অপেক্ষার আঁচল পর্ব-০২

0
50

#অপেক্ষার_আঁচল
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০২

রিদায়াত বাইক চালাতে চালাতে নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে যায়। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা বের করে দেখে, অর্ণব ফোন করেছে। রিদায়াত কিছুটা অবাক হয়। অর্ণব সাধারণত তাকে এভাবে ফোন করে না। ফোনটা ধরে রিদায়াত বলল,

“হ্যালো, অর্ণব, কি হয়েছে? তুমি তো এই সময়ে ফোন করো না!”

অর্ণবের কণ্ঠে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, “ভাই, তুই কোথায়? আমি তোকে একটু দেখাতে চাই, আসতে পারবি?”

রিদায়াতের মনের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল, “কি হয়েছে অর্ণব? ঠিক আছিস তো? কোথায় আসতে বলছিস?”

অর্ণবের উত্তর এল, “আমাদের বাসার কাছেই আয়। আমি নিচে অপেক্ষা করব। জরুরি একটা ব্যাপার আছে, তুই আসলে বলব।”

রিদায়াত দ্রুত বাইকের গতি বাড়িয়ে অর্ণবদের বাসার দিকে রওনা দিল। মনে মনে নানা রকম চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। অর্ণবের এমন হঠাৎ করে ফোন করা, তার কথার সুর, সব কিছুই যেন একটা অজানা শঙ্কা জাগিয়ে তুলছে।

কিছুক্ষণ পর রিদায়াত অর্ণবদের বাসার সামনে পৌঁছে। অর্ণব নিচে অপেক্ষা করছিল। রিদায়াত বাইকটা দাঁড় করিয়ে অর্ণবের দিকে এগিয়ে যায়।

“কি হয়েছে অর্ণব? তুই এভাবে ফোন করলি কেন?” রিদায়াত উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করল।

অর্ণব চারপাশে একবার দেখে নিয়ে নিচু গলায় বলল, “ভাই, চল তুই আমার সাথে। কিছু দেখাবো তোকে।”

রিদায়াত কিছু না বলেই অর্ণবের সাথে হাঁটা দিল। তারা দু’জনে অর্ণবদের বাসার পিছনের দিকে চলে গেল। সেখানেই অর্ণব তাকে একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, “ভাই, দেখ, এটা কিসের মতো লাগছে তোর?”

রিদায়াত ভালো করে তাকিয়ে দেখল, এক জায়গায় মাটি একটু খুঁড়ে রাখা। মাটির ওপরে কাঠগোলাপের ডাল পড়ে আছে। অর্ণব বলল, “এটা আজ সকালে এখানে দেখি। আমার তো কিছুতেই বুঝে আসছে না, কে বা কেন এটা এখানে রেখেছে। তুই কি কিছু বুঝতে পারছিস?”

রিদায়াত চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর গভীরভাবে ভাবতে শুরু করল। কিসের যেন একটা রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে। সে ডালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, “এই ডালটা এখানে এল কীভাবে? আর কে রেখে গেল?”

অর্ণব আবার বলল, “ভাই, কিছু একটা বলতে পারছিস? কেন এই ডালটা এখানে? আর কারও কি কোনো শত্রুতা ছিল আমাদের সাথে?”

রিদায়াত ধীরে ধীরে বলল, “অর্ণব, তুই এখনো এটা কাউকে বলিস না। আমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখি। তবে একটা কথা, তোর বাসার কেউ কি কোনো নতুন লোকের সাথে পরিচিত হয়েছে, যারা আমাদের আগে থেকে চেনে না?”

অর্ণব মাথা নাড়ল, “না ভাই, তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না। তবে মা কিছুদিন আগে বলছিল, শুভ্রতা নাকি একদিন গাছের ডাল ভেঙেছিল। কিন্তু সে তো এসব করবে না, তাই না?”

রিদায়াতের মনে হঠাৎ একরকম ভাবনা উঁকি দিল। শুভ্রতার কথা মনে পড়তেই যেন সবকিছু পরিষ্কার হতে শুরু করল। রিদায়াত মুচকি হাসল, “ঠিক আছে, তুই আর চিন্তা করিস না। আমি বিষয়টা দেখছি। তুই এখন বাসায় যা, আর ডালটাও যেখানে ছিল সেখানে রেখে দে।”

অর্ণব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নাড়ল, “আচ্ছা ভাই, তুই যেহেতু বলছিস, তাই করব।”

রিদায়াত ধীরে ধীরে বাইকের দিকে ফিরে আসে। বাইকে বসে আবারও একটা হাসি তার মুখে ফুটে ওঠে। মনে মনে সে ভাবতে লাগল, “শুভ্রতা… তুমি যদি জানতে, আমি তোমার এই কাণ্ডটা দেখে ফেলেছি!”

এদিকে শুভ্রতা পরীক্ষার জন্য রাতের খাটতে শুরু করলেও মনটা সেই কাঠগোলাপের ডালেই পড়ে আছে। সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, “পরীক্ষা শেষ হলেই ডালটা লাগাবো।” কিন্তু তার ভেতরে কেমন যেন একটা উত্তেজনা কাজ করছে। শুভ্রতা যেন বুঝতে পারছে, এই কাঠগোলাপের ডালটি তার জীবনে কোনো বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

রিদায়াতের মনেও চলছে নানা ভাবনা। হয়তো এই ডালের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের দু’জনের জীবনের নতুন কোনো অধ্যায়, যা তাদেরকে আরও কাছে নিয়ে আসবে।

আকাশে এখন গভীর রাতের চাঁদ উঠেছে, আর দু’জনের মনে নতুন কিছু ঘটার আগমনী বার্তা যেন চুপিসারে জানান দিচ্ছে।

রিদায়াত বাইকে বসে শুভ্রতার কথা ভেবে হাসছিল, কিন্তু তার মনের গভীরে একধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল। সে জানত, এই মেয়ে তার জীবনে কিছু একটা পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। বাইকের ইঞ্জিন চালু করে সে মনে মনে ভাবল, “শুভ্রতা, তুমি আমার নজরে পড়েছ, এখন দেখো আমি তোমাকে কীভাবে চিনতে শিখি!”

রিদায়াত বাইক চালিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু তার মন শুভ্রতার ভেঙে নেওয়া কাঠগোলাপের ডাল আর সেই রহস্যময় মেয়ে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। সে ঠিক করল, পরের দিন সকালে সে এই ব্যাপারে আরও খোঁজ নেবে।

পরের দিন সকালে রিদায়াত আগেভাগেই উঠে বেরিয়ে পড়ল। তার মনের মধ্যে আজকের দিনটা নিয়ে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে। সে ঠিক করল, অর্ণবদের বাসার দিকে যাবে, হয়তো সেখানে গিয়ে সে শুভ্রতাকে আরও কিছুটা বুঝতে পারবে।

অর্ণবের বাসার সামনে পৌঁছে রিদায়াত বাইকটা থামিয়ে নামল। ঠিক সেই সময় শুভ্রতা দরজা দিয়ে বাইরে বেরোচ্ছে। হাতে তার একটা ছোট্ট গাছের চারা। রিদায়াত দেখে বোঝার চেষ্টা করল, এটাই কি সেই কাঠগোলাপের ডাল?

শুভ্রতা রিদায়াতকে দেখে একটু থেমে গেল। মনে মনে সে চিন্তায় পড়ে গেল—এই ছেলেটা কে? এত সকালে এখানে কেন?

রিদায়াত শুভ্রতার দিকে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, “গুড মর্নিং! আমি ভাবছিলাম, এমন সুন্দর সকালে যদি কেউ একটা সুন্দর গাছের চারা রোপণ করে, তাহলে সকালটা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।”

শুভ্রতা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “আপনি কে? এখানে কী করছেন?”

রিদায়াত একটু মুচকি হেসে বলল, “আমি রিদায়াত। অর্ণবের বন্ধু। আর তুমি নিশ্চয়ই শুভ্রতা?”

শুভ্রতা কিছুটা বিস্ময় নিয়ে মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?”

রিদায়াতের চোখে-মুখে সেই একই রহস্যময় হাসি, “অর্ণব অনেক কিছুই বলে, তোমারও গল্প শুনেছি। আর তোমার এই গাছের প্রতি ভালোবাসার গল্প তো অর্ণবের মুখেই শুনেছি।”

শুভ্রতা কিছুটা বিব্রত হয়ে মৃদু হাসল, “ও, তাই বলুন। আসলে আমি গাছ ভালোবাসি। আর এই কাঠগোলাপের ডালটা অনেক কষ্টে পেয়েছি। তাই সেটাকে লাগাতে যাচ্ছি।”

রিদায়াত কিছুক্ষণ চুপ করে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সে বলল, “তুমি জানো, এই ডালটা ঠিকভাবে লাগালে সেটা অনেক সুন্দর ফুল ফুটাবে। কিন্তু ডালটা লাগাতে হবে যত্নসহকারে। আমি তোমাকে একটু সাহায্য করতে পারি, যদি চাও?”

শুভ্রতা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি যদি সাহায্য করেন, তবে আমি খুশি হব।”

রিদায়াত আর শুভ্রতা মিলে সেই কাঠগোলাপের ডালটা মাটিতে পুঁতে দিল। দু’জনই বেশ মনোযোগ দিয়ে কাজটা করল। শুভ্রতা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল, “ডালটা লাগানো হয়ে গেল, কিন্তু যদি ঠিকভাবে না গজায়?”

রিদায়াত মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “তুমি চিন্তা করো না। ঠিকভাবে যত্ন নিলে এই গাছটা ফুল দেবে। তবে শুধু গাছ নয়, সম্পর্কেরও যত্ন নিতে হয়। যেমন, আমি ভাবছি আমরা দু’জন কি নতুন একটা বন্ধুত্ব শুরু করতে পারি না?”

শুভ্রতা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল, “হয়তো পারি।”

রিদায়াত হাসি দিয়ে বলল, “তাহলে ঠিক আছে। এই গাছের ফুল ফুটলে আমাদের বন্ধুত্বের প্রথম স্মৃতি হয়ে থাকবে। আর আমরা দু’জনই যেন এই গাছের মতো আরও সুন্দর হয়ে উঠি, তাই না?”

শুভ্রতা সম্মতি জানিয়ে হাসল। এরপর দু’জনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা নতুন বন্ধুত্বের শুরুতে পা রাখল। আকাশের সোনালি আলোয় যেন তাদের বন্ধুত্বের বীজটাও ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে শুরু করল।

শুভ্রতা আর রিদায়াতের এই নতুন বন্ধুত্ব তাদের জীবনকে ধীরে ধীরে আরও রঙিন করে তুলতে শুরু করল। তারা নিয়মিত দেখা করতে লাগল, তবে সেই দেখা হওয়া আর পাঁচজনের মতো নয়। কখনও একসঙ্গে বইমেলায় ঘুরতে যাওয়া, কখনও বা শহরের কোন অজানা জায়গায় হাঁটতে যাওয়া—তাদের মধ্যে যে একটা গভীর টান তৈরি হচ্ছে, সেটা তারা দু’জনেই অনুভব করতে পারছিল।

রিদায়াত তার জীবনের অন্য সবকিছু থেকেও শুভ্রতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। শুভ্রতার সরলতা, তার হাসি, তার গাছের প্রতি ভালোবাসা—সবকিছুই তাকে মুগ্ধ করছিল। অন্যদিকে শুভ্রতাও রিদায়াতের স্নেহ ও সমর্থনের মধ্যে একধরনের নিরাপত্তা ও ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছিল।

তবে দু’জনের মধ্যে অস্বস্তি একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল। রিদায়াতের মনের মধ্যে যে রহস্যময় অস্থিরতা কাজ করছিল, সেটা শুভ্রতার সঙ্গেও ভাগ করতে চাইল না সে। শুভ্রতা বুঝতে পারছিল, রিদায়াতের মনে কিছু একটা লুকিয়ে আছে, কিন্তু সে সেটা নিয়ে কখনও প্রশ্ন করেনি। কারণ, সে জানত, একদিন রিদায়াত নিজেই সবকিছু বলবে।

একদিন বিকেলে, যখন আকাশে হালকা মেঘের ছায়া, শুভ্রতা আর রিদায়াত শহরের এক নিরিবিলি জায়গায় বসেছিল। শুভ্রতা নিজের মনেই বলল, “তুমি জানো রিদায়াত, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত যদি এমন শান্ত আর সুন্দর থাকত!”

রিদায়াত একটু চুপ থেকে বলল, “জীবন কখনও এক জায়গায় থেমে থাকে না, শুভ্রতা। সুখ আর দুঃখ মিলে আমাদের জীবনটা সম্পূর্ণ হয়। তবে আমাদের বন্ধুত্বের মতো সম্পর্কগুলো সেই সুখ-দুঃখের মধ্যে থেকে আমাদের সবসময় ভালো থাকতে সাহায্য করে।”

#চলবে