#অপরাজিতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_তিন
আপা আর দুলাভাইয়ের মাধ্যমে লং-স্টে ভিসা হয় আমার। হাতে পাওয়ার এক মাসের মধ্যেই ফ্রান্সে পা রাখি। সেখানে গিয়ে বসে না থেকে একটা কফিশপে জব নেই দুলাভাইয়ের মাধ্যমে। মূলত সব সময় কাজের মধ্যে ব্যয় করতে চাই। ঘটে যাওয়া ঘটনা যেন গভীরভাবে মনে না পড়ে, আর পড়লেও যেন তার প্রভাব তেমন না পড়ে, সব ফোকাস যেন কাজেই থাকে। সময়টা ভালোই কাটছিল। ভালো সময়কে আরও ভালো রূপ দিতে আমার জীবনে একজনের আগমন হলো। সেও ওখানে একটা কোম্পানিতে জব করে। আমাকে কফিশপে দেখে একদিন। তারপর পরপর এক সপ্তাহ একই কফিশপে আসে। আমাকে একদিন ডেকে বলে, “আমাকে বিয়ে করবেন?”
আচমকা এমন কথায় আমি তাজ্জব বনে গেলাম। রাগও হলো কিঞ্চিৎ। পুরুষদের প্রতি নিজের অজান্তেই কেন জানি একটা রাগ চলে আসছিল ভিতর থেকে। তাই কোনো ছেলের এত মাখামাখি কথাবার্তা একদম অসহ্য লাগে আমার। কিন্তু ছেলেটা রোজ আসতে লাগল কফি শপে। এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে আমাকে। অস্বস্তি ফিল হয় আমার। সহ্য করতে না পেরে সরাসরি একদিন বলেই দিলাম, “আপনি কফি খেতে আসেন, না কি মেয়েদের দেখতে আসেন?”
সে এক গাল হেসে বলল, “আপনাকে দেখতে আসি, কোনো সমস্যা?”
ফিরে কিছু বলার না পেয়ে সেখান থেকে সরে যাই।
দুলাভাই আর আপাকে বিষয়টা জানাই। দুলাভাই সরাসরি তার সাথে কথা বলেন। আমাকে ডিস্টার্ব করতে না বলেন। সে দুলাভাইকে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। বিয়ের কথা শুনে দুলাভাই আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বলেন। সে তাও বিয়ে করতে চায়। দুলাভাই আর আপার সাথে তার একটা সুন্দর সম্পর্ক হয়ে যায়। কিন্তু আমি তখনও এড়িয়ে চলি। নতুন করে কোনো পুরুষের সাথে জড়াতে চাচ্ছিলাম না। কফি শপে আসা-যাওয়া সে কমিয়ে দিলো। সপ্তাহে দু’দিন আসে। তার যাতায়াত এখন বাসাতেই হয়, দুলাভাইয়ের সাথে ভালো বন্ধুত্ব তাই। আমি তেমন সামনে পড়ি না। সে দুলাভাইয়ের বাসার পাশেই বাসা নেয়।
এক সকালবেলা হাঁটতে বের হয়েছি। খোলা বাতাসে, নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটছি। দূরে ছেলে-মেয়েরা জগিং করছে। গাছের ডালে দুটো পাখি টুকটাক করছে। সে জায়গায় থেমে গিয়ে অবাক চোখে তাদের দেখছি। কী যে সুন্দর লাগছে দেখতে!
“জোড়ায় জোড়ায় সবাইকে ভালো লাগে”— কথাটি শুনে চমকে গেলাম আমি। খানিক ভয়ও পেলাম। বুকে থু থু দিয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এক গাল হেসে দাঁড়িয়ে আছে ওই লোকটা। নামটা তার রোশান, দুলাভাইয়ের কাছে শুনেছি।
আমার আনইজি ফিল হচ্ছে, এত সকালে এই লোক এখানে! রাস্তায় প্রায় ফাঁকা। সে কি আমাকে ফলো করছিল? হেঁচকি উঠলো আমার। শক্ত হয়ে বললাম, “আপনি আমার পেছন পেছন আসছেন কেন? কবে ছাড়বেন এসব পাগলামি? ক্লিয়ার কথা শুনেন, কোনো অনুভূতি নেই আমার। আমি আপনার সাথে কখনও প্রেমে জড়াব না। দয়া করে আমার পিছু ছাড়েন। আপনি এরকম করলে আমি বিব্রতবোধ করি।”
“আমি তো প্রেম করতে চাই না। বিয়ে করতে চাই। বিয়ের পর প্রেম করব। একজনের কাছে ঠকছো বলে, অন্যজনকে শাস্তি দেবে কেন? আমি তোমাকে চাই। চাই মানে চাই। তুমি আমার না হলে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো।”
প্রচণ্ড বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে তাকালাম তার দিকে। “পা*গ*ল হইছেন?”
“হ্যাঁ, পা*গ*লই।” তারপর সে মুখ মলিন করে বলল, “দয়া করে মেনে নাও। আজ কতদিন ধরে তোমাকে চেয়ে যাচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না। আমার কষ্ট হয় খুব। একবার আমার হয়ে দেখো, কত ভালো রাখি তোমায়। দুঃখ তোমাকে ছুঁতেও পারবে না। প্লিজ সুমাইয়া। মেনে নাও।”
আমি কোনো কথা না বলে চলে আসি। চলে আসলে কি হলো! তার কথাগুলো কানে বাজছিল খুব। যতই বলি, পুরুষের প্রতি আগ্রহ উঠে গেছে, তবু আমার অবচেতন মন চায়— কেউ আমাকে ভালোবাসুক, যত্ন করুক, আগলে রাখুক। নতুন করে হাসিখুশি থাকতে শিখাক। ভালো থাকতে কে না চায়, আমিও চাই। শুধু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
তার প্রতি আস্তে আস্তে ফিলিংস আসতে শুরু করে। তবু তাড়াতাড়ি পাত্তা দেই না। সেও পিছু হটে না। সেইম এনার্জি নিয়ে আমাকে চাইতে থাকে। আপা অনেক বুঝালো আমায়, মাকে ফোন দিয়ে বলল, আমাকে বুঝাতে। সবাই বুঝালেন যাতে রাজি হই। এভাবে চলতে চলতে একসময় আমিও সায় দেই। ভাবলাম, নতুন করে আরেকবার সুন্দরভাবে বাঁচার চেষ্টা করেই দেখি। হয়তো সুখ আসবে। সবাই তো আর ঠকায় না।
তার পরিবারের খোঁজ নিলেন দুলাভাই। বলল, মা-বাবা নেই। শুধু একটা বোন আছে, বিবাহিত। তার সাথে সে কথাও বলিয়ে দিলো। তার দেশের বাড়ি সিলেটে, আর আমার দেশের বাড়ি বরিশাল। অনেক দূর। ছেলেকে দেখে সবার ভালো লেগেছে। আপা-দুলাভাইয়ের ভেতরে সে ততদিনে অনেক জায়গা করে নিয়েছে। তাই তাকে বিশ্বাস করে বোনের সাথে ফোনে কথা বলে সব ঠিক করা হলো। বাড়িতে আর যায়নি কেউ।
বিয়ে হলো প্যারিসে। ছোট্ট আয়োজনে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়ের পরবর্তী সময় এতো সুন্দর ভাবে কাটতে লাগলো, যা বলার বাহিরে। সে এত মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেখে, আমারই লজ্জা লাগে। এত ভালোবাসে, এত কেয়ার করে—যা দেখে আমি অবাক হই। ভেতর খুশিতে ভরে ওঠে। হাসি আর ভাবি, মানুষটাকে ফিরিয়ে দিলে কত কিছু মিস করতাম। এত যত্ন, ভালোবাসা আর কোথায় পেতাম! সে আমাকে নিয়ে রোজ ছুটির দিনে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। খুব ভালো গান গায় সে। আমার কোলে মাথা রেখে গান শুনায়। রাতে গান গেয়ে চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়ায়। সবসময় মনে হতো, দুঃখের পরেই বোধহয় সুখ হয়। আমার কপালে এত সুখ! হাজার শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে।
দিন ভালো কাটে আমার। সময় ভালো যায়। রাজরানীর মতো আছি আমি। নিশানকে একটা বার দেখাতে ইচ্ছে হয়, বলতে ইচ্ছে করে, দেখো—ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে আমায়, সেই আমাকেও কেউ কত যত্ন করে ভালোবাসছে, ইম্পরট্যান্স দিচ্ছে। তুমি বেইমানি না করলে এত ভালোবাসা আমি কোথায় পেতাম?
বছর খানেক পর সে দেশে ফিরতে চায়। আমি আসব কিনা জিজ্ঞেস করলে আমি জানাই, তুমি যাও, আমি আরও কয়েকদিন পরে আসব। সে দেশে আসে। আমার ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে তাকে ছাড়া। কষ্ট হয়। তার সাথে না এসে ভুল করলাম—এমনটাই মনে হতে লাগল।
খারাপ লাগলো তখন খুব বেশি, যখন দেখলাম, সে দেশে গিয়ে আমার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিলো—বলে দিনে একবার বা দুবার, তাও অল্প সময়। মন ছটফট করতে লাগল আমার। আজেবাজে কত কিছু মনে আসতে লাগল। তবু সে যখন কথা বলে তখন সব উধাও হয়ে যায়। কারণ খুব সুন্দর করে কথা বলে। যত্ন করে বলে। তার কথা শুনলেই আমি ফিল করি, সে আমাকে কতটা ভালোবাসে। সময় কম দিচ্ছ কেন জিজ্ঞেস করলে বলে, জমি নিয়ে মা*মলা চলছে, আরও কত কিছু—এজন্য সময় হচ্ছে না।
দিন দিন সময় আরও কমতে থাকে। আমি ছটফট করতে থাকি। মন খারাপে, একলা বিকেলে তাকে মনে পড়ে, কিন্তু চাইলেই পাই না। এসব পীড়া দিচ্ছিলো খুব। আর সহ্য করতে না পেরে আপাকে বলি, আমাকে দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। আমি আর থাকব না। নিশ্চয় রোশানের কিছু হয়েছে, নয়তো এমন করতো না আমার সাথে।
সবকিছু ঠিক করে এক মাসের ব্যবধানে বাড়ি আসি। রোশানকে জানাইনি যে আসছি। বাড়ি এসে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেই। মুগ্ধ হয়ে দেখি পুরো বাড়ি। ছেলের ক*ব*রের পাশে গিয়ে চুপচাপ খানিক দাঁড়িয়ে থাকি। তার কবরে আমের আঁটি ফেলে রেখেছিলাম—সে গাছটা অনেকটা বড় হয়েছে। বাতাসে গাছের ছোট ছোট পাতা আর ঘাসের পাতা নড়ছে, দেখতে খুব ভালো লাগছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি, পাতা নড়া দেখলে আমার মন পাড়ি দিয়ে দিচ্ছে ওই জগতে।
যত দাঁড়িয়ে থাকব, তত মন-মেজাজ খারাপ হবে, তাই আর না দাঁড়িয়ে বাড়ি যাই। মা-ভাবির সাথে এতদিনের জমা গল্প করি।
ওই দিন রাতে জানাই রোশানকে—আমি দেশে আসছি। তুমি এসে নিয়ে যাও আমাকে, নয়তো পুরো ঠিকানাটা দাও—ভাইয়াকে নিয়ে আসব।
সে বলল, বাড়িতে মা*মলা চলছে, এটা শেষ হোক। তুমি এসো না, আমিই আসব। মানলাম তার কথা। সে আসলো দুদিন পর। থাকলো এক সপ্তাহ। অনেক ঘুরলাম তাকে নিয়ে। বললাম, বাড়ি কবে নিবা? বাড়ি যেতে চাই। নয়তো পরে ছুটি ফুরিয়ে যাবে।
বলল, শীঘ্রই নেবো। এটা সমাধান হোক, জানিয়ে দেবো। আমাকে যেতে হবে লক্ষীটি। বুঝতেই পারছো, কত ঝামেলা বাড়িতে। সব ঠিক করে তোমাকে এসে নিয়ে যাব। ঘুরবো কয়েকদিন।
তার কথায় “আচ্ছা” বললাম। তবু জানি না কেন, ভেতরে একটা খটকা লেগেই থাকল। তার দেশে আসার পর থেকেই আমার এমন লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা বদলে গেছে।
তার জেলা-উপজেলা সব জানি। কখনও যাওয়া হয়নি ওখানে, তাই ক্লিয়ারলি অত চিনি না। সাহস করে বসলাম, ওখানে যাব। তাকে না জানিয়ে যাব। ছোট ভাইকে নিয়ে সিলেটের নাইট গাড়িতে উঠলাম। ভাবলাম, সিলেট নেমে তার কাছে কল দিয়ে সারপ্রাইজ দেবো। আর কোন গ্রামে বাড়ি সেটা জানব।
চলমান…..!