অপেক্ষার আঁচল পর্ব-০৩

0
41

#অপেক্ষার_আঁচল
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৩

শুভ্রতা তার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলছ। তবে জানো, আমি মাঝে মাঝে ভয় পাই, যদি আমাদের বন্ধুত্বে কোনও কিছু ব্যাঘাত ঘটে!”

রিদায়াত তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “শুভ্রতা, জীবনের প্রতিটা সম্পর্ক একটা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। কিন্তু যদি আমরা একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখি, তাহলে কোনো বাধাই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”

শুভ্রতা একটু ভেবে বলল, “তাহলে তুমি কি আমাদের বন্ধুত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছ?”

রিদায়াত একটু হেসে বলল, “ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা ঠিক নয়। বরং আমি চাই, আমরা বর্তমানটাকে উপভোগ করি। কারণ এই মুহূর্তগুলোই আমাদের জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে।”

শুভ্রতা আর কিছু বলল না, শুধু রিদায়াতের কথাগুলো মনে মনে ভাবতে লাগল। তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে আরও গভীর হতে লাগল, কিন্তু তার মধ্যেই একটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেল—রিদায়াতের মনে লুকানো সেই রহস্য, যা একদিন হয়তো তাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে।

শুভ্রতা আর রিদায়াতের বন্ধুত্ব গভীর হলেও, রিদায়াতের মনের অস্থিরতা শুভ্রতার চোখ এড়ায়নি। শুভ্রতা অনেকবার চেয়েছে, রিদায়াতকে তার মনের কথা খুলে বলুক, কিন্তু রিদায়াত সবসময় এড়িয়ে যেত। রিদায়াতের মধ্যে সেই যে গোপন একটা টানাপোড়েন কাজ করছিল, সেটা কখনও প্রকাশ পেতে চায়নি।

—————-

এক রাতে শুভ্রতা একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। সে দেখল, একটা অন্ধকার ঘরে রিদায়াত দাঁড়িয়ে আছে, আর ঘরের চারপাশে আগুন লেগে যাচ্ছে। শুভ্রতা চিৎকার করে রিদায়াতকে ডাকতে থাকে, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। ঘরের চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা ধীরে ধীরে রিদায়াতকে গ্রাস করতে থাকে, আর সে অসহায়ের মতো শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ্রতা চিৎকার করে উঠে দেখে, সে নিজের ঘরে, ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।

এই স্বপ্নটা যেন শুভ্রতার মনকে আরও অস্থির করে তুলল। তার মনের মধ্যে অজানা একটা ভয় ঢুকে পড়ল। সে ভাবল, হয়তো এটা শুধু একটা দুঃস্বপ্ন, কিন্তু তার মনের একটা অংশ তাকে বলছিল যে, এর পেছনে কোনো গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে।

রিদায়াতের সঙ্গে দেখা করে শুভ্রতা তার দুঃস্বপ্নের কথা বলল। রিদায়াত একটু থমকে গেল, তার মুখে এক অদ্ভুত ছায়া নেমে এল। সে শুভ্রতার হাত ধরে বলল, “শুভ্রতা, স্বপ্ন কখনও কখনও আমাদের মনে অজানা ভয় ঢুকিয়ে দেয়, কিন্তু বাস্তবতা সবসময়ই আলাদা। তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই।”

কিন্তু শুভ্রতা তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল, রিদায়াতের চোখে একধরনের দুশ্চিন্তা লুকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারল, রিদায়াত কিছু একটা লুকাচ্ছে, কিন্তু তার মুখে বলার সাহস পাচ্ছে না।

এরপর থেকে শুভ্রতার মনের সেই অজানা ভয়টা ক্রমশ বাড়তে লাগল। সে দিনরাত শুধু রিদায়াতের কথা ভাবত, আর সেই দুঃস্বপ্নটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকত। শুভ্রতা বুঝতে পারছিল, তাদের সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, যা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

এভাবেই কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। শুভ্রতার দিনগুলো কেটেছে শুধুমাত্র অদ্ভুত এক খটকায়।

হুট করে শুভ্রতার মনে হতে লাগল সাত আটদিন ধরে রিদায়াত শুভ্রতার সঙ্গে কথা বলা আগের থেকে কমিয়ে দিয়েছে। এতে যে শুভ্রতার মনের ভিতরের অস্থিরতা যেন বেড়েই চলছে। এমন কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। রিদায়াত কি এমন লোকাচ্ছে তার থেকে! কি এমন রহস্য আছে তার মাঝে! যা সে শুভ্রতাকে বলতে পারছেনা। এগুলো ভাবছিলো আর মাথার চুলগুলো দুহাতে শক্ত মুঠি করে ধরে বসে ছিলো শুভ্রতা। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। শুভ্রতা দ্রুততার সঙ্গে ফোনটা তুলে নিয়ে দেখলো রিদায়াত কল করেছে। শুভ্রতার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। শুভ্রতা কল রিসিভ করে কানে ধরতে অপর পাশ থেকে রিদায়াত বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“কাল একবার দেখা করতে পারবি শুভি!”

শুভ্রতা কোনো দ্বিধা ছাড়াই ঝট করে বলে উঠলো
“হুম পারবো”

“আমি তোকে ঠিকানাটা মেসেজ করে দিবোনি। কাল বিকেল চারটায় কলেজ শেষে আসিস।”

“আচ্ছা”

শুভ্রতার আচ্ছা কথাটা শুনেই কল কেটে দিলো রিদায়াত। শুভ্রতার মুখটা মলিন হয়ে এলো। সে ভেবেছিলো আজ হয় তো অনেকটা সময় নিয়েই কথা বলবে রিদায়াত। কিন্তু কি হলো! শুভ্রতার ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।

—————–

শুভ্রতা কলেজ শেষে বিকালে রিদায়াতের দেওয়া ঠিকানায় এসেছে। রিদায়াত তাকে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে তারা আগেও একাধিকবার বসেছিল। কিন্তু আজকের পরিবেশটা যেন একটু ভিন্ন ছিল। বাতাসে একধরনের শীতলতা, আর আকাশের মেঘগুলো ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছিল। রিদায়াত তার হাত ধরে, শুভ্রতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুভি, তোর আমার সঙ্গে একটা শেষ কথা বলার আছে।”

শুভ্রতার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সে জানত, আজ সেই দিন যখন রিদায়াতের মুখে লুকানো সেই অস্থিরতার কারণ বের হবে। সে নীরবে রিদায়াতের দিকে তাকিয়ে রইল, তার হাত শক্ত করে ধরল, যেন কিছুতেই রিদায়াতকে হারাতে চায় না।

রিদায়াত একটু থেমে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা নিচু করে এক নাগাড়ে বলল
“শুভ্রতা, আমার জীবনের কিছু অধ্যায় আছে যা আমি তোমাকে কখনও বলিনি। আমি ভেবেছিলাম, তোমার সঙ্গে সবকিছু ভাগ করে নেব, কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এত গভীর যে, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। তবে আজ আর সেটা লুকিয়ে রাখার মতো সময় নেই।”

শুভ্রতার চোখে পানি এসে গেল। সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি যা কিছুই লুকিয়ে রাখো, আমি সেটা মেনে নেব। শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি ও যেন তোমাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি এই কয়েক‍টা দিনে।”

রিদায়াতের চোখেও অশ্রু জমল। সে শুভ্রতার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলল
“শুভ্রতা, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না, কিন্তু আমার জীবনের একটা অংশ আছে যা তোমার জীবনকেও প্রভাবিত করতে পারে। সেই অংশটাই আমাকে আজ বলতেই হবে।”

রিদায়াত গভীর শ্বাস নিয়ে বলল
“শুভ্রতা, তুমি জানো আমি সবসময় ব্যস্ত থাকি, কিন্তু কখনও জানতে চাওনি, এই ব্যস্ততার কারণ কী। আসলে, আমার এই ব্যস্ততার পেছনে রয়েছে এমন কিছু, যা আমি তোমার থেকে লুকিয়ে রেখেছি।”

শুভ্রতা রিদায়াতের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, তার চোখে কৌতূহল আর ভয় মিশে ছিল।

রিদায়াত কিছুটা কাঁপা কণ্ঠে বলল
“আমি একজন সাধারণ মানুষ নই, শুভ্রতা। আমি একজন মাফিয়া গ্যাংয়ের প্রধান। আমার জীবন সবসময় বিপদের মধ্যে থাকে, আর আমি সেই বিপদের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাই। আমি এমন এক জগতে বাস করি যেখানে বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধ, আর মৃত্যুর ছায়া লেগে থাকে।”

শুভ্রতা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, যার সঙ্গে এতদিন সে এতটা কাছাকাছি ছিল, সে এমন একটা অন্ধকার জগতের সঙ্গে যুক্ত। তার হাত ঠাণ্ডা হয়ে এল, আর সে ধীরে ধীরে হাতটা রিদায়াতের হাত থেকে সরিয়ে নিল।

রিদায়াত বুঝতে পারল শুভ্রতার মনে কী চলছে। সে ধীরে ধীরে বলল
“আমি জানি, এটা শোনার পর তোমার মনে অনেক প্রশ্ন উঠবে, অনেক ভয় তৈরি হবে। কিন্তু আমি তোমাকে মিথ্যা বলিনি। আমি চাইনি তোমার জীবন এই অন্ধকারে জড়িয়ে যাক।”

শুভ্রতা শ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিল যেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে সে বলল
“তুমি কি তাহলে… মানুষ খুন করো?”

রিদায়াতের মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল
“হ্যাঁ, শুভ্রতা। কিন্তু আমি কখনও নিরীহ মানুষকে আঘাত করিনি। আমি শুধু তাদের শাস্তি দিই যারা সমাজের জন্য বিপদ। কিন্তু আমি জানি, আমার এই কাজকে তুমি বা অন্য কেউ সহজভাবে নেবে না।”

শুভ্রতা বুঝতে পারছিল না কী বলবে। তার মনের মধ্যে রিদায়াতের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর সেই অজানা ভয়ের সংঘাত চলছিল। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল “রিদায়াত, আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু এই জীবন… এটা কীভাবে মেনে নেব?”

রিদায়াত তার দিকে চেয়ে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে বলল
“আমি জানি, এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। তাই আমি তোমার থেকে কিছু চাই না, শুভ্রতা। যদি তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও, আমি বাধা দেব না। তবে একটা কথা মনে রেখো, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর সবসময় ভালোবেসে যাব।”

শুভ্রতা চোখের জল মুছে বলল
“আমি এখনই কিছু বলতে পারব না, রিদায়াত। আমার সময় চাই।”

রিদায়াত মাথা নেড়ে বলল
“ঠিক আছে। তুমি যতটা সময় চাও, নাও। তবে আমি অপেক্ষা করব।”

শুভ্রতা কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। তার মনে হাজারটা প্রশ্ন, হাজারটা ভয়, আর সেই সঙ্গে রিদায়াতের প্রতি তার ভালোবাসা। সে ধীরে ধীরে রিদায়াতের কাছ থেকে দূরে সরে গেল, যেন নিজের চিন্তাগুলো পরিষ্কার করতে চাইছে।

রিদায়াত তার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে মাটির দিকে তাকাল। সে জানত, তার জীবন সহজ নয়, আর শুভ্রতার মতো মেয়েকে এই জীবনে টেনে আনা অন্যায় হবে। কিন্তু তার ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে, সে কিছুতেই শুভ্রতাকে ভুলতে পারছিল না।

শুভ্রতা ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ির দিকে যেতে লাগল, তার মনে গভীর কষ্ট আর অস্থিরতা। রিদায়াতের ভালোবাসা আর সেই অন্ধকার জীবন—এই দুইয়ের মধ্যে তার মনের লড়াই শুরু হলো। কীভাবে সে এই সমস্যার সমাধান করবে, তা নিয়ে তার মনে কোনো পরিষ্কার উত্তর ছিল না।

শুভ্রতা তার মনের দ্বন্দ্ব নিয়ে বাড়ি ফিরল। দরজার সামনে পৌঁছে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। তার মনের মধ্যে রিদায়াতের কথা, তার গোপন জীবন—সবকিছুই ভেসে উঠছে। এতদিন যে মানুষটিকে সে শুধু ভালোবেসেছে, তার জীবন নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না, আজ তার সম্পর্কে এত ভয়ঙ্কর সত্য জানার পর সে কী করবে, তা বুঝে উঠতে পারছে না।

দরজাটা খুলতেই তার মা, মাহফুজা বেগম, হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানালেন।

“শুভি, কেমন ছিল দিনটা?”

মায়ের কণ্ঠে চিন্তার ছোঁয়া ছিল, কিন্তু শুভ্রতার মনে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না।

শুভ্রতা কেবল মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে হাসল। তার মায়ের চোখে কিছু যেন ধরা পড়ল, শুভ্রতার চোখের গভীরে যে অস্থিরতা ছিল, তা তার মা অনুভব করলেন। তিনি শুভ্রতার কাঁধে হাত রাখলেন ধীর কন্ঠে বললেন
“কী হয়েছে মা? ঠিক আছিস তো?”

শুভ্রতা কিছু বলতে চাইল, কিন্তু তার গলা শুকিয়ে গেল। সে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শব্দগুলো তার গলা থেকে বের হল না। অবশেষে সে মাথা নীচু করে কাঁপা কণ্ঠে বলল
“আমি ঠিক আছি, আম্মু। একটু ক্লান্ত লাগছে, তাই… একটু ঘুমাবো।”

#চলবে