#অপেক্ষারা
৩৩+৩৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
ডাইনিং টেবিলের ওপরে ল্যাপটপটা রাখা। সায়েমের অপলক চোখদুটো সেদিকেই আটকে আছে। ক্রমশই প্রবল আতঙ্ক খেলে যাচ্ছে মনে। দুশ্চিন্তায় পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। বসার ঘর থেকে টেলিভিশনের মৃদু আওয়াজ ভেসে এলো কানে, “কিছুক্ষণের মধ্যেই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা করে। ঘরে বসেই ইন্টারনেট এবং এসএমএসের মাধ্যমে ফলাফল জানতে পারবে শিক্ষার্থীরা। প্রযুক্তির অদম্য অগ্রগতির কারণেই আজ শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে এই সুবিধা।”
বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করলো সায়েম। মানুষ এদিকে টেনশনে মরে যাচ্ছে, আর এরা শুরু করেছে প্রযুক্তির গুণগান। পরপর দুই গ্লাস পানি খেলে টেনশন না-কি কয়েকটাই কমে যায়। সায়েমের ক্ষেত্রে অবশ্য সেসব কিছুই হলো না। ছেলেটা পরপর দুই গ্লাস পানি ঠিকই খেল, কিন্তু টেনশন কমার বদলে যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
সায়েম এদিকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে আর যার রেজাল্ট বের হবে তার কোনো বিকারই নেই। নাজের ঘরের দরজাটা এখনও বন্ধ। মেয়েটা কি এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে না-কি?
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নাজ। তার চোখেমুখে ঘুম ঘুম ভাব এখনো স্পষ্ট, চুলগুলো এলোমেলো।
তাকে দেখতে সায়েম ধমকের সুরে বলল, “যার আজ এইচএসসির রেজাল্ট দেবে, সে এতক্ষণ ঘুমায় কী করে?”
নাজ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “ওহ! দিয়েছে রেজাল্ট?”
“না, ঠিক বারোটায় বের হয়। তার মাত্র চৌত্রিশ মিনিট বাকি।”
জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারবে মাত্র চৌত্রিশ মিনিট পর – এ খবর মোটেও চিন্তিত মনে হলো না নাজকে। ভাবটা এমন যেন রোজ রোজ তার রেজাল্ট বের হয়, এমন গা হিম করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তার জন্যে রোজকার ব্যাপার।
নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “আমি চা খাবো, আপনার জন্যে বানাবো?”
সায়েম হতভম্ব হয়ে বলল, “এমন একটা পরিস্থিতিতে চা খাওয়ার কথা কী করে ভাবতে পারো তুমি?”
প্রশ্নটার উত্তর দিলো না নাজ। ধীর পায়ে চলে গেল রান্নাঘরে। পানিতে বলক আসার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুমের ঘোর থেকে বেরিয়ে এল।
সায়েমের চায়ের কাপটা টেবিলের ওপরে রাখতে রাখতে নাজ শুষ্ক কণ্ঠে বলল, “এখনো অনেক সময় আছে, মাথা ঠান্ডা করে চা টা খান তো!”
সায়েম চিন্তিত মুখে চুমুক দিলো ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে। এমন গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো মানুষের জিভ পুড়ে যাওয়ার কথা। সায়েমের কিছু হলো না কেন? দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মানুষের জন্যে প্রকৃতি কি বিচিত্র কোনো নিয়ম তৈরি করে রেখেছে?
কোনো এক বেচারাকে ফোন করে একের পর এক অনবরত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে সায়েম। কোন ওয়েবসাইটে ঢুকলে রেজাল্ট জানা যাবে, কোন নম্বরে এসএমএস করতে হবে, এসএমএসে কী কী লিখতে হবে, তারা রিপ্লাই দিতে দেরি করলে কী হবে – এসব হাবিজাবি প্রশ্ন করে জালিয়ে মারছে লোকটাকে। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা বেচারার ধৈর্য্যের প্রশংসা না করে পারলো না নাজ।
সায়েমের দুশ্চিন্তার সঙ্গী হওয়ার কোনো অর্থ নেই। নাজ এসে বসলো বারান্দায়। পরীক্ষার পর পর এখানে কতগুলো বেলী ফুলের চারা লাগিয়েছিল। বেলী ফুল চারায় না-কি প্রচুর যত্ন করতে হয়, অধিক হারে সূর্যালোক পড়ে এমন কোনো জায়গায় রাখতে হবে। বেলী ফুল চারা লালনের নিয়মগুলো বেশ ভালো করেই মেনে চলছে নাজ। চারাগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই বেড়ে উঠছে, তবে ফুল ধরছে না।
ইশ! গাছের টবগুলোকে যদি সুটকেসে ভরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত! গত কয়েকদিন ধরেই নাজ একটু একটু করে গোছগাছ করছে। রেজাল্ট তো আজ দিয়েই দিচ্ছে। এরপর যেকোনো একদিন চট করে একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে সায়েম বলবে, “চলো নাজ, তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসি।”
নাজকেও বাধ্য মেয়ের মতো সেই কাগজে সই করে দিয়ে চলে যেতে হবে। সংসারটা তো কোনোদিন তার ছিলই না। নাজ নিজের হাতে এই সংসারটাকে সাজায়নি। সাজানো-গোছানো সংসারে নিজের জায়গা করে নিয়েছিল কেবল। সেই জায়গাটা আবার একদিন ছেড়েও দিতে হবে।
চা শেষ করে নাজ ব্যস্ত হয়ে পড়লো চারাগুলোর আগাছা পরিস্কার করতে। ঘরের ভেতর থেকে ব্যস্ত এক ধরনের আওয়াজ ভেসে আসছে। রেজাল্ট সম্ভবত বেরিয়ে গেছে। কী বোর্ডের আওয়াজ শুনে মনে হলো, তড়িৎ গতিতে ল্যাপটপে কী যেন টাইপ করছে সায়েম। নিজের রেজাল্ট জানতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করছে না নাজ নেই, তার সকল মনোযোগ তুচ্ছ এই চারাটার ওপরেই এসে পড়েছে।
ঘর থেকে সায়েম চিৎকার করে বলল, “নাজ! তাড়াতাড়ি এদিকে এসো।”
নাজ উঁচু গলায় বলল, “এখন যেতে পারবো না। আমার হাতে মাটি!”
সায়েম নিজেই উঠে এলো নাজের কাছে।
নাজ চারাগুলোর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, “কিছু বলবেন?”
“এটা কী করেছ তুমি?”
নাজ কয়েক মুহূর্ত সায়েমের দিকে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটস্বরে বলল, “তিন পয়েন্ট পনেরোও পাইনি?”
সায়েম গর্বের হাসি হেসে বলল, “গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ!”
চাপা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নাজের মধ্যে থেকে। সেই দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘদিনের এই পরিশ্রমের উপযুক্ত ফলাফল পাওয়ার আনন্দ মিশে আছে না-কি বিষাদ তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
মেয়েটা শীতল গলায় বলল, “বাহ্, ভালো তো।”
অবিশ্বাস্য আনন্দের এই সংবাদে তিল পরিমাণ উচ্ছ্বসিত বলে মনে হলো না নাজকে।
আবারও তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল গাছের চারা। এমন সাফল্য অর্জনকারী একটা মেয়ের কাছ থেকে এমন আচরণ স্বভাবতই আশা করা যায় না।
তাই সায়েম ভড়কে গিয়ে বলল, “আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না নাজ।”
“জানি। এ আর এমন কী? দেশে কি আমি একাই গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছি?”
সায়েম কিছু বলতে যাবে তার আগেই সায়েমের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন করেছেন হাসনা বেগম। সায়েম ফোনটা রিসিভ করতে করতে ভেতরে চলে গেল।
উৎফুল্ল গলায় বলল, “মা! নাজ গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছে।”
হাসনা বেগম তৃপ্ত গলায় বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ। বৌমা আমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। কী বলিস বাবা?”
“তা তো অবশ্যই। কনার রেজাল্ট জানতে পেরেছ?”
“না বাবা, মেয়েটা তো সেই সাতসকালে বেরিয়েছে। কলেজ থেকেই না-কি রেজাল্ট জানবে।”
“তোমরা আর মডার্ন হতে পারলে না মা! একটা এসএমএস পাঠালেই তো জানা যায়। ওর রেজিস্ট্রেশন নম্বর হাতের কাছে আছে?”
হাসনা বেগম বিভ্রান্ত গলায় বললেন, “সেসব যে মেয়েটা কোথায় রেখেছে!”
কথার মাঝেই সায়েম লক্ষ করলো অনবরত কল আসছে অপরিচিত এক নম্বর থেকে।
সায়েম ব্যস্ত গলায় বলল, “রাখলাম মা, আমার একটা ফোন আসছে। কনার রেজাল্ট জানার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানবে কিন্তু।”
ততক্ষণে বারান্দার কাজ সেরে নিজের ঘরে ফিরে এলো নাজ। বিছানাটা অগোছালো হয়েই পড়ে আছে, গোছাতে ইচ্ছে করছে না। আবারও গলা পর্যন্ত চাদর টেনে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভালো হতো। নাজ ক্লান্ত ভঙ্গিতে চাদর ভাঁজ করছে, তখনি সায়েম এলো তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে।
“নাজ? তোমার প্রিন্সিপাল ম্যাম ফোন করেছেন। তোমাকে চাইছেন।”
নাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার সঙ্গে কী কথা?”
“কংগ্রাচুলেট করবেন হয়তো।”
নাজ অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “আমি কথা-টথা বলতে পারবো না।”
সায়েম চোখ পাকিয়ে বলল, “বেয়াদবি করবে না তো নাজ! কথা বলো?”
বাধ্য হয়েই ফোনটা কানে তুলে নিলো। কল লাইড স্পিকারে দেওয়া, ম্যাডামের কথাগুলো সায়েমও শুনতে পাচ্ছে।
“নাজনীন! উই আর সো প্রাউড অফ ইউ।”
নাজ ফ্যাকাশে গলায় বলল, “থ্যাংক ইউ ম্যাম।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বললেন, “কেন গর্বিত সেটা না জেনেই থ্যাংক ইউ বলছো?”
“রেজাল্টের জন্যে?”
“রেজাল্টের জন্যে তো অবশ্যই। তাছাড়া আরও একটা কারণ আছে।”
“কী কারণ ম্যাম?”
“কনগ্রাচুলেশনস নাজনীন, তুমি আমাদের কলেজে ফার্স্ট হয়েছ!”
চমকে উঠলো নাজ। চরম বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্তের জন্যে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল সায়েম আর নাজ। এসবের কী হচ্ছে? যে মেয়েটার টেনেটুনে পাশ করতেই কষ্ট হতো, সে আবার হয়েছে কলেজের সেরা? এও কি সম্ভব?
নাজ বিস্মিত গলায় বলল, “আমি? আপনি ঠিক দেখেছেন ম্যাম?”
“ভুল দেখার কোনো কারণই নেই। তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়ে চলে এসো। তোমার বান্ধবীরা অলরেডি মাঠে হইচই শুরু করে দিয়েছে।”
গর্ব এবং আনন্দের উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়লো সায়েমের চোখেমুখে। এটাই তো চেয়েছিল – মেয়েটা দুর্দান্ত রেজাল্ট করে তাক লাগিয়ে দেবে সকলকে। অথচ আবারও শীতল বর্ণ ধারণ করলো নাজের চোখমুখ। যেন কলেজে ফার্স্ট হওয়াটাও বড় কোনো ব্যাপার নয়। সায়েমের ফোনটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আবারও চাদর ভাঁজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেয়েটা সবসময় এমন গম্ভীর হয়ে থাকে কেন? সে কি জানে না, প্রচ্ছন্ন হাসিটা ছাড়া তাকে দেখতে একেবারেই ভালো লাগে না!
আচমকাই তার দুই বাহু চেপে ধরলো সায়েম। আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বলল, “এই মেয়ে! কী সমস্যা তোমার? যার আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা, তার চোখমুখ এমন মলিন থাকবে কেন?”
ভীষণভাবে অপ্রস্তুত পড়লো গেল নাজ। তার কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে গেল ঘটনাটা। সায়েম কি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে? প্রবল ঘোরে ডুবে যাচ্ছে নাজ। কিছুই মনে করতে পারছে না। বুঝতেও পারছে না তার কী করা উচিত।
এরপর যা ঘটে গেল, তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। সায়েম তার একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে আলতো করে একটা হাত রাখলো ডান গালের ওপরে। তার কপাল ঠেকিয়ে রাখলো নাজের কপালে। নাজের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বিয়ের পর দুটো বছর কেটে গেল, অথচ কোনোদিন তো মানুষটা তার এত কাছাকাছি আসেনি। তাহলে আজ আসছে কেন?
সায়েম শান্ত গলায় বলল, “চলো তোমাকে একটা গল্প শোনাই। কিন্তু শর্ত হলো গল্পটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে খুশিতে চিৎকার করতে হবে। রাজি?”
নাজ হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো সায়েমের চোখের দিকে। এর আগেও তো বহুবার দেখেছে মায়াময় এই চোখদুটো। বারবার কেবল এই চোখের প্রেমেই পড়েছে সে। তবে চোখদুটোতে আজ যে ভাষা ফুটে উঠেছে, তা ইতোপূর্বে কোনদিন দেখেনি নাজ।
নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “কী গল্প?”
“চলো, বলছি।”
সায়েম নাজের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের ঘরে। সময়টা যদি এখানেই, ঠিক এই মুহূর্তে থেমে যেত! মানুষটার হাত ধরে যদি কাটিয়ে দেওয়া যেত অনন্তকাল!
নিজের ঘরে এনে আলমারির সামনে দাঁড় করালো নাজকে। বিয়ের পরপরই নাজ বুঝে গিয়েছিল এই আলমারিকে ঘিরে সায়েমের কোনো একটা রহস্য রয়েছে। বাইরে গেলে সবসময় আলমারির লক করে চাবি সঙ্গে করে নিয়ে যায়, বাড়িতে থাকলেও আলমারির আশেপাশে পর্যন্ত ঘেঁষতে দেয় না নাজকে। তবে এ নিয়ে খুব একটা ভাবেনি নাজ। একটা মানুষ কিছু গোপন রাখতে চাইলে তা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই উত্তম।
সায়েম আলমারি থেকে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট ছবির ফ্রেম বের করে নাজের দিকে বাড়িয়ে দিলো। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নাজ। কী সর্বনাশ! ফ্রেমেগুলোতে বন্দী তার ছবি। তার থেকেও আশ্চর্যের ব্যাপার, নিজের এই ছবিগুলো নিজেই কখনো দেখেনি নাজ। কোন কালের বসন্ত মেলার ছবি, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে তোলা ছবি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ার ছবি।
আরেকটা ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে যেন সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। যে চিঠির কারণে রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটালো, অফুরন্ত অশ্রু ঝরালো – সেই চিঠিটাই বাঁধানো এই ফ্রেমে। তার ধারণা ছিল চিঠিটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলেছিল সায়েম। সেই ধারণা তাহলে একেবারেই ভুল? পরম যত্নে সুন্দর একটা ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা নীল কাগজে লেখা সেই চিঠি।
নাজ হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। তার চোখেমুখে প্রবল জিজ্ঞাসা। এক কোটি প্রশ্ন এসে জমেছে মনের মাঝে, কোনটা আগে কোনটা পরে করবে বুঝে উঠতে পারছে না নাজ।
সায়েম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শান্ত ভঙ্গিতে বসল বারান্দার দোলনায়। একটা মানুষের মাঝে প্রবল তুফান ছড়িয়ে দিয়ে এতটা শান্ত কী করে থাকতে পারে সে? বসন্ত মেলায় তোলা নিজের সেই ছবি বাঁধানো ফ্রেমটা হাতে নিয়ে নাজ গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়ালো বারান্দার দরজার কাছে।
সায়েম বলল, “বসো!”
নাজ লক্ষ্মী মেয়ের মতো গিয়ে বসলো তার পাশে। তার কৌতূহলী চোখ যেন নড়ছেই না সায়েমের ওপর থেকে। চোখদুটো কেবল একটাই প্রশ্ন অনবরত করে যাচ্ছে, “এসবের মানে কী?”
সায়েম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরিষ্কার গলায় বলতে শুরু করলো, “গল্পটা একটা ছেলের, পাগল একটা ছেলের। সে অন্যদের মতো নয় জানো। নতুন কোনো গান এলে আবেগে গা ভাসায় না, আবার প্রিয় ফুটবল টিম নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়াও করে না। দুপুরের রোদের মতো ছেলেটা। সে আছে, তার উপস্থিতি সবাই টেরও পাচ্ছে। তবুও তার তীব্রতাকে রীতিমত অগ্রাহ্য করে ছুটে চলছে নিজ ব্যস্ততায়।
ছেলেটা আবার মানুষজন সহ্য করতে পারে না। সোশ্যাল এনজাইটিতে ভুগে নিজেকে বলতে গেলে এক ঘরে করে রেখেছে। বছর পাঁচেক আগের কথা। তখন সে মাস্টার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়াশোনা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাবা-মা কেউই যেহেতু ঢাকায় নেই, তাই তাকে থাকতে হতো মহসিন হলে। এতেই অবশ্য সে খুশি। মানুষগুলোকে যতটা এড়িয়ে চলা যায় ততই ভালো।
বছরে দুয়েকবার অবশ্য বাধ্য হয়ে ঠিকই তাকে গ্রামের বাড়িতে যেতে হতো। সেবারও গেল। গ্রামের মানুষগুলোকে এড়িয়ে চলার জন্যে নিজের সদ্য কেনা ক্যামেরাটাও সঙ্গে নিয়ে গেল। ছবি-টবি তুলে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে। অথচ সে কি একবারও বুঝতে পেরেছিল, সেবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার জীবনটা পুরোপুরি বদলে যাবে? গল্পটা ভালো লাগছে নাজ?”
নাজ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল।
সায়েম আবারও বলতে শুরু করলো, “তখন বসন্তকাল। তাদের গ্রামে আবার প্রতিবছর ঘটা করে বসন্ত মেলার আয়োজন করা হয়। এদিকে ছেলেটা ভেবেছিল কোথাও ক্যামেরা নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে। কিন্তু নাহ্! সেই আশায় পানি ঢেলে তার বোন তাকে দিলো বিচিত্র এক এসাইনমেন্ট। বোন তার বান্ধবীদের নিয়ে মেলায় ঘুরে বেড়াবে আর ছেলেটাকে দূর থেকে তার ছবি তুলে দিতে হবে। ছবিগুলো এমনভাবে তুলতে হবে যেন সে বুঝতেই না পারে তার ছবি তোলা হচ্ছে।
কী যেন বলো তোমরা? ক্যান্ডিড! দূর থেকে ক্যান্ডিড ছবি তুলে দিতে হবে।
সে একরাশ বিরক্তি নিয়ে রেগে-টেগে চলে গেল মেলায়। জীবনটা ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিকই ছিল, আচমকাই প্রবল এক ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেল তার সবকিছু। তার করে চোখদুটো আটকে একটা মেয়ের দিকে। ছেলেটা যে জীবনে কোনদিন মেয়ে দেখেনি তা নয়। কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের আশেপাশেই তার পড়ালেখা। তবুও, ওই বাচ্চা
মেয়েটার মধ্যে কী যে ছিল! তার অকারণেই খিলখিল করে হেসে ওঠা, দোকানিদের সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া করে দরদাম করা – এসব কিছুও যেন ছেলেটাকে একটা ঘোরে নিয়ে ফেলল। তার তো সেই মুহূর্তেই ইচ্ছা করছিল মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, এই মেয়ে!তুমি আমাকে বিয়ে করবে?”
সায়েম লক্ষ করলো নাজের চোখদুটো বেয়ে নিঃশব্দে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে। সেই অশ্রু মোছার কোনো তাগিদ অবশ্য তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। প্রবল কৌতূহল আর বিস্ময় নিয়ে গল্পের বাকি অংশটা শোনার অপেক্ষা করছে নাজ।
তার পরম যত্নে তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “কেঁদো না তো, অনেক কেঁদেছো! তোমার তো অনেক বুদ্ধি নাজ। বলো তো ছেলেটা কে।”
অনেকটা সময় চুপ করে থেকে নাজ প্রায় ফিসফিস করে বলল, “আপনি?”
“হুঁ। আর সেই মেয়েটাকে তো দেখতেই পাচ্ছো।” সায়েম ছবির ফ্রেমের দিকে ইশারা করে বলল।
নাজের বিস্ময় যেন সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল। শুরুর দিকে মনে হচ্ছিল সায়েম তার নিজের ভালোবাসার গল্প শোনাচ্ছে। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষটা অন্য কেউ নয়, নাজ নিজেই? নাহ্! এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। নির্ঘাত সায়েম ভুল বলছে কিংবা সে ভুল শুনেছে।
“ওই দিনের পর থেকে স্কুলের পথে, বাজারে, সিনেমা হলে কতভাবে যে ফলো করেছি তোমাকে তার কোনো হিসাব নেই। এই ছবির ফ্রেমগুলো আমার ঘরের দেয়ালেই ঝুলতো। নীরবে নিভৃতে দূর বারবার থেকে প্রেমে পড়েছি তোমার। মনের মাঝে তোমাকে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন বুনতে শুরু করলাম।
তবে আমি বরাবরই চেয়েছিলাম যাকে বিয়ে করবো, যে হবে নিজের আলোয় আলোকিত। ঘরের কাঠের পুতুল হয়ে থাকবে না। সবাই তাকে আমার স্ত্রী হিসেবে নয় বরং নিজের পরিচয়ে চিনবে। তাই হাজার কষ্ট হলেও সেদিন নিজেকে আটকে রাখি। ছুটে গিয়ে প্রপোজ করিনি তোমাকে। আমি জানতাম একদিন তুমি অনেক বড় হবে। ঠিক করে রেখেছিলাম, যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে সেদিন তোমার সামনে গিয়ে মনের কথাগুলো বলবো।”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কী বলছেন এসব?”
সায়েম কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “এত অধৈর্য্য হচ্ছো কেন নাজ? গল্পটা তো এখনো শেষ হয়নি।”
নাজ চুপ মেরে গেল।
সায়েম বলল, “এসএসসি পাশ করার পর তুমি কলেজে ভর্তি হওনি কেন নাজ?”
নাজ হকচকিয়ে গিয়ে ইতস্তত করে বলল, “এমনিই।”
“সত্যিটা আমি জানি। আমার কাছে লুকাবার প্রয়োজন নেই।”
নাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জানেনই যখন, তখন জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
“তোমার মুখে শুনতে চাই বলে।”
নাজ থেমে থেমে বলল, “আমার এসএসসি পরীক্ষার পরপরই বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। রেজাল্টের কয়েকদিন পরই তিনি চলে যান। ব্যাংকে যা টাকা ছিল সব বাবার চিকিৎসার পেছনেই চলে যায়। আমাদের জন্যে ওই বাড়ি আর একটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ছাড়া তেমন কিছুই রেখে যাননি তিনি। বাবা মারা যাওয়ার ছয় মাস পর ইন্স্যুরেন্সের টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ততদিনে তো কলেজে ভর্তি হওয়ার ডেট পার হয়ে যাবে। তাই আমি আর মা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এক বছর পর ভর্তি হবো।”
সায়েম ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “তোমার বাবা কোনো ইন্স্যুরেন্স করেননি নাজ।”
নাজ আঁতকে উঠে বলল, “কী বলছেন এসব? ইন্স্যুরেন্স করেনি মানে?”
“ইন্স্যুরেন্সের কথাটা মা বলেছিলেন তোমাকে চিন্তামুক্ত রাখতে। যাতে তুমি ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা না করো। ছয় মাস পর কোনো টাকাই আসতো না, কলেজে ভর্তি হওয়াও হতো না।”
প্রচন্ড বিস্ময়ে খাবি খেল নাজ। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ তাকেই কখনো জানানো হয়নি?
সায়েম বলল, “আমার সবথেকে প্রিয় মানুষটার ভবিষ্যতে অন্ধকার নেমে আসবে, আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? তা তো হবে না। ঠিক করলাম এবার আমাকেই তোমার পাশে দাঁড়াতে হবে। তোমাকে সাকসেসফুল একটা মানুষ হিসেবে দেখার আমার যে স্বপ্ন, সেটা আমাকেই পূরণ করতে হবে।
বাট ইউ আর আ গার্ল উইথ প্রাইড। তুমি যদি জানতে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, তাহলে কোনোদিনই সেই বিয়েতে রাজি হতে না। তোমার আত্মমর্যাদা তাতে সায় দিতো না।ভাবতে বিয়ে করে হয়তো দয়া করছি। কিন্তু বিশ্বাস করো নাজ, আমি কাউকে দয়া করিনি। নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখেছি। আমার ওই স্বপ্নটা পূরণের স্বার্থকে।”
নাজ বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কিন্তু আপনার তো আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথাই ছিল। আপনার বিয়ে তো ঠিক হয়েছিল অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে!”
সায়েম ঠোঁটের কোণে বিচিত্র হাসির আভাস ফুটিয়ে তুলে বলল, “যে মেয়েটা আমাকে বিয়ে না করে পালিয়ে গিয়েছিল তাই না?”
“হ্যাঁ!”
“অন্য কারোর সঙ্গে কখনোই আমার বিয়ে ঠিক হয়নি নাজ। কেউ পালিয়েও যায়নি। ওই দিন তোমার সঙ্গেই আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। তুমি নিজের বিয়েতেই গেস্ট হয়ে এসেছিলে। বাই দ্যা ওয়ে, এই প্ল্যানটা কিন্তু আমার না। অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে পালিয়ে গেছে বলে সেকেন্ড অপশন হিসেবে তোমাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে – এই পিকিউলিয়ার নাটকটা যৌথভাবে লিখেছে আমার আর তোমার মা।”
নাজ হতবাক গলায় বলল, “ওরা জানে?”
“সবাই জানে।”
নাজ অবিশ্বাসে ডুবে গিয়ে বলল, “সবাই জানে, অথচ আমাকে কেউ কিছু বলল না?”
“বললে রাজি হতে এই বিয়েতে?”
নাজ উত্তর খুঁজে পেল না। আসলেই তো! সেই মুহূর্তে তার মনে সায়েমের জন্যে কোনো ভালোবাসাও ছিল না। হুট করে যদি জানতে পারতো বিয়ের পেছনের আসল উদ্দেশ্য, তাহলেও কখনোই রাজি হতো না নাজ। শুধু শুধু কারোর দয়ার পাত্রী হতে যাবে কেন সে?
সায়েম কোমল স্বরে বলল, “বিয়ের পরেও মনের কথাগুলো বলিনি তোমাকে। দীর্ঘদিন দূরে সরিয়ে রেখেছি। ভয় হতো, আমাকে নিয়ে ডুবে থেকে তুমি যদি নিজের লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ো? তাহলে তো তোমাকে সাকসেসফুল দেখার স্বপ্নটা অপূর্ণই রয়ে যাবে। নিজের স্বার্থের থেকেও বড় করে তোমার স্বার্থকে দেখলাম। আমার জীবনের সেরা দিনটা কবে ছিল জানো নাজ?”
নাজ না-সূচক মাথা নাড়ল।
“আমাদের ফার্স্ট অনিভার্সেরির দিন। যেদিন জানতে পারলাম আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে নিয়ে আমার মতো করেই ভাবে।নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষটা বলে মনে হচ্ছিল। কত হাজারবার যে পড়েছি সেই চিঠি, তার কোনো হিসাব নেই। ইচ্ছা করছিল ঠিক ওই মুহূর্তেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি তোমাকে।
কিন্তু মানুষ কী সবসময় নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারে? আমিও পারলাম না। উল্টো, তোমাকে কষ্ট দিলাম। এতটা কষ্ট বোধ হয় জীবনেও কেউ দেয়নি তোমাকে। বিশ্বাস করো নাজ, তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি ভালো থাকিনি। আমার ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। রাতের পর রাত কেবল তুমি একা নির্ঘুম কাটাওনি, আমিও কাটিয়েছি।
সবকিছুই আমার পরিকল্পনা অনুযায়ীই যাচ্ছিল। মাঝখানে ঝামেলা করলো আশফাক গাধাটা। বারবার বলে দিয়েছিলাম তুমি আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে যেন চুপ থাকে। তবুও বেকুবটা বলে দিল আমার জীবনে একজন আছে। ভাগ্যিস বলেনি সেই একজনটা কে! আশফাকের ওই একটা কথাই হয়তো তোমার কষ্টগুলোকে কয়েক হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
একটা সময় তোমার কষ্ট পরিণত হলো জেদে। কিছু একটা করে দেখানোর জেদ। মনে মনে ঠিক করলে মন দিয়ে লেখাপড়া করে নিজেকে প্রমাণ করবে। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে তুমি তাচ্ছিল্যের পাত্রী নও। তাই না?”
নাজ জবাব দিতে পারলো না। দুহাত দিয়ে চোখমুখ ঢেকে অশ্রুগুলো লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। নারীর সাফল্য যে প্রবলভাবে ঈর্ষান্বিত করে তোলে পুরুষকে, এই ধারণাটা ভেঙে।চুরমার করে ফেলল সায়েম। যে মানুষটা তার স্ত্রীকে সফল হতে দেখার জন্যে এতকিছু করতে পারে তার কাছে নির্ঘাত ঈর্ষা সবটা ভারী অপরিচিত।
সায়েম তার নেশালো কণ্ঠে বলল, “তোমার জেদটাই আমার সাফল্য নাজ, আমার স্বপ্নটা আজ পূরণ হয়েছে। এই দিনটার জন্যে বহুকাল অপেক্ষা করে ছিলাম। আমার #অপেক্ষারা আজ শেষ হলো। আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই।”
নাজের সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। অতিরিক্ত যন্ত্রণা যেমন সহ্য করা যায় না, অতিরিক্ত আনন্দও তেমনি অসহনীয়। জীবনটা যে আচমকাই এত সুন্দর হয়ে যাবে কে জানত?
নাজ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “আপনি কি জানেন, কতোটা খারাপ আপনি?”
সায়েম হেসে অন্যরকম গলায় বলল, “এখন জানলাম।”
নাজের চোখের জল যেন থামছেই না। চোখদুটো ফুলে উঠেছে মেয়েটার। সায়েম দ্বিতীয়বারের মতো তার চোখের জল মোছাতে মোছাতে বলল, “কেঁদো না তো! খেয়াল করেছ কিনা জানি না, তোমার চোখে জল সহ্য করতে পারি না আমি।”
নাজের বেশ অনেকটা সময় লাগলো নিজেকে সামলাতে। একটু আগে যখন ঘুম থেকে উঠেছিলো, ঘুর্ণক্ষরেও টের পায়নি আজকের দিনটিই হবে তার জীবনের সেরা দিন।
“নাজ?”
“হুঁ?”
“যে কথাটা শোনার জন্যে এতদিন অপেক্ষা করে ছিলে, যে কথাটার অভাব ঠোঁট থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছিল তোমার – সেই কথাটা এখন বললে কি খুব রাগ করবে?”
নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “কোন কথা?”
সায়েম কিছুটা সময় চুপ করে থেকে গভীর এক শ্বাস নিয়ে বলল, “ভালোবাসি নাজ। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কতোটা ভালোবাসি তোমাকে।”
এটা স্বপ্নদৃশ্য, নির্ঘাত স্বপ্নদৃশ্য! বাস্তব তো এতটা সুন্দর হয়না! মানুষটা তাকে ভালোবাসে? সত্যিই বাসে? না-কি তাকে নিয়ে দেখা নাজের হাজারটা স্বপ্নের মধ্যে এটিও একটি?
নাজ অবিশ্বাসে খাবি খেয়ে মিনতির স্বরে বলল, “আপনার হাতটা একটু ধরতে দেবেন? প্লিজ?”
সায়েম সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটা বাড়িয়ে শক্ত করে ধরল নাজের হাত। দুটো মানুষের অপ্রকাশিত ভালোবাসার অগোচরে থাকার দিন শেষ। এর থেকে সুন্দর মুহূর্ত আর কিছুই হতে পারে না। এভাবেই হাতে হাত রেখে, পাশাপাশি বসে বসে, নিঃশব্দে কতোটা সময় যে পার হয়ে গেল তার হিসাব কারো কাছেই রইল না।
(চলবে)