অন্তহীন সন্ধ্যা পর্ব-০৮

0
2
অন্তহীন_সন্ধ্যা #সূচনা_পর্ব #মাকামে_মারিয়া

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ০৮
#মাকামে_মারিয়া

ঝড়ের পূর্বাভাস ছাড়াই হুটহাট ঝড় আসার মতোই ফারিন তার গতিবেগ পাল্টিয়ে ফেললো। এতোদিন রাফসানকে সময় সুযোগ দিলেও এখন সে পুরো আটঘাট বেঁধেই নেমে পড়লো তার ডিভোর্স চাই এবার।

এতোদিন সময় দিয়ে বলেছিলো যতদিন না রাফসান নিজের পরিশ্রমের টাকায় ফারিনের দেনমোহর পরিশোধ করতে পারবে ততদিন ফারিন এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না এবং তাকে যেনো এ বাড়ির বউ হিসেবে দেখাও না হয়। প্রায় সাড়ে চার মাস সময় দেওয়া হয়েছে রাফসানকে। এর মধ্যেই দ্বিতীয় বিয়ে করাটাও রাফসানের ইচ্ছে তে ছিল না। বরং বাড়ির সবার মতামতে হয়েছে এটা। সবাই ভেবেছিলো রাফসান দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে ফারিন অন্তত ঠিক হয়ে যাবে অথচ যেই লাউ সেই কদু! ফারিন তার নিজের জায়গায় অটুট। সে এ সংসার করবে না মানে করবেই না। তবে সম্পূর্ণ টাকাটা ছাড়াও যাবে না। রাফসান নিজেও বিবেকবুদ্ধিমান ব্যক্তি, সে নিয়ত করেছে ফারিনকে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে দিবে।

এদিকে ফারিন হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার ডিভোর্স দরকার, এবং এখনই। এ ভাবে হুট করে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে বুঝতে পারলো না রাফসান, যদিও বা বাড়ির কেউই চায় না ফারিন আর এ ভাবে থাকুক এখানে। অবশ্য সবাই চাইতো সংসার করুক, কিন্তু সংসার না করলে তো আর কিছু করার থাকে না তাই এ ভাবে পরে থাকারও কোনো মানে হয় না।

সম্পূর্ন ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফারিন বসে আছে ডিভোর্স পেপার সামনে নিয়ে। বুঝায় যাচ্ছে সে অনেক আগে থেকেই এদিনটার অপেক্ষায় ছিল। মূলত সে তার নিজস্ব কাজের জন্য অপেক্ষায় ছিল রাফসানকে কোনো সময় টময় দেয়নি। আজ তার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে বলেই ডিভোর্স পেপার নিয়ে হাজির।

রাফসানকে ফোন করে আনা হয়েছে দোকান থেকে। তপ্ত দুপুরে ঘেমে জবজব শরীর নিয়ে রাফসান বাড়িতে এসেছে। জুহাইরা অসহায় হয়ে আড়চোখে রাফসানের দিকে তাকিয়ে ভাবে এতোগুলা টাকা কি ভাবে দিবে মানুষ টা??

রুমে ঢুকতেই রাফসানের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে জুহাইরা এক গ্লাস পানি এনে দিলো। সে পানি খেলো। জুহাইরা এগিয়ে আসলো কিছু জিজ্ঞেস করবে করবে ভাব। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। রাফসান অভয় দিয়ে নিজেই বললো ” পাঁচ লক্ষ টাকা জোগাড় হয়েছে। জুহাইরা শাড়ির আঁচলের হাত গুটিয়ে বসলো রাফসানের পাশে। আমতাআমতা করে শুধালো ” আমার গহনা গুলো বিক্রি করে হয়ে যাবে। বিয়ে তে তো দাদী কাকা, বাবা, শাশুড়ী আম্মা সবাই কিছু না কিছু দিয়েছে। আর এখন স্বর্নের দামও অনেক। আশা করি হয়ে যাবে।

রাফসান কয়েক মূহুর্ত ভেবেই জুহাইরাকে বললো কি কি আছে সেগুলো দিতে। জুহাইরা আলমারি থেকে একজোড়া ঝুমকা আর হাতের একটা বালা এনে দিলো। সাথে গায়ে পড়ে থাকা গলার চেইন আর কানের দলগুলোও খুলে দিলো। অবশিষ্ট বলতে জুহাইরার হাতের আঙুলে একটা আন্টি রয়েছে কেবল। সে এটাও খুলতে গেলে রাফসান বারন করে। আন্টিটা রাফসান দিয়েছিলো জুহাইরাকে।

সবগুলো নিয়ে রাফসান দৌড়ের ওপরে নিয়ে গেলো বাজারে। সেগুলো বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়েই বাড়ি ফিরলো। ফারিনের সামনে এসে বসে পড়লো। বেশ অনেক দিন পর ফারিনের সামনে মুখ খুলে জিজ্ঞেস করলো ” দশ লক্ষ তে হবে?

ফারিন দায়সারা ভাবে বললো ” এটাই আমার পাওনা। তাছাড়া ক্ষতিপূরণ নিতাম যদি তুমি আমার কোনো ক্ষতি করতে কিংবা ডিভোর্স টা তুমি নিজে থেকে দিতে। কিন্তু সেসব তো হয় নাই তাই আমি কেবল এতোটুকুই নিবো। আমি আবার এতোও জুলুম করি না।

” সে অহংকারী না, এই নিয়ে তার অহংকারের শেষ নেই!

এই কথাটার মতোই ফারিনের ভাবসাব। সে দশ লক্ষ টাকা ছাড় দিচ্ছে না অথচ ভাবছে সে জুলুম করছে না। রাফসানের হাত থেকে টাকাটা নিয়েই ফারিন ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। রাফসান মুখ ফুটে বলে উঠলো ” গুনে নেও।

ফারিন হাসলো। হেঁসে হেসেই বললো ” তোমার সাথে সংসার করিনি মানে এই নয় যে তোমাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখি বা তুমি খারাপ। তোমার সাথে এই কয়েকদিন থেকে বুঝতে পেরেছি তুমি মানুষ হিসেবে বিশস্ত। বাট তুমি আরো যা-ই হও না কেন আমি সংসার টা করবো না মানে করবোই না।

রাফসান তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো। যে মানুষটার জন্য এতো আগ্রহ দেখালো। এতো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো তার মুখে এখন এসব কথা যেন আগুনে ঘী ঢালার মতো। সত্যি বলতে আমরা আরো যতই আগ্রহ দেখাই না কেনো ওপর পাশের মানুষটা যদি নূন্যতম আগ্রহ না দেখায় তবে তোমার সম্পূর্ণ আগ্রহটাই বিষ হয়ে যাবে।

ফারিন ডিভোর্স পেপারে আগে থেকেই সাইন করে রেখেছে। এবার রাফসানের পালা। রাফসান পেপার টা হাতে নিয়ে একটু চোখ বুলিয়ে দেখলো। ভেতর থেকে হৃদয় ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিয়তির কথা চিন্তা করতেই সমস্ত অতীত চোখের সামনে ভেসে উঠলো। প্রথম স্ত্রী, প্রথম বর সাজা, আলাদা সব ফিলিংস। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তিন কবুল পড়া, তখনও কি কেউ ভেবে রাখে যে এগুলো একদিন বিনষ্ট হয়ে যাবে স্মৃতিপাতা থেকে? সবাই তো ভাবে এগুলো স্মৃতিপাতাতে স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে, যা অন্তত কাল অব্দি ঝলঝল করে জ্বলতে থাকবে। অথচ! অথচ আমাদের জীবনে কখন কি ভাবে কোথায় কি হবে সেটা আমরা আধো ধারণাতেও রাখতে পারি না।

রাফসান কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিলো। মূহুর্তেই এতোদিনের ঝুলে থাকা সম্পর্কের বাঁধ ছিঁড়ে গেলো। ঝুলন্ত সম্পর্কের দুটো দিক এবার দুই দিকে। ফারিন ওঠে দাঁড়ালো। শেষ মূহুর্তে এসে মনে হলো এবার অন্তত সবার সাথে একটু ভালো বিহেভিয়ার করে যাওয়া দরকার। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কোহিনূর বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো ” আন্টি! আসি ভালো থাকবেন। আপনাদের প্রতি একটু হলেও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিৎ। আমি এই সংসারে থাকবো না এটা আমিও জানতাম আর আপনারাও জানতেন তাও যে আমাকে এখানে এ ভাবে এতোদিন থাকতে দিয়েছেন এতে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।

কোহিনূর বেগম বড় করে নিশ্বাস নিলো। বড্ড শখ করে রাফসানের বাবা মেয়েটাকে এ বাড়িতে এনেছিলো। কোহিনূর বেগম বেশ আদর যত্ন করা শুরু করলো কিন্তু পারলো কই? ফারিন সব সময় দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতো। ফারিনের কথার পিঠে তেমন কিছুই বললো না কোহিনূর বেগম, কেবল মেয়েটার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বললো ” যেখানেই থাকো আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক।

ফারিন এবার শ্যামলা বানুর দিকে এগিয়ে এসে বললো ” ভালো থাকবেন।

এরচেয়ে বেশি কিছু বলার যেন আর কিছুই নেই। শ্যামলা বানু নিজেও কিছু বললো না। এক এক করে সবার সাথে একটু আকটু কথা বিনিময় করলো ফারিন। ছোট্ট জামিয়ার গালে হাত রেখে বলে গেলো তোমার জন্য অনেক গুলো মেকআপ পাঠাবো ঠিক আছে? জামিয়া কেবল অবাক নয়নে ফারিনের দিকে তাকিয়ে রইলো, ঠোঁটে অবশ্য মেকআপ পাওয়ার আনন্দও।

সবশেষে চলে যেতে নিবে ওমনি জুহাইরার দিকে এগিয়ে আসলো সে। জুহাইরা মনে মনে ভয় পাচ্ছে তবে ঠোঁটে যথাসম্ভব সৌজন্যমূলক হাসি রাখার চেষ্টা করছে। ফারিন কাছে এসে জুহাইরার সামনে দাঁড়িয়ে বললো ” তোমার হাসবেন্ড একজন ভালো মানুষ। একজন হাসবেন্ড হিসেবে সে ভালো তুমি চাইলে এটা আমি দলিল করে দিয়ে যেতে পারি।

প্রথম থেকে সে যথেষ্ট চেষ্টা করছে আমাকে বুঝার, আমাকে সময় দেওয়ার, আমাকে মানিয়ে নেওয়ার। কিন্তু একজনের চাওয়ায় কিছু হয় বলো?? সে চেয়েছে ঠিক কিন্তু আমি কখনো এসব বুঝতে চাইনি, আর না চেয়েছি কেউ আমার আশেপাশে আসুক! এ বাড়ির কারো সাথে আমি ইচ্ছে করে সখ্যতা গড়ে তুলতে চাইনি। তোমার হাসবেন্ড ডিভোর্সী, বা প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছে এটা ভাববে না কখনও। মনে রাখবে সে আমাকে ডিভোর্স দেয়নি বরং আমি তাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করেছি। তার একটা চড়ুই পাখির সংসার হবে এটা সে আমাকে হাজারো বার বুঝাতে চেয়েছে আমি বুঝেও বুঝিনি কারণ তাকে আমি চড়ুই পাখির সংসার দিতে পারবো না, দিতে চাইও না। তুমি তাকে একটা চড়ুই পাখির সংসার দিও!

এই প্রথম ফারিনের এতো সুন্দর আর মমতাময়ী কথায় জুহাইরার ভিষন মায়া হলো। কি সুন্দর কথা বলতে পারে মানুষটা। অথচ সব সময় এমন ভাবে চলতো আর বিহেভিয়ার করতো যে তার এতো সুন্দর আচরণ সে-ই কঠোরতার নিচে চাপা পড়ে থাকতো।

প্রতিটা মানুষেরই ভালো মন্দ দুটো দিক থাকে। মানুষ একেক জায়গায় একেকটা আচরণ দেখায়। কে কোথায় কি রকম আচরণ করবে বা দেখাবে সেটা ব্যক্তি নিজের উপর ডিপেন্ডেবল। মানুষের কঠোরতা দেখে নেওয়া মানেই এই না যে সে ভালো আচরণ করতে পারে না।

ফারিন চলে যাচ্ছে তার না হওয়া সংসার ছেড়ে। সে চায়নি এই সংসার হোক। জীবনে না চাইতেও অনেক কিছু হয় কিন্তু ফারিনের চড়ুই পাখির সংসার হলো না। সে অন্য পাখির সাথে সংসার পাতাতে চায়। যে যার সাথে যেই বাসাতে সংসার পাততে চায় সেখানেই তাদের সংসার হোক, মোটকথা একটা সংসার হোক, যেখানে হাজারো দুষ্ট মিষ্টি খুনসুটি থাকবে, থাকবে রাগ অভিমান, আর কিছুটা দুঃখ। সব মিলিয়ে একটা সংসার হোক প্রতিটা ফারিন আর জুহাইরার।

( প্রথম খণ্ডাংশ সমাপ্ত!)