#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ৩০
আয়ান নির্প্রাণ হয়ে তাকিয়ে রইল আছে ছোট আয়রার দিকে। ছোট মেয়েটাকে তার কাছে আয়রা নয় বরং ইশরাকে মনে হচ্ছে। অবিকল সেই মুখ, সেই হাসি, সেই কাজের রাঙা নয়ন যুগল। শাড়ি, অলংকারে অলংকৃত আয়রাকে দেখলে যে কেউ বলতে বাধ্য হবে, এটা আয়রা নয়; ছোট ইশরা। যে সারাদিন মুখ ফুলিয়ে চলতো। আয়ানের ভাবনার মাঝেই আধো আধো হাত জোড়া নেড়ে ধ্যান ভাঙালো আয়রা। ওরনা পেটে লুকাতে লুকাতে বলল..
— “পাপা, আমি একটু সাজলেই তুমি চোখ তালগাছ করে তাকিয়ে থাকো। বলি প্রিন্সেস দের দেখতে এমন হয় জানো না?”
সাথে সাথে না বোধক মাথা নাড়ালো আয়ান। মুহুর্তেই আয়রা দুহাত কোমড়ে গুঁজে নিল। ফাঁক দিয়ে ওরনাটা পড়ে গেল। বেশ বিরাগী হলো, মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু দুহাত নিচ থেকে উপরে তুলে নিজেকে শান্ত করলো। কারণ সে জানে, তার পাপা সুপারম্যান। সুপারম্যানের মতো তার সমস্যা সমাধান করে দিবে। পাপার গলা জড়িয়ে ধরলো। পায়ের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল..
— “প্রিন্সেস-দের দেখতে কিউট কিউট হয়। তবে আমার মতো এতো কিউট নয়। আমি তো প্রিন্সেস বাবুই আয়ু সোনা। তাই অনেক কিউট।” (হাত দিয়ে দেখিয়ে)
আয়ান দুহাতে জড়িয়ে নিলো আয়রাকে। গাল টেনে চুমু দিয়ে বলল..– “সেই তো! তুমি এতোটাই কিউট যে, সব পিন্সেসরা হার মেনে যাবে আর আমার প্রিন্সেস আজকে জিতবেই জিতবে।”
আয়রা নিজের গাল মুছে নিল। বলল..
— “পাপা তুমি সারাক্ষন আমার গাল কেন টানো? আমার গাল লম্বা হয়ে গেল সবাই আমাকে বুড়ো প্রিন্সেস বলবে।”
আয়রার পাকা পাকা কথা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো আয়ান। আরো একবার গাল টেনে দিলো আয়রার। আয়রা এবার চোখ পাকিয়ে তাকালো। ইশরার সেই রাগ। আয়ান বললো..
— “প্রিন্সেস-রা এতো কিউট হয় না। কিন্তু আমার মেয়েটা অনেক কিউট। এতোটাই কিউট দেখলে, শুধু গাল টেনে দিতে ইচ্ছে করে।”
— “হয়েছে, হয়েছে। যাও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসো না পাপা আমার স্কুলের কম্পিটিশন শুরু হয়ে যাবে যে।”
মেয়ের কথা শুনে আরো একবার হাসলো আয়ান। তার ইশরা এইসব দেখতে পারছে না। এটাই হয়তো পরিনতী। আয়ান তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। মেয়ের গালে আরো একবার অধর ছুয়ে দিয়ে ছুটল তৈরি হতে। নাহলে আয়রা আবার রেগে যাবে তখন তার রাগ ভাঙানো মহা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।
___________
ভিড় ভাট্টায় গিজগিজ করছে চারিদিক। সেদিকে আক্ষেপ নেই আয়রার। আয়রার হাতে তার মায়ের ছবি। মুখে পাকা পাকা কথা। পেটে বেল্ট বাঁধা। যেখানে ওরনা পেঁচিয়ে রেখেছে। প্রথম হয়েছে সে। তার পাকা পাকা করার জন্য সকলের কাছে বেশ পরিচিত সে। আজও তার জোরে প্রথম হয়ে এলো। ম্যাম পুরষ্কার-টা আয়রার হাতে তুলে দিল। আয়রা ট্রফিটা হাতে নিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আয়ানও মেয়ের হাসি দেখে হাসলো। আয়রাকে কিছু বলতে বলা হলো। সে মাইক্রো-ফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাবার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল..
— “আমার বাবা সুপারম্যান। আমাকে এতো এতো গিফ্ট কিনে দেয়। খাইয়ে দেয়। চুল বেঁধে দেয় গোসল করিয়ে দেয়। আমি যখন পাপাকে যেটা বলি, বাবা সব করে দেয়। আমাকে সব্বাই খুব ভালোবাসে।”
বলেই হেঁসে উঠলো আয়রা। চারিদিকে করতালি আওয়াজে ছেড়ে গেল। আয়ান হাত বাড়িয়ে দিল আয়রার দিকে। আয়রা একহাতে ট্রফি আর অন্যহাতে শাড়ির কুচি গুলো ধরে দৌড়ে এলো পাপার কাছে। আয়ান মেয়েকে জড়িয়ে নিল শক্ত বন্ধনে। আয়রার তার পাপাকে জড়িয়ে ধরলো।
একটা মেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে। সে এসে বক্তিতা দিলো কিছুক্ষণ। পুরোটা ছিল তার মাকে ঘিরে। আয়রার চোখ ছলছলিয়ে উঠলো। পাপার শার্ট খামচে ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠলো সে। আয়ান ভরকে গেল মুহুর্তেই। মনে হলো ভেতরে কেউ ছুড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে। আয়রাকে কোলে নিয়ে বলতে লাগলো..
— “আমার প্রিন্সেস কি হয়েছে তোমার? এই তো তোমার সুপার ম্যান আছে। বলো কি হয়েছে।”
আয়রা আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল..– “পাপা, আমি মায়ের কাছে যাবো। আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো!”
আয়ান ব্যাথিত হলো। যে মায়ের সাজ সেজে আজকে প্রথম হলো, সে থেকেও নেই। আয়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ছুটল হসপিটালের উদ্দেশ্য।
মেন্টাল এসাইলাম যার বাংলা পাগলা গারদ। গত সাড়ে চার বছর ধরে ইশরা এখানে আছে। আয়রার জন্মের পর জ্ঞানহীন থাকলেও পরে যথার্থ চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তোলা হয়। রক্ত মস্তিষ্কে জমাট বাঁধার ফলে কোমায় ছিলো সে। কিছু দিন পর কোমা থেকে ফিরে এলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আয়রা আয়রা বলে কাঁদত সে। ছোট প্রাণহীন পুতুলকে তার মেয়ে হিসেবে দাবী করতো। সারাক্ষন আজবুড়ি কথা বলতো। ইশরার চিকিৎসার জন্য তাকে হসপিটালে আর আয়রার জন্য আয়ানকে বাড়িতে থাকতে হতো। হঠাৎ একদিন জানতে পারে ইশরা হসপিটাল থেকে পালিয়েছে। আয়ান খুঁজে খুঁজে ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। মাস দুয়েক পরে তার সন্ধান পাওয়া যায়। পরেরবার আর রিক্স নিতে চায়নি আয়ান, বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে আয়রার ক্ষতি করার চেষ্টা করে ফেলে ইশরা। তার ধারণা, তার প্রিন্সেসকে সে মেরে ফেলেছে তাই সব বেবীদের সে মেরে ফেলবে। একসময় ইশরাকে বাড়িতে রাখা আয়রার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। তাই বাধ্য হয়ে এখানে রেখেছে। তবে প্রতিদিন আয়ান তার প্রিন্সেসকে নিয়ে দূর থেকে ইশরাকে দেখতে আসে।
এসাইলামের ভেতরে ঢুকতেই একটা কাঁচের গ্লাস ছুটে মারলো আয়ানের দিকে। আয়ানের পাশ কাটিয়ে গ্লাসটা গিয়ে ঠেকলো ফাঁকা দেয়ালে। কেঁপে উঠলো আয়রা। পাপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আয়ান ইশরাকে পেঁচিয়ে নিয়ে সামনে দিকে তাকালো। স্টার্ফরা ইশরাকে ইনজেকশন দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইশরা কিছুতেই ইনজেকশন দিবে না, তাই হাতের কাছে যা পাচ্ছে ছুঁড়ে মারছে। আয়ান আয়রাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে ইশরার দিকে এগিয়ে গেল। ইশরা আয়ানকে দেখে ছুটে এলো তার কাছে। পেছনে লুকিয়ে পড়লো তার। আয়ান সবাইকে হাতের ইশরায় থামিয়ে দিল। ইশরাকে বেডের উপর বসিয়ে দিল। গালে হাত দিয়ে বলল..
— “কি হয়েছে ইশুপাখি? এমন ছোটাছুটি করছো কেন?”
— “ওরা, ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায়। তুমি বলো, আমি মরে গেলে আমার প্রিন্সেসের কি হবে। কে দেখবে ওকে?
কিভাবে খুঁজে পাবো তাকে?
আয়ান ভিশন ভিশন চমকালো। ইশরা, পুতুল আয়রাকে ছেড়ে তার মেয়েকে খুঁজছে। যে ইশরা কারো সাথে কথা বলে না, আজ যে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। তাহলে কি খুব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে ইশরা। আয়ান হাতের ইশারায় আয়রাকে কাছে ডাকল। আয়রার হাতটা ইশরার হাতের মুঠোয় দিয়ে বলল ..
— “এটাই তোমার আয়রা, ইশুপাখি!”
— আমার আয়রা তো ছোট, একদম এইটুকু। তার মাকে ছাড়া খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না, হাঁটতে পারে না, কথাও বলতে পারে না।
(হাতের ইশারায়)
— “তুমি কি চাও না ইশুপাখি, তোমার আয়রা বড় হোক?”
“হ্যা চাই তো!”
মাথা চুলকে কথাটা বলে উঠলো ইশরা। আয়রাকে টেনে নিলো বুকে। আধো আধো ছোট ছোট হাত গুলোতে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো। নিজের শতবছরে তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত সে। আয়রাও যেন তার মাকে পেয়ে খুশি। আয়ান তৃষ্ণার্ত পাখির মতো তাদের মিষ্টি সম্পর্ক উপভোগ করতে লাগলো। হঠাৎ কি হলো জানা নেই ইশরাকে। আয়রাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো সে। দুহাত মাথায় চেপে চিৎকার করে উঠলো। ডাক্তারসহ সকলে তাকে থামাতে এগিয়ে এলো। অনেক চেষ্টার পর যখন ব্যর্থ হলো ইশরাকে থামাতে, তখন অন্য উপায় অবলম্বন করলো। ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নেতিয়ে পড়লো ইশরা। আয়ান তাকে বেডের উপর শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারে চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল।
মুখোমুখি বসে আছে আয়ান আর ডাক্তার। আয়রা তার মায়ের কাছে বসে আছে। বসে আছে বললে ভুল হবে, কাঁদছে। সেও তার মায়ের ভালোবাসা চায়।
— “আমাদের ধারণা আপনার ওয়াইফ খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। তবে কবে সুস্থ হবে জানা নেই।”
— “ডাক্তার আমি আমার ওয়াইফকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। আমার বিশ্বাস আয়রা তার ভালোবাসা দিয়ে তার মাকে ঠিক সুস্থ করে তুলবে।”
— “ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি। তবে প্রতিদিন একবার করে নিয়ে আসবেন।”
ঠিক আছে বলে হাত মেলালো দুইজন। আয়ান ছুটল ইশরার কাছে। ইশরার সমস্ত জিনিপত্র প্যাকিং করতে হবে। আজ থেকে তারা আবার একসাথে থাকবে।
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::৩১
চারদিকে শান্ত পরিবেশ। আয়রার খুশির সাথে যোগ দিয়েছে প্রকৃতি। যেন তাদের মন-কেও জয় করে নিয়েছে আয়রা। হাতে তার আইসক্রিমের বাটি। সামনেই টেবিল ভর্তি আইসক্রিমে। একটা একটা করে খাচ্ছে সে। সবগুলো এঁটো করে রেখেছে। হাত মুখ ইতিমধ্যে মেখে ফেলেছে। আয়রার অদ্ভুত কান্ড দেখে নিঃশব্দে হাসলো ইশরা। টিস্যু পেপার দিয়ে পরিস্কার করে দিল আয়রার হাত, মুখ। চামচ দিয়ে মুখে পুড়ে দিল। আয়রা খেয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিল। যেন এই খাবারের চেয়ে সুস্বাদু আর কিছু নেই। হয়তোবা নেই, প্রথমবার মায়ের হাতের খাবার বলে কথা। ফট করে নেমে গেল চেয়ার থেকে। লাফ দিয়ে ইশরার কোলে উঠে পড়লো। মায়ের মুখে আইসক্রিম ঢুকিয়ে দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরে রইলো।
আয়ান হাত টেবিলের উপর রেখে তাতে থুতনি স্থাপন
করলো। ভ্রু কুঁচকে বলল..
— “আমি বুঝি কেউ নই। মাকে পেয়ে প্রিন্সেস তার পাপাকে ভুলে গেছে।”
পুনরায় লাফ দিয়ে ইশরার কোল থেকে নেমে দাঁড়ালো। ছুটে গেল আয়ানের দিকে। আয়ানের কোলে উঠে বসলো। আইসক্রিমের বাটি থেকে এক চামচ তুলে দিলো তার মুখে। টিস্যু পেপার দিয়ে আয়ানের গাল পরিষ্কার করে দিলো। শব্দ করে চুমু দিলো আয়ানের গালে। দাঁত বের করে বলল..
— “আমি তোমাকে ভুলি নি পাপা। প্রিন্সেস-রা কখনো ভুলে না। আমি তো মাকে আইসক্রিম খাইয়ে দিচ্ছিলাম। বিশ্বাস করো, আমার ভাগের টা খাইয়ে দেয় নি।”
বলেই দুহাতে তালি দিলো। মেয়ের পাকা পাকা কথায় হাসলো ইশরা। তার ছোট মেয়েটা বাবা মা দুজনেই প্রচন্ড ভালোবাসে। সেদিকে আক্ষেপ নেই আয়রার। সে খেতে মন দিয়েছে।
.
.
ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। আশেপাশের মানুষগুলো এখনো জেগে আছে কিন্তু তাতে কোনো যায় আসে না। ইশরা আর আয়রা ঘুমিয়ে আছে বেডের উপর। এমন সময় রুমে প্রবেশ করলো আয়ান। মা মেয়েকে কাছাকাছি ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তৃপ্তিকর হাসি ফুটে উঠল তার মুখশ্রী জুড়ে। বাড়িতে ফেরার পথ থেকে ঘুমিয়ে আছে ইশরা। ঘুমাচ্ছে বললে ভুল হবে, মেডিসিনের সাহায্যে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে আয়ান। নিজের রুমে প্রবেশ করার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ঠিকই ছিল ইশরা। কিন্তু রুমে পদচরণ ফেরতেই চোখ আটকে গেল দেয়ালে থাকা ছবির দিকে। শুরু হয়ে গেল যন্ত্রনা। থামানোর চেষ্টা করল আয়ান। ব্যর্থ হয়ে মেডিসিন খাইয়ে দিলো ইশরাকে। এখন বেশ শান্তশিষ্ট হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আয়ান হাতের খাবারের প্লেট টা নিঃশব্দে সেন্টার টেবিলের উপর রাখল। ইশরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আজ নিজেকে পূর্ণ পূর্ণ লাগছে আয়ানের। মৃদু স্বরে ইশরা বলে কয়েকবার ডাক দিলো। বিনিময়ে ইশরা জাগল না, আয়রার ঘুম ভাঙল। চোখ ডলে পাপার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে হুঁস বলল। আয়ানও ঠোঁটে আঙুল দিলো। আয়রা নিচে নেমে গেল। পাপার হাত ধরে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়ে এলো, যাতে ইশরার ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে। ফিসফিসিয়ে বলল..
— “পাপা তুমি দেখতে পারছো না, মাম্মা ঘুমাচ্ছে। তাকে কেন জাগাচ্ছো? সুপিরম্যান রা এতো পঁচা হয় বুঝি। ”
আয়ান একহাটু ভাঁজ করে আয়রার পায়ের কাছে বসলো। আয়রার সাথে তাল মিলিয়ে সেও বলল..
— “তোমার মাম্মা তো এখনো অসুস্থ। তোমাকে ভালবাসে তাই তোমার সাথে এসেছে। তাকে মেডিসিন খাইয়াতে হবে না। খাবার না খেলে মেডিসিন খাবে কিভাবে আর ঘুম না ভাঙলে খাবার খাবে কিভাবে?”
ঠোঁটের উপর রাখা হাতটা নিয়ে কোমরে রাখল। বেশ বিরাগী মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। আরেক হাতের ইশারায় বলল..– “জানি জানি, সব জানি। আমি তোমার মতো নই যে, সব ভুলে যাবো। আমি অনেক আগেই মাম্মাকে খাইয়ে দিয়েছি। খাবার আর মেডিসিন দুটোই। বুঝেছো তুমি! এখন আর ডিস্টার্ব করো না, ঘুমাতে দাও বাপু।”
আয়ান দোটানায় পড়লো। আয়রা না বুঝেই তাকে মেডিসিন খাইয়ে দিয়েছে। এতে হিতের বিপরীত না হলেই হয়। আয়ানকে ভাবনায় বিভোর দেখে আয়রা বলল..
— “পাপা তুমি চিন্তা করো না। আমি প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে মিলিয়ে খাইয়ে দিয়েছে। এসো দেখাচ্ছি। তুমি আমাকে ততোটা ছোট মনে করো, ততোটা ছোট নই আমি।”
অতঃপর আয়ানকে টেনে নিয়ে এলো আয়রা। বেডের উপর বসিয়ে এঁকে এঁকে মেডিসিনগুলো আয়ানের নিকট এগিয়ে দিলো সে। আয়রার দায়িত্ব জ্ঞান দেখে অবাক হলো আয়ান। একদম ইশরার মতো। যেমন তার দায়িত্ব জ্ঞান তেমন দেখতে। হয়তো ইশরার কপি। তৃপ্তিকর হাসির রেখা ফুটি উঠলো মুখমন্ডল জুড়ে। মেয়েটা ইশরাকে এতোটা ভালোবেসে।
আয়রা গিয়ে শুয়ে পড়লো বেডের এক প্রান্তে। ইশরার বাম পাশে। আয়ান এগিয়ে গেল সেদিকে। আয়রাকে মাঝখানে আনতে চাইলে বাঁধ সাধল আয়রা। বলল..
— “পাপা, মাম্মাকে আমি যতোটা মিস্ করেছি তুমিও ততোটা করেছো। তাই তো মাম্মা আমাদের দুজনের। এখন থেকে মাম্মা আমাদের মাঝখানে ঘুমাবে।”
আরো একবার শব্দহীন হাসলো আয়ান। আয়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেডের কিনারায় কোল বালিশটা রেখে দিল। যাতে আয়রা নিচে পড়ে ব্যাথা না পায়। পায়ের কাছে গোটানো ভাঁজ করে রাখা ব্লাঙ্কেট-টা বুক পর্যন্ত তুলে দিলো। আলো বন্ধ করে ইশরার অপর পাশে শুয়ে পড়লো। অনেকদিন পরে ছুয়ে দেখলো প্রিয়শ্রীকে। হাহাকার করা বুকটার তৃষ্ণা মিটিয়ে নিলো। ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সে।
_________
রাত তখন গভীর। চারদিকের লোকজন ঘুমের তলদেশে। বাড়ির আলো গুলো বন্ধ। রাস্তার ধারের ল্যাম্প-পোস্টের আলো জ্বলছে। আয়ান আয়রা নিদ্রাচ্ছন্ন। সবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে ইশরার। নয়ন জোড়া মেলতেই নিজের শিকলে আবদ্ধ কোনো রমনী মনে হলো। দুজন মানব তাকে পেঁচিয়ে ধরে নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে আছে। নড়াচড়ার শক্তিটুকু অবকাশ নেই। ধীরে ধীরে দুজনকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো ইশরা। হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এতোক্ষণ মনে হচ্ছিলো তার শরীরের উপর কোনো চালের বস্তা রাখা।
বেলকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালো ইশরা। বাইরের দিকে মুখ করে রেলিং এর উপর বসলো। হাত মেলে মেলে দিলো গ্ৰিল বিহীন বেলকেনিতে। মুক্ত পাখিদের ন্যায় নিজেকে লাগছে। কিছুদিন আগেও সে সুইসাইড করতে গিয়েছিলো। কিন্তু সক্ষম হয়নি অথচ আজ সেই সুযোগ থাকার সত্ত্বেও সে ঝাঁপ দিচ্ছে না। নিজের জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেয়েছে। তদানীং শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠলো ইশরা। কোনো শক্তপোক্ত পুরুষের হাত তার কোমর বেধ করে গেছে। অতিশয় অনুভুতিতে গ্ৰথণ করে নিলো নয়ন যুগল। সাথে সাথে পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। তার আগেই কেউ কাঁধে মুখ গুঁজে দিল। অন্যহাত দিয়ে ইশরাকে পুরো পেঁচিয়ে নিল। ইশরা কাঁপা কাঁপা অধর জোড়া নাড়িয়ে বলল..
— “ককি কি-করছেন? ছা-ছাড়ুন। পরে যাবো।”
আয়ান আরো দৃঢ় বাঁধনে মুড়িয়ে নিল ইশরাকে বলল..
— “তুমি একসময় নিজের চেয়েও আমাকে বেশি বিশ্বাস করতে পারতে ইশুপাখি। তোমার সেই অন্ধবিশ্বাস কোথায় গেল।”
ইশরা ছলছল চোখে অবলোকন করলো আয়ানকে। এই স্পর্শ তার শতজন্মের চেনা। কোনো অস্বস্তি হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এই স্পর্শটার জন্য সে হাহাকার করছে। পরক্ষণেই স্মৃতিশক্তি সচল হয়ে উঠলো। দুহাতে মাথা চেপে মনে করার চেষ্টা করলো পূর্বের ঘটনাগুলো। বিনিময়ে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো। চিৎকার করে উঠল। — “আমার কিছু মনে পড়ছে না। কি করবো আমি।”
— “ইশুপাখি, তোমাকে কিছু মনে করতে হবে না। তুমি শান্ত হও।”
আয়ান তট জলদি ইশরাকে কোলে তুলে নিলো। বেলকেনিতে থাকা দোলনায় বসিয়ে দিল। জড়িয়ে নিলো ইশরাকে। বলল..
— “প্রয়োজন নেই কিছু মনে করার। শুধু তুমি একটু সুস্থ হও আমার আর কিছু চাই না।”
— “আয়ান, আমি চাই সবকিছু মনে করতে। আপনাদের সাথে ভালোভাবে, প্রাণখুলে বাঁচতে। কিন্তু পারছি না। প্লীজ আমাকে নিজের সাথে গুছিয়ে নিন।”
— “নিবো ইশুপাখি খুব কাছে গুছিয়ে নিবো। তুমি যেমন থাকো না কেন, আমার শুধু তোমাকে চাই।”
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)