#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১৮
#মাকামে_মারিয়া
দোচালা টিনের ঘর, এতোক্ষণ তীব্র রোদে ঘরময় তাপে পোড়ে যাচ্ছিলো যেন। এরপরই রোদের ঝিলিক ধীরে ধীরে নিভে আসলো। আকাশে ঘনকালো মেঘ জমলো। প্রচন্ড ধুলো উড়িয়ে বাতাস বইছে, উড়াধুড়া বাতাসে গ্রামের বউঝিরা ভিষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লো, কারো উঠোন ভর্তি ধান, কারো আবার খড়কুটো। সবাই জানপ্রাণ দিয়ে সবকিছু সেকেন্ডেই গুছিয়ে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে আর কেউই উচ্চস্বরে কেউই বা মনে মনে জিহবা নাড়িয়ে আল্লাহকে ডাকছে। দোয়া একটাই সব কিছু গুছিয়ে ফেলার পরেই যেন বৃষ্টি নামে। লিলি কিশোরও বাবা মায়ের সঙ্গে ধান ওঠানোর কাজে হাত দিয়েছে। চারদিকে বাতাস হলেও ছেলেমেয়ে গুলো ঘেমে-নেয়ে গোসল করা অবস্থায় হয়ে গেলো গরমে। সব কাজ কাম শেষ করতেই টপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। ছেলেমেয়ে গুলো প্রচন্ড আনন্দে এবার বৃষ্টিতে ভিজবে, ভিজা শরীর নিয়ে আম গাছতলায় আম কুড়াতে যাবে। একটা আম পাওয়া যেন সাত রাজার রাজ্যের রাজা হওয়ার সমান আনন্দ দেয় তাদের।
এদিকে ঝমঝম বৃষ্টিতে দক্ষিণে জানালার পাশে বসে ভাবুক নয়নে বৃষ্টির পানে তাকিয়ে বৃষ্টি বিলাস করছে জুহাইরা। মনে মনে চিন্তাও করছে বাড়িতে কি হাল হলো! সব গুছাতে পারলো কি না! ধানগুলো না আবার ভিজে যায়। ধান ভিজে যাবে ভাবতেই জুহাইরার মনে পড়লো ছোট বেলার এক কাহিনি।
সে বার জুহাইরা গিয়েছে স্কুলে, তখন বৈশাখ মাস। উঠোনে ধান ছড়িয়ে দিয়েই একপ্রকার পালাই পালাই করে জুহাইরা স্কুলে চলে আসলো। লিলি বেগম বার বার করে বারন করেছেন আজকে যেতে হবে না। আসমানের অবস্থা ভালা না, যাইস না আজকে। ধান বের করছি মেঘ বৃষ্টি আইলে সর্বনাশ হইয়া যাইবো। কিন্তু কে শুনে কার কথা? জুহা স্কুল মিস দেওয়া মেয়ে নয়। বাবাকে পটিয়ে চলো গেলো। বলে গেলো একটা ক্লাস করেই চলে আসবে। হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত এর দাগ যেন না লাগে। মেডাম বলছে যে একদিনও স্কুল মিস দিবে না তাকে পুরষ্কার দিবে। এই লোভ কি সামলানো সম্ভব?
ওই সময়টাতে ক্লাসে গেলেই শরীরে অন্য রকম একটা আনন্দময় ভাব চলে আসতো। জুহা দুটো ক্লাস করে ফেললো কিন্তু সে বেমালুম ভুলে বসে রইলো তাকে বাড়িতে যেতে হবে। হাসতে থাকা বান্ধবীদের মধ্যে একজন বললো ” দেখ আসামনের অবস্থা! মাত্রই তো রোদ ছিল। এখন মনে হচ্ছে ঝড়তুফান আসবে রে। ভালোই হলো আজকে সবাই মিলে ভিজে বাড়িতে যাবো।
বান্ধবীর মুখে বৃষ্টির কথাটা শুনেই দ্রুত আসমানের দিকে তাকালো। জুহাইরা থমকে গেলো হঠাৎ বুকটা লাফিয়ে উঠলো। তার মনে পড়লো বাড়িতে আম্মা একা, ভাই বোন গুলো তখনও ছোট, আব্বা গেছে কাজে। ভাবির পিচ্চি পিচ্চি দুটো দুধের বাচ্চা! কেমনে কি করবে?
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে মেয়েটা দৌড়াচ্ছে আর আল্লাহকে ডাকছে যেন বৃষ্টি না আসে। দৌড়ায় আর আকাশের দিকে তাকায়। আকাশও তখন অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকার হচ্ছিল। অতি ভয় আর দৌড়ানোর ফলে জুহার বুক কাঁপছিলো। দৌড়াতে দৌড়াতে একটা ইটের সাথে উষ্ঠা খেয়ে মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। পায়ের আঙুল কেটে রক্ত ছুটলো, দেখেও থেমে থাকলো না। প্রানপণ দিয়ে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই আকাশ তার সমস্ত গোমর ভাব কেটে দিয়ে প্রচন্ড ঝমঝম আওয়াজ করে নেমে পড়লো।
উঠানে তখনও একদলা ধান রয়ে গিয়েছিল। সবাই অনেক চেষ্টা করেও বৃষ্টি আসার আগে গুছাতে পারেনি। লিলি বেগম চোখ মুখ খিঁচে একবার জুহার দিকে তাকালো। পানি থেকে ছেঁকে ছেঁকে ধান গুলো তুললো, জুহা হাত বাড়ানোর সাহসও পেলো না কারন তার মায়ের এমন ভয়ংকর দৃষ্টি মানেই যে একদম হাত দিবি না বলে দিলাম”এমন টাইপ।
প্রচন্ড ভয়ে মেয়েটা বৃষ্টিতে ভিজেই ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে কানতে লাগলো। লায়লা আর কিশোর তখন ঘর থেকে উঁকি ঝুকি দিয়ে বোনকে দেখে। তাদেরও বুঝতে বাকি নেই আজকে বোনের পিঠে উত্তমমধ্যম পড়বে। বোনের উপর থেকে রাগ যেকোনো সময় তাদের উপরও চলে আসতে পারে ভেবেই দুটো বই নিয়ে ভালো বাচ্চার মতো বারান্দায় বই নিয়ে বসে পড়লো।
প্রায় আধাঘন্টা শেষ এ লিলি বেগম বৃষ্টিতে ভিজেই সব কিছু গুছালো।।অতঃপর জুহাকে ডেকে বললো এদিকে আয়। জুহা মিনমিন করে বললো ” না আম্মা আপনি মারবেন।
” মারবো না এদিকে আয়।
জুহা ছোট ছোট পা ফেলে মায়ের সামনে যেতেই খপ করে হাতটা ধরে নেয় লিলি, ওমনি জুহাইরার বুকটা ধক করে ওঠে। বুঝতে বাকি থাকে না আজকে আর মাফ নেই। মনে মনে বাবাকে স্মরণ করে। এখন বাবা থাকলেই রেহায় পেতো হয়তো।
লিলি বেগম রুমে নিয়ে দরজা আটকে দিয়ে ইচ্ছেমতো মেয়েটাকে মারলো। সবটা রাগ মেয়েটার উপর ঝাড়ে। রাগে দুঃখে ক্লান্ত হয়ে বের হয়ে আসে। জুহাইরা এককোনায় বসে গুনগুনিয়ে কান্না করে। তার কাছে এই মূহুর্তে সুলাইমান ছাড়া আর কারো যাওয়ার মতো সাহস পায় না৷
সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ মেয়েটার খবর নেয় না অতঃপর লিলি প্রচন্ড চেচিয়ে কিশোর আর লায়লাকে বলে ” এতো ডাকাইত ভাই বইন হয়?? আমি না হয় রাগ কইরা মারছি, তোরাও খুঁজ খবর নিবি না??
কিশোর ঠোঁট উল্টে মনে মনে বিরবির করে ” হু! এখন তো এডাই কইবা, পরে যদি আমরা কেউই যেতাম তাহলে আমাদেরও এই অবস্থায় করতা।
ছেলেমেয়ে গুলোর সাথে একটু চেচিয়ে লিলি গরম ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে জুহাইরার কাছে যায়। জুহাইরা মায়ের দিকে তাকিয়েই প্রচন্ড অভিমানে দুই ফোঁটা চোখের পানি ফেলে। সে জানতো মা আসবে। মা সব সময় ভুল করলে মারবে তারপর আবার নিজে এসেই আহাল্দ করবে। কিন্তু তখন জুহাইরার অভিমান হয়। ভাত খেতে চায় না। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে ” খুব তো মারলেন। একটু পর আব্বায় ঘরে আসবো এই জন্য এখন আমাকে আদর দেখাতে আসছেন।
এতোক্ষণ খুব ভয় পাওয়া মায়ের সামনে যেন মুখ ফুটে কথা বের হয়ে যায়। লিলি বেগমও হার মেনে নেয় তবে মিথ্যা রাগ দেখিয়ে ধমকায় যেন খাবারটা খেয়ে নেয়। নিজ হাতে খাইয়ে দেয়, দৌড়াতে গিয়ে পা কেটেছিলো ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে দেয়। কাঁথা মুড়িয়ে হাঁটুতে শুয়ে দিয়ে চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
কিশোর আর লায়লা ঠোঁট উল্টায়। মনে মনে ভাবে সে মাইর খেলো আবার সেই আদর পাচ্ছে আমরা কিছুই পেলাম না।
আকাশে প্রচন্ড জোরে বাজ পড়লো, জুহাইরার হুঁশ ফিরলো। একটা মূহুর্তের জন্য সে অতীতে হারিয়ে গিয়েছিল। মায়ের ভালোবাসা আদর শাসন গুলো ভিষন মনে পড়তে লাগলো। মা এখন আদর করে ঠিক কিন্তু ওই যে শাসন ওটা আর নেই। খুব মেরে তারপর যেই আদর টা করতো সেটার মতো তৃপ্তি আসে না এই আদরে। আজকাল খুব বড় অন্যায় করে ফেললেও মা আর মারে না। খুব বেশি হলে একটু ধমকায়। মন চায় মায়ের কাছে গিয়ে বলি ” আম্মা আমি একটা ভুল করি, আপনি আমারে মারেন। তারপর খুব করে আদর করে দিয়েন”। এমনটা বললে আম্মা অনেক হাসবে। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলবে ” তোরেই অনেক বেশি মারছি রে মা। ছোটো গুলোরে এতো শাসন করতে পারি না-ই।
ভালো মন্দ খুঁজ খবর নিতে মায়ের নাম্বারে কল দিলো। সম্পূর্ণ ঘরে একটাই মোবাইল আছে। এটাতেই সবার প্রয়োজনে ব্যবহার করে। রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলো লিলি বেগম।
” আম্মা ধানগুলো ঠিকঠাক নিতে পারছেন?
” হু আল্লাহ রহমতে পারছি মা, আরেকটু হইলেই সর্বনাশ হইয়া যাইতো। শুকরিয়া খোদার দরবারে।
জুহাইরা নিঃশব্দে হাসলো। একটু থেমে বললো ” আজকে যদি ধান ভিজে যেতো কার উপর রাগ দেখাইতেন? কারেই বা মারতেন?
লিলি বেগম হঠাৎ এমন প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলেও হাসলো। ভিষন সহজ সরল তার হাসি। তবে মেয়ের এই কথার ধরন তিনি বুঝলেন।
মায়ের সাথে কথা শেষ করে নিজেকে একটু হালকা লাগলো। রুম থেকে বের হয়ে হাঁটা ধরলো ফুলমতির কাছে যাওয়ার জন্য। মেয়েটা একা কি না! একটু সঙ্গ দেওয়া দরকার।
বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করে ঘরে ঢুকলো কিশোর। পড়নে লুঙ্গি, শরীরে জামা কাপড় নেই। বলিষ্ঠ বুকে পিঠে বৃষ্টির পানি চিকচিক করছে। গামছা হাতে মাথার ভেজা চুল মুছতে নিতেই খেয়াল করলো ফোন বাজতেছে। মায়ের উদ্দেশ্যে হাঁক ডেকে বললো ” আম্মা কল আইতেছে তো ধরেন না কেন?
” আমার হাত খালি নাই। জুহা ছাড়া আর কে কল দিবো। আমি কথা কইছি। ধরে দেখ আবার কি কয়!
হেলেদুলে আলসে পায়ে ফোনটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে রিনরিনে চিকন এক কন্ঠ ভেসে আসলো। প্রথমে মোবাইল স্ক্রিনে খেয়াল করেনি, কন্ঠ শুনেই কান থেকে মোবাইল নামিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার। কৌতূহলী হয়ে কানের পাশে ধরতেই ফের শুনতে পেলো ” কি হলো কথা বলছেন না কেনো? হ্যালো?
কিশোর থেমে গেলো। হঠাৎ কি যেন হলো তার ইচ্ছে করলো সাড়া না দিতে। মন হচ্ছিল আরেকটু মরিয়া হয়ে ডাকুক। মাঝে মাঝে অন্যকে বিরক্ত করতে মন্দ লাগে না। কিন্তু কে এই রমনী? যে এতো সুন্দর করে ডাকে?
চলবে……..
#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১৯
#মাকামে_মারিয়া
আমাকে চিনতে পারছেন? আমি তিন্নি।
” ওহ তিন্নি বেগম!
কিশোর মেয়েটাকে রাগানোর জন্য তিন্নি বেগম বলে ডাকে। তিন্নিও মিছেমিছি রাগ দেখিয়ে বললো ” একদম বেগম বলবেন না আমাকে। আমি এখনো ছোট।
” ছোট হয়ে এতো পাকামো করার তবে কি দরকার শুনি?
তিন্নি থমে গেলো। কি পাকামো করলাম আমি? উনি কি আমাকে অপমান করলো? মলিন মুখে চুপটি করে ফোনটা কানে নিয়ে বসে রইলো। কিছু বললো না। ফোনের ওপাশে রমণী যে মনমরা হয়ে বসে আছে সেটা বোধহয় কিশোরের মন বুঝতে পারলো। কিশোর খোলা বারান্দায় এসে বসলো। বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ” বৃষ্টি হচ্ছে? তিন্নির বলতে ইচ্ছে করলো ” হুম আমার হৃদয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু বলতে পারলো না। শুধু বললো “না হচ্ছে না।
এরপর আর দুজনের কারোই কোনো কথা রইলো না। চুপটি করে থেকে কলটা কেটে গেলো। তিন্নি হয়তো লায়লার সঙ্গেও কথা বলতো কিন্তু কেনো জানি ওটাও বলতে পারলো না কিশোরকে।
কিশোরের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। বাহিরে বৃষ্টি কিন্তু মেজাজ টা কেমন খারাপ হয়ে আসতেছে যেন। মেয়েলি ব্যাপার গুলোতে সে একেবারেই যেতে চায় না কিন্তু খুব করে টের পাচ্ছে যে তিন্নির প্রতি আলাদা টান অনুভব করছে। যেটা খুবই বাজে একটা অনুভূতি। কিশোর চায় না এমন কোনো কিছু সত্যিই হোক।
___________
রাফসান একটু অসুস্থ বিধায় আজকে দেরি করেই দোকানে যাবে নিয়ত করেছে তাই সকাল আটটা অব্দি সে বিছানায় গড়াগড়ি করছে। জুহাইরা ভোরেই বিছানা ত্যাগ করেছে। রান্নাঘরে গিয়ে ফুলমতি আর জুহাইরা মিলে রান্নার কাজ শেষ করেছে। বদিউর আর রাফসানের বাবাকে খাইয়ে বিদায় করেছে। রাফসান যাওয়ার সময় দুপুরের খাবার টা নিয়ে যাবে।
ফুলমতির সাথে জুহাইরার সম্পর্ক স্বাভাবিক। কোনো রকম ঝামেলা নেই। কিন্তু শ্যামলা বানুর চেহারা যেন কেমন অন্য রকম হয়ে থাকে আজ-কাল। জুহাইরা এসব খেয়াল করেও করে না। হেঁসে হেঁসেই কথাবার্তা চালিয়ে যায়। কোহিনূর বেগম রান্নাঘরে উঁকি মারলো। ফুলমতির পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো ” কি গো ফুলি! তোমার সাথে তো তেমন আলাপ হচ্ছে না। বলছি বদিউরের সাথে তোমার বনিবনা হচ্ছে তো?
ফুলি একটু অপ্রস্তুত হলো। স্মিথ হেসে বললো ” জি ভাবি।
” কি জি ভাবি? সব ঠিকঠাক কি না সেটা বলো?
” জি ঠিকঠাক!
কোহিনূর বুঝলো ফুলি বোধহয় বিস্তারিত আলোচনা করতে চায় না। একবার জুহাইরার দিকে তাকিয়ে শান্ত পায়ে রান্নাঘর ত্যাগ করলো। জুহাইরা এমন ভাবে কাজ করছিলো যেন সে তাদের কথা একেবারেই শুনছে না। পরে আবার কি না কি ভেবে বসে।
” কাকী আপনি বাকিটা গুছিয়ে নেন আমি জামিয়াকে রেডি করিয়ে স্কুলে পাঠাচ্ছি।
ফুলি জুহাইরার হাতটাকে আলতো করে ধরে বললো ” শুনো! একটা কথা বলি কিছু মনে করবে না তো?
জুহাইরা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। ” না না কাকী কিছু মনে কেন করবো বলুন না কি বলবেন।
” আসলে তুমি কিছু মনে না করলে আমি জামিয়াকে রেডি করিয়ে দিয়ে আসি। না মানে বুঝতেই তো পারছো তোমার কাকাই ভাবে আমি উনার মেয়েকে আদর যত্ন করি না। কিন্তু মেয়েটা তো আমাতে অভ্যস্ত না আমি কি বা করবো!
জুহাইরার বেশ অপরাধবোধ জাগলো মনের মধ্যে। আসলেই তো ফুলিকে দেওয়া দরকার ছিল জামিয়ার দায়িত্ব। জামিয়া ধীরে ধীরে ঠিক সহ্য করে নিতো।
” আমি দুঃখিত কাকী। আমার নিজেরই আগে দরকার ছিল আপনার কাছাকাছি রাখতে দেওয়া জামিয়াকে। জুহার কথা শুনে ফুলি চোখের কোণের পানিটা মুছতে মুছতে আলতো করে জরিয়ে ধরে বললো ” আমি এবার অন্তত সংসার টা করতে চাই রে মা। প্রতিটা মেয়েরই সংসার সাজাতে ইচ্ছে করে কিন্তু সে-ই জানোয়ার তো আমাকে সংসার করতে দিলো না। এবার কোনো ভাবেই সংসার ভেঙ্গে যাক সে আমি চাই না।
জুহাইরা দু’হাতে ফুলিকে আলতো করে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো ” কাকী চিন্তা করবেন না আমি জামিয়াকে বুঝিয়ে বলবো। জামিয়া খুবই লক্ষী মেয়ে। বুঝিয়ে বললেই সে সব কিছু বুঝে।
ফুলি তড়িঘড়ি করে ছুটলো জামিয়াকে রেডি করাতে। জুহা ফুলির পিছন তাকিয়ে রইলো।।ভাবছে একটা মেয়ের কি পরিমাণে তৃষ্ণা থাকে সংসার করার। অথচ ভাগ্য কি আর সবাইকে সায় দেয়!
ফুলিকে রুমে ঢুকতে দেখেই জামিয়া এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো ” ফুলি মা জুহাপু কোথায়? আমি স্কুলে যাবো না? আমাকে রেডি করিয়ে দিচ্ছে না কেনো?
ফুলি এগিয়ে এসে হাসোজ্জল মুখে বললো ” তোমার জুহাপু তো একটু কাজ করছে আজকে ফুলি মা রেডি করিয়ে দেই?
জামিয়া ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বোধক বুঝাতেই ফুলির মুখের হাসি প্রসস্থ হলো। মনের ভেতর এক অদ্ভুত আনন্দ লাগছে। ফুলি তো খুব করে চায় জামিয়াকে আগলে রাখতে। মেয়েটা ভালো করেই বুঝতে পারছে যে জামিয়াকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখতে পারলেই বদিউরের যোগ্য স্ত্রী হতে পারবে। যদিও বদিউর আজ অব্দি স্ত্রীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ করেনি এবং ওমন করার মতো পুরুষ নয়।
জুহাইরা হাতের কাজ শেষ করে হাত মুছতে মুছতে রুমে ঢুকে দেখলো রাফসান কাঁত হয়ে ঘুমাচ্ছে। এ বেলা অব্দি ঘুমানো লোক সে নয়। জুহা কাছে গিয়ে কপাল ছুঁয়ে দেখলো জ্বর কেমন আছে। তাপমাত্রা মুটামুটি। জুহার স্পর্শ পেতেই রাফসান নড়েচড়ে উঠলো।।জুহার বুঝতে বাকি রইলো না উনার ঘুম খুবই হালকা ছিল।
” ঘুম শেষ হয়নি এখনো?
ঘুম ঘুম চোখে রাফসান বললো ” শরীরে আলসেমি ঝেকে বসেছে।
জুহা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই টেনে তুলে দিলো রাফসানকে। রাফসান উঠে বসে জুহাইরাকে জরিয়ে ধরে বসে রইলো। জুহাইরা চুপটি করে থেকে বললো ” জানেন দাদী না কেমন কেমন করে! আমাকে উনার কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না।
রাফসান ঘাড় উঁচু করে বললো ” হুম তাতে কি হয়েছে?
জুহাইরার মন খারাপ হলো। ভাবলো রাফসান বুঝবে অথচ বুঝলো না। তাই চুপ করেই রইলো। রাফসান জুহাইরার মুখোমুখি বসে মুখ চেপে ধরে বললো ” কি সমস্যা? একদম চুপ করবে না বলে দিলাম। তুমি হচ্ছো আমার তোতাপাখি! সারাক্ষণ যা খুশি বলবা ঠিক আছে? মুখ বন্ধ করলেই মনে হয় আমার দম বন্ধ বন্ধ লাগে। তুমি আজাইরা বকবক করলেও শান্তি লাগে।
” আমি আজাইরা বকবক করি?
” এই যে উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এখন গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে। মাফ চাই! কি বলতেছিলে ওটা বলো?
জুহাইরার মত ছিল সে ওই বিষয়েই কথা বলতে চায়। তাই শান্ত কন্ঠে বললো ” দাদীকে আগে আমি ঔষধ খাইয়ে দিতাম। মাথায় তেল দিয়ে দিতাম, হাত পায়ে তেল মালিশ করে দিতাম। এখন এসব করতে দাদী আমাকে ডাকে না। এমনকি সুযোগও দেয় না। কাকী রে দিয়ে সব করায়।
” এতে মন খারাপ করার কি আছে? তোমার আরও ভালো একটু অবসর থাকতে পারলে।
” দাদী বোধহয় আমার সাথে রেগে আছে তাই তো দেয় না।
” সেটআপ জুহা! একদম ওভার থিংকিং করছো। ফুলিমতি, মানে চাচি তার শাশুড়িকে দেখাশুনা করছে তুমিও বরং তোমার শাশুড়ীর দেখাশোনা করো। করেছো আজ অব্দি শাশুড়ীর দেখাশোনা?
জুহাইরার মনে অপরাধবোধ কাজ করলো। কোহিনূর বেগম প্রথম থেকেই সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে যে কারণে বাড়ির কারো সাথেই তেমন মাখো মাখো সম্পর্ক নেই উনার। জুহার সাথেও সম্পর্কের তেমন আগাগোড়া নেই। প্রয়োজনে কথাবার্তা বলে। তাছাড়া উনি তেমন কারো সাথেই কথাবার্তা বলেই না।
রাফসানকে দোকানে পাঠিয়ে জুহাইরা ধীরে ধীরে পা ফেলে কোহিনূর বেগম এর রুমে সামনে দাঁড়ালো। ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছে। যাবে কি যাবে না ভাবতেই রুম থেকে ডাক আসলো ” দাঁড়িয়ে আছো কেন জুহা আসো ভেতরে?
শাশুড়ী যে টের পেয়ে ডেকে বসবেন এটা তো ভাবেনি সে। দরজা ঠেলে যেতে যেতে ভাবলো যদি জিজ্ঞেস করে কিসের জন্য আসছো তখন কি জবাব দিবো?
” কি হয়েছে কোনো সমস্যা? চোখ মুখ শুকনা লাগছে যে?
” না আম্মা কিছু হয়নি।
” কিছু হচ্ছে না কেন শুনি? খুশির খবর টবর পাবো না বুঝি?
জুহাইরা এবার লজ্জা পেলো সাথে শাশুড়ী প্রতি ভয়টা একটু কমে আসলো। খাটেই চুপটি করে বসে পড়লো। হাত কচলাতে কচলাতে শাশুড়ীর রুমটার দিকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বেশ গুছালো রুমটা। এর আগে প্রয়োজনে আসলেও তেমন খেয়াল করেনি।
আম্মা বসেন আপনার চুলে তেল লাগিয়ে দেই”।
কথাটা ভিষণ কষ্টে জুহাইরা বললো। কষ্টে বললো কারণ ভয় পাচ্ছিলো, না জানি কথাটা শুনে উনার রিয়াকশন কেমন হয়। কিন্তু কোহিনূর বেগম চুপ করেই রইলো। শুকানো কাপড় গুলো বাছ করে রেখে তেল আর চিরুনি নিয়ে জুহাইরার সামনে বসলো। মেয়েটা যেন সাত আসমানের চাঁদ হাতে পাইলো। মনে মনে খুশীতে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছিলো। কোহিনূর শান্ত কন্ঠে বললো ” হঠাৎ শাশুড়ীকে যত্ন করতে ইচ্ছে করলো যে?
” দাদীকে এগুলো করে দিতাম। ইদানীং দাদী এসব করতে দিচ্ছে না। নিয়মের হেরফের হচ্ছে মনটা যেন কেমন করছে তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু আদর যত্ন ভাগাভাগি করি।
জুহাইরা বাঁধ ভাঙা নদীর মতো সব উজার করে বলে দিলো। কোহিনূর বেগম লুকিয়ে মুচকি হাসলেন। যেন এতে উনি ভিষণ খুশী হয়েছে। জুহাইরা তখন মনের আনন্দে শাশুড়ির চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। কোহিনূর বেগম এর হাসি মুখটা দেখতে পেলে বোধহয় আর-ও বেশি খুশী হতো মেয়েটা। পুত্রবধূকে কাছে পেয়ে উনার এই হাসি,তবে কি উনি এতোদিন জুহাকে সহ্য করতে পারতো না শ্যামলা বানুর সাথে? নাকি শ্যামলা বানুকেই তার পছন্দ না!?
চলবে……
#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ২০
#মাকামে_মারিয়া
তোমার শশুরের সাথে আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার পনেরো বছর বয়স। আমার বাবার বাড়ি ছিল বিরাট নামকরা। আমি তখনও ছোট কিন্তু আব্বা ভালো পাত্র হাত ছাড়া করতে চাইলো না। সরকার বাড়ির বড় ছেলে মানে রাফসানের বাবা আমাকে তার বউ করে ঘরে তুললো। মেঝো ভাই আতিকুর আর বদিউর তখনও ছোট। বলতে গেলে আমার হাতেই ওদের বড় হওয়া। রাফসানে কোনো ফুফু ছিল না। বাপ চাচা তিনজনই তারা। আমার শশুর মারা গিয়েছেন রাফসানের বাবা ছোট্ট থাকতেই যে কারনে আমার শাশুড়ী মানে শ্যামলা বানু তিন ছেলেকে নিজ হাতে পেলেপুষে বড় করেছেন বলে তার মধ্যে আলাদা একটা দেমাক থাকতো।
আমি হচ্ছি কিশোরী, কিন্তু শাশুড়ী আম্মা সেটার ধার ধারেনি। আমাকে বেশ নিয়ম শৃঙ্খলার ভেতর আবদ্ধ করে রেখে দিলেন।।আমি তখনও জানতাম না বিয়ে মানে এতো এতো নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। বাবা মায়ের এক প্রকার আহাল্দের ছিলাম বলা যায়। কিন্তু আমার শাশুড়ী ছিলেন ভিষণ কঠোর। কাজে কোনো রকম ভুল হলে তিন বাড়ির লোক ডেকে এনে জোড়ো করতেন সাথে আমার বাপ মা তো আছেই। কেন আমি এই ভুল করলাম? আমার বাপ মা আমাকে কেন শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠালেন না এসবই ছিল তার নিত্যদিনের মুখের বুলি। প্রথম প্রথম আমি লুকিয়ে কান্না করতাম। একদিন তোমার শশুর দেখে ফেলে। মানুষ টা আবার আমাকে ভিষন যত্ন করতেন,বুঝাতেন তার মা একটু কঠোরই যেন আমি মেনে নেন । কান্নারত অবস্থায় আমাকে দেখে একটু রেগে গিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে চেচামেচি করলেন। বললেন ” আম্মা মেয়েটা ছোট একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে হয় না??
আম্মা সেদিন কি বলছিলো জানো?
এতোক্ষণ চুপটি করে সব কিছু শুনতে থাকা জুহাইরা মাথা নাড়িয়ে কোহিনূরের কাছে জানতে চাইলেন কি বলেছিলো?
কোহিনূর বেগম একটু থম মেরে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ” এ এক ভিষন লজ্জার কথা। আম্মা হুট করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে দিলো ছোট্ট মাইয়া? ছোট্ট মাইয়া হইলে বিয়ার আড়াই মাসের মাধ্যেই পেট বাইন্ধা নিতে পারে কেমনে? কামের বেলায় যত বাহানা।
ছিছিছি! সেদিন লজ্জায় শরমে আমি মুখ দেখাবো কি ভাবে বুঝতে পারিনি। কান্না করতে করতে আমি একাই বাপের বাড়ি চলে আসলাম। রাফসানের বাবা হাতে পায়ে ধরে বুঝালো, মায়ের হয়ে ক্ষমা চাইলো আমি তাও এই সরকার বাড়িতে আসবো বলে রাজি হইনি। এমন বাজে কথা হজম করার মতো মন আমার ছিল না। মনে হচ্ছিল লজ্জায় আমি মরে যাই।
বিয়ে দিয়েছে বাবা মা, মরে হলেও মেয়েদের সংসার করতে হয় আর সেখানে আমাকে এই সামান্য কথাটাই বলেছে আর মিথ্যা অপবাদও নয় সত্যিটাই বলেছে তাই এখানে রাগের কিছু নেই। ঠিক এই কথাগুলো আমার প্রতিবেশী চাচী কাকীরা চব্বিশ ঘণ্টা শুনাতো। এক সময় অসহ্য হয়ে আমি আবারও এই সরকার বাড়ির মুখো হই। না হয়েও উপায় ছিল না আমার মধ্যে যে আরেকজনের অস্তিত্ব বেড়ে ওঠছিলো।তবে এর মধ্যে একদিনও আমার শাশুড়ী আমাকে আসতে বলেনি। প্রতিবারই রাফসানের বাবা বলেছে এবং তার হাত ধরেই এসেছি।
জুহাইরা অধির আগ্রহে কোহিনূর বেগম এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এ যেন রুপকথা বিষাদিনীর গল্প শুনছে। কোহিনূর থেমে রইলো মনে হচ্ছে এরপরের কাহিনি বলতে উনার কলিজা কাঁপছে কিন্তু এদিকে জুহাইরার আগ্রহ বেড়েই চলেছে তাই জিজ্ঞেস করলো “তারপর?
কোহিনূর আবারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ” তারপর? তারপর আর কি! আমার কপালে বোধহয় সুখ লেখা ছিল না। এ বাড়িতে আসার পর যে শাশুড়ী ভালো হয়ে গেলো তা নয়। উনি আগের মতোই রইলো বরং আর-ও বেশি ঘ্যান ঘ্যান করতো। গিরস্থালি বাড়িতে কতো কাজ কাম থাকে বলো? সব আমাকে দিয়ে করাতো উনি নিজেও করতো। তাও কোনো লোক রাখতো না। বদিউর ছেলেটাও কম খাটেনি আতিকুর পড়াশোনা নিয়ে থাকতো প্রায় সময়। আব্বাকে চিঠি লিখলাম, জানালাম এ বাড়ির অবস্থা, আমার কষ্ট হয় এটাও জানলাম। আব্বা ফের চিঠি লিখে জানালো ” বেয়াইন বাড়িতে যেহেতু অনেক কাজ আপনি বরং একটা দুটো কাজের মানুষ রাখেন। খরচাপাতি না হয় আমিই দিলাম।
আয়হায় সেই চিঠি যেন ছিল আগুনে ঘী ঢালার মতো। শাশুড়ী তো আগুন হয়ে গেলেন। চিল্লিয়ে তিন বাড়ি শুনালেন ” কি এক জমিদারের মাইয়া আনছি ঘরে। এহন নাকি কামের লোক রাখতে হইবো জমিদারের ছেমরির লাইগা।
ততদিনে আমার সহ্য হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কান্না করতে হতোই আমাকে। এরপর! এরপর যখন আমার মানিক চাঁন দুনিয়ায় আসলো কিন্তু টিকলো না। সে-ই থেকে এই আমি আর কান্না করি না। আর না আমার চোখে আর পানি আসে।বলতে বলতে কোহিনূরের চোখ ভিজে আসলো।
জুহাইরার বুক ছিঁড়ে কান্নারা বেড়িয়ে আসতে চাইলো সে নিজেকে সামলিয়ে জিজ্ঞেস করলো ” বাচ্চা টা মারা গিয়েছিলো?
কোহিনূর ঘাড় নিচু করে বসে থেকে কেবল মাথা নাড়ালো। মুখে কিছু বললো না। জুহা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না এমন এক পরিস্থিতি যার সঙ্গে হয় সে-ই বুঝে কি যন্ত্রণা। আর চুপ থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো ” মারা গেলো কেন? কি হয়েছিল?
” জানি না কি হয়েছিলো! হয়তো খোদা চায়নি সে এই পৃথিবীতে বিচরণ করুক তাই নিয়ে গিয়েছে। তবে মজার ব্যাপার কি জানো?
জুহাইরা উসখুস হয়ে চেয়ে রইলো। কোহিনূর ভিজা চোখ মুছে স্মিথ হেসে বললো ” শাশুড়ী আম্মা এতেও আমাকে দোষ দিলো। অপবাদ দিলো আমি নাকি এমনটাই চেয়েছিলাম আমার চালচলন নাকি সুবিধার ছিল না আরও কতো কিছু। আমার বাচ্চা মারা গেলো আমার প্রথম সন্তান আমার আবেগ আমার ভালোবাসা মায়া মমতা সব সবকিছু! আর উনি সেটার জন্য আমাকেই দায়ী করলো। এরচেয়ে বড় অপবাদ পৃথিবীতে আছে বলে আমার জানা নেই।
আমি এমন অপবাদ পেয়ে পাথর হয়ে গেলাম। সব মুখ বুজেঁ সহ্য করে নিলাম। সেদিনের পর থেকে আমি আমার শাশুড়ীর সাথে কোনো প্রকার ঝামেলায় যাই না। উনি যা বলে আমি সেটাই হজম করি। এখন অবশ্য উনার রাগ পানিতে পরিনত হয়েছে। আগে কি ছিল আর এখন কি হয়েছে! সে বিশাল পরিবর্তন।
সে যাইহোক এরপর আমার কোল আলো করে আমার একমাত্র সোনার টুকরো ছেলে রাফসান আসলো। রাফসান আসার পরে খেয়াল করলাম শাশুড়ী আগের মতো নেই তবে একেবারে পানি হয়নি। রাফসান বদিউর পিঠেপিঠি বড় হয়ে ওঠলো। রাফসানকে বদিউর কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। ওর কোলে দিয়ে দিয়ে কতো কাজ করেছি। শাশুড়ী সারাক্ষণ পান চিবুতো আর এ বাড়ি ও বাড়ির সব মহিলাদের নিয়ে আসড় জমিয়ে গল্পসল্প করতো। কিছু কাকী চাচী আমাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য বলতো ” অল্প বয়সে স্বামী মারা গিয়েছে তো তিনটে সন্তান নিয়ে কষ্টে চলছে, এখন সুখের মুখ দেখছে। তাই তোর শাশুড়ী খিটখিটে। ধৈর্য ধর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম আমার শাশুড়ীর স্বভাবই ছিল ওমন তাই ওগুলো পরিবর্তন হয়নি আজও। রাফসান হওয়ার পর কেনো জানি আমার আর কোনো সন্তান হলো না। বহু চেষ্টা করেও পারলাম না। এ নিয়েও কম কথা শুনায়নি।
জুহাইরা চুপ করে শাশুড়ীর সব গল্প শুনলো। উনি কেন এতো চুপচাপ আজ সেটার কারণ জানতে পেরে কেমন জানি লাগছে। শ্যামলা বানু বদমেজাজি সেটাও এতোদিনে বুঝা হয়ে গিয়েছে তবে আজকে আরেকটু ক্লিয়ার হলো তবে আগের মতো কঠোর আজকাল নয়। বয়স হওয়ার সাথে সাথে রাগটাও মিয়িয়ে এসেছে। জুহা ভাবলো কথা বোধহয় শেষ। এখন কি করবে? চলে যাবে? নাকি আরেকটু বসা দরকার?
ওমনি কোহিনূর আবারও বললো ” মেঝো ভাই আতিকুর পড়াশোনায় ভালো ছিল। পড়তে সে ঢাকায় চলে যায়। এখানে তখনও তেমন সুযোগ সুবিধা ছিল না। তাকেও ঢাকা যেতে দিতে রাজি ছিল না। সে একপ্রকার জোর করেই গেলো। এরপর আর কি? পড়াশোনার সুবাদে সমবয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেললো ঢাকায়। এ কথা শুনে শাশুড়ী আড়াইঘন্টা বেহুঁশ ছিল। মেঝো ছেলে এমন করবে ভাবতে পারেনি। মুটামুটি আদরের ছিল বলা যায়, বদিউর আর আতিকুর ভাইকে বেশি আদরের চোখে দেখতেন। সে-ই আদরের ছেলে হতাশ করলো।
আর-ও হতাশ তখন হলো যখন দেখলো মেয়েটা পুরাই মর্ডান। শাশুড়ীর সঙ্গে একটা দিনও সে খাবে না এটা তাকে দেখে বুঝাই গেলো। দুজনেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত তাই শাশুড়ী যে বউ হাতের নাগালে পাবে সেই স্বপ্ন দেখাও ছিল পাপ। এরপর থেকে আতিকুরের সঙ্গে এ বাড়ির একটা গোপন দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেলো। দেখলে না কতোদিন পর আসলো বাড়িতে? তাও তো শাশুড়ী কতো আমোদপ্রমোদ করে ছেলে আর ছেলের বউকে। অথচ যত ঝড়ঝাপটা সব আমার উপর দিয়ে গেলো। শক্তের ভক্ত নরমে জম।
জুহাইরা চুপটি করে বসে রইলো। খুব করে বুঝলো প্রতিটা মানুষের জীবনে একটা করে গল্প থাকে। কারো টা প্রকাশ হয় আর কারোটা অপ্রকাশিত থাকে। তেমনি কোহিনূর বেগম এর গল্পটাও অপ্রকাশিত ছিল অথচ এমন গল্প প্রতিটি নারীর জীবনে জড়িয়ে আছে।
চলবে…..