অপরাজিতা পর্ব-০৬

0
1

#অপরাজিতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_ছয়

এক অসহনীয় যন্ত্রণা পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে শরীর এতটাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল যে, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টেরও পাইনি। সকালে ঘুম ভাঙতেই শরীরটা সতেজ লাগছিল। আশ্চর্য হলেও সত্য, অনেকক্ষণ কান্নার পর ঘুমালে ঘুমশেষে শরীরটা কেন যেন একটু ফ্রেশ লাগে। জানালা খুলে দিলাম। পাখিরা কিচিরমিচির করছে, বাতাসে জানালার ধারের জারুল গাছের পাতাগুলো দুলছে এলোমেলোভাবে। কী স্নিগ্ধ, শান্ত একটা সকাল! এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই যাই আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। পরমুহূর্তেই সবকিছু মনে পড়ে বুকটা আবার হু হু করে ওঠে।

ব্রাশ করে বাইরে বের হলাম। বাড়ির কেউ তখনও উঠেনি। হয়তো সবাই নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কতদিন হলো ছেলেটাকে দেখি না। নিজের ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে, সেটা সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছি, ছেলের কাছে যাওয়ার মতো মানসিক শক্তিও আমার নেই।

কবরপাড়ে গিয়ে দেয়াল ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। গোলাপজলের বোতলের কিছু অংশ এখনো দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, একটা মানুষের আয়ু যেন সামান্য একটা বোতলের থেকেও কম। মনে মনে কত কথা বললাম ছেলের সঙ্গে। আমি যখন ওর কবরের পাশে আসি, তখন ভাবি, ও আমার কথা সব শুনছে। আফসোস করে বলি, আজ তুমি বেঁচে থাকলে, আমি তোমাকে নিয়েই নির্দ্বিধায় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।

বাড়ি ফিরে দেখি, মায়ের রুমে আমাকে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। সেদিকে না তাকিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলাম। মা-বাবা বার কয়েক ডাকলেন আমাকে। অবশেষে গেলাম তাদের কাছে। থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম রোশানকে দেখে। কখন এলো ও?

রোশানকে দেখে বুকের আগুন দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে উঠল। কাউকে পরোয়া না করে সোজা নিজের রুমে চলে এলাম। সে পেছন পেছন এসে ঢুকে পড়ল। আমি চিৎকার করে বললাম, “বের হও এখুনি! তোমার সাহস কী করে হয় আমার সামনে আসার?” তাকে ধাক্কা দিতে লাগলাম। সে আমার হাত ধরে ফেলল, জড়িয়ে ধরে বলল, “শান্ত হও প্লিজ।”

নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার শক্তি আমার নেই, তাই গলা নিচু করে বললাম, “আমাকে ছেড়ে দাও। যা বলার দূরে দাঁড়িয়ে বলো। ”

সে খাটে বসে বলল, “দেখো সুমাইয়া, কত মানুষ আছে যাদের দুই স্ত্রী আছে—তারা একসাথেই সংসার করছে। তোমাকে তো একসাথে থাকতে বলছি না আমি। আমরা বিদেশে থাকব, কিন্তু তুমি আমাকে ছেড়ে দিও না প্লিজ। খুব ভালোবাসি তোমায়। তুমি না থাকলে আমি নিজেকে সামলাতে পারব না।”

আমি ফুঁসে উঠলাম, “আমি যাকে ভালোবাসি, যাকে বিয়ে করেছি, হঠাৎ জানতে পারলাম তার স্ত্রী-সন্তান আছে! এটা কত বড় প্রতারণা বুঝতে পারছো? আমি মরে গেলেও তোমার স্ত্রী হয়ে থাকব না। যে আমার, সে কেবল আমার—সে অন্য কারও একবিন্দুও হলে সে আমার নয়।”

রোশান বলল, “আমি যদি তাকে ছেড়ে দিই? তবে কি তুমি থাকবে আমার সঙ্গে? কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি যেন চলে না যাও, তাই আমি প্রথমে মিথ্যে বলেছি। বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার যে টান, যে মায়া, তা আর কারও জন্য কখনও অনুভব করিনি। কে কখন কাকে ভালোবেসে ফেলে মানুষ তা জানে না। নিজের অজান্তেই কখন তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমিও বুঝতেই পারিনি। দয়া করে ক্ষমা করো আমায়, সম্পর্কটা ভেঙো না। আমি জানি, আমি ভুল করেছি, কিন্তু একটু বুঝো আমায়।”

আমি রাগে গলা কাঁপিয়ে বললাম, “তোমার কোনো কথা শুনব না আমি। কারও কথা শুনব না, যদি সেটা তোমার কাছে ফেরার কথা হয়। যারা বিবাহিত পুরুষকে দ্বিতীয় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে, আমি তাদের ঘৃণা করি। আমি ওরকম হতে পারি না, হতে চাই না।তোমাকে মেরে টুকরো টুকরো করলেও আমার দুঃখ কমবে না। দয়া করে সরো আমার চোখের সামনে থেকে। ”

সে ফিসফিস করে বলল, “তুমি যদি আমার না হও, তবে আমাকে মেরে ফেলো। তোমায় ছাড়া বেঁচে থাকার মানে নেই।”

আমি হু হু করে হেসে উঠলাম। রোশান পাগল হয়ে গেছে, নাকি আমি পাগল হয়ে গেছি—বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কীসব বলছে সে! ভালোবাসে নাকি আমাকে!

চোখ কঠিন করে বললাম, “অনেক হয়েছে। এবার বের হও। এক সেকেন্ডও দাঁড়াবে না এখানে।” জোর করে ঘর থেকে বের করে দিলাম তাকে। দরজা বন্ধ করে দিলাম।

বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগলাম। যতই রাগ করি না কেন, মন বলে, রোশান আমাকে সত্যিই ভালোবাসে। আমি অনুভব করি সেটা। আর সে সত্যি সত্যি ভালোবাসলেও তার সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। তার একটা বাচ্চা আছে। যদি জাকিয়া জানতে পারে আমরা আবার এক হয়েছি, সে কী করবে কে জানে! মেয়েটা প্রচণ্ড স্বার্থপর। আর আমি নিজেও এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারব না। সবসময় মনে হবে—ওর আরেকজন স্ত্রী আছে, ও তাকে ছোঁয়, তার সঙ্গে রাত কাটায়, খুব কাছাকাছি হয়। এসব ভাবলে না মরেও নরকের যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আমাকে। প্রতিদিন ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে। তার চেয়ে একবারেই কাঁদতে কাঁদতে মরে যাওয়া ভালো।

রোশান একটা ছেলে, তার চিন্তা আমার করে লাভ নেই। সে যখন জাকিয়ার কাছাকাছি যাবে, তখন আর কিছুই মনে থাকবে না। আমি যে ছিলাম তার জীবনে, সেটাই ভুলে যাবে। তাই এই সম্পর্ক এখানেই শেষ।

রোশান ব্যর্থ হয়ে চলে যায়। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখি। বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। ভীষণ মায়া লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এখনই দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি। বুকের উপর মুখ রেখে বলি—”অসম্ভব ভালোবাসি তোমায়!”

_______

বাড়ির সবাই আমার বিপক্ষে। কেউ ভালো করে কথা বলে না। মনে হয়, আমি যেন একটা উটকো ঝামেলা। সবাই কথা ছিল, রোশানকে যেন মেনে নেই। ওর ব্যবহার, ওর চোখের ভাষা, সবই দেখে যে কেউ বলবে, যা হয়েছে ভুলে যাও। ছেলেটাকে ক্ষমা করে নতুন করে শুরু করো।

কিন্তু আমি পারিনি। পারবও না।তার প্রতি ভালোবাসা এখনও আছে আমার, তবু তার থেকে যোজন যোজন দূরে থাকব আমি। বাড়ির লোকজন ও যখন আমাকে চায় না, এড়িয়ে চলে। তখন আমিইবা কেন তাদের চোখের সামনে থাকব?

আমি আবার প্যারিসে ফিরে এলাম। আসার আগে বাড়ির লোককে বললেও কেউ ভালো করে কথা বলেনি। এমনকি মা-ও না। মাঝেমধ্যে হাসি পায় অনেক, মনে হয় জীবনে দূর্ঘটনা না ঘটলে এক জীবন পার হয়ে গেলেও আমি মানুষ চিনতাম না। বুজতে পারতাম না, আপনজন ও পর হয়।

প্যারিসে আসার আগের দিন ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেই রোশানের ঠিকানায়। অনেকে হয়তো ভাববে, আমি তাকে শাস্তি না দিয়ে কেন এত সহজে ছেড়ে দিলাম? ‘মায়া’ কি জিনিস যারা জানেনা, তারাই এমনটা বলবে। অনেকবার ভেবেছি তাকে শাস্তি দিয়েই ছাড়ব। কিন্তু ভাবনা টা বাস্তব করতে পারিনি।

আমি তাকে এতটা ভালোবাসি, এতটা আসক্ত তার প্রতি, তাকে কষ্ট দেওয়া, তার ক্ষতির কথা ভাবাও আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি, আমার প্রতি তার মনের টান এখনো আছে। থাকুক না সে তার মতো, ভালো থাকুক।

প্যারিসে ফিরে আপা-দুলাভাইয়ের ব্যবহারও সুবিধার মনে হলো না। বুঝলাম, তারাও পরিবারের বাকিদের মতো চায়, যা হয়েছে ভুলে গিয়ে সংসারটা টিকিয়ে রাখতে হতো আমাকে।আমি উল্টো পথে হাঁটায় সবার রাগ আমার প্রতি।থাকুক রাগ।যারা আড়চোখে দেখে আমাকে, তারা যতই আপন হোক, আমি আর থাকব না তাদের পাশে। চলে যাব এমন জায়গায়, যেখানে আমার ছায়াটাও কেউ খুঁজে পাবে না।নতুন শহর, নতুন পরিচয়ে, সেখানে নতুন করে বাঁচব আমি।

রাতে গুগলে ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরের খোঁজ নিলাম।শেষে দক্ষিণ ফ্রান্সের ছোট্ট শহর ‘আভিগ’ শহরকে পছন্দ হলো।অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কেটে ফেললাম।আমি চলে গেলে আপা-দুলাভাই হয়তো কষ্ট পাবেন না, তবুও একটা চিঠি রেখে গেলাম, যাতে আমাকে না খোঁজে।

সকালে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম নতুন শহরের পথে। চার ঘণ্টার জার্নি শেষে এসে পৌঁছালাম ‘আভিগ’। দুহাতে ট্রলি ব্যাগ, গায়ে কালো ওভারকোট জড়িয়ে হাঁটছি। পাশ দিয়ে বয়ে চলা রোন নদীর কুয়াশা মাখা বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগছে।একটু থেমে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে দূরে একটা বুকশপ দেখলাম, ভাবলাম ওখানে গিয়ে হয়তো ভাড়ার বাড়ির খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু দোকান অব্দি যেতেই হলো না। তার আগে চোখে পড়ল একটা কাঠের বোর্ড, লেখা ‘রুম ভাড়া দেওয়া হবে’।

বোর্ডটা একটা পুরনো দু’তলা বাড়ির সামনে ঝুলছে।আশার আলো চোখে নিয়ে বাড়িটা সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।দুরুদুরু বুকে বেল বাজালাম।

মুহূর্তেই দরজা খুলে এক বৃদ্ধা বের হলেন। ঠোঁটে হালকা হাসি, চোখে মায়া।ইংরেজিতে বললেন, “কি চাই?”
আমি তার ভাষায় জবাব দিলাম, “বাসা ভাড়া দেওয়া হবে? আমি একটা রুম চাই।”
তিনি বললেন, “ভেতরে আসো, কথা বলি।”
তোমার নাম কী? কোথা থেকে আসছো?”

“প্যারিস থেকে।”
“প্যারিস থেকে কেউ এই ছোট শহরে আসে না সচরাচর।”
কি বলব, বুঝতে পারছিলাম না।সত্যি বললে হয়তো রুম ভাড়া দেবেন না।সত্যি পরে বলা যাবে, এখন একটা আশ্রয় দরকার।

বললাম, “পর্যটক হয়ে এসেছি। শহরটা ঘুরে দেখতে চাই। পরিচিত কেউ নেই। একমাসের জন্য রুমটা চাই।”
“ নাম ?”

এক সেকেন্ড ভেবে বললাম, “আমার নাম ক্লারা।”
ঢোক গিললাম গোপনে। এখন থেকে এই নতুন শহরে আমি ‘ক্লারা’। ক্লারা হয়েই থাকব।

তিনি একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, “তুমি বিদেশি? দেখতে তো বাঙালি মনে হচ্ছে।”
হেসে বললাম, “মা বাঙালি, বাবা ফ্রান্সের।”
হেসে বললেন, “আমি মাদাম এলিনা। আসো, রুমটা দেখিয়ে দিই। আমি একাই থাকি। এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে, ওরা প্যারিসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।উপরে ভাড়াটিয়ারা থাকে। তুমি যেহেতু মেয়ে, তোমাকে নিচতলায়, আমার রুমের কাছের রুমটা দিচ্ছি।”

রুমটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো আমার সাদামাটা হলেও অদ্ভুত সুন্দর, শান্ত, নিরাপদ।
মাদাম এলিনা সেই রুমের জানলা খুলে দিলে আমি অবাক হয়ে গেলাম। জানলার পাশেই সেই রোন নদীটা৷ জানলা দিয়ে রোন নদীর জলরঙা ছায়া দেখা যাচ্ছে। শা শা শব্দে নদীর জল বয়ে যাচ্ছে। বাতাসের ঝাপ্টায় রুমের পর্দা দুলছে বাতাসে। আমি স্তব্ধ হয়ে এক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম দৃশ্যে। অসম্ভব সুন্দর!

মাদাম এলিনার প্রশ্নে ঘোর ভাঙল আমার। তিনি মৃদু হেসে জানতে চাইলেন, “পছন্দ হয়েছে?”
উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, “অনেক, অনেক পছন্দ হয়েছে।”
“ওকে, বিশ্রাম নাও।”

এত অন্ধকারের পর এই আলোর দেখা পেয়ে মনে হলো বুকের ভেতর জমে থাকা ভারটা একটু হালকা হলো। ঠিক করলাম, পেছনে ফিরে আর তাকাবো না। মন পুড়লেও না।আমার কেউ ছিল না, না আমি কারও ছিলাম। এখন থেকে আমি শুধুই ‘ক্লারা’।

বিছানায় গা না এলিয়ে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে মনে হলো—এই শহর, এই নদীর পাড়ে, এই ছোট্ট রুমেই আমি বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব অনায়াসে।

চলমান…..!