#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ১৪
[কপি করা নিষিদ্ধ]
রকি কথাটা শুনে দ্রুত সামনে তাকালো। চোখ দুটো খুলে দেখার চেষ্টা করলো সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে তার চোখগুলো বড় হয়ে গেলো। বেশ চমকে গিয়ে বললো:অর্নি তুমি?
_হ্যাঁ আমি। অবাক হচ্ছেন?
_এতো সকাল সকাল হঠাৎ এখানে আসছো কেনো?
_এমনেও আসতে তো হতো।সকাল সকাল আসলাম আরকি। আপনাদের ডিস্টার্ব হলো বুঝি?
_আরে না। তুমি তো আরাফের বাসায় যেকোনো সময় আসতে পারো। আমার এতে কি ডিস্টার্ব হবে।
_তাহলে ভেতরে নিয়ে চলুন।
_আরে ভেতরে যাবে কেনো?দেখা তো হলো। তুমি একজন ব্যস্ত মানুষ। অফিসে কতো কাজ আছে তোমার। এখন চলে যেতে পারো।
_আমার কাজ আমি বুঝে নেবো।কখন কি করতে হবে সেটাও আমি ঠিক করবো। এখন আপাতত আপনি আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিন।
অর্নির কথায় রকি একটু অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে বললো: আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেনো? আমি তোমার সিনিয়র। তোমার হাসবেন্ডের বড় ভাই। সম্মান দিয়ে কথা বলো।
_আপনাকে এতোদিন ধরে সম্মান দিয়ে আসছি সেটা ভাবতেই তো আমার কষ্ট লাগছে।এখনো সম্মান দিয়ে কথা বলবো? বাহ্।
কথাটা বলে অর্নি আর রুমানা রকিকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।রকি তাদের থামিয়ে দিয়ে বললো:তার মানে তুমি সব জেনে গেছো?
_হুম। এখন লুকানোর কিছুই নেই। আপনার আর জুঁইয়ের সব প্ল্যান এখন আমার হাতে।
অর্নির কথাটা শেষ হওয়ার আগে হঠাৎ করে রকি বাড়ির মেইন দরজাটা বন্ধ করে দিলো। অনেকটা জোরে জোরে হাসছে সে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে অর্নির সামনে এসে বললো: আমাকে তোমার এতো বোকা মনে হয়? তোমাকে আর তোমার এই সহকর্মীকে এক কবরে পুঁতে দিতে আমার এক মিনিটের বেশি লাগবে না। তারপর কেউ কিছুই জানতে পারবে না।
অর্নি রকির কথায় বেশ চমকে গেলো। একজন মানুষ কতোটা জঘন্য হলে এমন কথা বলতে পারে।তাও তাকে কথাগুলো রকি বলছে।আরাফ রকির এমন কি ক্ষতি করেছে যার জন্য সে মানুষ খুন করতেও প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে? অর্নি রকির দিকে তাকিয়ে বললো: এসব কেনো করছেন?আরাফ আপনার কি করেছে?
অর্নির মুখে আরাফ নামটা শুনে রকি বেশ রেগে গেলো।তার সামনে মেঝেতে থাকা ফুলদানিটা সে লাথি মেরে ভেঙে ফেললো। বেশ চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো:এই আরাফ নামটা আমার সামনে উচ্চারণ করলেও আমার ঘৃণা হয়। আমি ওকে কিছুতেই ছাড়বো না।খুন করবো ওকে আমি।তিলে তিলে শেষ করবো।
অর্নি বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে কথাগুলো।আরাফের সাথে তো রকির বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এমন কি হলো দুজনের মাঝে? বুঝতে পারছে না অর্নি। এদিকে রকির চিৎকার শুনে জুঁইয়ের ঘুম ভাঙলো।সে দ্রুত ছুটে আসলো রকির কাছে। এসেই বললো:কি হয়েছে রকি?
জুঁইয়ের গলা শুনে অর্নি একবার সেদিকে তাকালো। জুঁইকে দেখে অর্নির রাগ হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে চুলের মুঠি ধরে কয়েকটা দিতে। তবেই তার মনটা শান্ত হবে। শুধু এই মেয়ের জন্য তার জীবনটা নরক হয়ে যাচ্ছে।তার চেয়েও বড়ো কথা কতোটা স্বার্থপর এই মেয়ে! নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে, নিজের গোছানো সংসারটা ছেড়ে সে প্রেম করছে অন্য ছেলের সাথে। আবার আরাফ-অর্নির সংসারে ভাঙন সৃষ্টি করতে চাইছে। এমন মেয়েকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য শাস্তিটা দিলেও যেনো কম হয়ে যাবে।
জুঁই রকির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অর্নির দিকে তাকালো একবার। অর্নিকে বেশ ভালোভাবে একবার পর্যবেক্ষণ করলো সে। তারপর বললো:এই মেয়েটাকে যেন কোথায় দেখেছি।
জুঁইয়ের কথায় রকি বললো:আরে তোমার সতিন আই মিন আরাফের বউ।
এই বলে দুজনেই সমস্বরে হেসে উঠলো। তাদের আচরণ দেখে অর্নির ইচ্ছে করছে কষিয়ে দুটো চড় দিতে। কিন্তু তার আগে অর্নি এসবের কারণ জানতে চায়। শান্ত কন্ঠে রকিকে বললো: এগুলো কেনো করছো?কি লাভ পাবে এসব করে?অপরাধ করে কখনো সুখী হওয়া যায় না।
রকি এবারো অর্নির কথায় রেগে গেলো। চিল্লিয়ে বললো: একদম জ্ঞান দিতে আসবে না। তোমার জ্ঞান তোমার কাছে রাখো।আরাফকে আমি শেষ করবোই করবো।তার আগে আমি থামবো না।
_আরাফ তোমার কি ক্ষতি করেছে?
_আরাফ আমার কি ক্ষতি করেছে?আরাফ আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে।ওর জন্য আমি কিছুই পাচ্ছি না।
_মানে?
_মানে খুব সিম্পল।আরাফের দাদা সকল সম্পত্তি তার নামে লিখে দিয়েছে। কোম্পানির চেয়ারম্যান পদটাও তাকে দিয়েছে।আর আমাকে তার কামলা করে রেখেছে সারাজীবনের জন্য।এটা আমি কিভাবে মেনে নিবো?
কথাটা শুনে অর্নি রেগে গিয়ে বললো:কেনো? মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? মানুষের বাড়িতে কাজ করে এমন মহিলার ছেলে হয়ে এতো বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারছো তাতে তো তোমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত।আরাফ এই বাড়ির ছেলে তাই সে সব সম্পত্তি পেয়েছে।এসব সম্পত্তিতে তো তোমার অধিকার নেই।
অর্নির কথায় রকি আরো রেগে গেলো। জুঁই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে অর্নির দিকে। অর্নি এসব কি বললো সে বুঝতে পারছে না।তাই জুঁই অর্নিকে প্রশ্ন করলো:কি বলছো এসব? মানুষের বাড়িতে কাজ করতো মানে?
_ঠিক বলেছি।রকির মা আরাফদের বাসায় কাজ করতো।রকি ছোট থাকতেই তার মা মারা যায়। তখন থেকে আরাফের বড়ো আম্মু রকিকে নিজের ছেলের মতো করে লালন-পালন করে।রকি সেই বাড়ির ছেলের মতো করে মানুষ হয়।আরাফকে যেভাবে মানুষ করেছে তাকেও সেইম ভাবে মানুষ করেছে। কিন্তু সম্পত্তি তো ঘরের ছেলে পাবে।তাই সব সম্পত্তি আরাফ পেয়েছে।তাতে ভুল কোথায় হলো?
জুঁই অর্নির কথা শুনে চমকে গেলো। রেগে গিয়ে রকিকে বললো:এই ছোটলোকের বাচ্চা, কখনো তো আমাকে এসব বলিস নি। সবসময় বলেছিস তুই ওই বাড়ির ছেলে।আরাফের চাচাতো ভাই। তোকে তারা অবহেলা করে সম্পত্তি দেয়নি। কিন্তু তুই তো বলিস নাই যে তুই ওই বাড়ির কেউ নয়।
অর্নি জুঁইয়ের কথাগুলো শুনে তার দিকে তাকালো।এই মেয়ের আসলেই ট্যালেন্ট আছে। কিভাবে রকিকে কথাগুলো বললো সে।কতোটা স্বার্থপরের মতো সব কথা। যাক এসব অর্নি দেখে কি করবে? তাদের পার্সোনাল ব্যাপার তারাই সামলাক।
অর্নি রকিকে বললো:যা যা করেছো সব বাদ দাও এখন।আরাফের দাদা যদি তোমার এসব কথা জানতে পারেন তাহলে তোমাকে শেষ করে ফেলবে। আমি কাউকে কিছুই বলবো না। এমনকি আরাফকেও না। তুমি তোমার মতো শুধরে যাও। একটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে।
অর্নির কথায় রকি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। তারপর বললো: তুমি এসব বলার জন্য তো তোমাকে এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে। কিন্তু আমি তো তোমাকে এই বাড়ির বাইরে যেতেই দিবো না। তাহলে মানুষ জানবে কি করে?
রকির কথায় অর্নি তার দিকে তাকালো।তার কথায় মানে কি?সে কি অর্নির ক্ষতি করবে বলছে? রুমানা তখন থেকে চুপচাপ সব শুনছে।কোনো কথা বলছে না সে।তার অবশ্য বলার মতো কিছু নেই।সে তো এসবের মাঝে নেই শুধু অর্নির সাথে এসেছে। তাহলে সে কি বলবে?তাই চুপচাপ থাকা ভালো।
অর্নি হেসে রকিকে বললো:আমি কে তুমি তো জানো। তোমার মতো এতো ছোট্ট একটা প্রাণী আমাকে হুমকি দিবে আর আমি ভয় পেয়ে যাবো।ভাবলে কি করে এমনটা?
রকি এবার হো হো করে হাসলো। মুচকি হাসি দিয়ে বললো: তোমাকে কি করে খুন করতে হয় তা আমার খুব ভালো করে জানা আছে।
_তাই নাকি?
_আরাফের মতো স্ট্রং একজন ছেলেকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলাম আর তুমি বলছো তোমার মতো বোকা একজন মেয়েকে খুন করা কোনো ব্যাপার না?
অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো রকির কথায়। তখনি কেউ এসে বেল চাপলো। সাথে সাথে জুঁই গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অর্নি উঁকি দিয়ে দেখলো কে এসেছে সেটা। অর্নি তো অবাক!আরাফ এসেছে। কিন্তু হঠাৎ সে এখানে আসলো কেনো? তার এখানে কাজ কি?অর্নি একটা বিষয় লক্ষ্য করলো।আরাফ আসার সময় জুঁই দরজা খুললেও সে জুঁইয়ের সাথে কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ ভেতরে ঢুকে গেছে।এরপরও জুঁইয়ের সাথে কোনো কথা বলে নাই।বিষয়টা দেখে অর্নি মনে মনে হাসলো।যাক একটা বিষয় তো নিশ্চিত হলো।আরাফ আর জুঁইয়ের মাঝে কিছুই নেই।
আরাফ ভেতরে এসে অর্নিকে দেখে বেশ চমকে গেলো।অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো সে। ভ্রু কুঁচকে অর্নিকে উদ্দেশ্য করে বললো: তুই এখানে কি করছিস? এখানে এসেছিস কেনো?
রকি পেছন থেকে হেসে উঠে বললো:তোর সাথে একসাথে মরতে এসেছে।
জুঁই রকির সাথে তাল মিলিয়ে বললো:অর্নি তোমাকে খুব ভালোবাসে আরাফ।তাই বাঁচলে একসাথে বাঁচবো আর মরলে একসাথে মরবো এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে এখানে চলে এসেছে।
এই বলে দুজনেই একসাথে হাসলো।আরাফ রাগী দৃষ্টিতে অর্নির দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো সে কি করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ পাঁচ-ছয়জন ছেলে আসলো সেখানে। অর্নি তাদের দেখে একটু চমকালো।এরা কারা আবার?কেনো এসেছে এখানে?
অর্নি তাদের দিকে তাকিয়ে বললো:ওরা কারা?
অর্নির কথায় সবাই হাসলো। তারপর বললো: তোদের একসাথে মাটিতে পুঁতে দিতে এসেছি।
অর্নি এবার বুঝতে পারলো পরিস্থিতি ঠিক নেই। দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ হবে না।রুমানাকে ইশারা করলো সে। সাথে সাথে রুমানাও প্রস্তুত। সিআইডি অফিসার হওয়ায় মারামারিতে বেশ পটু সে। ছেলেগুলোর সাথে মারামারি শুরু হয়ে গেলো।আরাফ সাধারণ ছেলে।সে তো আর মারামারি পারে না। বেচারা একপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে পেলে কয়েকটা দিচ্ছে সে। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজে আসছে না।
কয়েক দফা মারামারি চললো।রকি আর জুঁই একপাশে ছিল। ছেলেগুলো মারামারি করলেও তারা সব তামাশা দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ রকি তার সাথে থাকা বন্দুকটা বের করে অর্নির দিকে তাক করলো।নিশানা ঠিক করে গুলি ছুড়ে দিলো।
বন্দুকের আওয়াজ পেয়ে অর্নি পেছনে তাকাতেই বেশ চমকে গেলো। চিৎকার করে “আরাফ” বলে ডাক দিলো।তার সামনে থেকে আরাফ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।রকি অর্নির দিকে গুলি ছুড়ছে দেখে আরাফ সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তখনি গুলিটা তার বুকে গিয়ে লাগে।আরাফের এমন অবস্থা দেখে অর্নি দৌড়ে আসে।
চলবে…