অন্তহীন সন্ধ্যা পর্ব-০৫

0
13
অন্তহীন_সন্ধ্যা #সূচনা_পর্ব #মাকামে_মারিয়া

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ০৫
#মাকামে_মারিয়া

রাত যখন তিনটে ঠিক সেই সময় ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে রাফসান দেখলো ফারিন তখনও জেগে। দেয়ালে পা ঠকিয়ে দু’হাতে ফোন চাপছে। রাফসান পাশ থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে সময় চেক দিয়েই বুঝলো গভীর রাত তখন। কিন্তু ফারিন জেগে আছে যে? হাতে আবার ফোন! আচ্ছা মেয়েটার কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি নতুন বাড়িতে এসে? কাউকে কিছু বলেও না। কেমন মুখ কুঁচকে থাকে।

বিয়ের তখন দুই দিন। প্রথম রাত তো ও ভাবেই কেটে গিয়েছিলো। দ্বিতীয় রাতেও রাফসান এসে ফারিনের পাশে সাইড পায়নি। ফারিন বিন্দু পরিমাণ পাত্তা দেয়নি তাকে। এতে একটু রাগ আর অভিমানও হয়েছিল বেচারার। দুটো রাতেই যদি একটা মেয়ে এমন করে কার না অভিমান হবে? বার বার কথা বলতে গিয়ে অপরজনকে বিরক্ত করতেও রাফসানের বিবেকে বাঁধে।

সন্ধ্যা রাতে অভিমান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও এই মাঝ রাতেও ফারিনকে জেগে থাকতে দেখে নিজের প্রতি খারাপ লাগা কাজ করলো। নিজেকে দোষী ভাবতে লাগলো। মেয়েটাকে একটু সময় দেওয়া দরকার, পাশে থাকা দরকার, সে কি চায় সেটাও জানা দরকার, সাথে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না এটাও জানা দরকার ভেবেই সে বালিশ ছেড়ে ওঠে পড়লো। ফারিন আড়চোখে খেয়াল করলো রাফসানের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে, সে জেগে ওঠেছে। কিন্তু তাতে ফারিন একচুলও নড়লো না। নিজের মতোই ফোনে ব্যস্ত।

ফারিনের এমন অনাগ্রহী দেখে রাফসান ভাবলো মেয়েটা হয়তো অভিমান করছে। একটা মেয়ে নিজ বাড়ি ছেড়ে নতুন জায়গায় এসেছে, একটু আকটু মুড সুইং তো হতেই পারে। স্বামী হিসেবে রাফসানের দায়িত্ব তাকে সময় দেওয়া। সহজ হতে সাহায্য করা। রাফসান এমনটা ভেবেই বিছানা ত্যাগ করলো। ড্রয়িং রুমে গিয়ে ডাইনিং এ খাবারের খুঁজ করলো। সন্ধ্যা রাতে মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলো ফারিন নাকি খায়নি। কেনো খায়নি এটাও রুমে এসে জিজ্ঞেস করেছিলো অথচ সে উত্তর পর্যন্ত দেয়নি।

ভাতের হাড়িতে অল্প একটু ভাত রয়েছে। কিন্তু তরকারি নেই বললেই চলে। ডালের পাতিলে ডাল রয়েছে একটু। রাফসান চিন্তায় পড়লো। কি করবে এখন? মেয়েটা না খেয়ে আছে। নিশ্চয়ই খিদে তে ঘুম পাচ্ছে না।

ফ্রিজ খুলে একটা ডিম বের করলো। কড়াইতে তেল গরম করে ডিম ভেজে নিলো। অল্প একটু ডাল সহ প্লেটে ভাত নিয়ে রুমে ঢুকলো রাফসান। উদ্দেশ্য ফারিন খাবে এগুলো। মেয়েটাকে খাইয়ে দিবে না হয়।

রাফসান হাত ধুয়ে ফারিনের সামনে প্লেট নিয়ে বসলো। ভাত মাখিয়ে এক লোকমা মেয়েটার মুখের সামনে নিতেই সে চেচিয়ে উঠলো। ” সমস্যা কি আপনার?? খাওয়াতে আসছেন নাকি অন্য ধান্দা?? শুধু কাছাকাছি আসতে চান। আমি বলেছি তো আমার কাছে আসতে চাইবেন না।
আমি কি বলেছি আমি খাবো?

সামান্য যত্ন নিয়ে খাওয়াতে আসলে এ ভাবে চেচামেচি করে মেয়েরা! রাফসান জানতো মেয়েদের মুড সুইং হয়। কিন্তু মুড সুইং কেমন সেটা তো সে জানতো না। তাই ভয়ংকর রকমের এই চেচামেচিকেই সে ধরে নিলো এটাই বুঝি মুড সুইং! মুচকি হেঁসে বললো ” আম্মা বললো তুমি নাকি রাতে খাও নাই। তাই তো ভাবলাম খিদে তে হয়তো ঘুম আসছে না।

” আশ্চর্য! আপনাকে দেখতে যেমন আস্ত হাতি লাগে, ব্রেইনের দিক দিয়েও আপনি একটা গরু! আপনার কি মনে হয় আমি খিদের যন্ত্রণায় জেগে আছি?? আপনাদের বাসার ওমন অখাদ্য আমার গলা দিয়ে নামে না। আমি বাহির থেকে খাবার আনিয়ে খেয়ে নিয়েছি।

রাফসানের চোখ টলমল করতে লাগলো। সে জানতো মেয়েরা নাকি নরম হয়! কিন্তু তার স্ত্রী তো নরম নয়। তাহলে কি সে ভুল জানতো? কই আম্মাকেও তো দেখি আম্মা কতো নরম মনের মানুষ! তাহলে আমার স্ত্রী?

এগুলো ভেবেই রাফসান হাতে থাকা প্লেটের দিকে তাকালো। টপ করে একটা ফোঁটা পানি ভাতের প্লেটে পড়ে গেলো। ভাজা ডিম ভাত আর ডাল এখনো অবিশিষ্ট রয়েছে। যেন ওরা রাফসানের অপমানে হাসছে। হাতের একপাশে গরম তেল ছিটে পড়েছিলো, সেখান টায় জ্বলছে কিন্তু হৃদয়ের জ্বলুনি এর থেকেও তীব্র।

★★

আপনার চোখে পানি যে?? কিছু হয়েছে?

রাফসান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখটা মুছার চেষ্টা করলো। ঠোঁটে মুচকি হাসির রেশ টেনে বললো ” আরেহ দূর! পুরুষ লোক কাঁদে? আমরা হচ্ছি স্ট্রং ম্যান। আমরা কান্না করতে জানি না।

এ কথা জুহাইরা মানতে চাইলো না। সে স্পষ্ট দেখলো রাফসানের চোখে পানি। খাবার প্লেট সামনে নিয়ে খাচ্ছিলো দুজনে। জুহাইরা হঠাৎই আবদার করলো ‘ চলুন আজকে আমরা একই প্লেটে খাবার খাই। স্বামী স্ত্রী একই পাত্রে খাবার খাওয়া সুন্নত!

জুহাইরার মিষ্টি আবদার ফেলতে পারলো না সে। তাই তো একই প্লেটে খেতে বসেছিলো দুজনে। দুই লোকমা খাওয়ার পরেই জুহাইরা অতি যত্নে রাফসানের মুখের সামনে একটা লুকমা ধরতেই বেচারা রাফসানের সে রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো ফারিন ঠিক কি ভাবে তার সাথে বিহেভিয়ার টা করলো। আর ওসব ভাবতে ভাবতেই তো রাফসানের চোখ ভিজে এসেছিলো। কিন্তু সেসব লজ্জার কথা কি আর জুহাইরাকে বলা যায়? যায় না তো। এসব তো নিজেরই লজ্জার কাহিনি! আজ অব্দি এসব কাউকে বলেনি সে। কিন্তু আজকে হুট করেই মনে পড়ে গেলো। কিছু আঘাত অতি সূক্ষ হলেও হৃদয়ে দাগ কেটে থাকে। যেই ক্ষতের দাগ কখনো মুছে না।

__________

বাবা মা ভাই বোনদের ছেড়ে দ্বিতীয় বারের মতো আবারও শশুর বাড়িতে যাত্রা হচ্ছে জুহাইরা। রাফসান বার বার তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি করে রেডি হতে। এদিকে মেয়েটা মুখ ফুলিয়ে এককোনায় বসে আছে। মুখ দিয়ে ভালো মন্দ কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। ভাবি, ছোট বোন, মা সবাই একটু পর পর বুঝাচ্ছে শশুর বাড়িতে যেতেই হবে। এমনটাই নিয়ম। জুহাইরা নিজেও জানে যেতে হবে। কিন্তু তাকে কোনো এক মায়া টেনে ধরে রেখেছে। নড়তে ইচ্ছে করছে না। কান্নাও পাচ্ছে খুব। কিন্তু যেতে তো হবেই।

” ইয়ে মানে না গেলে হয় না?

শুট বুট পরে রেডি হয়ে বসে ছিল রাফসান। জুহাইরার এমন প্রশ্নে ফোন থেকে চোখ তুলে একটা বড়সড় ধমকি দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই মনে পড়লো, ‘ না এই মেয়েটাকে যত্ন করতে হবে। খুব যত্ন!

দরজার কাছ থেকে জুহাইরার হাতটা ধরে টেনে এনে দরজা টা হালকা লাগিয়ে দিলো। জুহাইরার পিছনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো হাত খোঁপা করে ক্লিপ লাগিয়ে দিলো। বোরকা হিজাব জুহাইরার সামনে এনে দিলো। কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো ” জুহা! রেডি কি হবে? নাকি আমিই বোরকা হিজাব পড়িয়ে দিবো?

ছেলে নাছোড়বান্দা! এদিকে কষ্ট আরো যতই লাগুক যেতে তো হবেই। তাই সে রাফসানকে মুখ ভেঙ্গচি কেটে বোরকা হিজাব পড়ে রেডি হতে লাগলো। চোখে মুখে কান্না আর রাফসানের প্রতি মৃদু অভিমান।

চলবে…………….