অন্তহীন সন্ধ্যা পর্ব-১৩+১৪

0
1
অন্তহীন_সন্ধ্যা #সূচনা_পর্ব #মাকামে_মারিয়া

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১৩
#মাকামে_মারিয়া

অতিমাত্রায় কল্পনায় ডুবে থাকা মানুষদের জন্য দুনিয়া টা একটু কঠিনই বটে। রাফসান সত্যি সত্যিই এসেছে, কিন্তু সামান্য নেনো সেকেন্ড এর জন্য জুহাইরার চোখের আড়াল হয়েছিল কেবল ঠিক এ কারণেই মেয়েটা অস্থির হয়ে গেলো। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সে আসলেই এসেছে নাকি স্বপ্ন ছিল!

” আমার কাপড়চোপড় কিছু আনছো?

রাফসান এসেছে এই খুশিতে জুহাইরা আত্মহারা কিন্তু তাও চোখে মুখে অভিমান ফুটিয়ে রেখেছে। ফুলেফেঁপে উঠে বললো ” আপনার কাপড় কেনো আনতে যাবো?? আপনি আসবেন আদোও এটা জানতাম আমি??

” জানো না কেন?? কেমন বিবি তুমি? বরের খুঁজ খবর রাখো না।

রাফসান ইচ্ছে করে মেয়েটার রাগে আগুন ঢেলে দিলো। জুহাইরাও ফুঁসে ওঠে বললো ” বেশি বেশি করছেন কিন্তু! ফোন-টোন একটা দেওয়া যেতো না নাকি?? আব্বায় আমারে একা নিয়া আসতে হলো কেনো? উচিৎ ছিল আপনারও আসা।

” এই যে আসলাম তো! বাচ্চামো করো না। কাজের অনেক চাপ! তাও বউটা রাগ করবে বিধায় কোনো রকম দৌড়ে আসলাম।

জুহাইরা জানে,বুঝেও! রাগটা তো কেবল উপরের। মন তো সবই জানে। তবে নারী রাগ করে বেশি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। ভালোবাসায় কমতি দেখা দিলেই তাদের রাগ বাড়তে থাকে তিরতির করে।

” কাপড়চোপড় কি কিছু দিবা? ফ্রেশ হওয়া দরকার।

” আমি কি আপনার কাপড় আনছি নাকি?

” তাহলে তোমার কাপড় দাও! প্লাজু, পেটিকোট, কামিজ! পড়ে বসে থাকি! কি করার আর!

না চাইতেও রাফসানের দুষ্ট কথায় জুহাইরা শব্দ করে হেঁসে উঠলো। হাসতে হাসতেই লাগেজ থেকে কাপড় নামিয়ে দিলো। সাথে করে একসেট কাপড় নিয়ে এসেছিলো অবশ্য।

গ্রামের বাড়ি। ঘর হতে বের হয়ে জুহাইরা মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে রাফসানকে নিয়ে টিউবওয়েল গিয়েছে। রাফসান অবশ্য এই রাত করে জুহাইরাকে বারন করেছে বের হতে কিন্তু এই অন্ধকার রাতে জুহাইরাও তাকে একা ছাড়তে রাজি নয়।

টিউবওয়েলের কাছাকাছি আসতেই একটা ব্যাঙ লাফ মেরে জুহাইরার পায়ে এসে পড়লো। অন্ধকার বিধায় একটু ভয়ই পেলো সে। হঠাৎ চিৎকার করে ওঠায় সুলাইমান মিয়ার কানে বাজলো। তিনি বড়গলায় জিজ্ঞেস করলো ” বাহিরে কে রে? জুহা মা বাহিরে গেলি নাকি?

জুহাইরা ইতস্ততবোধ করলো। সবাই শুয়ে পড়েছিলো বিধায় রাফসান যে এসেছে এটা কেউই টের পায়নি। কাজ শেষ করে জুহাইরা ঘরে ঢুলে জানালো রাফসানের আসার কথা। এ কথা শুনে লিলি বেগমের আত্মা শুকিয়ে গেলো। জামাই এসেছে! কিন্তু এই রাতে কি খেতে দিবে তাকে? সবার খাওয়া শেষ এ অবিশিষ্ট কি বা থাকে? আর এগুলোকে কি জামাইয়ের পাতে দেওয়া যায়? জামাইকে খাবার দিতে হয় মস্ত বড় আয়োজন করে সাজিয়ে।

মায়ের মুখের অবস্থা দেখে জুহাইরার কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলো না।।মায়ে কাছে এসে শান্তনা দেওয়ার স্বরে বললো ” ঘুমিয়ে যান আম্মা! খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

” মাইয়া বলে কি? জামাই কি না খেয়ে থাকবো নাকি রে?

” আহা আম্মা! আপনি ঘুমান! আমি দেখতেছি।

লিলি বেগম চিন্তা মুক্ত হতে পারলেন না। মেয়ে কি দেখবে কে জানে? জুহাইরা রুমে এসে দেখলো রাফসান ল্যাবটপে মুখ গুঁজেছে। সারাক্ষণ এ কাজ, ও কাজ করতে করতে দিন যায় তার। মাঝে মাঝে মুখ ফোলায় জুহাইরা, তখন অবশ্য এটা ওটা বলে শান্তনা দিয়ে দেয়। মেয়েদের মন নরম, একটু মায়াময় বাক্যেই মন গলে যায়। আবার রাগ করতেও সময় নেয় না এরা।

তখন জুহাইরার জন্য যেই খাবারটা আলাদা করে ঘরে দিয়ে গিয়েছিল। সেটাই রাফসানের সামনে এনে দিলো সে। রাফসান আড়চোখে তাকালেও কিছু বললো না। মনোভাব বুঝতে অসুবিধা হলো না জুহাইরারও।

হাতটা ধুয়ে এসে খাবার মেখে রাফসানের মুখের সামনে লোকমা তুলে দিলো। রাফসান মুচকি হেঁসে জিজ্ঞেস করলো ” মন পড়তে পারো ভালো!

” তা পারবো না কেনো? নিজের মানুষের মন পড়া খুব কঠিন কিছু নয়। এই পড়টা অবশ্য সহজ,কোথাও আটকাতেও হয় না। ক্লাসে রিডিং পড়তে গিয়ে আটকে যাওয়া মেয়েটাও তার প্রিয়জনের মন পড়তে গিয়ে আটকায় না।

কথা হলো, আড্ডা হলো, খাওয়া হলো, ভালোবাসা আদান-প্রদান হলো। একটি রাত কেটে গিয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর সকাল হলো। বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে রাফসানকে দেখে তো মহাখুশি। জামিয়া এসে কোলে উঠে পড়লো।

” ভাইয়া আমার জন্য চকলেট আনো নাই?

” কে বললো আনি নাই?? সব চকলেট খেয়ে নিয়েছে তোমার রাক্ষসী পঁচা জুহাপু!

রাফসানের কথায় জামিয়া চোখ বড়বড় করে তাকালো তার দিকে। কই জুহাইরার উপর রাগ দেখাবে কিন্তু তা না। জুহাইরাকে নিয়ে একদম পঁচা কথা শুনতে পারে না বাচ্চাটা।

” তুমি পঁচা কথা বলতেছো ভাইয়া! জুহাপু কখনো আমার চকলেট খেয়ে নেয় না। আমি তোমার কোলে বসবোই না তুমি পঁচা, মিথ্যা কথা বলো। জুহাপু বলছে মিথ্যা কথা বলা ভালো নয়, পঁচা লোক মিথ্যা কথা বলে।

রাফসানে মাথায় হাত! এই পিচ্চিকে এমন ট্রেনিং দিয়েছে জুহাইরা এগুলো কি আর জানতো নাকি রাফসান। জামিয়া, আর জুহাইরার ছোট দুটো ভাতিজি ইতি বিথি, ওদেরকে অনেক গুলো চকলেট এনে দিলো জুহাইরা। রাফসান আসার সময় পরিবারের সবার জন্য জামা কাপড় নিয়ে এসেছে। শশুর শাশুড়ী, ভায়রা বউ,তার মেয়ে, ছোট শালা আর শালি লায়লার জন্য। যদিও এগুলো ঈদের আগেই দেওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু ব্যস্ততা আর সুযোগ সুবিধার জন্য পেরে ওঠেনি।

____________

দুটো দিন থেকেই তিনদিনের মাথায় চলে আসতো হলো বাপের বাড়ি ছেড়ে শশুর বাড়িতে। এতো তাড়াতাড়ি চলে যায় দিনগুলো চোখের নিমিষেই কেটে গেলো দুটো দিন। অথচ শশুর বাড়িতে যেন একটা দিন কাটতেই বহুযুগ মনে হয়।

এ বাড়ির সবাই অবশ্য গিয়েছিল দাওয়াত রক্ষা করার জন্য। শুধু শ্যামলা বানু যায়নি। তিনি বাড়ি থেকে বের হয় না অতি জরুরি না হলে। বদিউর সহ সবাই গিয়েছে। তাহসিনও গিয়েছে। কিন্তু তার আলাদা কোনো হেলদোল নেই দেখে জুহাইরা স্বস্তি পেলো। জামিয়া বাবাকে দেখেই মহাখুশি। বদিউর মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ” মা আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারলা কেমনে?

” কেমন কেমন করে জানি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম আব্বু! কিন্তু তোমাকে মিসও করছি।

বদিউর হাসলো। মেয়েটা প্রথম প্রথম একেবারে গায়ের সাথে লেগে থাকতো, তখন কি যে মুসিবতে পড়তে হতো। তাকে রেখে কোথাও নড়তে পারতো না। এখন আর আগের মতো করে না, অবশ্য বড় হওয়াতেও আরেকটু গা ছেড়েছে।

আলসে বিকেলে বিছানায় শুয়ে আছে জুহাইরা।।একটু আগেই এসেছে, শরীর মন দুটোই ক্লান্ত। রাফসান বাড়ি ফেরেনি। ওখান থেকেই দোকানে চলে গিয়েছে। বাকিরা অবশ্য বাড়িতে এসেছে। মাথার মধ্যে এটা ওটা ঘুরছে, হুট করেই চোখ লেগে আসলো মেয়েটার।

কিছুসময় পর হালকা শোরগোল শুনে বিছানা ত্যাগ করলো। মনে হচ্ছে কেউই এসেছে। এলোমেলো পায়ে হেঁটে ড্রয়িং রুমে উঁকি দিতেই দেখলো দুই তিনটে অচেনা মুখ।

শ্যামলা বানুর সাথে কোলাকুলি করলো, আর এখন জমিয়ে কথা বলছে। মনে হচ্ছে বহুদিন পর দেখা। জুহাইরাকে দেখতেই ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো ” সই এইটা আমার নাতি বউ!

জুহাইরা বুঝলো বয়স্ক মহিলাটা শ্যামলা বানুর পুরনো দিনের বান্ধবী! মুচকি হেঁসে সালাম কালাম করলো। অতঃপর রান্নাঘরে ছুটলো নাস্তার ব্যবস্থা করতে। তবে ঠোঁটের কোণে হাসি, আর বিরবির করে ভাবছে নীতুটার সাথেও হয়তো বুড়ী কালে আমার এমন ভাবে দেখা হবে। তখন আমি আবার নাতি বউদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিয়ে দিবো। এককালে ছয় সাত ঘন্টা চোখের সামনে থাকা বন্ধুগুলোকে ছয় সাত বছর পরেও দেখা মিলে না।

চা বিস্কুট নিয়ে আসলো জুহাইরা। সবাইকে দিতে দিতে খেয়াল করলো সাথে একটা মেয়ে আছে। খুব সম্ভবত জুহাইরার বড় হবে। কিন্তু দেখতে ভিষন মিষ্টি, আর কেমনে চুপসে বসে আছে। ফর্সা মুখটা লাল টকটকা হয়ে আছে। আচ্ছা মেয়েটা কি কোনো কারণে লজ্জা পাচ্ছে?

জামিয়া কোথা থেকে দৌড়ে এসে চা চেয়ে বসলো। জুহাইরা আরও এক কাপ চা আনতে যাবে ওমনি সেই বসে থাকা মেয়েটা নিজের চায়ের কাপ জামিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো।।জামিয়া অচেনা কারো সাথে হুট করে মিশতে পারে না আর তার থেকে কিছু নেওয়া তো দূরে থাক। তাই হাত গুটিয়ে বসে জুহাইরার দিকে তাকিয়ে রইলো। জুহাইরা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো ” আপনি এটা খান।।আমি জামুর জন্য নিয়ে আসছি।

মেয়েটা আর নড়লোও না। ঠিক যে ভাবে বসে আছে ও ভাবেই রইলো। কথাবার্তার এক পর্যায়ে জানা গেলো মেয়েটা হলো শ্যামলা বানুর সাথে দেখা করতে আসা বান্ধবীর বোনের মেয়ে। বয়স আনুমানিক ছাব্বিশ সাতাশ হবে। তবে ডিভোর্সী। মা মারা গিয়েছে বহু আগে, বাবা আরেক বিয়ে করে সংসার পেতেছে, দায়িত্ব হাসিল করার জন্য মেয়েটাকে ষোলো বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দিলো এক ছোকরার সঙ্গে। কিন্তু সংসার টিকেনি। এরপর থেকে সে এই খালার সঙ্গে থাকে।

” তোমার নাম কি বোন?

কোহিনূর বেগমের প্রশ্নে মেয়েটা একটু নড়েচড়ে বসে শান্ত কন্ঠে বললো ” ফুলমতি! সবাই ফুলি কইয়া ডাকে!

জুহাইরার মুখের হাসি প্রশস্ত হলো। মানুষের সাথে তাদের নাম গুলো কি সুন্দর মিলে যায়, এই যেমন মেয়েটা দেখতে একদম ফুল, আর নামটাও কি সুন্দর মিলে গেলো!!

বহু কথাবার্তা হলো, জুহাইরা এক কোণে দাঁড়িয়ে সব শুনলো। অবশেষে বুঝলো মেয়েটাকে ইচ্ছে করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। মূলত দেখানোর জন্য আনা হয়েছে, তাও বদিউরের জন্য। কিন্তু আদোও সে রাজি হবে বিয়েতে? এ অব্দি বহু মেয়ে দেখানো হয়েছে তাকে কিন্তু তার কথা সে বিয়েই করবে না।। জুহাইরা ভাবছে এবারও কি না করে দিবে?? ওমন সুন্দর একটা পুতুলের মতো দেখতে মানবীকে কি ভাবে প্রত্যাখান করবে সেটা জুহাইরা নিজ চোখে দেখতে চায়।

চলবে…………

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১৪
#মাকামে_মারিয়া

বিষন্ন মন আর চেহারা নিয়ে বসে আছে বদিউর। কিছু দূরেই ছোট্ট পাখির মতো মেয়েটা ঝাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মিষ্টি মুখো সেই চেহারা দেখলেই বদিউর অতীতে হারিয়ে যায়। মেয়েটা দেখতে একেবারে মায়ের মতো হয়েছে, মায়ের চোখ, নাক, হাসি! কি ভিষন মিষ্টি দেখতে! কিন্তু এই মিষ্টি দৃশ্যটা দেখে মন শান্ত হচ্ছে না তার। বরং মেয়ের পানে তাকালেই মন কেঁদে ওঠছে এই ভেবে যে মেয়ের মুখের এই হাসি কতকাল থাকবে? কতোকাল দেখতে পাবে?

বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। বদিউরকে বিয়ের কথা জানানোর পরেই বড়সড় ভাবে ধমকে উঠলো সে। মায়ের মুখের উপর কথা বলে না কেউই। আর আজ কি না ধমকেই উঠলো। রাফসান বাড়িতে এসেই বদিউরের রুমে ঢুকে পড়লো।

” কাকা! তোমার সাথে সব সময় বন্ধুর মতো চলেছি। তাই একটু কথা বলি আমি?

বদিউর জানে রাফসান বিয়ে নিয়ে বলতে আসছে। ওই বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছে নেই, শুনারও ইচ্ছে নেই কিন্তু রাফসানকে প্রত্যাখান করারও সাহস নেই। তাই চুপটি করে রইলো। মাঝে মাঝে চুপ থাকাই সম্মতি প্রকাশের লক্ষণ ভেবে রাফসান বলতে শুরু করলো ” দাদী ভিষন কষ্ট পেয়েছে তোমার ব্যবহারে। ছোট বেলা থেকে তোমাদের কাউকে দেখিনি দাদীর সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে আর আমাদেরকেও সে ভাবেই শিক্ষা দিয়েছো। তবে আজ কেন এমন করতেছো বলো?

বদিউর অসহায় কন্ঠে শুধালো ” আমার মেয়েটা??

রাফসান বদিউরের দুটো হাতে ধরে অতন্ত্য শান্ত কন্ঠে বললো ” মেয়ের মা যেহেতু নেই তাই মায়ের মতো আদর যত্নে রাখবে এমনটা বরং আমরা আশা না করি! অতি আশায় হতাশ হতে হয়। তাছাড়া তুমি যেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছো যে তোমার মেয়েকে নতুন মা কতোটা করবে! আচ্ছা আমরা তো আছি না?? জুহা নিজেও তো জামিয়াকে কতোটা যত্নে রাখে!

” কিন্তু?

রাফসান থামিয়ে দিয়ে বললো ” কোনো কিন্তু না কাকা। তোমার মেয়ের কপালে যদি মায়ের ভালোবাসা থাকতো তবে তার মা’কে আল্লাহ নিয়ে যেতো না। ওর কপালে যতটুকু সুখ লেখা আছে ততটুকুই পাবে, মা থাকুক আর না থাকুক!

বদিউরের মাথা ঠান্ডা হলো কিন্তু মনের মধ্যে তখনও খুঁতখুতে ভাব রয়ে গেলো। রাফসান তার হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেলো শ্যামলা বানুর কাছে। উদ্দেশ্য দাদীর সাথে কাকার ভাব করিয়ে দেওয়া এবং পাশাপাশি বিয়ের বিষয় টা নিয়ে আলোচনা করা।

রুমে ঢুকেই দেখলো এখানে সবাই উপস্থিত। সবাই মূলত আলাপ আলোচনা করছে আর শ্যামলা বানুকে শান্তনা দিচ্ছে। বদিউর এসে চুপটি করে মায়ের গা ঘেঁসে বসে পড়লো। মাথা নিচু করে রাখা, শক্ত পোক্ত গায়ের ইয়া লম্বা পুরুষ, যে কি না মায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসে আছে।মা কি তখনও রেগে থাকতে পারে?? শ্যামলা বানু রাফসানের দিকে তাকাতেই রাফসান চোখের ইশারায় কিছু বুঝালো। ইশারা বুঝতে পেরে শ্যামলা বানু ছেলের মাথার একঝাঁক চুলে হাত ডুবিয়ে দিতেই বদিউর ফুপিয়ে কেঁদে ওঠলো। অশান্ত মনকে এবার আর মানাতে পারলো না। কতশত কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলো সবকিছুর বাঁধ ভেঙে গেলো।
মানুষ বোধহয় এমনি,একটু আহাল্দের ছুঁয়া পেলেই নিজেকে আরও ভেঙ্গে চুড়ে দেখিয়ে দেয়।

শ্যামলা ছেলের মাথাটা টেনে নিজের কোলে রাখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। ছেলেটা ভিষন বউ পাগলাটে ছিল। প্রথম যখন মেয়েকে দেখে আসে তখনই কি খুশি,মুখ থেকে হাসি যেন সরেই না। বাড়িতে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো এই মেয়েকে ছাড়া সে কখনও বিয়েই করবে না। দরকার হলে চিরকুমার থেকে যাবে। এই পাগলাটে ছেলেকে মেয়ে উপহার দিয়ে বউ চিরতরে বিদায় নিয়েছে। সে-ই থেকে বিয়ের কথা মাথায় আনবে তো দূরে থাক বাড়ির কেউই মুখে পর্যন্ত আনতে পারেনি। কিন্তু আর কতকাল এ ভাবে?? মৃত মানুষের জন্য দোয়া করা যায় কিন্তু অপেক্ষা নয়, কারণ জীবিতদের ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলেও মৃতদের থাকে না।

হুট করে রুমে ঢুকেই বাবাকে কাঁদতে দেখে জামিয়া ভরকে গেলো। বাবাকে আদোও কাঁদতে দেখেনি মেয়েটা। ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো ” আব্বু তুমি কান্না করছো কেনো? তোমার আম্মু কি তোমাকে বকা দিয়েছে?
আমার তো আম্মুও নাই আর আমাকে কেউই বকাও দেয় না তাই আমি কাঁদিও না।

মেয়ের কথা বদিউরের কান্না বেড়ে গেলো। ফোপাঁতে ফোপাঁতে মেয়েকে বুকে টেনে নিলো। বাবার কান্নায় এবার সত্যি ভয় পেলো। ছোট্ট ফুলটা জানতো, আম্মু বকা দিলে মানুষ কাঁদে, আর চিপস চকলেট খেতে না দিলে কাঁদে। কিন্তু বাবারা কেন কাঁদে? সে-ই প্রশ্ন তো তার জানা নেই। তবে বাবার কান্নায় এবার নিজেও কাঁদতে শুরু করলো। কিন্তু সে জানলোই না সে কেনো কাঁদছে। তবে এটা বুঝলো চিপস চকলেট না পেয়েও কান্না করা যায়, দুনিয়ায় কান্না করার মতো আরও অনেক কারণ রয়েছে যে।

উপস্থিত সবার চোখ ভিজে আসলো সেই কান্নারত অবস্থা দেখে। কেউই কাউকে থামতে বললো না। সবাই যার যার মতো অশ্রু বির্সজন দিলো। কান্নাকাটি শেষ হলো। বদিউর জানালো বিয়েটা এবার সে করছে। সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো!

তাহসিন পাশ থেকে গলা পরিষ্কার করে বললো ” যাক বড়ভাই আর কাকার বিয়ে করা শেষ হলো এবার আমার সিরিয়াল ক্লিয়ার হলো।

সবাই একদফা হাসলো। রাফসান তাহসিনের পিঠে থাপ্পড় মেরে বললো ” আমরা কি তোকে আটকে রেখেছিলাম বিয়ে না করতে?

” করোনি। তাও তো একটা মানবতা আছে না? সমাজ বুঝতে হয় তো মিয়া।

দুষ্টমির ছলে তিন্নি নিজেও আনমনে বলে উঠলো ” ভাইয়া বিয়েটা করে নিলেই আমার রাস্তা ক্লিয়ার হয়।

ওমনি সবাই মিলে তিন্নিকে চেপে ধরলো। তোর বয়স হয়েছে? বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেলি? সংসার করতে পারবি?? ইত্যাদি ইত্যাদি কতো কথা। তিন্নিও কম যায় না। সে গলাবাজি করে বলতেই থাকলো সে এখনো ছোট নেই। আমি ক্লাস নাইনে, আর একটা বছর চলে গেলেই তোমাদের গ্রামের অনুযায়ী আমার বিয়ের বয়স পাড় হয়ে যাবে।

এ ভাবে কয়েক দফা দুষ্ট মিষ্টি তর্কবির্তক চললো। সবাই যার মতো নিজস্ব প্রস্তুতি নিতে লাগালো বিয়ের। বিয়ে তো আর ততটাও আয়োজন করে হবে না। আর ওদিকে মেয়ের পক্ষের লোকও একেবারে সল্প।

রাতের খাবার শেষ করে, সব কিছু গুছিয়ে জুহাইরা রুমে আসলো।।আজকের দিনটা বেশ শান্তি পূর্ণ মনে হলো। সবার চোখ মুখ উজ্জ্বল। বাড়িতে সবাই হাসিখুশি থাকলে একটা আলাদা আনন্দ কাজ করে। জুহাইরার ঠোঁটের কোণেও মিষ্টি হাসি। রুমে ঢুকে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে চলছে। হাতও চলছে শুকনো কাপড়রের বাজে। মেয়েটার মিষ্টি চাহনী আর হাসি দেখে রাফসান আড়মোড়া ভেঙ্গে মেয়েটাকে এক হাতে কাছে টেনে নিলো।

” আহা ছাড়ুন! কাজটা শেষ করি।

” আজকে এতো খুশি লাগছে কেন?

” বাড়িতে বিয়ে, খুশি হবো না?

” বাড়িতে বিয়ে,বিয়েটা কিন্তু তোমার নয়। মানুষ নিজের বিয়েতেও এতো হাসে না। তুমি হাসছিলে নিজের বিয়েতে?

” আপনিই তো বললেন মানুষ নিজের বিয়েতে নাকি হাসে না তবে আমি কেন হাসবো?

রাফসান হার মানলো। এ মেয়ের সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা সম্ভব নয়। জুহাইরা ছাড়া পেয়ে আবারও কাপড় বাজ করতে লাগলো। রাফসান জিজ্ঞেস করলো ” হবু চাচী শাশুড়ী দেখছো?

জুহাইরার হাসি প্রশস্ত হলো। বিরাট হেঁসে বললো ” হুম দেখেছি তো! মাশা-আল্লাহ এতো সুন্দর! একেবারে পুতুল!

” আমার বিবির চেয়ে বেশি সুন্দরী তো একদমই না।

জুহাইরা চোখ রাঙালো। মুখে বললো ” এটা বেশি বেশি বলে ফেললেন। কই উনি আর কই আমি! যে যাইহোক এতো সুন্দর আর মিষ্টি মেয়েটাকে চাচী ডাকতে হবে এটাই মানতে পারতেছি না।

” এহ! আমি আর আমার কাকাও কতো স্মার্ট দেখো না দেখতে প্রায় সমবয়সী। তোমরাও এমন।

জুহাইরা হাসলো। হেঁসেই বললো ” আপনাদের সম্পর্কে নিশ্চিত গড়মিল আছে। আমার কেমন জানি বুঝতে অসুবিধা হয়।

রাফসান জুহাইরাকে থামিয়ে দিলো। ওসব কথায় পাত্তা না দিয়ে মেয়েটাকে কাছে টেনে নিলো। ফিসফিসিয়ে বললো ” এতো কিছু বুঝতে হবে না বিবি। আমাকে বুঝলেই এনাফ!

চলবে…………