#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১০ ( দ্বিতীয় খণ্ডাংশ)
#মাকামে_মারিয়া
আকাশের চাঁদটা এখনও জ্বলজ্বল করছে। তখন মধ্যে রাত। জুহাইরা এপাশ ওপাশ করছে। হঠাৎ কোনো এক অজানা কারণে চোখ থেকে ঘুম উড়ে গিয়েছে। বহু চেষ্টা করেও ঘুম আসছে না। পাশে ফিরতেই দেখলো রাফসান প্রশান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। জুহাইরার লোভ হলো, এমন একটা ঘুম তারও দরকার। কিন্তু কেনো যে ঘুম আসছে না।
শুয়া থেকে উঠে দক্ষিণের জানালার পর্দা টা সরিয়ে বসে পড়লো। তিরতিরে বাতাসে গায়ে হালকা ঠান্ডা লাগলেও বেশ ভালো লাগছে। মৃদু আলোয় বাহিরের স্পষ্ট মৃদু বাতাস গায়ে লাগতেই জুহাইরা চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস টেনে নিলো।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখতেই পিছন থেকে কাঁধে কারো স্পর্শ পেলো।কিন্তু থমকালো না, এই স্পর্শ খুব পরিচিত। জুহাইরা চুপটি করে আছে। পিছন থেকে রাফসান জুহাইরার কাঁধে মাথা রাখলো। এক হাতের সাহায্যে হাত খোঁপাটা খুলে দিতেই একরাশ চুল লুটিয়ে পড়লো বিছানায়। প্রায়শই রাফসান জুহাইরার সুন্দর চুলগুলোকে নিয়ে এটা ওটা করে। কখনো বিলি কেটে দেয়, কখনো তেল দিয়ে বেনুনি করে দেয় যত্ন সহকারে।
” এতো রাতে না ঘুমিয়ে আমার বিবি বসে আছে যে?
রাফসানের প্রশ্নে জুহাইরা হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মুচকি হাসার চেষ্টা করে বললো ” ঘুম যদি আপনার বিবিকে ধরা না দেয় এতে কি করার?
“সারাদিন এতো কাজ কামে থাকো; ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় বালিশে মাথা রাখলেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়ার কথা।
জুহাইরা বিরবির করে বললো ” মাথা ভর্তি চিন্তা থাকলে চোখেও ঘুম আসে না প্রিয়তম!
” জুহা মন খারাপ?
” কি যে বলেন! মন খারাপ কেন হবে? ঘুম উবে গেলো তাই তো বসে বসে চন্দ্রবিলাস করছি।
রাফসান ঘোর বিরুদ্ধিতা করে বললো ” এ কেমন চন্দ্রবিলাস হচ্ছে আমাকে ছাড়াই? এটা তো নেহাৎ অন্যায়।
রাফসান হুটহাট বাচ্চামু করে অথচ সে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ! তাকে কি আদোও এগুলো খাটে? হয়তো বা খাটে। প্রিয় মানুষের নিকটবর্তী হলে প্রতিজনই বাচ্চা টাইপ হয়ে যায়। জুহাইরা অন্যায় মাথা পেতে নিয়ে বললো ” তবে শাস্তি কি বলুন দেখি?
“একটা গান শুনাও তবে!
” এ মা না না! আমি গান পারি না একদমই। আমার পক্ষে সম্ভব না।
” তাহলে?
” আপনি বরং আমার হয়ে গেয়ে দেন। আপনি আর আমি তো একই তাই না?
রাফসান ফাঁদে পড়লো। জুহাইরা বেশ কায়দা করেই রাফসানকে জব্দ করতে পারলো। রাফসান নিজেই গান ধরলো…………
” পিরিত পিরিত সবাই বলে…!
পিরিতি সামান্য নয়।
কলংক অলংকার করে…
দুঃখের বোঝা বইতে হয়!
পিরিত পিরিত সবাই বলে..
পিরিতি সামান্য নয়..!
কলংক অলংকার করে
দুঃখের বোঝা বইতে হয়..!
কাম হইতে হয় প্রেমের উদয়, প্রেম হইলে কাম থাকে না।
সখী তোরা প্রেম করিও না পিরিত ভালা না……!
” ইশশ কি সুন্দর গাইলেন আপনি!
রাফসান হাসলো খানিক! জুহাইরার কাঁধে মাথা খানা আরো গাঢ় করে রেখে শুধালো ” নেও এবার বলে ফেলেতো কি হয়েছে? কিছু তো হয়েছে একটা।
জুহাইরা এবার থমকালো। কি হবে?! কই কিছু তো হয়নি। সত্যিই কিছু হয়নি কেবল মনের মধ্যে কেমন যেন অশান্তিরা বৈশাখ মাসের অন্ধকার আকাশের মতো গুড়ুম গুড়ুম করছে। কিন্তু আসলেই হয়েছেটা কি সেটাই বুঝতে পারছে না বেচারি। এখন রাফসানকে কি জবাব দিবে?
জুহাইরাকে চুপ থাকতে দেখে রাফসান ফের অতি অধিকার বোধ দেখিয়ে জোরালোভাবে বললো ” আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করতে বারন করেছি জুহা! যাই হোক না কেনো সেটা প্রতিবার নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবে। বিকেল থেকেই তোমার চোখ মুখ ফেকাসে লাগছে। আমার থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে? তোমার চোখ দেখলেই আমি মন পড়তে পারি। মনের আকাশে যে বৃষ্টিরা দৌড়াদৌড়ি করছে সে আমার বুঝতে বাকি নেই।
জুহাইরা হাসার চেষ্টা করলো। বরাবরই রাফসানের অধিকার বোধ ভিষন গোছানো আর যত্নের। যা দেখে বরাবরই মুগ্ধ হয় সে। একটু জোর দিয়েই বললো ” সত্যিই কিছু হয়নি।
রাফসান আনমনেই বলতে লাগলো ” কিছু হয়নি বললেও আমি বুঝি জুহা! আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে আমার ধারণা রয়েছে। কে কি রকম কথাবার্তা বলতে পারে সেটাও আমার জানা। তাদের কথায় তুমি আঘাত পেয়ে থাকলে তাদের হয়ে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
” ছিহহ কি সব বলছেন! দূর! এগুলো কোনো কথা?
” তাহলে এগুলো কি শুনি?
” ছাতার মাথা।
দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো। জুহাইরাকে হাসতে দেখে রাফসানের মন হালকা হলো। খুব বেশি আপসেট না হলে জুহাইরার মুখ থেকে হাসি সরে না এটা রাফসান জানে আর তাই তো আজকের মুখটা দেখেই বুঝে ফেলেছে কিছু একটা হয়েছে। দুজন বসে গল্প শুরু করে দিলো। এক পর্যায়ে রাফসান হুট করেই বলে উঠলো –
” তাহসিনকে দেখছো? কতো স্মার্ট একটা ছেলে। একেবারে রাজপুত্র। মানুষ তো মাঝে মাঝে বিশ্বাস করে না সে আমাদের বংশের ছেলে।
জুহাইরা ছোট্ট করে জবাব দিলো ” হুম!
” আমার সাথে বেশ মিশে ছেলেটা। প্রায় কয়েক বছর আগে যে এখানে এসেছিলো আর আসেনি। এরপর এতোদিনে আজকেই আসলো।
” কেনো আসেনি?
” ওমা আসবে কি ভাবে?? পড়াশোনায় আটকে গিয়েছে তো। পড়াশোনা নিয়ে অনেক সিরিয়াস। আর অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টও সে। যেমন দেখতে তেমন তার আচরণ। খুবই ভদ্র।
কেনো জানি এসব প্রশংসা জুহাইরার মনপুত হচ্ছে না। রাফসানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবারও বাহিরে তাকালো সে।
রাফসান নিজের মতো করে গল্প কাহিনি বলতেই লাগলো।
জুহাইরা এবার কৌতূহলী হয়েই জিজ্ঞেস করে বসলো ” আচ্ছা তবে এ বাড়িতে আসার পর তো মেঝো কাকাদের কথা শুনিনি কখনো।
রাফসান দুহাতে মুখ মুছলো! মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো সেসব বহু কাহিনি! অন্য সময় বলবো কেমন?
জুহাইরা মাথা নাড়লো একটু। দু’জনেই এবার ঘুমানোর চেষ্টায়। ঘুমাতে হবে রাত অনেক হয়েছে। রাফসান শুয়ে পড়েছে সাথে জুহাইরাও।
___________
কুচকুচে অন্ধকার, আশেপাশের কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হুরহুর করে ঘামছে জুহাইরা। সামনে কেউই একটা দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা স্পষ্ট নয়। কিন্তু কেমন ভয়ংকর লাগছে । জুহাইরা ভিষন চেষ্টা করছে মুখ খুলে জিজ্ঞেস করতে তুমি কে?
কিন্তু না পারছে না। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। নিজের মধ্যেই ছটফটানি বেড়ে চলছে। হাত পা অসাড়তায় জমে যাচ্ছে। চিৎকার করে কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করছে কিন্তু না পারছে না।
ছায়ামূর্তি টা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ভয়ে কুচকে থাকা জুহাইরা পিছনের দিকে যেতে যেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো। প্রচন্ড ভয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে কিন্তু কোথাও কোনো কিছু নেই পালাবার মতো। অন্ধকারে হাতড়ে মরছে সে।
” আর কতোবার পালাতে চাও??
ভয়ংকর এই আওয়াজে জুহাইরার কান গরম হয়ে গেলো। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করতে চেয়েও পারছিলো না। মনে হচ্ছিল মুখের মধ্যে কোনো কিছু চেপে ধরে রেখেছে।
মনে মনে দোয়া আওড়াচ্ছিলো। কিন্তু দোয়াও অর্ধেক অর্ধেক পড়তে পারছে। সম্পূর্ণ দোয়া পড়া হচ্ছে না। মাঝে দিয়ে ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে।
ছায়ামূর্তি টা এবার জুহাইরার একেবারে নিকটে চলে আসলো। নিজের ভয়ংকর ভাবমূর্তি নিয়ে জুহাইরার দিকে হাত বাড়াতে নিবে ওমনি জুহাইরা চেচিয়ে উঠলো
” কাছে আসবেন না।
ছাড়ুনননননন, ছেড়ে দিনননননন!
চলবে………..