অপেক্ষার বসন্ত পর্ব-০৫

0
240

#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০৫

তাই তো সবাই তাকে ভুল বুঝছে।তার মা কথা বলতে পারলে তখন হয়তো সব সমস্যার সমাধান হবে।তাই শুধু অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আরাফের মা মিসেস আরমিনকে আইসিইউ থেকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়েছে।এই দুদিন ধরে অনেক ডাক্তার এবং নার্স তাকে দেখতে এসেছেন।সবাই আরাফের বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র এবং শিক্ষক। কিন্তু জুঁই আসেনি। হয়তো সে জানেই না আরাফের মা অসুস্থ।যারা এসেছেন সবাই আরাফকে রুমের বাইরে আবিষ্কার করেছে। একজন কার্ডিওলজিস্ট হয়ে নিজের মায়ের ট্রিটমেন্ট করছে না কেন, কেন সে মা’কে দেখতে রুমের ভেতর যাচ্ছে না এই নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন জাগছে। প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।কারণ সে তখন থেকেই রুমের বাইরে বসে আছে। কোথাও যাচ্ছে না, কারো সাথে কথা বলছে না সে।এমনকি দু’দিন ধরে কিছুই খায়নি সে। অবশ্য বাড়ির কেউ তাকে খেতেও বলেনি। এমন ছেলের খোঁজ কে রাখবে তাও এতো টেনশনের মধ্যে?

কেবিন রুমে আনার পরও আরাফকে তার বাবা যেতে দেয়নি মায়ের কাছে।এখন তার সহ্যের সীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে।কখন যে হুট করে বাবার আদেশ অমান্য করে কেবিনে ঢুকে পড়ে তা তার জানা নেই। ‌মনে মনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে একটু পর ডাক্তার চেক‌আপ করতে আসলে সেও ডাক্তারের সাথে ঢুকে যাবে।তার বাবা রেগে গিয়ে বড়জোর দুটো চড় দিবে।দোষ যেহেতু করেছে চড় খেতে তার কষ্ট নেই।তাই মনের মধ্যে সাহস জমিয়ে কেবিনে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তার আশাকে নিরাশা করে দেওয়ার জন্য একটু পর ঘটে গেলো ঝামেলা। জুঁই এসেছে হাসপাতালে।এসেই সোজা আরাফের কাছে চলে আসলো সে।আরাফ তাকে দেখেও চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু জুঁই এসেই হুকুম দিলো:আরাফ চলো। কথা আছে তোমার সাথে।

আরাফ জুঁইয়ের কথায় একটু ইতস্তত করে উঠে দাঁড়ালো। একপলক তার বাবার দিকে তাকিয়ে আরেক পলক অর্নির তাকালো।অর্নিও তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার বাবার দৃষ্টি অন্যদিকে। তিনি ইচ্ছাকৃত অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন।আরাফের সাড়াশব্দ না পেয়ে জুঁই আবারো বললো: দাঁড়িয়ে আছো কেনো?চলো আমার সাথে।
_আমার আম্মু অসুস্থ। এখন যেতে পারবো না।
জুঁই আরাফের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো: তোমার মা অসুস্থ। তুমি তো সুস্থ আছো তাই না? তাছাড়া তোমার মাকে দেখার জন্য এখানে অনেকেই আছে।তারা দেখবে আরকি।
_আমার যেতে ইচ্ছে করছে না এখন।
_তুমি যাবে আমার সাথে।যাবে মানে যাবে।আর কোনো কথা শুনতে চাই না।
আরাফ এবার ছোট গলায় ফিসফিসিয়ে বললো: দেখো, এখানে আমার ফ্যামিলি চেম্বারস আছে। আমার আব্বু আছে। আমার ছোট বোন, স্ত্রী আছে।তারা আমাকে কতো সম্মান করে।তুমি সবার সামনে এভাবে কথা বলছো কেন? একটু ম্যানার্স তো শিখো।
_আমাকে ম্যানার্স শেখাতে আসবে না।চলো সোজা।

আরাফ জুঁইকে আর কিছু বললো না। চুপচাপ চলে গেলো।কারণ সে তো জানে জুঁই কখনো মানবে না তার কথা। জুঁই তো আর অর্নি নয় যে চুপ বললে চুপ হয়ে যাবে। অর্নি চুপচাপ আরাফের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার চোখ দুটোও ছলছল করছে। আরাফকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে এখন জুঁইয়ের সাথে যেতে চাচ্ছে না।বাধ্য হয়ে যাচ্ছে সে।অথচ আরাফকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে অনেক ক্লান্ত আর চিন্তিত।অর্নির মাথায় জুঁইয়ের আচরণটা কেমন জানি গণ্ডগোল লাগছে। একটু ভাবতে হবে বিষয়টা।আরাফের মুখের উপর তার বাবা ছাড়া কেউ কথা বলতে পারে না।অথচ জুঁই তার সাথে এভাবে কথা বলছে আর সে সব অনায়াসে মেনে নিচ্ছে। বিষয়টা তো ভাবতেই হয়।

হাসপাতাল থেকে নামার সময় আরাফের দুজন বন্ধু আসছিল। তাকে এবং জুঁইকে দেখে একটা বাঁকা হাসি দিলো।সব জেনেও না জানার ভান করে বললো:তোর মা অসুস্থ মনে হয়? এখন ভাবিকে সময় না দিয়ে একটু আন্টিকে সময় দিতে তো পারিস।
আরাফ কোনো জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।এই কদিন ধরে তার সাথে এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।জীবনে যেসব পরিস্থিতি কখনো চোখে দেখেনি সেসব এখন তার সাথে হচ্ছে। কিন্তু সে নিরুপায়। নেই কোনো জবাব। নেই কোনো সমাধান।

আরাফকে সবাই খুব ভালো করে চিনে। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে পরিচিত মুখ সে।এলাকায় এবং আত্নীয়-স্বজনের কাছে সে ভদ্র ছেলের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।এইস‌এসসি পর্যন্ত দুনিয়ার মুখ না দেখে পড়াশোনা করেছে। সারাদিন পড়াশোনা আর বিভিন্ন এক্সট্রা এক্টিভিটিতে যুক্ত থাকতো।সব পরীক্ষায় টপ করতো।প্রেম করা তো দূরের কথা কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতো না। তার এসব গুণের কাছে অর্নির কিশোরী মন পরাজিত হয়ে গিয়েছিল। সবসময় সে আরাফকে ফলো করতো।আরাফ কয় ঘন্টা পড়ছে, কোথায় যাচ্ছে সব ফলো করতো।আরাফ এক প্রকার তার ডেইলি রুটিন ছিল।তাই শিক্ষাজীবনে সেও কম সফলতা পায়নি।আরাফের মতো হতে না পারলেও অনেকটা কাছাকাছি গিয়েছে সে।

আরাফ মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর প্রথম দুই বছর ভালোই ছিল। কিন্তু তৃতীয় বছরে জুঁই সেই মেডিকেলে ভর্তি হয়। জুঁই তার দুই বছরের জুনিয়র। অর্নি তার মনের কথাগুলো আরাফকে বলার আগে জুঁই আরাফের জীবনে চলে আসে। তিন বছরের প্রেম ছিল জুঁই আর আরাফের। আরাফ এই তিন বছরে অনেকটা পাগল জুঁইয়ের প্রেমে। তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।মন উজাড় করে ভালোবেসেছিল সে জুঁইকে। কিন্তু তার এমবিবিএস শেষ হলে সে ডিগ্রি নিতে বিদেশ যায়। তখন থেকেই জুঁইয়ের সাথে দূরত্ব শুরু। বিদেশ যাওয়ার প্রথম মাসেই জুঁই তাকে কোনো কারণ ছাড়াই সবকিছু থেকে ব্লগ দিয়ে দেয়।আরাফ তখন অনেক চেষ্টা করেও জুঁইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। এদিকে বাবার ভয়ে দেশেও ফিরে আসতে পারছিল না সে।

দুই বছর পর দেশে ফিরে সে জানতে পারে জুঁইয়ের এমবিবিএস শেষ হয়েছে এবং সে এখন আরাফদের মেডিকেলে নেই।

দেশে এসে জুঁইকে না পাওয়ার পর থেকেই আরাফ পাল্টে গেছে। তখন থেকে তার বাবা-মা, পরিবার তাকে বুঝিয়েছে,অন্যত্র বিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু তার একটাই কথা।সে কখনো অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারবে না। শুধু জুঁইকে চায়। অন্য মেয়েকে সে জুঁইয়ের অধিকার দিতে পারবে না।তাই সে বিয়েও করবে না। তার বিশ্বাস জুঁই একদিন ফিরে আসবে। দেশে আসার পর থেকে বিভিন্ন মেডিকেলে গিয়ে খোঁজ করেছিল। কিন্তু জুঁইকে সে কোথাও খুঁজে পায়নি তখন।ছয় বছর চেষ্টার পর এক প্রকার ব্যর্থ হয় সে যখন জানতে পারে জুঁই তাদের মেডিকেলে থাকতে আরাফের এক ব্যাচমেটকে বিয়ে করেছিল।তার এক বন্ধু তাকে খবরটা বলেছিল।

জুঁইয়ের বিয়ের খবরটা জানার পরে পরিবারের সদস্যদের চাপে সে অর্নিকে বিয়ে করতে রাজি হয়। তবে বিয়ের সময় আরাফ সরাসরি বলে দিয়েছিল অর্নির সাথে এডজাস্ট হতে তার সময় লাগবে।তাই তাকে সময় দিতে হবে।কারণ সে এখনো জুঁইকে ভালোবাসে। জুঁইকে ভুলতে একটু সময় লাগবে তার।তখন অর্নিসহ দুই পক্ষের সবাই বিষয়টা মেনে নিয়েছিল।অর্নিও আরাফের কথামতো তাকে এডজাস্ট হতে সময় দিয়েছে। আরাফ‌ও অর্নির সাথে এডজাস্ট হ‌ওয়ার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু বিয়ের দুই মাসের মাথায় আবার সব এলোমেলো হয়ে গেলো। জুঁই ফিরে এসে আরাফের হাসপাতালে জয়েন করলো। তখন থেকে আরাফ আবারো জুঁইয়ের প্রতি দূর্বল হয়ে গেলো‌। পুরনো প্রেম ফিরে আসায় সে কি করবে বুঝতে পারছিল না। অর্নির সাথে এডজাস্ট হ‌ওয়া দূরের কথা উল্টো সে অর্নিকে সহ্য করতে পারছিল না। দুই মাস প্রচেষ্টার পর অর্নি ব্যর্থ হয়ে আরাফকে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু অর্নি এখনো জানে না জুঁই এই ছয় বছর কোথায় ছিল?আরাফ এতো খোঁজাখুঁজির পরেও জুঁইকে কেন খুঁজে পেলো না? বিয়ের দুই মাসের মাথায় জুঁই আবার আরাফের জীবনে ফিরে আসলো কেনো? জুঁইয়ের হাসবেন্ড থাকা সত্ত্বেও আরাফ কেনো তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো? অথবা জুঁইয়ের হাসবেন্ড এখন কোথায়?সব প্রশ্ন অর্নির মনের মধ্যে গেঁথে আছে। কিন্তু কোনো প্রশ্নের সঠিক সমাধান এখনো সে বের করতে পারছে না।

অর্নির সাথে বিয়ের পর আরাফ জুঁইকে অনেকটা ভুলে গিয়েছিল। জুঁই তার ক্লাসমেটকে বিয়ে করেছে শোনার পর থেকে সে জুঁইকে অনেকটা ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। একপ্রকার সব দিক দিয়ে অর্নি জিতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনি জুঁই ফিরে আসলো।আরাফের সাথে দেখা করলো। দু’জনের মাঝে কি কথা হয়েছে অর্নি জানে না। কিন্তু জুঁইয়ের কোন কথায় আরাফ ঘৃণার পাহাড় ঠেলে আবার জুঁইকে ভালোবাসতে শুরু করলো সেটা এখনো অর্নি বুঝতে পারছে না।

জুঁইয়ের ফিরে আসাটা কখনো কাকতালীয় হতে পারে না। অর্নি তার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। কিন্তু কোনো কিছু এখনো খোলাসা করতে পারছে না সে।তাই আরাফকেও প্রেসার দিতে চাই না সে।আরাফের অবস্থা বুঝে এখন সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিছুদিন সব সহ্য করুক।আরাফের কাছাকাছি থাকুক।আরাফের কথামতো তাই সব করছে সে। তার ভাবনা যদি সত্যি জুঁই এই ছয় বছরে কোনো বিপদে পড়ে আরাফ থেকে দূরে সরে গিয়ে থাকে থাকে তাহলে ডিভোর্সটা চূড়ান্ত হবে আর অর্নি তাদের দুজনের জীবন থেকে সরে যাবে।আর যদি জুঁই আরাফকে কোথাও ফাঁসাতে চায় তখন অর্নি আরাফের হয়ে সবকিছু করবে।

হাসপাতালে দাঁড়িয়ে জীবনের প্রায় অনেকটা অংশ ভাবছে সে।রোজ বিষয়গুলো ভেবে নিজের মনকে সান্তনা দেয় সে। অথচ সে চাইলে অনেক কিছু করতে পারতো। একজন সিআইডি অফিসার হ‌ওয়ায় তার হাতে যথেষ্ট পাওয়ার আছে।আরাফের অপমানের জবাব দেওয়া তার জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তাকে বুঝতে হবে আরাফ কি পরিস্থিতির স্বীকার নাকি অন্য কিছু। ভালোবাসার মানুষটাকে এতটুকু না বুঝলে, এতটুকু সেক্রিফাইস না করলে তা আর কেমন ভালোবাসা হলো। প্রকৃত ভালোবাসার প্রথম শর্ত একে অপরকে বোঝা। মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতির স্বীকার হতে পারে।ভালোবাসলে মনে সাহস নিয়ে সব কিছু সমাধান করা যায়। সন্দেহ করে বা না বুঝে ছেড়ে দেওয়া বা ছেড়ে যাওয়া কখনো ভালোবাসা হতে পারে না। তাইতো হাজারো মানুষ পরিস্থিতি বুঝে দূর থেকে ভালোবেসে যায়। কিন্তু অর্নি আরাফের কাছে চলে আসায় না হয় কিছুদিন সহ্য করলো সব।

একটু ভেবে অর্নি তার একজন সহকর্মীকে ফোন দিলো।সে সিআইডির সদস্য রুমানা।কয়েক রিং পড়ার পর সে রিসিভ করলো।অর্নি হেসে বললো:হাই রুমানা। কেমন আছো?
_জি ম্যাম ভালো। আপনি কেমন আছেন?
_ভালো।একটা কাজ করতে হবে। দ্রুত একটা তথ্য দাও আমাকে।
_জি ম্যাম সিউর।
_আমি একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি।ওটার লোকেশন ট্র্যাক করে আমাকে দাও।
_ওকে ম্যাম
অর্নি ফোন কেটে সিদ্ধান্ত নিলো রুমানা লোকেশন দিলে সে সেখানে যাবে। তাকে দেখতে হবে কি হচ্ছে এসব।

চলবে…