#অন্তহীন_বসন্ত~১৭
লিখা- Sidratul Muntaz
নিশান্ত বিলকিসকে সালাম জানিয়ে বের হয়ে গেল। কিন্তু বিলকিস কোনো জবাব দিল না। তাকে দেখে মনে হলো সে নিশান্তর সালাম শুনতেই পায়নি। অবন্তী বিলকিসকে ধরে বিছানায় বসানো মাত্র সে প্রশ্ন করল,” অবন্তী, তুই কি সত্যি রাত্রীর হার চুরি করেছিস?”
অবন্তী কাতর গলায় বলল,” তোমার কি মনে হয় আমি চুরি করতে পারি?”
বিলকিসের চেহারা করুণ দেখালো। নিরুপায়ের মতো বলল,” সবাই যে বলছে! তোর ব্যাগ থেকে নাক হার পাওয়া গেছে? ওই হার তোর ব্যাগে এলো কি করে?”
” সেই কথা তো আমি নিজেও জানি না।”
বিলকিস গর্জন করে বলল,” জানবি না কেন? তোকে আমি একশোবার নিষেধ করেছিলাম এই বাড়িতে আসতে। বল করিনি? আর তুই আমাকে কি কথা দিয়েছিলি? নিশান্তর সাথে আর মিশবি না বলেছিলি না? তাহলে এখন আমি কি দেখলাম? তোরা দরজা বন্ধ করে এই ঘরে কি করছিলি? নির্লজ্জতারও একটা সীমা থাকা উচিৎ। ”
অবন্তী আড়ষ্ট গলায় বলল,” এসব কি বলছো মা? আমরা কিছুই করিনি। নিশান্ত শুধু বলতে এসেছিল যে ও আমাকে সাহায্য করতে চায়।”
” ওর কোনো সাহায্যের দরকার নেই আমাদের। কপালে যা আছে হবে। খবরদার তুই আর একবারও নিশান্তর সাথে কথা বলবি না। নিচে রিমা আমাকে কি পরিমাণ অপমান করেছে তা কি তুই জানিস? এমন নোংরা কথা নেই যা সে আমাকে শোনায়নি। আমরা নাকি তোকে এই বাড়িতে পাঠাই চুরি করতে। তোর মূল উদ্দেশ্য হাতসাফাই করা আর রূপ দেখিয়ে বেটাদের পাগল করা। আর কিছু শুনতে চাস?”
অবন্তীর কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। অবাক হয়ে বলল,” রিমা আন্টি এইভাবে কথা বলেছেন? ”
” সুযোগ পেলে বলবে না?”
” কিন্তু রিমা আন্টি কখন আসলেন? উনি না বিদেশে ছিলেন?”
” কিছুক্ষণ আগেই এসেছে। তুই হয়তো জানিস না। তোকে নিয়ে এমন নোংরা কথা বলছিল যা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ শুনলেও অসুস্থ হয়ে যাবে। নেহায়েৎ আমি জানি তোরও দোষ আছে। তাই কিছু বলতে পারিনি। নয়তো ওর মুখে ঝামা ঘঁষে দিয়ে আসতাম। তুই তো মুখ দেখানোরও জায়গা রাখলি না অবন্তী!”
অবন্তীর কিছুক্ষণ আগের খুশির আমেজটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। একটা বিষাক্ত অনুভূতি কাঁটার মতো আঁকড়ে ধরল হৃৎপিন্ডকে। কান্না পেতে লাগল আবারও। বিলকিস স্বগতোক্তি করল” পুলিশ ডাকার হুমকি দিচ্ছিল আমাকে। যদি সত্যিই তোকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাহলে তো আমরা কিছু করতেও পারব না। কেন এতোবড় সর্বনাশ করলি বলতো? তোকে একা ছাড়াই আমার ভুল হয়েছিল। সত্যি যদি তোকে পুলিশ ধরতে আসে তোর বাপে মনে হয় হার্ট ফেইল করবে। আর আমি কি করব জানি না। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ম-রব।”
অবন্তী আশ্চর্য হয়ে বলল,” এভাবে কথা বলছো কেন মা? তোমার কি মনে হচ্ছে আমিই হারটা চুরি করেছি?”
” তুই চুরি করেছিস কি করিসনি সেটা বড় কথা না। কথা হলো তোর ব্যাগ থেকে হার পাওয়া গেছে। তাই ওদের যদি ইচ্ছে করে তোকে পুলিশে ধরাবে তাহলে ধরাবেই। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।”
অবন্তী উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিলকিস চেঁচিয়ে ডাকল,” অবন্তী, যাচ্ছিস কই?”
অবন্তী জবাব দিল না। সে সোজা গিয়ে ঢুকল সানভীর ঘরে। অবন্তীকে দেখে সানভী হাসিমুখে বলল,” কি অবস্থা? মায়ের সাথে দেখা হয়েছে?”
অবন্তী দরজা আটকে তীক্ষ্ণ এবং ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে বলল,” আপনি কি চান? আর কত সহ্য করব বলেন তো? আপনার জন্য আমার মাকে জীবনে প্রথমবার এতো অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। যদি আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই তাহলে কি এইসব থামাবেন আপনি বলুন? তাহলে আমি হাতজোড় করছি। প্লিজ, বন্ধ করুন এগুলো। আমার বাবা-মাকে এভাবে কষ্ট দিয়েন না। ওদের তো দোষ নেই। আপনার রাগ আমার উপর।”
অবন্তী সানভীর সামনে দুই হাতজোড় করে কাঁদতে লাগল। সানভী একটু অবাকই হলো। সে ভাবেনি এতো সহজে অবন্তী ক্ষমা চাইতে আসবে। সে শান্ত ভঙ্গিতে অবন্তীর কাছে এলো। তার কাঁধে হাত রাখল। অবন্তীর শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। এই মানুষটার স্পর্শ নেওয়াও পাপ। সে ফুঁসে উঠে বলল,” আমাকে ধরবেন না।”
সানভী নিম্ন কণ্ঠে বলল,” আহা, শোনো। এদিকে আসো। শান্ত হও৷ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সানভী অবন্তীকে টেনে বিছানায় বসালো। অবন্তীর কোমরে হাত রাখল। অবন্তী ক্রুদ্ধ গলায় বলল,” ইউ বাস্টার্ড, এসব কি করছেন আপনি?”
সানভী চেপে ধরল অবন্তীর মুখ। ধমক দিয়ে বলল,” শাট আপ। একদম সাইলেন্ট। কথা বলছি, কথা শোনো।”
অবন্তীর দুই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রু। সানভী নরম গলায় বলল,” আমি তো তোমাকে অপশন দিয়েছিলাম৷ তুমি চাইলেই সবকিছু এক নিমেষে ঠিক হয়ে যাবে। যারা তোমার বাবা-মাকে অপমান করেছে তারাই দেখবে এসে ক্ষমা চাইবে। সবকিছু তোমার হাতে। শুধু তোমার একটা ‘ হ্যাঁ’ এর অপেক্ষা।”
অবন্তী মুখ বিকৃত করে বলল,” ছি, নোংরা আপনি। প্রচন্ড নোংরা!”
” তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি আরও অনেক নোংরামি করতে পারব। এটা মাত্র শুরু।” এই কথা বলে সে অবন্তীর গালে চুমু দিল। অবন্তী কেঁপে উঠল। এমনভাবে গাল মুছতে লাগল যেন বিষাক্ত কিছু লেগে গেছে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” আমাকে ছাড়ুন। নয়তো আমি এমন চিৎকার করব যে সবাই এখানে চলে আসবে।”
” তাই নাকি? আচ্ছা করো চিৎকার। সেটাই ভালো। আমি তো তোমাকে এখানে ডাকিনি। তুমি নিজে থেকে এসেছো।”
সানভী আরও শক্ত করে অবন্তীর কোমর চেপে ধরল। তার দু’টো হাত বিচরণ করতে লাগল অবন্তীর গোটা শরীরে। অবন্তী শক্তিতে কিছুতেই পেরে উঠল না। বুঝতে পারল এই ঘরে আসা বিরাট ভুল হয়েছে৷ সানভী উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করেছে। অবন্তীর চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো। ঠিক সেই সময় দরজায় করাঘাত করল কেউ। নিশান্তর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে,” ছোটমামা, দরজা খোলো।”
সানভী বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” উফ, ভাগিনা! শান্তি দিলানা। অবন্তী লুকাও। তুমি নিশ্চয়ই চাও না যে নিশান্ত এইখানে এই অবস্থায় তোমাকে দেখুক।”
অবন্তীর মুখ ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেল। নিশান্ত তাকে এখানে দেখলে কি ভাববে? সানভী আলমারি খুলে বলল,” এটার ভেতর ঢুকে যাও।”
অবন্তীর মাথা কাজ করছিল না৷ তাই সানভী যা করতে বলল সে তাই করল। অবন্তীকে আলমারিতে লুকিয়ে রেখে সানভী দরজা খুলে দিল। নিশান্ত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকেই অতর্কিতে আক্রমণ করল। সানভীর চোয়াল বরাবর শক্তহাতে ঘুঁষি মেরে চিৎকার করে বলল,” তুমি অবন্তীর সাথে এসব কি শুরু করেছো? বাড়িতে পুলিশ কেন আসলো? অবন্তীর গায়ে যদি একটা আঁচও লাগে, আমি তোমাকে ছাড়ব না!”
নিশান্তকে ক্রোধে উন্মত্ত দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই ভীড় জমে গেল সানভীর ঘরে। বাড়ির সবাই নিশান্তকে থামাতে ব্যস্ত হলো। আড়াল থেকে ওই দৃশ্য দেখে নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল অবন্তী।
চলবে
#অন্তহীন_বসন্ত~১৮
লিখা- Sidratul Muntaz
বাড়িতে বিশ্রী কোলাহল শুরু হয়ে গেল। বহু কষ্টে সানভীকে নিশান্তর থেকে ছাড়ানো যায়। জাকির তাকে সবেগে ধা-ক্কা মেরে ধমকানো গলায় বলল,” পাগল হয়েছিস? বেয়াদব!”
সানভীর চোখমুখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। সন্তানের মতো ভাগ্নের হাতে মা-র খেয়ে সে চূড়ান্ত অপমানিতবোধ করছে৷ এমন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা সবাইকে হতভম্ব বানিয়ে দিয়েছে। বাচ্চারা ভয়ে জড়সড়। তবে হেলেনকে দেখে মনে হলো এই ঘটনায় সে মজা পাচ্ছে। রিমা এসে সানভীকে শান্ত করে বলল,” তুই কিছু মনে করিস না। আমি দেখছি বিষয়টা। নিশান্ত, আমার সাথে ঘরে চল।”
নিশান্ত উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,” আমি কোথাও যাব না। আমি এই সবকিছুর শেষ দেখতে চাই। একটা সাজানো নাটকের উপর ভিত্তি করে তোমরা কাউকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারো না৷ এই বাড়িতে পুলিশ কেন এলো? কে আনলো পুলিশ? অবন্তী নির্দোষ সেটা সবাই জানার পরেও না জানার ভাণ করছে। কি আশ্চর্য! আর তুমি… সবকিছু করেছো তুমি। অবন্তীকে নিয়ে তোমার কি সমস্যা?”
নিশান্ত আবার সানভীর দিকে তেড়ে যেতে নিচ্ছিল। রিমা আর জাকির তাকে থামালো। রিমা অনেক কষ্টে নিশান্তকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সানভী অভিযোগের স্বরে বলল,” মা, আমি এর বিচার চাই। নিশান্ত বিনা অপরাধে আমার গায়ে হাত তুলতে পারে না।”
দিলারা সানভীর কাছে এসে বললেন,” বাদ দে। মাথাটা গরম ছিল। ও যেটা করেছে না বুঝে করেছে।”
” তুমি বলতে চাইছো ও আমার গায়ে না বুঝে হাত তুলেছে?” ক্রোধে গলার শিরা ফুলে উঠল সানভীর। দিলারা চোখ রাঙিয়ে বললেন,” তুই-ই বা পুলিশ আনতে গেলি কেন? আগেই বলেছিলাম ঝামেলার দরকার নেই৷ রাত্রীর হার তো পাওয়া গেছেই। তাও পুলিশ কেন?”
” হার পাওয়া গেছে বলে কি আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিবো? চোরকে শাস্তি দিবো না?”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বিলকিস সবকথা শুনছিল৷ সানভী যখন ‘চোর’ শব্দটা উচ্চারণ করল তখনি তার তীব্র কণ্ঠে বলতে মন চাইল,” খবরদার আমার মেয়েকে চোর বলবে না!” কিন্তু বলতে পারল না। জাকির সানভীকে শান্ত করার জন্য ঘর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। ধীরে ধীরে সবাই চলে গেল। বিলকিস দাঁড়িয়ে রইল একা। নিথরের মতো। তাকে দেখেও কেউ কোনো কথা বলল না। ইচ্ছাকৃতই অগ্রাহ্য করল সবাই। অপমানের তীব্র আঘাত কাঁটার মতো শরীর ছিন্ন করে দিল। অবন্তী যখন বুঝল ঘরে কেউ নেই তখন ক্লজেটের দরজা খুলে বের হলো। বিলকিস তাকে সানভীর ঘরের আলমারি থেকে বের হতে দেখে প্রথমে ভ্রু কুচকালো এবং পরমুহূর্তেই তার মাথায় র-ক্ত উঠে গেল। হিংস্র বাঘিনীর মতো তেড়ে এসে সজোরে চপোটাঘাত করল অবন্তীর গালে। আচমকা আক্রমণে অবন্তী হতবিহ্বল। কথা বলার সুযোগটাও পেল না এর আগেই বিলকিস দ্বিতীয় চড় মারল। চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগল,” এই ঘরে তুই কি করছিলি? বল তুই কি করছিলি এই ঘরে? আর কত যন্ত্রণা করবি আমাকে? যদি আমি না দেখে অন্য কেউ তোকে দেখতো তাহলে কি ভাবতো?”
বিলকিস এলোপাতাড়ি চড় মেরে যেতে লাগল। তার সমস্ত রাগ সে অবন্তীর উপরই উপচে পড়ল। হেলেন ছুটে এসে অবন্তীকে বাঁচালো।
” আপা কি করছিস? ছাড় ওকে, ছাড়!”
বিলকিস আর্তনাদ করে বলল,” এই মেয়েকে আমি মে-রেই ফেলব। ওর জন্যই এতো বিপদ। কারো সামনে মুখ পর্যন্ত দেখাতে পারছি না আমি। ও ম-রে না কেন? বল ম-রে না কেন?”
অবন্তী থরথর করে কাঁপছে আর কাঁদছে। হেলেন তাকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেল।
নিশান্ত ঘরে এসেও ঠান্ডা হলো না৷ তার মন চাইছে সবকিছু ভেঙে ফেলতে। রিমা তাকে এক গ্লাস পানি দিল। নিশান্ত ধাক্কা মেরে সেই গ্লাস ভেঙে ফেলল। রিমা ভীত কণ্ঠে বলল,” এসব কি পাগলামি শুরু করেছিস? একটু শান্ত হো প্লিজ।”
নিশান্ত শান্ত হলো না। বক্স খাটে লাথি বসিয়ে বলল,” পুলিশ যদি অবন্তীকে কিছু করে তাহলে এর চেয়েও খারাপ হবে আম্মু। আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।”
রিমা কয়েক মুহূর্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল অবাক দৃষ্টিতে। তারপর নিশান্তর কাঁধে হাত রেখে ঠান্ডা গলায় বলল,” বস।”
” আমি বসব না। যা বলার দাঁড়িয়ে বলো।”
” সব সমস্যারই সমাধান আছে। তুই বস, আমি সমাধানটা বলছি। অবন্তীকে বাঁচাতে চাস তো? আমি সাহায্য করব তোকে।”
নিশান্ত এই কথায় কিছুটা নিভল। বিছানায় বসল। রিমা তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল,” একটু আগে যেটা করলি সেটা একদম ঠিক হয়নি। তুই সবার আগে সানভী মামার কাছে ক্ষমা চাইবি।”
” অসম্ভব!” গর্জে উঠল নিশান্ত। রিমা কোমল গলায় বলল,” আহা, আমার পুরো কথা শোন। আমি সানভীকে বুঝিয়ে বলব। সে পুলিশ বিদায় করবে। অবন্তীর কিচ্ছু হবে না।”
” পুলিশ বিদায় করলেই প্রবলেম সলভ হবে না আম্মু। অবন্তীর কোনো দোষ নেই তাও সবাই তাকে চোর ভাবছে। তার বাবা-মাকে ডেকে এনে অপমান করা হচ্ছে। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। আমি আর টলরেট করতে পারছি না। সবকিছু বন্ধ করতে হবে।”
” ঠিকাছে। সবকিছু বন্ধ হবে। আমার ছেলের কোনো আবদার আমি কখনও অপূর্ণ রেখেছি? এবারও তুই যা চাস তাই হবে। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
” শর্ত মানে?” নিশান্ত বিরক্ত হলো। রিমা স্মিত হেসে বলল,” তোর জন্য এতোবড় একটা কাজ করবো আর প্রতিদান হিসেবে তুই আমার জন্য কিছু করবি না?”
নিশান্ত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ক্ষীণ গলায় বলল,” আচ্ছা করব।”
রিমা অতি উৎসাহে বলল,” আমি বলব তা করতে পারবি তো? ভেবে দ্যাখ, সব প্রবলেম সোলভ হয়ে যাবে।”
” বলো, কি করতে হবে?”
” অবন্তীর সাথে ব্রেকাপ।”
” ব্রেকাপ মানে?” নিশান্ত ভ্যাবাচেকা খেল। রিমা কৌশলী হাসি হেসে বলল,” আমি তোকে জন্ম দিয়েছি নিশান্ত। তোর ভাব-গতিক আমি বুঝবো না তাই কি হয়? অবন্তীর সাথে তোর সম্পর্ক যে শুধু বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ নেই বরং আরও অনেক দূর গড়িয়ে গেছে তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।”
নিশান্তর চেহারা পুরোপুরি ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল। চোখের মণি প্রসারিত হলো। গলা শুকিয়ে এলো। রিমা উঠে নিশান্তর পাশে বসতে বসতে বলল,” তুই শুধু আমার এই একটা কথা রাখ। বিনিময়ে আমি তোর সব কথা রাখব। ”
নিশান্ত ফট করে উঠে দাঁড়ালো। খুব শীতল কণ্ঠে বলল,” তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব। থ্যাংকস ফোর ইউর কনসার্ন।”
এই কথা বলেই সে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নিল। রিমা বলল,” দাঁড়া নিশান্ত, আমাকে কথা শেষ করতে দে।”
নিশান্ত গম্ভীর গলায় বলল,” তুমি যা ইচ্ছা বলো, কিন্তু আমি তোমার এই অন্যায় আবদার মানব না। এটা অসম্ভব।”
রিমা উঠে এসে নিশান্তর মুখোমুখি দাঁড়ালো। কণ্ঠে আদর ঢেলে বলল,” আমার বাচ্চা, আমার একমাত্র আদরের ছেলে। আমি কখনও তোর খারাপ চাইতে পারি না৷ তুই অবন্তীকে প্রটেক্ট করার জন্য যা-ই করবি তাতেই কিন্তু সে আরও বিপদে পড়বে। তুই তো জানিস না সানভী ওর কতবড় ক্ষতি করতে চাচ্ছে। তুই আমার অবাধ্য হলে আমিও বাধ্য হবো সানভীকে সাহায্য করতে।”
নিশান্ত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল। পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠল তার চোয়াল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,” হোয়াট ডু ইউ মিন?”
” আমার বুদ্ধিমান ছেলে, আমি জানি তুই বুঝেছিস আমার কথা। আমি অবন্তীর মতো থার্ডক্লাস মেয়েকে কখনও আমার রাজপুত্রের পাশে মানতে পারব না। এটা আমার জন্য অসম্ভব ব্যাপার। তাই স্বাভাবিকভাবেই তোকে বাঁধা দেওয়ার সবরকম চেষ্টা আমি করব। যদি অবন্তীর ক্ষতি করতে হয়, তাও করব। কারণ সন্তানের ভালোর জন্য মা সব করতে পারে।”
রিমার মুখভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক৷ এতো সহজে সে কিভাবে এমন ভয়ংকর কথাগুলো বলছে তা ভেবে পাচ্ছে না নিশান্ত। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে মুখ বিকৃত করে বলল, ” ছি, তুমি মা হওয়া ডিজার্ভ করো না!”
রিমা কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে ছেলের কটূবাক্য হজম করল৷ তারপর হৃষ্টচিত্তে বলল,” ওয়েল, অবন্তীকে প্রটেক্ট করার জন্য তুই সবসময় ওর পাশে থাকবি না। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। তুই কি অবন্তীর পাশে থেকে তার বিপদ বাড়াতে চাস নাকি ওর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে ওকে একটা সুন্দর আর নিশ্চিত জীবন উপহার দিতে চাস?”
নিশান্তকে সামান্য দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” আমি থাকতে কেউ অবন্তীর কিছু করতে পারবে না।”
খুব মজার কথা শুনলে মানুষ যেভাবে হাসে, রিমাও ঠিক সেভাবে হেসে বলল,” তাই নাকি? তুই কি করবি? এই পর্যন্ত অবন্তীর সাথে ঘটে যাওয়া কয়টা ঘটনার কথা জানিস তুই? আজকের কথাই ধর না, তোর চোখের সামনে দিয়ে অবন্তীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। কিন্তু তুই কিছুই করতে পারবি না৷ আর যদি তুই আমার কথা শুনিস, তাহলে আমি সবকিছু ঠিক করে দিবো। এই বাড়ির সবাই আবার অবন্তীকে আগের মতো বিশ্বাস করবে, অবন্তীর পরিবার তাদের হারানো সম্মান ফিরে পাবে। শুধু তাই না, এর পর থেকে অবন্তীর সব ধরণের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিবো। প্রয়োজনে তার পারিবারিক দায়িত্বও বহন করব। অবন্তীর বাবাকে তোর চাচ্চুর অফিসে ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিবো। তারা সুখে-শান্তিতে থাকবে। অবন্তী ভালো জায়গায় লেখাপড়া করবে, তার ভালো ক্যারিয়ার হবে। বিনিময়ে তোকে শুধু একটা কাজ করতে হবে। অবন্তীকে ভুলতে হবে। ব্যস!”
নিশান্ত নিশ্চুপ হয়ে রইল৷ তার মুখভঙ্গি কঠিন৷ রিমা নরম গলায় বলল,” বাবা একটা মানুষের জীবনে কিন্তু ভালোবাসাই সবকিছু না। ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে যদি সবাইকে ভালো রাখা যায় তাহলে একজন বুদ্ধিমান সেটাই করবে। আমার কথা শেষ। এখন সিদ্ধান্ত তোর।”
” আমি পারব না।” অকপটে বাক্যটি বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নিশান্ত। ড্রয়িংরুমে পুলিশ দেখা যাচ্ছে। দূর বারান্দায় বিলকিসকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কেমন পাগলের মতো কাঁদছে সে। অবন্তীকে হাতকড়া পরানো হয়ে গেছে। তার চেহারা বিষণ্ণ, নিষ্প্রাণ। তাকে জড়বস্তুর মতো দেখাচ্ছে। আসামী হিসেবে তাকে ধরে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কি আশ্চর্য! কেউ কিছু বলছে না কেন? অবন্তীর বাবা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল৷ বাবাকে দেখে অবন্তী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। অবন্তীর বাবাকে ওই মুহূর্তে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। সে পুলিশদের জিজ্ঞেস করছে অবন্তীকে কয়দিনের জন্য নেওয়া হচ্ছে! নিশান্তর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। চোখের কোণ জলে সিক্ত হলো। সে আবার ঘরে ফিরে গিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” আমি তোমার সব শর্ত মানতে রাজি আম্মু।”
রিমার চোখ দু’টি আনন্দে ঝলমল করে উঠল। নিশান্তর কাছে গিয়ে তার কপালে চুমু দিয়ে বলল,” থ্যাংকিউ বাবা। আজকে তুমি আমাকে কতটা খুশি করেছো তা আমি বলে বোঝাতে পারব না।”
নিশান্ত কাতর গলায় বলল,”অবন্তী যেন সবসময় ভালো থাকে, প্লিজ।”
রিমা ভরসা মেশানো কণ্ঠে বলল,” অবশ্যই ভালো থাকবে। আমি আমার ছেলেকে করা প্রমিস কখনও ভুলব না।”
চলবে