অন্যরকম ভালোবাসা ২ পর্ব-২৪+২৫

0
711

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ২৪

পড়ন্ত বিকেল। চারদিকে সূর্যের শেষ বিকেলের উত্তাপ। ইশরা জানালার পাশে বসে শান্ত মনে বাইরে তাকিয়ে আছে। দুপুরের দিকে তার এসে পৌঁছেছে তাদের কাঙ্খিত জায়গায়। ফ্রেস হয়ে লাঞ্চ করে বসে আছে। নদী দেখতে বরাবারই ভালো লাগে তার
আজকেও তার ব্যাতিক্রম নয়। নদীর অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য ইশরার মনকে ক্লান্তহীন করে তুলেছে। শাওয়ার শেষে বেরিয়ে এলো আয়ান। পড়নে তার ছাই রাঙা ট্রাউজার ছাড়া কিছু নেই। গলায় একটা হালকা সবুজ কিংবা টিয়া রঙের টাওয়াল। চুলগুলো কপালে কাছে লেপ্টে রয়েছে। বিন্দু বিন্দু জল কণা জমে আছে উন্নুক্ত বুকে। দেখতে সমুদ্রের তলদেশের মুক্তার মতো লাগছে। আয়ান এগিয়ে গেল ইশরার দিকে। একদম পিছনে বসে পড়ল তার। ইশরার পিঠের সাথে নিজের বুক মেশালো। নড়েচড়ে উঠলো ইশরা। জলকণা গুলো সুতি কাপড় ভেদ করে পিঠের কিছুটা অংশ ভিজিয়ে তুলেছে ইশরার। মৃদু লজ্জার্থ হাসলো সে। পরক্ষণেই আয়ান তার কাঁধে মুখ গুঁজে দিলো। তার ভেজা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গেঁথে গেল ইশরার গলায়। ইশরা হাত রাখল আয়ানের গালে। ভেজা দাড়িগুলোতে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে বলল..

— “প্রচন্ড ডিস্টার্ব করছে এই দাঁড়িগুলো।”
আয়ান ইশরার হাতের উপর নিজের হাত রাখল। অধর ছুয়ে দিলো গভীরভাবে। বলল..

–” তাই বুঝি? আজকেই লাগছে? আগে যখন আরো কাছে এসেছিলাম তখন লাগে নি। ”

ইশরা আয়ানের এমন ভাবল্যাস বিহীন উত্তর অভিলাস করে নি। ফট করে তাকালো নিজের অতি প্রিয় মানুষটির দিকে। সে নেশাগ্রস্ত দের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেই লোচনে ভাষা ভিন্ন। সাথে সাথে সরিয়ে নিল সে‌। এই ভাষা পড়তে গেলে নিজেকে হারিয়ে যেতে হবে ভালোবাসার গহীনে। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। — “ধ্যাত।”

যাওয়ার জন্য উদ্দেগ হতেই হাত টেনে থামিয়ে দিলো আয়ান। ইশরার কাঁধে দুহাত স্থাপন করে নিল বিনা বাধায়। স্বল্প ঝুঁকে গেল ইশরার দিকে। অধরে অধরে ছুঁই ছুঁই করে বলল..

— “ইশু, এই ইশুপাখি। আমার কাছে এতো লজ্জা পাও কেন? তোমার প্রতিটি লজ্জা পাওয়া কথাগুলো আমার বুকে তীরের মতো বিঁধে। ক্ষতবিক্ষত করে তুলে। মনে হয় হারিয়ে যাই তোমার গহীনে।”

বলেই নিজের অধর কামড়ে ধরলো ইশরার। ইশরা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আয়ানকে। ওষ্ঠ জ্বলছে। ঘসতে ঘসতে বলল..– “ইস্। হয়তো কেটেই গেছে।”
আরেকটু এগিয়ে এলো আয়ান। ঝুঁকলো তার দিকে। ফলস্রুতিস্বরুপ ইশরার নিচের দিকে ঝুঁকে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল..

— “তৈরি হও, ঘুরতে যাবো। আজ তোমাকে নিয়ে সারারাত আমি নামক স্থানে থাকবো। যেটা বর্তমানে শুধু আমার।”

আয়ান বেলকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। ইশরা এখনো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা পানসে হয়ে আসছে। তিতগুটে ঢেকুর আসছে ভেতর থেকে। সাথে সাথে দুহাত ঠেকালো মুখে। দৌড়ে ছুটল ওয়াশরুমের দিকে। বমি হলো না। বিরাগী হয়ে উঠলো ইশরা। ইদানীং কিছুদিন যাবৎ তার সাথে ক্রমাগত এমন কিছু হয়ে চলেছে। এই ভেতর থেকে ঠেলে আসছে কিন্তু বমি হচ্ছে না। মাথাটা ঝিম দিয়ে থাকে। শরীরটাও অস্তির হয়ে থাকে।
.
.
সূর্য ডুবে গেছে বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে। তার রক্তিম আভা গুলো আকাশের বুকে বিদ্যমান রয়েছে। সমুদ্রের পানির মাঝে তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। হাতের ভাঁজে জুতো গুলো বন্দী। একটা মস্ত ঢেউ এসে ইশরার পায়ের পাতা স্পর্শ করে চলেছে আর সে অজানা কারণে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। মন মুগ্ধকর সেই হাসির শব্দ। আয়ান বক্ষে হাত রেখে ইশরার ভঙ্গিমা দেখে চলেছে। চারদিকে পর্যটক কারীটা আড়চোখে ইশরার দিকে তাকাচ্ছে। যেটা মোটেও ভালো লাগছে না তার। নিজের পড়নের উপরের শার্ট খুলে ইশরার গায়ে জড়িয়ে দিলো। ঢেউএর মাঝে লাফ ঝাঁপ করার কারণে আংশিক ভিজা সে। সমুদ্রের তীরে ইশরার হাত ধরে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল..

— “ইশু, রিসোর্টে ফিরে চলো।”

— “প্লীজ আয়ান আরেকটু থাকি!”

— “এখানে দাঁড়িয়ে পানিতে ভিজে ভিজে ছেলেদের মজা দিতে খুব লাগছে বুঝি। যদি এতো ভালো লাগে তাহলে এখানে মজা না দিয়ে ওদের সাথে রুমে চলে যাও।”

হাসৌজ্জ্বল মুখটা নিমিষেই ফেকাসে হয়ে উঠলো। অশ্রুতে পূর্ণ হলো আঁখি জোড়া। কিভাবে আয়ান পারলো নিজের বউকে অন্য ছেলের সাথে মিশিয়ে এভাবে কথা বলতে। ইশরার মন খারাপ পাত্তা দিলো না আয়ান নিস্তেজ হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেল। আসার সময় সাইকেল ভাড়া করে নিয়ে এসেছে সে।

ইশরাকে আয়ানের সামনে বসাতে চাইলে জেদ করে পেছনে গিয়ে বসলো সে। সাইকেল ধরে নিজেকে ব্যালেজ করে নিল। সে আয়ানের সাথে একটুও কথা বলবে না।
_________________
জনশূন্য হীন নির্জন দ্বীপের এক প্রান্তে বসে আছে দুজন মানব। কারো মুখে কোনো কথা নেই। একজন অন্যজনের উপর অভিমানের ডালা পূর্ণ করে বসে আছে আরেকজন অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত। সামনেই ধাউ ধাউ করে অগ্নিশিখা জ্বলছে। তার পাশের ছোট একটা কুড়েঘড়। মৃদু মৃদু কুয়াশা জমে আছে শূন্যতায়। অদৃশ্যতায় দেখা যাচ্ছে না দুরের আবহাওয়া। আয়ান ইশরার পাশে বসে পড়লো। ইশরা তেতে উঠল এবার..

— “কেন? কেন এসেছেন আমার কাছে? আমাকে তো অন্য ছেলের কাছে ছিঃ। আপনার ভাবনা এতোটা নিচ। কবে জানি টাকা লোভে, অন্য কারো কাছে বিক্রি করতেও দ্বিধা বোধ করবেন না।”

ইশরার মনে অন্য আশঙ্কা দানা বেঁধে রয়েছে। তখন সমুদ্র পাড়ে দিবার মতো দেখতে একটা মেয়েকে দেখেছে। একদম সেই মুখ, সেই কথা বলার ধরণ, সেই স্টাইল, পড়নে সেই আধুনিক জামা। আয়ান সেই মেয়েটাকে দিবা মনে করেনি তো? ফিরে যাবে না তো তার কাছে। যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে এই সামান্য কিছুদিনের জীবনটা বিসর্জন দিবে সে। এই জীবনে আর কখনো আয়ানকে সে অন্যকারো পাশে সহ্য করতে পারবে না।
পুনরায় বিরাজমান রইলো দুজনের পিনপিনে নিরবতা। আয়ান এগিয়ে গিয়ে আগুনের শিখা নিভিয়ে দিলো। অন্ধকারে আবৃত হয়ে গেল জায়গাটা। ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল ইশরা। তার পড়নে এখনো আয়ানের শার্টটা। সেটাকে পেঁচিয়ে ধরে রইলো। অন্যহাতে হাতরাতে লাগল আয়ানকে। হাতটা আয়ানকে স্পর্শ করতে দুহাতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মিশে গেল আয়ানের সাথে। আয়ান সরিয়ে নিল নিজেকে। বলতে শুরু করল..

— “দেখেছো ইশরা, তুমি যতোই আমাকে লোভী বলো। তোমার সাথে খারাপ ভাষায় কথা বলি। কিন্তু দিন শেষে এই হৃদয়হীন, লোভী মানুষটিকে তুমি সবচেয়ে বেলী ভালোবাসো, বিশ্বাস করো। তোমার কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও এটাই সত্য, আমি কখনো তোমাকে ঠকাবো না। তাহলে..

— “স্যরি, আসলে আমি নিজেকে তুমি ছাড়া অন্যকারো সাথে মেলাতে পারি না তাই..

আর বলার প্রয়োজন হলো। কারণ পরের বাক্যগুলো মুখে প্রকাশ না করলেও মনের কোণে উঁকি দিয়েছে। আর সেটা বিশ্বাস আর ভালোবাসা।

কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। মিটে গেল দুজনকার মাঝের ভুল বোঝাবুঝি। কৃত্রিম আলোর নেই। অর্ধ চাঁদের আলোয় মনের ভাব আদান প্রদান করে চলেছে তারা। নিরবতা ভেঙ্গে মুখ খুললো ইশরা..

— “আয়ান তুমি তো বলেছিলে, আমাকে স্পেশাল জায়গায় নিয়ে আসবে। সেটা একান্ত তোমার! কোথায় সেই জায়গা।”

— “কেন ইশুপাখি? এই জায়গাটা তোমার পছন্দ হচ্ছে না বুঝি। এটা তো তোমার স্বপ্নে জায়গা ছিল।”

চরম অবাক হলো ইশরা। আমতা আমতা করে বলল..
আমার স্বপ্নের জায়গা!

— “তোমাকে তো পুরোটা বলা হয়নি ইশুপাখি! আমি যখন মায়ের গর্ভে ছিলাম তখন এই জমিটা লিচে নেওয়া হয়েছে। একদম ৯৯ বছরের জন্য। মায়ের মন খারাপ হলেই সে এখানে আসে কিছুদিনের জন্য। আর এইযে কুঁড়েঘর দেখছো, এটা মায়ের ইচ্ছেতে হয়েছে। শহরের ইট, পাথরের আবরন থেকে বেরিয়ে এই কুঁড়েঘরে তিনি শান্তি পায়।
এইবার ভেবে দেখো, যে মা আমাকে এই অসাধারণ জায়গা উপহার দিয়েছে। আমাকে শুভ্রের সাথে তুলনা করছে। আমি কেন মায়ের কাল্পনিক শুভ্রের মতো হতে পারব না। মায়ের কথা শুনে চলতে পারব না। মা, নিজে তোমাকে পছন্দ করে এনেছে। আর আমি জোর করে বিয়ে করেছি। তাকে কি পছন্দটা কিন্তু মায়ের ছিল। তাই তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়।”

— “যদি আন্টি না চাইতেন, তাহলে আমাকে ছেড়ে দিতি! তাই না।”

অজান্তেই বলে ফেললো সে। ইশরা উত্তরের আশায় চাতক পাখির নিমিত্তে তাকিয়ে রইলো। আয়ানও ভাষা খুঁজে পেল না। বলল..

— “মা কখনো এমন চাইবে না।”
— যদি চাই কখনো?
— “জানি না।”

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ২৫

রঙিন আলোয় সেজেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের একটাই বড় অংশ। বিয়ের অনুষ্ঠানে মেতে উঠেছে সকলে। তনয়া দুয়ানের বিয়ের সাথে ইশরা আয়ানের বিয়েও পাকাপোক্ত করা হয়েছে। রৌদ্র জুবায়ের আর তমোনার সম্মতিতে বিয়ের তোরজোর চলেছে তাদের। কিছুক্ষণ পর প্রায় রাত আটটার দিকে শুরু হবে হলুদ সন্ধ্যায় উৎসব। প্রায় কিছুদিন ধরে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ইশরা আয়ান। ইশরার বর্তমান স্থান তনয়ার সাথে একই ঘরে।
সাধারণ সাজে প্রস্তুত দুজনে। তনয়া বসে বসে ফোন স্ক্রুল করছে আর ইশরা ওয়াশরুমে আছে। তট জলদি কেউ ঘরে ডুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তনয়া প্রচুর চমকালো। আয়ানকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো সে। ফোনটা পাশে রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল..– “তুই এখানে ভাইয়া! ব্যাপার কি?”

— “ব্যাপার-টা তোর বুদ্ধিহীন মাথায় ঢুকবে না। তাড়াতাড়ি বেরু ঘর থেকে, আমার অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ কাছে?”

তনয়া বাঁকা হাসলো। আয়ানের হাতের ভাঁজে অনেকটা হলুদ অবস্থান করছে। যার থেকে হলুদের পানি মেঝেতে চুইসে চুইসে পড়ছে। ফোন নিয়ে পুনরায় বেডের উপর বসে পড়লো সে। স্ক্রিনে দৃষ্টি বন্ধ করে বলল..– “তোর গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী ভাবীকে হলুদ ছুঁয়ানো?”

— “দিনদিন বেশি পেকে যাচ্ছিস। যা বের হ রুম থেকে। ”

তনয়া একহাত বক্ষে গুঁজে অন্যহাত মেলে দিল আয়ানের দিকে। সরু চোখে তাকিয়ে বলল..– “দুই হাজার লাগবে?”
আয়ান বিরাগী হলো। সময় ক্রমাগত ফুরিয়ে আসছে। কোনো ঝামেলায় সে ঝড়াতে চাইছে না। পকেট থেকে পাঁচশত টাকার নোট বের করে তনয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। ভাব দেখিয়ে টাকাটা নিতে গিয়েও নিলো না তনয়া। চুল ঠিক করতে করতে বলল..
— “পাঁচ হাজার লাগবে?”

— “মানে!”

অবাকের সুরে বলল আয়ান। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল..– “দুই হাজার টাকার এক টাকা কম দিলে, আস্তে আস্তে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।”

— “আমার বউয়ের সাথে দেখা করতে আসছি, আর তুই আমার থেকে টাকা নিচ্ছিস।”

— “তাতে কি? এখন তোর বউ নেই। এখন তোর হবু বউ। হতেও পারে না হতে পারে।”

আয়ান ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছে, তনয়ার সাথে টাকা নিয়ে কথা বাড়ালে সময় নষ্ট ছাড়া কিছু হবে না। পকেট থেকে মানিব্যাগ টা বের করে তনয়ার হাতে দিয়ে দিল। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল..– “এবার তো যেতে পারিস?”

তনয়া গেল না। টাকা গুনতে বসলো। ততক্ষণ সহ্য হলো না আয়ানের। এক প্রকার হাত ধরে টেনে বের করে দিল তনয়াকে। আয়ানের উপস্থিতি যাতে ইশরাত অনুভব করতে না পারে তাই ওয়াশরুমের পাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো আয়ান। বেশ কিছুক্ষণ পর ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে এলো ইশরা। সবার প্রথমে নজর বুলিয়ে নিল পুরো রুমে। তনয়া নেই। তট জলদি এগিয়ে গেল দরজায় দিকে। লক করে বেডের উপর গা হেলিয়ে দিল। চুলের সামনের অংশ ভেজা। অর্থাৎ মাথায় পানি দিয়েছে সে। মিনিট পাঁচেক পেরুবার পরেই উঠে বসলো। মেডিসিন বক্স বের করে কয়েকটা মেডিসিন পানি সমেত খেয়ে নিল। মাথাটা পৃথিবী নিয়ে ঘুড়তে। হাঁটার চেষ্টা করতেই পড়ে যেতে নিল সে। তৎক্ষণাৎ আয়ান এসে ধরলো তাকে। কয়েকটা মৃদু শব্দে চপল মারল ইশরার গালে। হতাশাগ্ৰস্থ কন্ঠে বলল..–” ইশু, এই ইশুপাখি। কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে।”
বলেই নিজের সাথে জড়িয়ে নিল ইশরাকে। ইশরা মুরগীর ছানার মতো নেতিয়ে গেল আয়ানের বক্ষপাজরে। আয়ান ইশরাকে শুইয়ে দিলো বেডের উপরে। টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছিয়ে দিল। ইতিমধ্যে জ্ঞান হারিয়েছে ইশরা। অসহায় হয়ে পড়লো আয়ান। বাইরে হলুদের তোড়জোড় চলছে। এই ব্যাপারটা বাইরে জানাজানি হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা চালালো সে। গ্লাসের পানি হাতে ঢেলে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ইশরার মুখে দিল। বেষ্টিত ক্লান্তময় নয়নজোড়া খুলে অবলোকন করলো ইশরা। উঠে বসার চেষ্টা করতেই আয়ান দিলো এক ধমক। থেমে গেল সে। শিতল চাওনি দিয়ে বলল..

— “কি হয়েছে তোমার?”

— “তেমন কিছু না।”

— “তেমন কিছু না হলে জ্ঞান হারাবে কেন? হুয়াই?”

— “আসলে কিছুদিন ধরে প্রচন্ড মাথা ব্যাখা করছে। শরীরটা অস্থির অস্থির করছে।”

আয়ানের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো এবার। দাঁতের সাথে দাঁতের অদ্ভুত ঘর্ষণ সৃষ্টি করে বলল..– “তাহলে এতো দিন কেন বলো নি?”

— “আমি চাইনি কেউ আমার জন্য চিন্তা করুক। তনুর বিয়েতে বিঘ্ন ঘটুক।”

— “হয়েছে তোমার বিঘ্ন। তাহলে চলো হসপিটালে যাবো।”
ইশরাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো আয়ান‌। বাঁধ সাধল ইশরা। হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল ..– “আয়ান প্লীজ। এখানে হসপিটাল পাবো কোথায়? তাছাড়া এতো আয়োজন। আই প্রমিজ, আমি হলুদে যাবো আর ফিরে আসবো। তবুও..

ক্লান্তময় হাসলো আয়ান। ইশরার গালে হাত রেখে এগিয়ে নিল নিজের দিকে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে তৃপ্তিকর শ্বাস ত্যাগ করলো। এই মেয়েটা যে শুধু নিজের কথা না ভেবে অন্যর কথা ভাবে। সেটা বেশ পিড়া দেয় তাকে‌। কেন ভাবে না নিজের কথা। কেন বুঝে না, তার ভালো থাকার সাথে আয়ানের ভালো থাকা মিশে হয়েছে।
হলুদের পুরোটা সময় নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছিলো ইশরার। সবাই মুখ চেপে হেসেছিলো। কিন্তু তাকে পাত্তা দেয় নি আয়ান। তবে ইশরা লজ্জায় কুটিকুটি হয়েছিলো। না পারছিলো আয়ানকে সরাতে, না পারছিলো সবাইকে সত্যটা বলতে। তাই মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলো।
__________________
গভীর রাত। ধীরে ধীরে আরো গভীর হয়ে উঠছে। একজোড়া বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে অনেকক্ষন পূর্বে। বউ সেজে বসে আছে ইশরা। এটা তার জন্য নতুন কোনো বিষয় নয়, তবে নতুন অনুভূতি। এখনো মাথা ঘুরে চলেছে তার। আয়ানকে মিথ্যা বলেছে সে, বলেছে তার মাথা ব্যাথা সেরে গেছে‌। হঠাৎই মনের ভেতরে অন্য অনুভূতির ছোঁয়া খেয়ে গেল। গুগলে সার্চ করে অন্যকিছু জানতে পেরেছে সে। ভারী লেহেঙ্গা স্বল্প উঁচু করে উঠে দাড়ালো। এখানকার স্টাফকে দিয়ে একটা প্রেগনেন্সি কীট আনিয়ে রেখেছে সে। তা নিয়ে ওয়াশরুমে ছুটল।
বেশ কিছুক্ষণ পর লজ্জামাখা মুখ নিয়ে বেরিয়ে এলো সে। সেই মুখের ভেতরে আনন্দের ঢেউ। নয়নজোড়া অম্ভুতে চিকচিক করছে‌। দরজার দিকে অবলোকন করলো সে। নিজের ভেতরে এই খুশিটা একা বইতে পারছে না। কাউকে তার সুখের ভাগ দিতে হবে। একটা খাতা আর কলম নিয়ে কিউট কিউট বেবীদের নাম দেখতে বসলো ইশরা।

অন্ধকারে আবৃত রুমে প্রবেশ করলো আয়ান। অন্ধকার থাকলেও বাইরে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলো রুমের ভেতরে প্রবেশ করছে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না ইশরাকে। আরো কয়েক কদম এগিয়ে গেল সে। ইশরাকে অন্ধকারে কিছু লিখতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। যে মেয়ে পরীক্ষা ছাড়া কখনো পড়াশোনা করে না। সেই মেয়ে বাসর ঘরে পড়াশোনা করছে। হাউ ফানি। একটু ঝুঁকে বলল..– “ইশু এতো মন দিয়ে কি লিখছো তুমি?”
আয়ানের বচন গুলো ইশরার কর্ণপথে গেল না। সে নিজের মতো লিখেই চলেছে। আশাহত হলো আয়ান। সে রুমে প্রবেশ করেছে আর ইশরা শুনলোই না। মাথার পাগরীটা খুলে কাবার্ডের উপরে রাখল। দ্রুত পায়ে বেলকেনির দিকে পা বাড়ালো।
বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে মাথা তুলে তাকালো ইশরা। তার কাজ শেষ। আগে নামগুলো আয়ানকে দেখাবে, তার পছন্দ না হলে আবার নতুন নাম লিখবে। দরজার দিকে দৃষ্টি দিল, ভেতর থেকে দরজা লক করা। বেলকেনিতে দরজা খোলা। নিজেই নিজের মাথায় চপল মারলো। নিজেও বেলকেনির দিকে এগিয়ে গেল। আয়ানের পেছনে দাঁড়িয়ে রইল ইশরা। কিভাবে তাকে জানাবে খুঁজে পাচ্ছেনা সে। অবশেষে ভেতরকার শক্তি সঞ্চয় করে ডাক দিলো,”আয়ান” আয়ান তাকালো না। ইশরার মন খারাপ হয়ে এলো। কাঁপা কাঁপা হাতটা আয়ানের কাঁধ স্পর্শ করতে সরে গেল আয়ান। বেলকেনির ওপর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো। ইশরা সেখানেও দিয়ে দাঁড়ালো। আয়ান নিশ্চুপ রইলো তখনও। সরে আসার চেষ্টা করতেই ইশরা আয়ানের বাহু চেপে ধরলো। ইনোসেন্স ফেইস করে বলল..–” কি হয়েছে আয়ান, রেগে আছিস আমার উপর। আমি সত্যিই তখন খেয়াল করি নি। স্যরি।”

— “ইশরা প্লীজ, তোর লেখালেখি শেষ হলে ঘুমিয়ে পড় গিয়ে।”

বলেই আবার হাটা দিল আয়ান। কি হলো জানা নেই ইশরার। আয়ানের ঘড়ি বিহীন বাম হাতটা নিজের পেটের উপর ঠেকালো। অভিমানী সুরে বলল..

— “তুমি যদি আমার উপরে রেগে থাকো, তাহলে আমরা তোমার উপরে রেগে থাকবো।”

ইশরা তখনকার আয়ানের মুখটার দেখার মতো সাহস নেই। তার নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে রইলো।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)