#অপেক্ষারা
৫০+৫১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
কাকডাকা ভোর। কাকের কুৎসিত ডাকের সঙ্গে আরেকটি পাখির ডাক ভেসে আসছে। এমন ডাক সচরাচর শোনা যায় না। কাকের চাইতেও কয়েকগুণ বেশি কুৎসিত এই পাখির ডাক। কুয়াশার আবছা চাদরে চারিদিক ঢেকে গেছে। সূর্যটা কেবল আলো ছড়াতে শুরু করেছে। নাজ নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়।
প্রেগন্যান্সি শুরুর পর থেকে তার চোখদুটো থেকে ঘুম যেন উধাও হয়ে গেছে। রাতে ভাঙা ভাঙা ঘুম হচ্ছে। বারবার সামান্য একটু শব্দেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। এই যেমন একটু আগে ঘুম ভাঙলো দেওয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটায় টিকটিক শব্দে। নাজের সঙ্গে সায়েমও প্রতিটি রাতে জেগে থাকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, গল্প শোনায়। বেচারা কেবল কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছে, আবার যেন উঠে না যায় সেজন্যেই নাজের বারান্দায় এসে দাঁড়ানো।
কিন্তু সায়েম যে ঘুমের মাঝেও পাশে শুয়ে থাকা প্রেয়সীর অনুপস্থিতি ঠিকই টের পায়। তাই একটা সময় পর তারও ঘুম ভেঙে গেল। সায়েম ঘুম ভেঙে পাশে নাজকে না পেয়ে, তাকে খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় চলে এলো। মেয়েটা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। সায়েম কিছু না বলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো নাজকে।
এমন আকস্মিক আলিঙ্গনে নাজ কিছুটা চমকে উঠলেও মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। এই স্পর্শ তো তার কাছে অচেনা কিছু না। অতি অচেনা, অতি প্রিয় এক স্পর্শ। নাজ কোমল স্পর্শে তার হাতটা রাখল সায়েমের হাতের ওপরে।
সায়েম তার নেশালো গলায় বলল, “কী করছেন ম্যাডাম?”
“ঘুম আসছিল না, তাই দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“বাইরে কী পরিমাণ কুয়াশা দেখেছো? বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
নাজ ঠাট্টার ছলে বলল, “লাগুক, তুমি টেক কেয়ার করবে।”
“তা তো করতেই হবে! এখন চলো, ঘুমিয়ে পড়ি।”
“তুমি তো জানো, এখন আমার ঘুম আসবে না।”
“চেষ্টা করবে, চলো।”
নাজ আর কথা বাড়ালো না। বাধ্য মেয়ের মতো সায়েমের সঙ্গে গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো বিছানায়। চোখদুটো বুজে রেখেছে। যদিও জানে এই মুহূর্তে ঘুমের নামগন্ধ পর্যন্ত আসবে না।
প্রায় অনেকটা সময় পর সায়েম নাজের কপালে হাত রেখে বলল, “ঘুম আসছে না?”
“উঁহু।”
“মাথা ব্যাথা করছে?”
প্রেগন্যান্সি শুরুর পর থেকেই সারাক্ষণ নাজের মাথায় ভোঁতা ধরনের একটা যন্ত্রণা থাকে। সাধারণ মাথা ব্যাথা একটা নির্দিষ্ট সময় পর চলে যায়। তবে এই ব্যাথার জাত আলাদা। সারাদিন মাথার এক কোণায় ব্যাথাটা রয়েই যায়। অন্য সময় হলে ব্যাথা দূর করতে দুয়েকটা প্যারাসিটামল খেয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু এখন ডক্টরের কঠিন নিষেধ, তার পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া তো দূরের কথা ছোঁয়াও যাবে না। তাতে ওর ক্ষতি হতে পারে।
সেজন্যেই মুখ বুজে এই অসহনীয় মাথা ব্যাথা সহ্য করছে নাজ। মায়েরা আসলেই পৃথিবীর সেরা যোদ্ধা। সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই তাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কখনো সেই যুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে, কখনো বা বাস্তবতার সঙ্গে।
সায়েম কোমল স্বরে বলল, “খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “হচ্ছে তো! সব তোমার বাবুর দোষ। পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই আমাকে বিরক্ত করা শুরু করেছে।”
“এই মেয়ে! খবরদার আমার বাবুকে বকবে না।”
“কেন? বাবুটা কি তোমার একার? আমার বাবু, আমি যখন খুশি তখন বকবো।”
“তাহলে আমিও তোমাকে বকবো, তখন বুঝবে!”
নাজ খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, “ঠিক আছে, দেখা যাবে। এই! আমি তোমার ঘুমে খুব অসুবিধা করছি তাই না?”
“তুমি অসুবিধা করবে কেন? ও আসার পর থেকে তো তুমি নিজেই ঠিকমত ঘুমাতে পারছো না। তুমি সারারাত একা একা জেগে থাকবে, আর আমি ঘুমিয়ে থাকবো কী করে?”
“এখন তো একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো, কাল আবার ডক্টরের কাছে যেতে হবে।”
“কাল কোথায়? আজই, সকাল তো হয়েই গেল।”
“ওহ তাই তো!”
“আমারও এখন আর ঘুম আসবে না।”
“সত্যি তো?”
সায়েম কৌতূহলী গলায় বলল, “এমন জেরা করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“কারণ না ঘুমালে তোমাকে জরুরি একটা কথা বলবো।”
“কী কথা?”
“আমি কিছু একটা ঠিক করেছি। ঠিক করিনি মানে ভেবেছি। এখন তোমার মতামতের দরকার।”
“ভনিতা না করে বলো তো, কী বলবে নাজ!”
“আমি ঠিক করেছি বিবিএ পাশ করার পর আর পড়াশোনা করবো না।”
সায়েম কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল, “বাহ্! কী সুন্দর কথা! আমি আর পড়াশোনা করবো না।”
নাজ আহত গলায় বলল, “আমি কিন্তু সিরিয়াস।”
“আমি সিরিয়াস নই। পড়াশোনা করবে না মানে কী? বাবু আসছে বলে ভেবো না, পড়ালেখা ছেড়ে ঘরে বসে থাকবে তুমি।”
“বাবুর জন্যে লেখাপড়া ছাড়ার কথা ভাবছি না তো! অন্য একটা কারণ আছে।”
সায়েম ভ্রুযুগল সামান্য কুঞ্চিত করে বলল, “কী কারণ?”
“তুমি একটু ভেবে দেখো। মানুষ পড়াশোনা করে কেন? ভালো চাকরি পাওয়ার জন্যে না-কি সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে?”
“দুটোই।”
“সেটাই তো! কিন্তু শুধুমাত্র ভালো চাকরি করেই কি সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়?”
সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “তোমার মাথায় কী চলছে নাজ?”
নাজ ইতস্তত করে বলল, “আমি বিজনেস করতে চাই। আমার ইচ্ছা নিজের বিজনেস তৈরি করে উদ্যোক্তা হওয়ার।”
“উদ্যোক্তা? মানে এন্ত্রেপ্রেনিওর?”
“হ্যাঁ ব্রিটিশ বাবু, এন্ত্রেপ্রেনিওর!”
“হঠাৎ বিজনেস করার আইডিয়া এলো কোত্থেকে?”
“হঠাৎ না, অনেক আগে থেকেই এসেছে। বিজনেস নিয়ে পড়াশোনা করে যদি অন্যের বিজনেসই সামলাতে হয়, তাহলে লাভটা কী?
একবার ভেবে দেখো আমাদের আশেপাশে বেকার মানুষের ছড়াছড়ি। আমি একটা বিজনেস শুরু করলে আমার কর্মসংস্থান তো হবেই, পাশাপাশি তাদেরও কর্মসংস্থান হবে। তাছাড়া আমার বরাবরই ইচ্ছা গরীবদের নিয়ে কাজ করার।”
সায়েম কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাজের দিকে। মেয়েটার চোখদুটো স্বপ্নে চকচক করছে। সায়েমের আজ নিজেকে খুব সফল বলে মনে হচ্ছে। সে তো শুরু থেকেই চেয়েছিল, নাজ যেন বড় বড় স্বপ্ন দেখতে শেখে, সেই স্বপ্নগুলোকে যেন নিজের যোগ্যতাতেই সফল করতে পারে। সায়েমের সেই চাওয়া আজ সত্যি সত্যিই পূর্ণতা পেয়েছে।
নাজ আগ্রহ নিয়ে বলল, “প্রথমে ছোট একটা বিজনেস শুরু করলেও কয়েক বছর পর মিলিয়ন ডলারের কোম্পানি দাঁড় করাবো!”
সায়েম মোহিত গলায় বলল, “দ্যাট ইস দ্য রিজন হোয়াই আই লাভ ইউ। তুমি বড় স্বপ্ন দেখতে ভয় পাও না।”
লজ্জায় কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইল নাজ। ছেলেটা কী নির্দ্বিধায় কথার ফাঁকেই বলে দিলো ‘ভালোবাসি’।
তবে মুহূর্তেই সেই লজ্জা গোপন করে নাজ বলল, “ভয় পাওয়ার কী আছে?”
“ভালো কথা, বিজনেস শুরু করতে হলে তো ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন। ইনভেস্টমেন্ট পাবে কোথায়?”
নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “তুমি দেবে!”
“বাহ্! সবকিছুই দেখি ভাবা হয়ে গেছে।”
“ভাববে না একেবারে দিয়ে দিচ্ছো, লোন দেবে। সুদে-আসলে লোন ফিরিয়ে দেওয়া হবে।”
সায়েম দুষ্টুমির ছলে বলল, “তা কত পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট দেবে?”
নাজ কিছুটা সময় ভেবে বলল, “পাঁচ-ছয় পার্সেন্ট?”
“পাঁচ-ছয় পার্সেন্টের জন্যে ড্রয়ার থেকে আমার চেকবুকই বের হবে না।”
“তাহলে?”
“মিনিয়াম বারো থেকে পনেরো পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট দিলে ভেবে দেখবো।”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “এই প্লিজ এরকম করো না! বউ হওয়ার খাতিরেও কি আমি ডিসকাউন্ট পাবো না?”
“তার থেকে বরং লোন না নিয়ে কোম্পানির দশ পার্সেন্ট ইকুইটি দিয়ে দাও। লোন ফেরত দেওয়ার টেনশনও থাকবে না!”
“ভালো আইডিয়া!”
সায়েম হাসতে হাসতে বলল, “নাজ, তুমি দেখি ব্যাপারটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে বসে আছ!”
“তো নেব না? আমার ভবিষ্যতের প্রশ্ন!”
“এত কিছু ভেবে রেখেছ, কিন্তু কীসের বিজনেস করবে সেটা ভেবেছো?”
“সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। তুমি একটা আইডিয়া দাও না!”
সায়েম অভিজ্ঞ গলায় বলল, “তুমি তো বললেই, তোমার গোল বেকার বা অসহায় মানুষদের কর্মসংস্থান করা। তাই না?”
“হুঁ।”
“কীসের বিজনেস করবে ঠিক করার আগে মাথায় রেখো যেন সেই খুব একটা ক্রিয়েটিভ আর কোয়ালিফাইড কর্মচারীর প্রয়োজন না হয়। এতে অসহায় মানুষরা সহজেই তোমাকে সাহায্য করতে পারবে।”
“কিন্তু সাহায্য করার মতো অসহায় মানুষ পাবো কোথায়?”
“আমাদের গ্রামের তো কত কর্মহীন মানুষ আছে। তুমি খোঁজ নিলেই…”
সায়েমের কথার মাঝেই নাজ উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো, “পেয়েছি!”
“কী পেয়েছো?”
“কীসের বিজনেস করবো, তা পেয়ে গেছি। আরেকটু সকাল হলেই আমার মাকে ফোন করতে হবে!”
“মাকে ফোন করতে হবে কেন?”
“সেটা তো এখন বলবো না। যখন ফোন করবো তখনই জানতে পারবে। উফ! কখন যে সকাল হবে!”
“শান্ত হও নাজ, তোমার কর্মকান্ডে আমার বাবুটা ভয় পেয়ে যাবে।”
ভোরের আলো কিছুটা ছড়িয়ে পরতেই নাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন করলো তার মাকে। সুখবরটা জানার পর থেকেই আয়েশা বেগম নিয়ম করে দিনে তিনবার মেয়েকে ফোন করেন আর গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত নানান জ্ঞান দেন। তবে আজ নাজের কাছ থেকেই ফোন পেয়ে মনে মনে বেশ ভালোই চমকে গেলেন তিনি।
হতবাক গলায় বললেন, “কী রে? তুই এত সকাল সকাল?”
নাজ বলল, “জরুরি একটা দরকারে ফোন করেছি মা।”
“কী দরকার?”
“তোমার মনে আছে? একবার আমি যখন বাড়িতে গিয়েছিলাম, তুমি আমাকে এক আচার খাইয়েছিলে? বলেছিলে গ্রামের বিধবা আর দুস্থ মহিলারা আচারের বিজনেস শুরু করেছে।”
“সে তো অনেকদিন আগের কথা!”
“সেটা তো আমিও জানি। মনে আছে কি-না বলো।”
আয়েশা বেগম সরল গলায় বললেন, “আছে। তুই হঠাৎ ওই কথা জানতে চাচ্ছিস কেন? তোর কি আচার খেতে ইচ্ছা করছে? আমাকে বললেই তো পারতি। এই সময়ে আবার মেয়ের টক খেয়ে ইচ্ছে করে।”
নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “উফ! মা আমার কোনো আচার-টাচার খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি শুধু বলো ওদের বিজনেসটা এখন আর আছে কিনা?”
“না! সেসব তো কবে শেষ হয়ে গেছে।”
“কেন?”
“আচার নিয়ে ঘরে বসে থাকলে কি চলে বল। দোকানে বিক্রির জন্যেও তো নিয়ে যেতে হয়। অবশ্য ওদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। গরীব ঘরের মেয়েরা, ব্যবসা বুঝবে কী করে? তুই হঠাৎ ওদের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন বললি না তো!”
“দরকার আছে, তুমি বুঝবে না। তুমি শুধু ওদের করো ফোন নম্বর আমাকে পাঠিয়ে দিও।”
“ফোন নম্বর? কী যে তুই বলিস নাজ! ওদের কারোর ফোনই তো নেই।”
“ওহ! তোমার কাছে ঠিকানা আছে?”
“হ্যাঁ তা আছে।”
“আমি কনাকে বলে দেবো, ও গিয়ে তোমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আসবে।”
“ঠিকানা দিয়ে কী হবে?”
“বললাম তো দরকার আছে, এত বিরক্ত করো কেন মা?”
“দেখ, আর যাই কর কোনপ্রকার বাঁদরামি করবি না। তোর সমস্ত ধ্যানজ্ঞান এখন বাচ্চা বুঝলি? কোনো কাজ করার আগে ভেবে দেখবি বাচ্চার কোনো অসুবিধা হবে কিনা।”
“ঠিক আছে।”
আয়েশা বেগম ইতস্তত করে বললেন, “নাজ শোন, আমি ভাবছি কী তুই কয়েকটা দিন আমার কাছে এসে থাকলে কেমন হয়।”
“তোমার কাছে গিয়ে থাকতে হবে কেন?”
“এই সময়ে মেয়েদের মায়ের আদর-যত্নের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া, তুই তো মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়িস, পড়িস না?”
“হুঁ।”
“সায়েম তোকে সামলাবে না নিজের কাজ করবে। সারাদিন অফিস করে আসার পর বেচারার যদি আবার তোকে সামলাতে হয়।”
নাজ খিলখিল করে হেসে উঠলো।
আয়েশা বেগম অবাক হয়ে বললেন, “ওমা! আবার হাসছিস কেন?”
“তুমি এখনো উনাকে চিনলে মা।”
“মানে?”
“নাও, কথা বলো। নিজেই বুঝতে পারবে।”
নাজ ফোনটা ধরিয়ে দিলো সায়েমের হাতে। চোখের ইশারায় বলল, “কথা বলো।”
সায়েম ভদ্রভাবে বলল, “আসসালামআলাইকুম মা।”
“ওয়ালাইকুমআসসালাম। কেমন আছো বাবা?”
“ভালো আছি মা। আপনি কেমন আছেন?”
“এইতো চলছে বাবা। নাজ বেশি জ্বালাচ্ছে না তো?”
“আপনার মেয়ে তো সারাক্ষণই জ্বালায়। এ আর এমন কী?”
“এজন্যেই তো আমি নাজকে বলছিলাম কয়েকটা দিন আমার কাছে এসে থাকতে?”
“হ্যাঁ? কেন মা?”
“এই সময়ে মায়ের আদর-যত্নের প্রয়োজন হয় বাবা। নাজ পৃথিবীতে আসার আগে আমিও তো কয়েক মাস আমার মায়ের কাছে ছিলাম।”
“এখানে নাজের আদর-যত্নের কিন্তু কোনো ত্রুটি হচ্ছে না কিন্তু মা।”
“আমি সেটা খুব ভালো করেই জানি বাবা। তবুও চিন্তা হয়।”
সায়েম আশ্বাস দেওয়া ভঙ্গিতে বলল, “দরকার হলে আপনি এখানে এসে কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গে থাকুন মা। কিন্তু ও চোখের সামনে না থাকলে আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়।”
নাজ দূর থেকে সায়েমের কথা শুনছে আর মিটিমিটি হাসছে। ছেলেটার লজ্জা-টজ্জা কি দিনদিন উবে যাচ্ছে? বউয়ের প্রতি ভালোবাসাটা পৃথিবীর থেকে লুকিয়ে রাখার তিলপরিমাণ ইচ্ছা নেই তার।
হাসপাতাল জায়গাটা বরাবরই নাজের অপছন্দের। চারিদিকে কড়া ফিনাইলের গন্ধ আর কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ। প্রত্যেকটি মানুষের চোখেমুখেই কেমন দুশ্চিন্তার ছাপ। চিরকাল এই জায়গা এড়িয়েই এসেছে নাজ। তবে এখন প্রতি মাসে কিংবা কখনো কখনো মাসে দুবারও আসতে হয় রেগুলার চেকআপের জন্যে।
ডাক্তার সাহেবা বেশ অনেকক্ষণ যাবত কীসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন, “মা ও বেবি দুজনেই সেফ আছে। তবুও থার্টিন উইকস পর্যন্ত একটু বেশিই সাবধানে থাকতে হবে। একদম স্ট্রেস ফ্রি থাকতে হবে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কয়েকদিন ভালো ঘুম হচ্ছে না। প্রতিদিন আট ঘণ্টা বা তার বেশি ঘুমাতে হবে।”
নাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আপনাকে তো আগেই বলেছি কনসিভ করার পর থেকে রাতে আমার ঘুম হচ্ছে না।”
ডাক্তার সাহেবা মুচকি হেসে বললেন, “প্রথম দিকে একটু আধটু অসুবিধা তো হবেই। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
হসপিটাল থেকে ফেরার পথে সায়েম নাজকে নিয়ে এলো অদ্ভুত সুন্দর একটা পার্কে। পার্কের একপাশে বিল অন্যপাশে বাচ্চাকাচ্চাদের খেলার সরঞ্জাম। তাদের বারান্দা থেকে এই পার্কটাই দেখা যায়। বিলের ঝকঝকে পানিকে ডুবন্ত সূর্যটার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে পুরো বিলটাই যেন কমলা রঙের। নাজ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেই বিলের দিকে। আর সায়েমের মুগ্ধ দৃষ্টি আটকে আছে পার্কের অপরপাশে ছোটাছুটি করতে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে।
এক পর্যায়ে নিরবতা ভঙ্গ করে সায়েম বলল, “দেখো! কী সুন্দর আনন্দ করছে ওরা।”
নাজ ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো বাচ্চাগুলোর দিকে। ওদের হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলো দেখে নিজের অজান্তেই প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে।
সায়েম মোহিত গলায় বলল, “আমাদের বাবাকেই প্রতিদিন স্কুলের পর এখানে নিয়ে আসবো। ও বন্ধুদের সাথে খেলবে আর আমরা দূর থেকে দেখবো। ঠিক আছে?”
নাজ অবাক গলায় বলল, “ওর খেলার বয়স হতে হতে তো অনেক দেরি!”
“হোক! আগেভাগেই প্ল্যান করে রাখলে ক্ষতি কী?”
“তুমি অনেক খুশি তাই না?”
“অনেক! আমি তো আর অপেক্ষাই করতে পারছি না – ওকে দেখার জন্যে, কোলে নেওয়ার জন্যে, ওর মুখ থেকে বাবা ডাক শোনার জন্যে।”
নাজ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই চোখদুটো পড়লো এক ফুচকাওয়ালার দিকে।
নাজ বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী স্বরে বলল, “এই! আমি ফুচকা খাবো!”
সায়েম চোখমুখ বিকৃত করে বলল, “মোটেও না। এসব আনহেলদি খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার ইচ্ছা আছে?”
“আনহেলদি খাবার মানে? ফুচকা তো বাঙালি মেয়েদের জাতীয় খাবার। আমি ফুচকা খাবোই।”
“উফ নাজ! এত জ্বালাও কেন তুমি?”
“জ্বলো না একটু। প্লিজ!”
অবশেষে বাধ্য হয়েই নাজকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যেত হলো সায়েমকে। পার্কের বেঞ্চে বসে নাজ ফুচকা খাচ্ছে আর সায়েম স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ফুচকা খেতে খেতেই আনমনে নাজ বলে উঠলো, “জানো একটা জিনিস আগে আমার খুব অসহ্য লাগতো।”
“কী?”
“প্রেমিক-প্রেমিকাদের জোড়া বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, হাত ধরাধরি করে হেঁটে বেড়ানো, পাশাপাশি বসে গুটুর গুটুর করে গল্প করা, ফুচকা-চটপটি খাওয়া। কোনো জুটিকে এসব করতে দেখলেই ইচ্ছা হতো তাদের দিকে ঢিল ছুড়ে মারি।”
সায়েম বাঁকা হাসি হেসে বলল, “আর এখন?”
নাজ উত্তর দিতে পারলো। লজ্জায় তার দু গাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। লজ্জারাঙা সেই মুখটা সায়েমের কাছ থেকে আড়াল করতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল নাজ।
সায়েম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নাজকে সহজ করতে বলল, “আমারও একটা সময় খুব অসহ্য লাগতো।”
“কী?”
“যখন দেখতাম কারও পৃথিবী একটা নির্দিষ্ট মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।”
নাজ কৌতূহলী গলায় বলল, “মানে?”
“ইউনিভার্সিটিতে আমার খুব একটা বন্ধু ছিল না। হাতে গোনা দুয়েকজনের সঙ্গেই আড্ডা দিতাম। তাদের মধ্যে একজন ছিল নয়ন। হঠাৎ নয়ন একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল। এরপর থেকে রেগুলার ক্লাসে আসতো না, আড্ডা দিতো না। সারাক্ষণ মেয়েটার পিছে পিছে তার বিচরণ। আমার খুব রাগ হতো, ভাবতাম একটা মানুষের ধ্যান-জ্ঞান কী করে কেবল আরেকটা মানুষ হতে পারে? ধরেই নিয়েছিলাম, আমি কোনোদিন এমনটা হতে পারবো না।”
নাজ দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “আর এখন?”
সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “এখন আমার চিন্তায় দিনরাত কেবল একজনেরই আনাগোনা। মেয়েটা যখন আশেপাশে থাকে না, তখন আমার চোখদুটো তাকে দেখার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর যখন চোখের সামনেই থাকে তখন এক মুহুর্তের জন্যেও চোখ সরাতে পারি না তার ওপর থেকে।”
নাজ আর্দ্র গলায় বলল, “আপনি কি জানেন সেই মেয়েটা অনেক অনেক লাকি?
সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “আবারও আপনি? তোমার এই আপনি-তুমির জগাখিচুড়ি অনেক সহ্য করেছি। এবার একটা সেটেলমেন্টে এসো।”
নাজ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, “আচ্ছা, তুমিই ডাকবো। অনেক ভেবে দেখলাম তুমি এতটাই বুড়ো হয়ে যাওনি যে সবসময় আপনাআপনি করতে হবে।”
সায়েম রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাজের দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে মেয়েটার হাসি স্রোত যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
সূর্য ডুবে গেলেও চারিদিকে তার লাল আভা ছেয়ে আছে। সূর্যাস্তের এই দৃশ্যটা নাজ প্রায়ই বারান্দা থেকে দেখে। তবে কোনোবারই দৃশ্যটাকে এমন মোহনীয় লাগেনি। পাশে ভালোবাসার মানুষটা থাকলে বোধহয় জীবনের প্রতিটা মুহূর্তই স্মরণীয় হয়ে ওঠে।
“সায়েম?”
সায়েম হতবিহ্বল হয়ে তাকালো নাজের দিকে। বিয়ের পর কতগুলো দিন পার হয়ে গেছে। অথচ নাজ কখনো তাকে নাম ধরে ডাকেনি, এই প্রথম ডাকছে।
সায়েমকে আরেকদফা চমকে দিয়ে প্রচন্ড সাহস নিয়ে নাজ বলল, “আই লাভ ইউ।”
কিছু বলার ভাষা যেন সায়েম হারিয়েই ফেলল। এই মেয়েটার কারণে প্রতিনিয়ত জীবনটাকে এত সুন্দর বলে মনে হয়।
সায়েম নাজের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “আই লাভ ইউ টু নাজ।”
(চলবে)
#অপেক্ষারা
৫২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
প্রায় অনেকটা সময় যাবত হতবাক হয়ে সায়েমের কর্মকান্ড লক্ষ করছে নাজ। বাড়ির একটা শোবার ঘরের সবগুলো ফার্নিচার বের করে, ঘরটাকে নতুন করে সাজাচ্ছে। ঘরের দেয়ালজুড়ে নানান কার্টুনের ছবি, এক কোণে ছোট্ট একটা দোলনা আর বাচ্চাদের একটা বিছানা। সারা ঘরটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট বড় বিভিন্ন খেলনা। এতগুলো খেলনা একসঙ্গে জীবনে দেখেনি নাজ।
নাজ বিস্মিত গলায় বলল, “এতগুলো খেলনা দিয়ে আমার বাচ্চা একা খেলবে?”
সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমাদের!”
“ওই একই কথা। কিন্তু এতগুলো খেলনার কী দরকার? পুরো এলাকার বাচ্চারা এগুলো দিয়ে খেলতে পারবে।”
“তুমি বুঝবে না নাজ। ছোটবেলায় বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা দিয়ে খেলতে হয়। এতে তাদের ইমাজিনেশন পাওয়ার বাড়ে।”
“ও পৃথিবীতে আসবার পরেই না হয় এগুলো আনতে। আমরা তো জানিই না ছেলে হবে না-কি মেয়ে। ছেলে হলে এই পুতুলগুলো দিয়ে কী করবো? আর মেয়ে হলে এই গাড়িগুলো দিয়েই বা কী করবো?”
“তোমাকে কে বলেছে, মেয়েরা গাড়ি দিয়ে আর ছেলেরা পুতুল দিয়ে খেলতে পারে না? খেলনার মধ্যে কোনো জেন্ডার থাকে না, মানুষের মস্তিকে থাকে।”
নাজ ঠোঁট উল্টে বলল, “বাব্বাহ! দিন দিন ফিলোসফার হয়ে যাচ্ছে দেখি।”
“কী আর করা? তোমার মতো বাচ্চার সাথে থাকতে থাকতে জ্ঞান দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“এই! আমি তোমাকে হেল্প করি?”
সায়েম সতর্ক গলায় বলল, “একদম না! যাও ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও, আমাকে হেল্প করতে হবে না।”
“রেস্ট তো সারাদিনই নিলাম, একটা মানুষ আর কত রেস্ট নিতে পারে? দাও না হেল্প করতে, তোমার ঘর সাজানো দেখে আমারও লোভ লাগছে।”
“আচ্ছা, বেশি কিছু করতে হবে না। এখানে বসে ড্রেসগুলো গোছাও।”
বাচ্চাদের জামাগুলোকে সাধারণত রঙের ভিত্তিতে আলাদা করে দেওয়া হয়। গোলাপী বা লালাভ রংগুলো মেয়েদের পোশাকে এবং নীলাভ রংগুলো ছেলেদের পোশাকে। এরজন্যেই গোলাপীকে মেয়েদের রং বলা হয়।সায়েম ভেবে পায় না একটা রং কী করে শুধুমাত্র ছেলেদের বা শুধুমাত্র মেয়েদের হয়। রং তো রংই। একে আবার আলাদা করে দেওয়ার কী আছে।
বাবুর জন্যে সায়েমের আনা পোশাকগুলোর মধ্যে নীল রঙও আছে আবার, গোলাপীও আছে। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, এই দুটো রংই পড়বে সে। নাজ বাবুর বিছানাটায় বসে পোশাকগুলো ভাঁজ করতে করতে কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। ঘরের পুরো দেয়ালজুড়ে কার্টুনের ওয়ালপেপার লাগানো হবে। এসব কাজে সাধারণত সায়েম বাইরে থেকে মিস্ত্রি ভাড়া করে আনে। তবে আজ সবকিছু নিজের হাতেই করছে।
নাজ আনমনে বলে ফেলল, “তুমি অনেক ভালো বাবা হবে।”
সায়েম ঠোঁটের কোণে বিচিত্র এক হাসির আভাস নিয়ে বলল, “কী করে বুঝলে?”
“তোমার ছেলেমানুষী দেখে। বাচ্চা আসার খবর শোনার পর থেকে দিন দিন নিজেই বাচ্চা হয়ে যাচ্ছ। দেখো! ও আমার থেকে তোমাকেই বেশি ভালোবাসবে।”
সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “কেন তুমি কি জেলাস?”
“অবশ্যই জেলাস! হুট করে কেউ এসে আমার ভালোবাসায় ভাগ বসাবে, আর আমি মেনে নেবো?”
সায়েম হঠাৎই কাজ থামিয়ে নাজের পাশে এসে বসলো।
অনেকটা সময় একদৃষ্টিতে নাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার মনে হয় ও এলে আমি আর তোমাকে আগের মতো ভালোবাসবো না?”
নাজ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
“আর আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী?”
“আমার মনে হয় তুমি আস্ত একটা বোকা।”
নাজ আহত গলায় বলল, “মানে?”
“আমি তোমাকে ভালোবেসেছি ঠিকই, কিন্তু কী করে ভালো না বেসে থাকা যায় তা শিখিনি। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে নাজ, যাই হয়ে যাক না কেন, আমি সারাটাজীবন এভাবেই তোমাকে ভালোবাসবো।”
নাজ আর্দ্র গলায় বলল, “সত্যি তো?”
“এখনো সন্দেহ আছে?”
নাজ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই লক্ষ করলো সায়েমের ফোন বেজে উঠেছে। সায়েম পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো স্ক্রিনে মায়ের নাম ভেসে উঠছে।
ফোনটা রিসিভ করে সায়েম স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যালো? কেমন আছো মা?”
হাসনা বেগম কোমল স্বরে বললেন, “ভালো আছি। তুই কেমন আছিস বাবা? বৌমা ভালো আছে?”
“হ্যাঁ, আছে। কথা বলবে?”
“পরে বলবো। আগে তোর সঙ্গে জরুরি কথাটা সেরে নিই।”
“আমার সঙ্গে আবার কী জরুরি কথা?”
হাসনা বেগম লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “শোন সায়েম, আগামী সপ্তাহে কনার পরীক্ষা শেষ হচ্ছে। আমি ঠিক করেছি তার পরপরই আমরা ঢাকায় চলে যাবো। বৌমার ডেলিভারির আগ পর্যন্ত সেখানেই থাকবো। এই সময়ে মেয়েদের নানান অসুবিধা হয়। আশেপাশে কোনো গুরুজন না থাকলে সেই অসুবিধা সামাল দেবে কী করে?”
“বাহ্! বেশ তো! আমি তো সেই কবে থেকে বলছি আমাদের সঙ্গে এসে থাকার জন্যে। এতদিন পর কথাটা কানে গেল তোমার।”
“তুই তো জানিস বাবা, ঢাকা শহরে পরপর কয়েকটা দিন থাকলেই আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। তবুও এবার আমার নাতি বা নাতনির কথা ভেবে রাজি হয়েছি।”
“ভালো ডিসিশন নিয়েছো। এখন আমিও অফিসে গিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। কনার পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই চলে আসবে।”
“সেটা আর তোকে শিখিয়ে দিতে হবে না। কই, বৌমাকে দে তো! ওকেও জানিয়ে দিই।”
সায়েমের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নাজ হাস্যোজ্জ্বল গলায় বলল, “আমাকে জানাতে হবে না মা। আমি নিজেই পাশ থেকে শুনছিলাম।”
হাসনা বেগম চিন্তিত গলায় বললেন, “তোমার ওপর আমার এতটুকুও ভরসা নেই বৌমা। যেমন ছেলেমানুষ তুমি! দেখা গেল ভুল করে ভারী একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভার্সিটিতে চলে গেছ। আমি এবার নিজেই গিয়ে তোমার দেখাশোনা করবো। তোমার মাকেও কতো করে বললাম, ভাবি আমাদের সঙ্গে চলুন। দুই বেয়ান মিলে একসঙ্গে মেয়েটার যত্ন করি। উনি না-কি নিজের বাড়ি ফাঁকা রেখে কোথাও যাবেনই না।”
নাজ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “হ্যাঁ সায়েম…”
কথাটা শেষ করার আগেই থেকে গেল। সায়েম সায়েম ডাকার মধ্যে যদিও অন্যায়ের কিছু নেই তবুও শাশুড়ির সামনে কেমন যেন লজ্জা লাগছে।
নাজ আবারও ইতস্তত করে বলল, “মানে উনিও মাকে বলেছিল…”
“থাক থাক, নিজের স্বামীর নাম ধরে ডাকবে না তো কি আমার নাম ধরে ডাকবে?”
“সরি মা।”
“আবার সরি বলতে হবে কেন? ভেবেছো কী? কেবল এযুগের বাচ্চাকাচ্চারাই আধুনিক। চাইলে আমরা বুড়ো-বুড়িরাও আধুনিক হতে পারি।”
নাজকে রাতের খাবার খাওয়াতে বেশ ভালোই ঝামেলা পোহাতে হলো সায়েমকে। মেয়েটা দুয়েক লোকমা খাচ্ছে, আর অন্য ঘরে চলে যাচ্ছে। সায়েমকেও বাধ্য হয়ে প্লেট হাতে এক থেকে অন্য ঘরে যেতে হচ্ছে তার পিছু পিছু।
নাজ আহ্লাদী স্বরে বলল, “আমি আর খেতে পারবো না। প্লিজ!”
“আরেকটু না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো নাজ।”
“পড়লাম অসুস্থ হয়ে! তবুও খেতে পারবো না।”
“তুমি না খেলে আমার বাবুটাও তো না খেয়ে থাকবে।”
“শোনো, বাবুটা আমারও! ও আমাকে বলেছে ওরও খেতে ইচ্ছা করছে না।”
সায়েম কঠিন গলায় বলল, “নাজ, আমি রেগে যাবো কিন্তু।”
“তুমি এই অবস্থাতেও আমার ওপরে রাগ করবে?”
“অবশ্যই করবো। চুপ করে খেয়ে নাও।”
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল নাজের। যদিও প্রেগন্যান্সির এই সময়টায় তার ঘুম ভেঙে যাওয়া নতুন কিছু না। প্রতি রাতে ঘড়ির কাঁটা যখন আড়াইটার ঘরে এসে থাকে, তখনি তার ঘুমটা ভেঙে যায়। কিন্তু আজ নির্ধারিত সময়ের বহু আগেই ঘুম ভেঙে গেল। এবং ঘুম ভেঙে হওয়ার কারণটাও নাজের কাছে স্পষ্ট।
পাশে সায়েম ঘুমাচ্ছে। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় তার মায়াভরা মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে নাজ। আহারে! মানুষটা এখন ডেকে তুলতে হবে ভাবতেই একরাশ খারাপ লাগা ছড়িয়ে গেল নাজের মাঝে।
তবুও উপায়ন্তর না পেয়ে নিচু এবং ক্লান্ত স্বরে নাজ ডাকল, “সায়েম? একটু উঠবে প্লিজ?”
সায়েমের ঘুমটা বোধ হয় ততক্ষণে গাঢ় পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তাই নাজের একডাকেই ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলে উঠলো, “হুঁ?”
“ওঠো না!”
“কী হয়েছে?”
“আমার খুব খারাপ লাগছে।”
সায়েম সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসলো। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “মানে? কী হয়েছে?”
নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “পেটে খুব ব্যথা করছে।”
“সে কী? কখন থেকে? আমাকে ডাকোনি কেন?”
“কী করে ডাকবো? আমার নিজেরই তো এইমাত্র ঘুম ভাঙলো।”
সায়েম আলতো স্পর্শে নাজের পেটে হাত রেখে বলল, “বেশি ব্যাথা করছে?”
“হুঁ।”
অবশ্য মুখে “হুঁ” না বললেও সায়েম ঠিকই বুঝতে পারতো নাজের ব্যথার তীব্রতা। মেয়েটার চোখেমুখে তা স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। খানিকক্ষণ আগেও যে মানুষটা একেবারে সুস্থ ছিল, হুট করে অচেনা এক ব্যথা কাহিল করে ফেলেছে তাকে।
নাজ ভীত গলায় বলল, “এই! এরকম তো কখনো হয়নি। আমার খুব ভয় করছে। ওর কিছু হবে না তো?”
“কিচ্ছু হবে না। শান্ত হও তো তুমি।”
সায়েম আর কথা না বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে কন্টাক্ট লিস্টে কার নম্বর যেন খুঁজছে।
নাজ বলল, “কাকে ফোন করছো?”
“ডক্টর রেহানাকে।”
“এত রাতে?”
“কেন উনিই তো বললেন, দিনে-রাতে যখনই কোনো প্রবলেম হোক তাকে কল করতে।”
ডক্টর রেহানা একটা ইমার্জেন্সির কারণে হাসপাতালেই ছিলেন। ফোন রিসিভ করেই বললেন, নাজকে।
নাজ ক্লান্ত গলায় সায়েমকে বলল, “এত রাতে আবার হসপিটালে যাওয়ার কী দরকার?”
সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “তোমাকে এতকিছু বুঝতে হবে না। চুপচাপ স্যান্ডেল পড়ো।”
সায়েমের মাঝে এক বিচিত্র ধরনের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা দেখতে পেল নাজ। তার সামান্য কোনো অসুবিধাতেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলেটা। তবে আজ সেই ব্যস্ততার সীমা পৌঁছে গেছে চূড়ান্তে। সায়েমের উদ্বেগের কাছে পরাজয় স্বীকার করে স্যান্ডেল পড়ে নাজ গাড়িতে গিয়ে বসলো।
নাজের ব্যথাটা আগের মতোই আছে।
হাসপাতাল এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। গাড়িতে বড়জোর দশ মিনিটের মত সময় লাগে। তার ওপরে এই মাঝরাতে রাস্তা বলতে গেলে ফাঁকাই। দুয়েকটা বড় বড় ট্রাক ছাড়া রাস্তায় আর কিছুই নেই। কেমন গা ছমছমে একটা পরিবেশ। সায়েমের বাম হাতটা ব্রেকের ওপরে। নাজ তার একটা হাত রাখলো সায়েমের হাতের ওপর।
সায়েম চিন্তিত গলায় বলল, “খুব বেশি খারাপ লাগছে তাই না?”
“উহুঁ।”
“এইতো, অলমোস্ট পৌঁছে গেছি।”
নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “তোমার কাঁধে একটু মাথা রাখি?”
“জিজ্ঞেস করার কী আছে?”
প্রিয় মানুষটার কাঁধে মাথা রাখতেই হুট করে একরাশ ঘুম নেমে এলো নাজের দুচোখ জুড়ে। মনে হচ্ছে যেন এক্ষনি তলিয়ে যাবে ঘুমের রাজ্যে।
ডক্টর রেহানা প্রায় অনেকক্ষণ যাবত কী সব চেক আপ করলেন। স্বস্তির বিষয়, বাবু একদম ঠিক আছে। প্রেগন্যান্সির সময়টাতে খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলেই মাঝে মধ্যে এমন ব্যথার আগমন হতে পারে। তিনি নাজকে পরামর্শ দিলেন সারাদিন জুড়ে অল্প অল্প খাবার খেতে। আর ঘুমের একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে নিতে। সেই সাথে কয়েকটা ওষুধের ডোজও পরিবর্তন করে দিলেন।
ব্যথা উপশমের জন্যে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ বা পেইনকিলার দেওয়া যেত। কিন্তু এখন সেসব কিছুই করা যাবে না, বাবুর অসুবিধা হতে পারে। তাই আপাতত হট ওয়াটার ব্যাগই ভরসা।
ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সায়েম ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে বসলো কেবিনের সামনের ওয়েটিং এড়িয়ায়। তার চোখেমুখে তীব্র উদ্বেগের ভাবটা না থাকলেও দুশ্চিন্তার ছাপ রয়েই গেছে।
নাজ অবাক গলায় বলল, “চলো, বাসায় যাবে না?”
সায়েম ক্লান্ত গলায় বলল, “পাঁচ মিনিট বসি এখানে?”
নাজ তার পাশে বসতে বসতে শান্ত গলায় বলল, “খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছিলে তাই না?”
“হ্যাঁ, ভয় হচ্ছিল। আসলে কী, বাবুটা আসার আগেই ওর প্রতি এত মায়া জন্মে গেছে তো। ওর কিছু হয়ে গেলে…”
নাজ সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমার এ নিয়ে কথা বলছি কেন? ডক্টর তো বললেনই ও ঠিক আছে।”
(চলবে)