করার পর মানুষ যেভাবে নিঃশ্বাস নেয় নিশান্তও ঠিক সেভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শান্ত, স্থির, স্বস্তিভরা নিঃশ্বাস। একবার তো মনে হলো সে বুঝি ঘুমিয়েই পড়েছে। অবন্তীর চোখ দু’টি টলমল করছে। নিঃশ্বাসটা বোধ হয় এখনও থেমে আছে৷ হঠাৎ তার হিঁচকি ওঠা শুরু হলো। সেই শব্দে নিশান্তর ঘোর কাটল। সে ব্যস্ত হয়ে পানি খাওয়ালো অবন্তীকে। বোতলের সবটুকু পানি শেষ করার পরেও হিঁচকি থামছে না। ছোটবেলায় অনেক অবাক হয়ে গেলে অবন্তীর এমন হতো। একবার নিশান্ত তার সামনে এসে হাত-তালি বাজালো। সাথে সাথে অবন্তীর হিঁচকি থেমে গেল। আজকে নিশান্ত হাত-তালি বাজালো না৷ টুপ করে অবন্তীর ঠোঁটে চুমু দিয়ে ফেলল। অবন্তীর হিঁচকি সাথে সাথে গায়েব। সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। নিশান্ত হেসে বলল,” হিঁচকি থেমেছে?”

অবন্তী মাথা নাড়ল। থেমেছে হিঁচকি। কিন্তু বুকের বামপাশে যে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে! তারা একে-অপরের দিকে তাকিয়ে রইল আচ্ছন্নের মতো। যেন মিষ্টি একটা আবেশের বলয় তৈরী হয়ে গেছে চারপাশে। সেই বলয়ের ভেতর দু’জনই হারিয়ে যাচ্ছে বেখেয়ালি স্রোতে। একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত অনুভূতি তাদের গ্রাস করে নিচ্ছে ব্ল্যাকহোলের মতো। কয়েকটি এলোমেলো নিশ্বাস, ঘোরলাগা মুহূর্ত, তারপর নিশান্ত আবার তার ঠোঁটজোড়া চেপে ধরল অবন্তীর ঠোঁটে। অবন্তীও সানন্দে চোখ বুজে গ্রহণ করল প্রথম ভালোবাসার হৃদয় ভোলানো স্পর্শ। আর ঠিক তখনি ঠকঠক করে বেজে উঠল দরজায় করাঘাতের শব্দ। অবন্তী চমকে উঠল। দুইহাতে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল নিশান্তকে। তার হঠাৎ বেফাঁস ধাক্কায় নিশান্ত বিছানার প্রান্তে ছিটকে পড়ল৷ সে এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
অবন্তী দুইহাতে মুখ ঢেকে অপরাধী কণ্ঠে বলল,” স্যরি।”

নিশান্ত উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,” ইটস ওকে।”

অবন্তী তাকিয়ে রইল বোকার মতো। যেন কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। নিশান্ত বলল,” দরজা খুলবে না?”

অবন্তী যেন হুঁশ ফিরে পেল এমনভাবে বলল,” ও হ্যাঁ, খুলছি। ”

তার মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। নিশান্ত দেখল, অবন্তী কিছুতেই দরজার ছিটকিনি খুলতে পারছে না। তার হাত কাঁপছে। এমনভাবে ছিটকিনি ধরে টানছে যেন ভেঙেই ফেলবে। খুব বেসামাল দেখাচ্ছে তাকে। নিশান্ত নিজেই উঠে এসে দরজা খুলে দিল। বিলকিস দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। সে ঘরে ঢুকেই অবন্তীকে জড়িয়ে ধরল আর কেঁদে ফেলল। কিন্তু অবন্তীর ঠোঁটে হাসি লেগে আছে।

চলবে