অন্যরকম ভালোবাসা ২ পর্ব-১৪+১৫

0
710

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৪

ঘরের প্রতিটি জিনিস ভেঙ্গে পড়ে আছে। অতিশয় ভয়ে গুটিয়ে আছে ইশরা। চোখের কোণে অম্বুধারা চিকচিক করছে। হঠাৎ আয়ানের এতো ক্ষোভের কারণ বুঝতে ব্যর্থ সে। মুঠোতে নিজের ওরনাটা পেঁচিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল ইশরা। তৎক্ষণাৎ আরো একটি বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো ইশরা। আয়ান টেবিলের উপর সজ্জিত কাঁচের ফুল-দানিটা ছুড়ে ফেলেছে নিচে। ভেঙ্গে ইশরার পায়ের কাছে ছুটে এলো সেই কাঁচের টুকরোগুলো। কেঁপে উঠলো ইশরা। নেতিয়ে গেল সে। ধীরে ধীরে মাথা তুলে সামনে থাকা আয়ানকে দেখলো সে। আয়ানকে দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে। মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। বড় বড় পা ফেলে আয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত রাখলো কাঁধে। স্বল্প মাত্রায় ঝাকুনি দিয়ে বলল..

— “আয়ান শান্ত হ! কি হয়েছে তোর? এতো রেগে আছিস কেন!”

দাঁত কিরমির করে নয়ন যুগল বন্ধ করে নিল আয়ান। সেকেন্ড দুই পরে মেলে তাকালো। সেই নয়নে ভরকে গেল ইশরা। কেঁপে উঠলো সে। রাগের মাত্রা এতোটাই যে, আয়ানের শরীর কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। আয়ান হাত ছড়িয়ে গলা চেপে ধরলো ইশরার। ছাড়াতে ব্যস্ত হলো ইশরা। মাথা গিয়ে ঠেকালো দেয়ালের সাথে। হাতের সর্বশক্তি প্রয়োগ করলো ইশরার গলায়। দুহাতে আয়ানের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। ব্যর্থ হলো সে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে তার। হা করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা চালালো। জিভ মুখের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। চোখ উল্টে গেল মুহুর্তে, মুখ থেকে তরল রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল। ইতিমধ্যে শরীরে শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। হাত দুটো ক্ষসে পড়লো নিচে। নিজের হুসে ফিরল আয়ান। হাত ছেড়ে দিতেই দেয়ার ঘেসে নিচে বসে পড়লো ইশরা। দুহাত গলায় চেপে খকখক করে কেঁশে উঠলো। সেই কাশি শব্দে আয়ানের কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না।

বেডের কিনারায় বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো আয়ান। ইদানিং কি হচ্ছে তার সাথে, কিছুই বুঝতে পারছে না। সামান্য একটা ব্যাপারেই এতোটা হাইপার হয়ে যাচ্ছে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল..

— “ইশরা এখান থেকে যা..!! তোকে আমি দুই চোখে সহ্য করতে পারছি না।”

ঘনঘন শ্বাস নিয়ে গলায় হাত বুলিয়ে আড়-চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে একরোখা উত্তর দিলো..

— “আমি বলেছি, আমাকে ছাড়তে! মেরে ফেলবি আমাকে, ফেল মেরে। জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি, তোর কথা রেখে। এখন সেই ভুলের মাসুল দিতে হচ্ছে।”

ইশরার কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো আয়ান। ইশরার বরাবার দাঁড়িয়ে চুলের মুঠি শক্ত করে ধরলো। চেপে ধরলো গাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল..

— “সেদিন সপ্তম ফ্লোর থেকে লিফ্টে ঢুকেছিলিস, ৪টা ৩৫ মিনিটে। দ্বিতীয় ফ্লোরে এসেছে ৩৭মিনিটে। মাঝখানে একবার ষষ্ঠ ফ্লোরে থেমেছে, যখন শেফা নেমেছে। দ্বিতীয় ফ্লোরে আটকে ছিলো পাক্কা ৭ মিনিট। লিফ্টে প্রবেশ করার সময় একদম পরিপাটি ছিলিস তুই। এমন কি হয়েছিলো ভেতরে, যাতে বিধ্বস্ত অবস্থায় বেরিয়ে ছিলিস তুই?”

কথাগুলো গলায় আটকে গেল ইশরার। আয়ান কি বোঝাতে চাইছে, বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার। ব্যাথায় আর্তনাদ করলো বটে, তবে গলায় পেঁচিয়ে বেরুতে ব্যর্থ হলো। গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা অশ্রু। সেটা ব্যাথার নয়, অপবাদে। মুখের ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তগুলো শুকিয়ে আছে। পরক্ষণেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাকে। বেডের মাঝ বরাবর গিয়ে পড়লো ইশরা। ততক্ষণে এসে পৌঁছে বাকি সদস্যরা। রুমের বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে বিচলিত হয়ে গেল তাঁরা। ইশরাকে এবারে দেখে ধরলো গিয়ে তাকে। তখনও অনবরত স্বরে কেশে চলেছে ইশরা। তনয়া পানির গ্লাস পূর্ণ করে এগিয়ে দিল মায়ের দিকে। পানির গ্লাসটা নিলো তিথি। মাথার নিচে হাত রেখে ইশরার মাথাটা তুলে নিল। গ্লাসটা ঠোঁটের কোণে তির্যকভাবে ধরলো। নিভু নিভু চোখে তাকালো ইশরা। শব্দময় ধীরে ধীরে পানি পান করলো ইশরা।

ঠাস ঠাস চড়ের শব্দ কানে এলো ইশরার। সেদিকে অবলোকন করলো ইশরা। গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল..

— “কি পেয়েছিস তুই? মেয়েটাকে মেরে ফেলবি? তুই সবসময় ওর পাশে থাকবি, আগলে রাখবি। তা নয়, জানোয়ারের মতো মারছিস। নিজেদের মাঝে সমস্যা তৈরি হয়েছে, মিটিয়ে নিতি..

আয়ানের মাঝে জবাব দেওয়া মতো কোনোরুপ ভাবাবেগ দেখা গেল না। ইশরার ফেকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে বললো..– “আমি কেন ওকে আগলে রাখতে যাবো। জোর করে বিয়ে করেছি বলে কি সব দায়িত্ব পালন করতে হবে।”

সাথে সাথে ঘর কাঁপানো আওয়াজে আরো একটা চড় পড়লো আয়ানের গালে। তেগে গেলেন তমোনা। বললেন..– “তুই আমার সন্তান তো? সেই বোকা সোকা শুভ্র? যাকে সৃষ্টিকর্তার সেরা উপকার মনে করে নাম রেখেছিলাম, আয়ান। ছিঃ,.

শেষের কথাটা বাকি শব্দ গুলো চেয়ে বেশি কঠোর ভাবে বললেন তিথি। তার ধ্বনিগুলো দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে বিরাজ করলো কিছুক্ষণ। তিথি এগিয়ে গিয়ে ধরলো ইশরাকে। ইশরার একহাত নিজের কাঁধে রেখে উঠে দাড় করালেন। অন্যপাশ নিজের কাঁধে রাখলো তনয়া। ছোট ছোট পা ফেলে প্রস্থান করলো। বাকিরা সকলে দর্শকের মতো ভূমিকা পালন করলেন। যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো, তেমনি নিঃশ্বাসে রুম ত্যাগ করলেন।
.
.
আয়ান স্পঞ্জের বল দেয়ালে ছুড়ে খেলছে। নিজের করা কাজের জন্য কোনো অনুতাপ নেই। মনে হচ্ছে আরো কিছু করার দরকার ছিলো। বলটা হাতের মুঠোয় নিয়ে কাবার্ডে রাখতেই নজর গেল হাতের করতলে। হাতে জমাট বাঁধা রক্ত। মুছার চেষ্টা করলো অন্যহাত দিয়ে, মুছলো না। বলেও রক্ত লেগে আছে। রক্তের উৎস খুঁজতে চারিদিকে অবলোকন করলো। দেয়ালের পাশে ছিপছিপ রক্ত পড়ে আছে। মাথায় হাত রেখে বসে পড়লো আয়ান। কষ্ট হচ্ছে ইশরার সেই বিধ্বস্ত চেহারার কথা মনে পড়লে। ইচ্ছে করছে, একবারের জন্যও ইশরাকে দেখতে যেতে। কিন্তু তার ইগো তাকে থামিয়ে দিচ্ছে। ” আমার বউ, আমার যা ইচ্ছে তাই করবো। প্রয়োজনে শেষ করে ফেলবো”
সেই রাতে আর রুমের বাইরে পা রাখলো না আয়ান। বেডের মাঝ বরাবর অগোছালো হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

_____________ অনেক ঝগড়ার পরেও যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে না।
তাকে তুমি ভাগ্য করে পেয়েছ!
— ইফা 🌿
____________
সকাল থেকে ‘বর্ষা এলায়েছে তার মেঘময় বেণী।’ বিরতিবিহীন তার ধারাবর্ষণে গ্রীষ্মের দহনতপ্ত বক্ষে নেমে এসেছে কোমর শান্তিপূর্ণ সজল স্নিগ্ধতা। চোখে লাগে নবীন মেঘের নীল অঞ্জন, আমার হৃদয় মনে লাগে বর্ষাদিনের সজল স্নিগ্ধ স্পর্শ ।আকাশে মেঘের’ পরে মেঘ জমে আছে।দিগন্তের পরপার থেকে বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ধেয়ে আসছে। সেই মেঘের সাথে জোট বেঁধেছে আহম্মেদ বাড়ির সকলে। কারো সাথে তেমন কথা নেই।

নাস্তার টেবিলে প্লেট আর চামচের টুং টাং ধ্বনি ছাড়া কিছুর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তিথি ধরে ধরে ইশরাকে টেবিলে এনে বসালেন। প্লেট সাজিয়ে দিলেন সবজি তরকারি আর ডিমের অমলেট এ। ভাঁজ করে দুটো পরোটা দিলেন প্লেটে। বাদ সাধলো ইশরা। নিভু নিভু কন্ঠে বলল..

— “আন্টি, একটা দাও। খেয়ে পারব না।”

তিথি শুনলেন না। ধমকের সুরে বললেন..

— “কাল সারারাত কিছু খাসনি। চুপচাপ খেয়ে তারপর উঠ।”

তিথি নিজের হাতে খাইয়ে দিতে শুরু করলেন। ছোট ছোট টুকরো করে সবজি মিশিয়ে ইশরাকে খাইয়ে দিতে লাগলেন। ততক্ষণে এসে দাঁড়ালো তনয়া। ইশরা দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে বললো..

— “ভাবী শরীর কেমন আছে? গলাটা কালো হয়ে ফুলে গেছে, বেশি ব্যাথা করছে?”

তিনটা প্রশ্নের উত্তর-ই একসাথে মাথা হেলিয়ে দিলো ইশরা। কাল রাতে বরফ দিয়ে অনেকক্ষন গলা ভিজিয়ে রেখেছিল। তারপরেও এতোটা ফুলে গেছে। কেটলি থেকে কাপে পরিমান মতো চা ঢেলে ইশরার দিকে এগিয়ে দিল। বললো..– “চা খাও, ব্যাথা সেয়ে যাবে।”

ইশরা কাপটা নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো কাপে। তখনই ভেসে এলো আজাদ আহম্মেদের কন্ঠস্বর..

— “আমি তোমার বাবা মাকে ফোন করেছিলাম।”

দ্বি-বাক্যে উচ্চারণ করলো না ইশরা। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আর তার বাবা মা জানবে না। পরের কথাটায় বেশ স্বস্তি পেলো ইশরা।– “তবে তেমন কিছু বলিনি। বাড়িতে আসতে বলেছি।”
বিরবির করে ইশরা বললো..
— “তাহলে কিছু বলার দরকার নেই। আমি চাইনা, তারা কষ্ট পাক?”

নয়ন যুগল সরিয়ে সামনে দিতেই আয়ানের মুখশ্রী নজরে এলো ইশরার। রাঙ্গানিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো সে। একদম হিংস্রের মতো। বাম হাতের তর্জনী আঙুল টা ডুবিয়ে দিলো গরম চায়ের কাপে। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়তে লাগলো। আঙুল জ্বলতে শুরু করলো। আঙুল তুললো না কাপের মাঝ থেকে। বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়ালো ইশরা। হনহনিয়ে চলে গেল।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৫

দেয়ালে হেলান দিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে ইশরা। শব্দহীন প্রাণের মানুষটির জন্য সেই কান্না। মন হালকা করার চেষ্টা। চোখ মুছে বেলকেনির রেলিং এ হাত রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল সে। মনের কোণে বারবার উঁকি দিচ্ছে, আয়ান আসবে। নিয়ে যাবে তাকে। হয়তো পূরণ হলো তার মনোবাসনা। শীতল কোনো পুরুষনালী হাত ইশরার কাঁধ স্পর্শ করলো। বুকের ভেতরে বয়ে গেল সেই মাতাল করা হাওয়া। নিজের হাত, সেই হাতের উপরে ঠেকালো। অনুভব করলো সেই অতিপরিচিত আয়ানের স্মেল। অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। এবার আয়ান তার হাত সরিয়ে নিল ইশরার কাঁধে থেকে। পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁধে নিজের চিবুক রাখল। কেঁপে উঠলো ইশরা। শিহরিত হলো সারা শরীর। কাঁপা কাঁপা অধর জোড়া নাড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল..

— “কেন এসেছিস তুই? আমার কতোটা কষ্ট হচ্ছে, তার মজা দেখতে?”

আয়ানের বাঁধণ দৃঢ় হয়ে এলো। চেপে ধরলো ইশরাকে। কাঁধ থেকে থুতনিটা তুলে শব্দ করে সময় নিয়ে অধর ছুয়ে দিল ইশরার গালে। নিজের গালে হাত রাখল ইশরা। আয়ান পর মুহূর্তে সেখানে অধর ছুয়ে দিল। ইশরার নরম কর্ণের কাছে ঠোঁট এনে কামড় বসিয়ে দিলো সে। বিরবির করে বলল..

— “ইশু; এই ইশুপাখি! রেগে আছিস আমার উপরে না-কি অভিমান করে আছিস? খুব অভিমান তোর। কিন্তু আমি যে, আমার প্রিয়শ্রীকে অভিমানী মুখ করে থাকতে দিবো না। যতক্ষন না সে আমাকে ক্ষমা করছে, ততক্ষণে এইভাবে লজ্জায় লাল করে রাখবো।”

ইতিমধ্যে লজ্জার লালাভ আভা ছড়িয়ে পড়েছে ইশরার গালে। লজ্জার্থ মুখটা নুইয়ে ফেললো নিচে। আয়ান নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিল ইশরাকে। অধর ছুয়ে দিলো গলায়। মাথা তুলে ইশরার নয়নে নয়ন বন্দী করলো। গলায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল..
— “এই খানটায়; এই খানটায়। আঘাত করেছিলাম আমি। খুব ব্যাথা পেছেছিলি তুই।”

এবার নিজেকে আঁটকে রাখতে ব্যর্থ হলো ইশরা। দুহাতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল..

— “আয়ান, তুই অনেক খারাপ! কতোগুলো সময় পেরিয়ে গেছে। প্রতিটা সেকেন্ড প্রতিটা মিনিট প্রতিটা মুহূর্ত, ঘন্টা, দিন পেরিয়ে গেছে। তখন কেন এসে আমার অভিমান ভাঙালি না।”

কাঁদতে কাঁদতে মাথা রাখল আয়ানের বক্ষে। সেখানে নিজের কষ্টের সমাপ্তি টেনে মন খুলে কাঁদতে লাগলো ইশরা। তদানীং ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকালো ইশরা। ভেঙ্গে গেল তার স্বপ্ন। মুহুর্তেই মন খারাপেরা এসে ভর করলো মনে। এতোক্ষণ স্বপ্নটাকে বাস্তব মনে করে করেছিলো সে‌। ধীরে ধীরে উঠে বসলো ইশরা। তার থেকে দুহাত দূরে ফোনটা পড়ে আছে। ফোনটা হাতের মুঠোয় নিতে নিতে কেটে গেলো। স্ক্রিনে বন্ধ হলো নয়ন। সকাল নয়টা পনের বাজে। কালকের বিকেলে আয়ানের বাড়ি থেকে ফিরে বেডে গাঁ হেলিয়ে দিয়েছিল। কখন তন্দ্রা লেগে এসেছিলো জানা নেই। গতরাত নির্ঘাত কাটানোর ফলে এই রাতটা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। পুনরায় ফোন বেজে উঠল তার। দুষ্টু নামটা জ্বলজ্বল করলো। দুয়ান ফোন করেছে। রিসিভ করে শ্রবণপথের কাছে নিতেই এপার থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শোনা গেল..

— “কই তোরা? তোদের সারপ্রাইজ দিতে এয়ারর্পোট থেকে বাড়িতে গিয়ে আবার তৈরি হয়ে ভার্সিটিতে এসেছি। কিন্তু সেখানে আয়ান আর তোর দেখা নেই। দশ মিনিট সময় দিলাম, তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

ফোনটা নামিয়ে বেডের উপর ছুঁড়ে ফেললো ইশরা। কিছুক্ষণ বসে রইল নিরিবিলিতে। পরক্ষণেই তট জলদি উঠে পড়লো সে। কাবার্ড থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে দৌড় লাগালো ওয়াশরুমে।
________________
ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে আছে চার বন্ধু। মুখ ভার করে আছে দুয়ান। শেফা তার পাশে বসে মনের আনন্দে নুডুলস খাচ্ছে। বাকি দুজন চুপচাপ নত হয়ে বসে আছে। একবারও সরাসরি আয়ানের দিকে তাকায়নি ইশরা, আড়চোখে দুই তিনবার দৃষ্টিপাত করেছে। থমথমে পরিস্থিতি দেখে বিরাগী হলো দুয়ান। কর্কট কন্ঠে বলল..

— “কি হয়েছে বলবি তো? এতো মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?”
একরোখা জবাব দিলো ইশরা..– “কোথায় মুখ থমথমে করে আছি? তোর জন্য তাড়াতাড়ি করে আসতে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে পারিনি। তাই কথা বলতে পারছি না।”

— “তুই এখনো খাস নি! ইশু; এতো দিন পেরিয়ে গেছে। মানুষ বদলে যায় আর তুই মোটেও বদলাস নি?”

ইশরা আয়ানের দিকে অবলোকন করলো। সে তো নিজেকে পাল্টাতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভাগ্য তাকে পাল্টাতে দেয় নি। সে কখনো আয়ানকে ক্ষমা করতে পারবে না, না নিজেকে পাল্টাতে পারবে। তাচ্ছিল্যের হেঁসে বলল..

— “চাইলেই কি পাল্টে যাওয়া যায়। তাছাড়া গিরিগিটি সেকেন্ডে সেকেন্ডে পাল্টে যেতে পারে, মানুষ নয়।”

ইশরার কথন শেষ হওয়ার আগেই আয়ান ফিরে চাইলো তার দিকে। ইশরা তদানীং আয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। বিধায় দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেল।
আয়ানের সময় লাগল না ইশরার কথা বুঝতে। ইশরাত
তাকে মিন করে কথা বলছে, বাকিরা না জানলেও সে জানে।
দুজনের দৃষ্টি ব্যাঘাত ঘটলো দুয়ানের কথায়।

— “বুঝতে পারছি, ঝগড়া হয়েছে। মিটিয়ে নিস সময় বুঝে। (একটু থেমে আবার) রাফসানের কি খবর সেটা বল আগে?”
রাফসান ভার্সিটির সিনিয়র। পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাজনীতি নিয়ে বসে আছে। ইশরাকে নিয়ে ক্ষনে ক্ষনে আয়ানের সাথে ঝগড়া হতো তাদের। বলতে গেলে মেয়েবাজ একটা ছেলে।
সাথে সাথে চপল পড়লো দুয়ানের কাঁধে। রাঙ্গানিত কন্ঠে বলল শেফা..– “তোকে কতোবার বললো, তুই যাওয়ার পর ওরা ভার্সিটিতে আসেনি। তাই ইশরাকে বিরক্ত করার কোনো চান্স নেই মামা!”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল দুয়ান। ইশরাকে নিয়ে কতোবার রাফসানের সাথে ঝগড়া হয়েছে হিসেব নেই। কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। শেফা নেড়েচেড়ে খাচ্ছে। চারপাশে শব্দগুলো বেড়ে চলেছে। দুয়ান নুডুলস অর্ডার করলো। বাধ সাধল ইশরা। অভিমানী স্বরে বলল..
— “এখন আমার খেতে ইচ্ছে করে না। কাল রাত থেকে খাইনি অথচ ক্ষুধা নেই। কিছুই ভালো লাগছে না। তোরা থাক, আমি ক্লাসে যাচ্ছি..

কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে।‌ সিঁড়ি বেয়ে ব্যস্ত পায়ে ধাবিত হলো ক্লাস রুমের দিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো না সেখানে। তার আগেই হাত টেনে অন্ধকার ক্লাস রুমে ঢুকিয়ে নিল কেউ। দরজা বন্ধ করে চেপে ধরলো দেয়ালের সাথে। কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলতে নিলে হাত চেপে ধরলো মুখে। একহাতে তার মুখ চেপে আছে, অন্যহাতে দিয়ে ইশরার দুহাতে। ভরকে গেল ইশরা। শ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে তার। মুচড়া মুচড়ি শুরু করে দিয়েছে। পরক্ষণেই নেতিয়ে গেল ইশরা। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে নিল। নড়াচড়া থামিয়ে দিলো। আঁখি জোড়া দিয়ে অন্ধকারের মাঝে থাকা মানুষটিকে দেখা না গেলেও ভয় করলো না ইশরা। কারণ এই স্পর্শ তার গভীর ভাবে পরিচিত। আয়ান এসেছে। বাঁধন আলগা করে সরে গেল সে। ধীরে ধীরে পরিস্কার হতে লাগল অন্ধকারের বেষ্টিত রুমটা।

সরে গেল সেই মানুবটি। বসে পড়লো কিছুটা দূরে বেঞ্চিতে। বললো..

— “আমার উপরে রাগ করে খাওয়া কেন বন্ধ করেছিস তুই? আবার আমাকে কটু কথাও শুনাচ্ছিস দেখছি? বাহ দুদিনে অনেক বড় হয়ে গেছিস দেখছি।”

প্রতিউত্তর দেওয়ার মতো ভাবাবেগ খুঁজে পাওয়া গেল না ইশরার ভেতরে। বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো ক্লাসের ভেতর থেকে। সক্ষম হলো না। প্রবেশদ্বারের সিটকিরি উপর থেকে বন্ধ। অসন্তুষ্ট হলো ইশরা। পায়ের পাতা মৃদু উঁচু করে সিটকিরি খোলার অদম্য চেষ্টা করলো। সফল হলো না সে। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো সে। বর্তমানে তার ইচ্ছা, এলিয়েন হওয়া। যে এলিয়েন কেউ দেখেনি। আকাশ সমপরিমাণ লম্বা সে। তাহলে পা দিয়ে আয়ানকে পিষে ফেলতো। আচ্ছা এলিয়েনের পা আছে তো। ইশরা যখন গভীর ভাবনায় বিভোর তৎক্ষণাৎ ভেসে এলো আয়ানের গানের স্বর..

— “পাগলে কি-না বলে, ছাগলে কি-না খায়। গাধাকে যত পেটাও, সেকি ঘোড়া হয়!”

অগ্নিরুদ্ধ দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকাতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। জীবনেও ইশরা, আয়ানের সাথে কথা বলবে না। কোমড়ে হাত রেখে ফোঁস ফোঁস করে করতে করতে বলল..

— “আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করি নি।”

— “আমি দেয়ালকে বলছি, অন্যকারো গায়ে লাগছে কেন?”

গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে আয়ান বলতেই অতিশয় ক্ষোভে ফেটে পড়লো ইশরা। সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করলো দরজায়। দরজা তো খুললোই না বিপরীতে আঘাতপ্রাপ্ত হলো চরণ। হট্টহাসিতে ফেটে পড়লো আয়ান। হনহনিয়ে বেঞ্চির কাছে চলে গেল ইশরা। টেনে নিয়ে এলো দরজার কাছে। উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে নিল।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)