অপরাজিতা পর্ব-০২

0
1

#অপরাজিতা
#শারমিন_প্রিয়া

#পর্ব_দুই

মাথা ঝিনঝিন করছে। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় ব্যথা অনুভব করলাম পুরো শরীরে। চোখ খুলতে গেলে কষ্ট হলো। তবু আস্তে আস্তে বন্ধ চোখ খুললাম। নিজেকে অচেনা একটা জায়গায় দেখে চমকালাম। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে বুঝলাম আমি হাসপাতালে। চট করে মনে পড়তে লাগলো রাতের ঘটনা। কলিজা কাঁপতে শুরু করল, ধড়ফড় করে উঠার চেষ্টা করে ব্যথা পেলাম। স্যালাইন লাগানো হাতে। পেটে হাত দিয়ে আমার আ*,ত্মা শুকিয়ে গেল। পেটে আমার মানিক নেই। পেট খালি। জোরে কান্না করে দিলাম।

ঠিক তখনই নার্স আসলো রুমে। জিজ্ঞেস করলাম, “আমার মা কই? আমার বেবি কই?”

নার্স বলল, “আপনি কেবিনে আছেন। আপনার বাড়ির সবাই আছে এখানে।”

“আর আমার বাচ্চা? পেট খালি কেন আমার?”

নার্স চুপ থাকল। আমি হেঁচকা টান দিয়ে স্যালাইনের সুচ খুলে উঠলাম। নার্স শক্ত করে আমাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারল না। চেচিয়ে উঠলো, “রোগীর লোক কই? পড়ে যাবেন তো উনি!”

আমি চি*ৎ*কার করলাম, “মা!”

ভাবি দৌড়ে এসে আমাকে ধরলেন, “তুমি উঠেছো কেন?”

“আমার ছেলে কই ভাবি?”

“সে আছে। তুমি বসো তো এখানে। বসো। তোমার যা অবস্থা, এই অবস্থায় উঠছো কেন? দেখো তো, হাতে র*ক্ত বের হচ্ছে।”

মা আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। মুখ ঘুরিয়ে আছেন। কেঁদে কেঁদে ডাকলাম মাকে, “মা, তাকে আমার কাছে এনে দাও। তাকাও না মা। আমার দিকে তাকাও। মুখ ঘুরিয়ে আছো কেন?”

মা এসে আচমকা আমার হাত ধরে কাঁদতে লাগলেন। আমি স্ত*ব্ধ। কিছু টের পাচ্ছি। কাঁপছে শরীর। “কি হয়েছে মা খুলে বলো, আমাকে টেনশনে রেখো না।”

ভাবি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “দেখো সুমাইয়া, আমাদের হাতে কিছু নেই। সব আল্লাহর হুকুমে হয়।

কাল রাতে তুমি এমন জোরে ফ্লোরে পড়েছিলে যে, ভিতরে থাকা বাচ্চার চাপ সহ্য হয়নি। ডেলিভারি ডেট নিকটে হওয়ায়, আগেভাগেই প্র*স*বের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার আগেই বাচ্চার মাথা নিচের দিকে নেমে আসে… তোমার ওমনভাবে পরে যাওয়ায় বাচ্চার মাথায় প্রচণ্ড চাপ পড়ে, অনেক র*ক্তও যায়। তুমি তখন অ*জ্ঞা*ন ছিলে।

তোমাকে আর বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাচ্চাকে এনআইসিইউতে রাখা হয়। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বাচ্চার মাথায় গুরুতর আঘাত লাগায় তারা হার মেনেছেন। ঘণ্টাখানেক আগে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়!”

আমি পা*থর হয়ে বসে থাকলাম। বুঝতে পারছি না আমার সাথে কি হচ্ছে, না হচ্ছে। টাল খেতে লাগল মাথা। সবাই আমাকে ঘিরে ধরল আবার। পানি খাওয়ালো। মা পা*গল হয়ে ডাক্তারকে ডাকলেন। ডাক্তার এসে আমাকে উত্তে*জিত না হতে বললেন।

আমি স্থির থাকতে পারছি না। মাকে বললাম, “আমার কিছু হবে না। আমার পোড়া কপাল। পোড়া কপাল যাদের, তাদের কিচ্ছু হয় না। আমাকে আমার ছেলের কাছে নিয়ে যাও। উঠো। ধরো আমাকে।”

মা আর ভাবি আমাকে বাচ্চার ওয়ার্ডে নিয়ে গেলেন। আমার কলিজাটা ঘুমিয়ে আছে অচেতন হয়ে। কী সুন্দর চেহারা আল্লাহ দিয়েছেন, মাশাআল্লাহ। তার কাছে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমার বাবা আর ভাই। আমি তার কাছে বসলাম। হাতে-পায়ে পা*গলের মতো হাত বুলিয়ে চুমু খেতে লাগলাম। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না তো আছেই।

পাশেই একজন ডাক্তার ছিলেন, তাঁকে ডাকলাম জোরে। কাছে আসলে অনুরোধ করলাম, “প্লিজ, আরেকবার চেক করে দেখুন না, হয়তো বেঁচে আছে।”
ডাক্তার না বলেননি। আমার কথামতো দেখলেন। দুইবার চেক করলেন। তিনি বললেন, “বাচ্চা আর নেই। আপনার জন্য আবারও দেখলাম। মন খারাপ করবেন না। আল্লাহর ইচ্ছে সব।”

মা জোরে জোরে কাঁদছেন। হাসপাতালের অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে মায়ের কাছে। আমি বাবুর পায়ের কাছে মাথা নুইয়ে আমার ঠোঁটজোড়া তার পায়ে লাগিয়ে বসে আছি। চোখের পানিতে আমার বুক ভিজে গিয়ে সিটে পড়ছে।

মহিলারা আমাকে বুঝাতে লাগলো, “ছোট বাচ্চা মা*রা যাওয়া ভালো। কেয়ামতের দিন সুপারিশ করে মা-বাবাকে জান্নাতে নেবে। তোমার ভাগ্য ভালো, তাই আল্লাহ তোমার বাচ্চাকে উনার কাছে নিয়ে গেছেন।”

কারও কথা আমাকে স্পর্শ করছে না। আমার ভেতর যে অদ্ভুত ব্যথা হচ্ছে সেটা আল্লাহ ছাড়া কেউই টের পাবে না।

বাচ্চাকে বাড়ি নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, “আমার কোলে দাও। বাড়ি পৌঁছানোর আগে অব্দি সে আমার কোলে থাকুক।”

নার্স বলল, “আপনার শরীর ভালো না। ট্রিটমেন্ট চলছে। আপনাকে হাসপাতালে থাকতে হবে।”

আমি কারও কথা শুনিনি। মাকে বললাম, “দরকার হলে পরে আসব। তবুও আজ থাকব না হাসপাতালে। ম*রলে ম*রব, তাও থাকব না।”

বাবা-ভাই মিলে আমার ওষুধ নিয়ে অ্যা*ম্বু*লে*ন্সে করে বাড়ি চললাম। সারা রাস্তা ছেলেকে আমার কোলেই রাখলাম। বুকের সাথে বুক জড়িয়ে রাখলাম। চুমু খেলাম। গাড়ি থেকে নামলে মা বললেন, “আমার কাছে একটু দে সুমাইয়া, আমি একটু সোনাটারে বুকে জড়িয়ে রাখি।”

আমার সাথে যে কাল রাত থেকে এত কিছু হয়েছে তা নিশানের বাড়ির কেউ জানেনা। রাগে আমাদের বাড়ির কেউ তাদের জানায়নি। অবশেষে হয়তো ভাবি জানিয়েছেন, বাচ্চার খবর। শাশুড়ি, ননদ, শ্বশুরসহ আরও কয়েকজন আসছেন ওখান থেকে। শ্বশুর একবার বলছিলেন, “আমাদের বংশের ছেলে আমাদের বাড়ি নিয়ে ক*ব*র দেই।” কথাটা আমার কানে আসতেই সারা শরীরে আ*গুন ধরে গেল আমার।

গলা উঁচু করে বললাম, “ও আমার ছেলে! আমার পেট থেকে হয়েছে। এটাই ওর বড় পরিচয়। ওর বাবা নেই, বাবার বাড়ির কেউ নেই। আমার ছেলের ক*ব*র আমার বাবার বাড়িতেই হবে। আমার চোখের সামনে থাকবে। এটাই শেষ কথা।”

তারা কেউ আর কিছু বলেনি। চুপ থাকলেন।
শাশুড়ি আমার কাছে অনুনয় করলেন অনেক, দুঃখ প্রকাশ করলেন, কাঁদলেন। ছেলের জন্য তো আর তাঁকে বা তাঁর পরিবারের অন্য কাউকে দোষ দিতে পারি না।

ছেলের ক*বর দেওয়া হলো। হাসপাতাল থেকে বাড়ি এনে ক*বর দেওয়া পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক ছিলাম। কান্না করিনি।
কিন্তু যখন তাকে ক*বর দিয়ে সবাই বাড়ি আসল, তখন আকাশ, গাছ-গাছালী ভেঙে চুরে বৃষ্টি নামলো ধরণীতে। চারপাশ ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল।
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। সব খালি লাগতে লাগল।
যার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম, যাকে কোলেপিঠে করে আদরে মানুষ করতাম, হেসে খেলে দিন যেত, সে আজ আমার কাছে নেই। একটা বিড়াল পুষলেও তার প্রতি মানুষের মায়া হয়, আর যাকে নয়টা মাস কষ্টে, যন্ত্রণায় গ*র্ভে বড় করলাম, সেই মানিক আজ আর আমার পেটে নেই। বড্ড খালি খালি লাগে পেটটা। পেটের চারপাশে হাত বুলিয়ে এক হাতে শক্ত করে ধরে মুখে ওড়না গুঁজে চি*ৎকার করতে লাগলাম। এত অসহায় আমি নিজেকে কখনও অনুভব করিনি৷

বারবার মনে হচ্ছিল, কেন আমাকে আল্লাহ নিয়ে নিলেন না? আমি কীভাবে বেঁচে থাকব সামনে? এই এত কষ্টের দিন আমি কীভাবে পার করব?

আমাকে পরদিন হাসপাতালে নেওয়া হয়।
সেখানে অনেকদিন থাকার কথা থাকলেও দিন কমিয়ে নিয়ে আসি। বলি, বাসায় ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করব৷ বাসায় থাকার মূল কারণ—বাড়ির পশ্চিম দিকে আমার ছেলের ক*বর। আমি সেটা রোজ কয়েকবার দেখি। রোজ রাতে তার জন্য আমি কাঁদি।

নিশানের প্রতি এমন ঘৃ*ণা জন্মেছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। জা*নো*য়া*রকে সামনে পেলে জ্যা*ন্ত মে*রে ফেলতাম আমি।
আস্ত এক খু*নি সে। তাকে পু*লি*শে ধরিয়ে শা*স্তি না দিলে আমি শান্তি পাব না।
অ*মা*নুষটার জন্য আজ আমার বাচ্চা আমার কাছে নেই।

তার কথা তো বলাই হয়নি—আমার ছেলে মা*রা যাওয়ার পরদিন তার সমস্ত তথ্য জানা গেছে।
কক্সবাজারের একটা হোস্টেলে উঠেছিল মেয়েটাকে নিয়ে। অলরেডি বিয়ে করেছে তারা। মেয়েটার বাড়ি তার আর আমার বাড়ির ধারেকাছেই।

তাদের সম্পর্ক নাকি বিয়ের আগে থেকেই ছিল। বিচ্ছেদ হয়েছিল মাঝখানে, তাই পরিবারের কথামতো বিয়ে করেছিল।অবশেষে একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে না পেরে বিয়ে করেছে।

মেয়েটার প্রতি ও রাগ হলো প্রচুর। যদি হাতের সামনে পাই, তাকেও শেষ করে দেব আমি।
তোদের এত ভালোবাসা কোথায় থাকে রে! কী সুন্দর করে তোরা মানুষকে শেষ করে ফেলিস!

মেয়েরাই মেয়েদের প্রধান শত্রু।
জানে একজন বিবাহিত, তবুও বিয়ে করে! যতই আগের প্রেমিক হোক না কেন! ন*ষ্টা মেয়ে!

দুইদিনের মধ্যেই চাচা তাদের গ্রেফতার করেন।
একজন বউকে ডিভো*র্স না দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে—এর জন্য নিশানের একবছর জেল আর টাকা জরিমানা করা হয়।
আমার পক্ষ থেকে ডিভো*র্স পেপার ও পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

যেদিন তাকে গ্রেফতার করে থানায় নেওয়া হয়, সেদিন ভাবি মাকে সঙ্গে নিয়ে আমিও যাই চাচা, বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে।
পু*লিশ অফিসারকে বলি, “আমার একটু কথা আছে, একটু দাঁড় করান ওদের।”
চাচা থামাতে বললে অফিসার থামিয়ে দিলেন।
নিশান এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। মেয়েটা মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমি পায়ের জুতো খুলে দুই হাতে দুজনকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকি।
ভাবি আমাকে টেনে সরান।
আমি চি*ৎ*কার করে বলি, “চাচা, ওদের ওতটুকু শা*স্তি দেবেন যতটুকু আমি পাচ্ছি। আমার কাছ থেকে আমার বাচ্চাকে কেড়ে নেওয়ার শাস্তিটাও দেবেন।
যন্ত্রণা দিতে দিতে দুজনকে জ্যান্ত মে*রে ফেলবেন। আদালতে মেয়েটার বিচার হবে না জানি, ওরে আমার কাছে ছেড়ে দিন, থা*প্পড় আর লা*ত্তি দিতে দিতে শেষ করে ফেলব আমি। ভাবি টেনে সরান আমাকে। হাাঁপাতে থাকি আমি। জোরে নিশ্বাস নেই।

________

দিন, মাস গড়িয়ে যায়। আমার ক্ষত ধীরে ধীরে সারতে থাকে। না, নিশানের জন্য আমার খারাপ লাগে না। কখনও আমার কলিজা কাঁদে না—কাঁদে আমার বাচ্চার জন্য।
হয়তো নিশানের জন্য আমার অনেক কষ্ট হতো, যদি আমার বাচ্চা মা*রা না যেত।
যার কারণে আমার সব শেষ, সে আমার কাছে আস্ত একটা জা*নো*য়া*র। এর থেকে বড় পরিচয় আর কিছু নেই তার।

আগের চঞ্চল আমি দিন দিন চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে যাচ্ছি। কারও সঙ্গে বেশি কথা বলি না, আগের মতো হাসি না।

একজন বে*ই*মা*ন আমার সব কেড়ে নিয়েছে। এখনও সে জে*লে। মেয়েটা কই জানিনা৷ তাদের তালাক হয়নি এতটুকু জানি। সাজা শেষ হবে, বের হবে। দুটো মিলে সংসার করবে। করুক।
আমার কিছু যায় আসে না। আমি তার কোনো খবর রাখি না।
তবু হঠাৎ হঠাৎ, মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মনে হয়—সে কেন আমার সঙ্গে এমন করল?
সে তো বহুবার বলেছে, আমাকে ভালোবাসে, আগলে রেখেছে, কেয়ার করেছে।
তবে এত যত্ন করে কীভাবে মানুষ মানুষকে ঠকাতে পারে? আমার কোনো হিসেবই মেলে না।

জীবনের এত কঠিন সময় পার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি আমি। ধুঁকে ধুঁকে ম*র*ছি রোজ। নতুন করে বাঁচতে চাই। আগের আমি হতে চাই। হাসিখুশি দিন ফিরে পেতে চাই। হুট করে একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, এ শহরে আর থাকব না। বাংলাদেশেও না। পাড়ি জমাবো এবার সাত সমুদ্রের ওপারে।

ফ্রান্সের প্যারিসে আমার বড় বোন, তার মেয়ে আর জামাই থাকে।দুলাভাইয়ের নিজস্ব ব্যবসা আছে সেখানে। আমি সেখানে যাব।
ভিন্ন জায়গায় গেলে হয়তো আমার আগের আমিকে একটু হলেও খুঁজে পাব।
নতুন করে সব পেছনে ফেলে বাঁচতে পারব। নিশান আমাকে ঠকিয়ে দিব্যি বেঁচে থাকতে পারলে, আমি কেন ঠকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারব না?
অবশ্যই পারব। পারতেই হবে আমাকে।

পাসপোর্ট অলরেডি আগে থেকে করা আছে আমার। বাবাকে বললাম, “আমার সবকিছু রেডি করো, আপুর সঙ্গে কথা বলে। আমি প্যারিস যাব। দয়া করে কেউ বাধা দিও না। আমাকে নতুন করে বাঁচতে সাহায্য করো।”

চলবে…?