#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ১৭
[কপি করা নিষিদ্ধ]
অর্নির বেশ চিন্তা লাগছে।এতো সময় হয়ে গেলো তবু জ্ঞান ফিরছে না কেনো?আবার কোন সমস্যা হলো না তো? দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে অর্নিকে।
রুমানা আর অর্নি এফএ ভিলাতে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসলো। কিছুক্ষণ পর এফএ ভিলাতে পৌঁছালো দুজনে।ব্যাগটা ঠিক কোথায় রেখেছে অর্নির মনে নেই।এতো ঝামেলার মাঝে মনে রাখাটা একটু ডিফিকাল্ট বটে। দুজনেই পুরো রুমটা তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু ব্যাগটা পেলো না। অর্নির বেশ টেনশন হচ্ছে।তার ব্যাগটা গেলো কোথায়?ব্যাগে তো ইম্পরট্যান্ট ডকুমেন্ট আছে কিছু।উদাস মন নিয়ে এফএ ভিলা থেকে বের হলো অর্নি। রুমানা অর্নির পেছন পেছন আসছে।তারও টেনশন লাগছে। এক বিপদের উপর আরেক বিপদ।
এফএ ভিলাতে গণ্ডগোল হওয়ার পর থেকে পুলিশের একটা টিম পাহারা দিচ্ছে। তাহলে কেউ ভেতরে আসবে কি করে?তার ব্যাগটা তো তাহলে এখানেই থাকার কথা। অর্নি গেইটে গিয়ে পুলিশের ইন্সপেক্টর রাশেদুল ইসলামের সাথে কথা বললো:আপনারা ডিউটিতে থাকা অবস্থায় কেউ কি ভেতরে গিয়েছিল?
_না ম্যাম। কেউ যায়নি। এখন আপনারা গেলেন।
_আমার ব্যাগটা তখন রেখে গিয়েছিলাম ভুলে। এখন নিতে এসে দেখলাম ব্যাগটা নেই। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো। আমার ফোনটাও ব্যাগে আছে। ফোন ট্র্যাক করলে দ্রুত পেয়ে যাবেন।
_ওকে ম্যাম। আমরা চেষ্টা করছি।
_আচ্ছা পেলে আমাকে জানাবেন। আমি এখন আসি।
রুমানাসহ আবার দু’জনে বেরিয়ে গেলো এফএ ভিলা থেকে। গাড়িতে উঠে বসতেই রাশেদুল ইসলাম ডাক দিলেন ম্যাম বলে। অর্নি আবারো নেমে আসলো।
_জি বলুন কি হয়েছে?
_ম্যাম আপনার ব্যাগ থানায় আছে। একজন কনস্টেবল থানায় গিয়ে জমা দিয়েছে ব্যাগটা। এখন আমি ফোন দিয়ে জানতে চাওয়ায় তারা বললেন।
_ওকে থ্যাংকস।
যাক একটা সমস্যার সমাধান হলো অবশেষে। অর্নির মনে একটু সাহস এসেছে খবরটা শুনে।রুমানা এবার বললো:ম্যাম তাহলে একেবারে থানায় গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে আসুন। তখন একেবারে নিশ্চিত হয়ে যেতে পারবেন।আর কোনো টেনশন থাকবে না।
_হুম আমিও তাই ভাবছি।চলো তাহলে এখন থানায় যাওয়া যাক।
_ওকে ম্যাম চলুন।
দুজনেই আবারো গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভারকে বললো থানায় নিয়ে যেতে।গাড়ি চলছে দূর্বার গতিতে। হঠাৎ রুমানার ফোনটা বেজে উঠলো।সে ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর অর্নিকে বললো:ম্যাম,এই নম্বরটা আমি চিনতে পারছি না।আমার যদি ভুল না হয় আপনি এই নম্বরে ফোন দিয়ে কথা বলেছিলেন তখন। দেখুন তো।
অর্নি একবার ফোনের স্ক্রিনে নম্বরটা দেখলো। হুম এই নম্বরে সে ফোন করেছিল।আরাফের বাবার পার্সোনাল নম্বর। দ্রুত রুমানার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে অর্নি রিসিভ করলো।অপর পাশ থেকে অবনি কথা বলছে:অর্নি কি আছে আপনার সাথে?
এদিক থেকে অর্নি বললো:আপু আমি বলছি।বলো কি হয়েছে?
_অর্নি তুমি কোথায় আছো? একটু তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসো।
_কেনো?কি হয়েছে হাসপাতালে?
_আরাফের জ্ঞান ফিরেছে।ও তখন থেকেই ছটপট করছে। তোমাকে দেখতে চাইছে।ওর ধারণা তোমার কোনো সমস্যা হয়েছে আর আমরা সেটা ওকে জানাতে চাচ্ছি না।তাই এমন করছে। তুমি একটু আসো।
_আচ্ছা আমি এক্ষুনি আসছি।
অবনি ফোনটা কেটে দিলো।অর্নি ড্রাইভারকে বললো গাড়ি ঘুরিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।সে এখন হাসপাতালে যাবে। রাস্তায় জ্যাম না থাকায় খুব একটা দেরি হয়নি পৌঁছাতে। গাড়ি এসে পৌঁছালে অর্নি দ্রুত পায়ে আরাফের কেবিনে গেলো। তাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। বাইরে বাড়ির সবাই বসে আছে।সবাই আরাফের পাশে বসে হৈহুল্লোড় করলে আরাফের ডিস্টার্ব হবে। তাই ভেতরে শুধু আরাফের বড় আম্মু আছেন আর বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করছে।
অর্নি কেবিনে ঢুকতেই আরাফ তার দিকে তাকালো। তাকে দেখে বড় আম্মু বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। ডাক্তার বলেছেন যেকোনো একজন সাথে থাকতে। একাধিক মানুষ থাকলে স্পেস কম হবে। অর্নি আরাফের পাশে গিয়ে বসলো।আরাফ কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু এখনো স্পষ্ট গলায় কথা বলতে পারছে না সে। অস্পষ্ট কন্ঠে বললো: কোথায় ছিলি?
_একটু কাজে গিয়েছিলাম।
_কি দরকার ছিল রকি আর জুঁইয়ের পেছনে পড়ার? যদি কোনো সমস্যা হয়ে যেতো তখন কি হতো?
অর্নি আরাফের দিকে তাকালো।তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।তবু এতোগুলো কথা বলছে আজ।অথচ অন্যদিন এক কথায় জবাব দিতো সে। শান্ত কন্ঠে বললো: এখন এতো কথা বলতে হবে না আপনার। আগে সুস্থ হোন তারপর কথা বলবেন।
আরাফ রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তারপর বললো: কথা বলবো কি বলবো না এটা আমার ইচ্ছা।
অর্নি আরাফের কথায় চমকে গেলো।তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে বলেই তো অর্নি বারণ করলো কথা না বলার জন্য।এখন উল্টো তাকে কথা শোনাচ্ছে। আরাফের দিকে একবার তাকিয়ে বললো: বলেন, ইচ্ছামতো কথা বলেন। আমার বাপের কি?নিজেরই তো কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আমার কি হচ্ছে?
_তোকে আমার জন্য এতো ভাবতে হবে না। আমার কষ্টের কথা ভাবলে এতো কিছু করতি না।
_আমি আবার কি করলাম?
_কি করেছিস জানিস না? জুঁই আর রকির পেছনে কেনো পড়তে গেলি? একটুর জন্যই তো বেঁচে গেলি।
_হুহ।ওরা আমাকে কি করতে পারতো? আপনার জন্য সব হয়েছে। আমার মেজাজ গরম করবেন না একদম। এমনেই তো আধমরা হয়ে আছেন।এর উপর কয়েক ঘা বসিয়ে দিবো।
অর্নির কথায় আরাফ হেসে উঠলো।বলে কি এই মেয়ে?মাথা কি ঠিক আছে ?সে একবার রাগী দৃষ্টিতে তাকালে যেই মেয়ে চোখ তুলে তাকায় না তার মুখে এমন কথা শুনলে তো এমনিতেই হাসি পাবে।হাসি থামিয়ে বললো: একবার সুস্থ হই তারপর দেখবো তুই কি কি করতে পারিস।বাই দ্যা ওয়ে, জুঁই এখন কোথায়?
আরাফ হাসপাতালের বেডে শুয়ে জুঁইয়ের খবর নেওয়ায় অর্নির রাগ হলো বেশ।এতোকিছুর পরেও কি সে তার এক্সকে ভুলতে পারছে না? অর্নি রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো: আমার কাছ থেকে কেনো জুঁইয়ের খবর নিচ্ছেন?এতো শাস্তির পরেও এই মেয়েকে ভুলতে পারছেন না বুঝি?ভালো। আপনার সাথে ওকে মানায়। আমার মতো ভদ্র মেয়ে কখনো মানাবে না।আমি চলে যাবো একদম। তারপর আপনার জুঁইকে আপনার কাছে এনে দিবো।
আরাফ আবারো হাসলো। আজকে অর্নির বোকা বোকা কথাগুলো বেশ ভালো লাগছে তার। কোনো কথা না বুঝে না শুনে যে এই মেয়ে এতো বকবক করতে পারে!সে বলে কি আর অর্নি জবাব দেয় কি?আরাফ চুপ করে থাকলো।তাতেও অর্নির সমস্যা। ভ্রু কুঁচকে বললো: জুঁইয়ের এনে দিবো একথা শুনার সাথে সাথে আমার সাথে আবারো ভাব দেখানো শুরু করে দিলেন?আপনি তো মহা স্বার্থপর পুরুষ।
আরাফ এবার বললো: আমাকে কথা না বলতে বারণ করে এখন বলে আমি ভাব দেখাচ্ছি। আচ্ছা আমি কথা বললেও দোষ না বললেও দোষ হলে আমি করবো কি? কোথায় অসুস্থ মানুষকে সেবা করবি তা না। আমাকে পুলিশের মতো জেরা করছে সে। আমিও তোর মতো হৃদয়হীন মহিলা দেখি নাই জীবনে।
_ওকে ফাইন।আপনি এখন চুপ থাকুন।আমিও কোনো কথা বলছি না।
আরাফ এবার দম নিলো। ডাক্তার বলেছে কথা না বলে চুপচাপ থাকতে।তার মধ্যে সে প্রতিযোগিতা দিয়ে কথা বলছে। সিনিয়র ডাক্তার তার স্যার হয়। এতো কথা বলছে দেখলেই আস্ত রাখবে না।তার মধ্যে নিজেরও কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে আওয়াজ খুলতে কোথাও যেন টান পড়ছে। ভেবেছিল ইম্পরট্যান্ট কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু অর্নি পুরো বিষয়টাকে এমন ভাবে টেনে টেনে লম্বা করছে যে আপাতত তার চুপ থাকাটায় শ্রেয়।সে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমানোর চেষ্টা করছে সে। মেডিকেল লাইফে না ঘুমাতে ঘুমাতে এখন প্রয়োজন হলেও ঘুমাতে পারে না।অর্নিও তার পাশে চুপচাপ বসে আছে।
আরাফের ঘুম এসেছিল।প্রায় কিছুক্ষণ পর কতোক্ষণ তা জানা নেই দুজনের।আরাফের ঘুম ভাঙতেই সে মাথা উঠিয়ে দেখার চেষ্টা করলো।দেখলো অর্নি তার সিটের পাশের চেয়ারে বসে তার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। বেচারি কখন বিছানায় শুয়ে একটু আরাম করে ঘুমিয়েছে জানা নেই।ক্লান্ত ছিল তাই মাথা রাখতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।আরাফ অর্নির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলো। মানুষকে জাগ্রত অবস্থার চেয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ভালোভাবে দেখা যায়।তার মধ্যে চোখ বন্ধ থাকলে মানুষের মুখে একটা এক্সট্রা সৌন্দর্যের ছাপ ফুটে উঠে।তাই ঘুমন্ত অবস্থায় প্রত্যেক মানুষকে একটু অন্যরকম লাগে।আরাফ মনোযোগ দিয়ে দেখছে অর্নিকে।কতোটা নিষ্পাপ লাগছে তাকে।এমনেও সে বেশ ভালো একজন মেয়ে।সেটা আরাফের অজানা নয়। কিন্তু আজ অর্নিকে অন্যরকম লাগছে।আরাফ বারবার অর্নিকে দেখছে কিন্তু ঘুম থেকে ডাকছে না। ভালোই লাগছে তার।কখনো তাদের এতো কাছে আসা হয়নি।আজ প্রথম এভাবে আরাফ অর্নিকে দেখছে।তাও এতো কাছ থেকে।
হঠাৎ বাইরে থেকে তাদের কেবিনে কেউ প্রবেশ করলো।আরাফ মাথাটা একটু তুলে সেদিকে উঁকি দিলো।তার এক বান্ধবী এসেছে। সে এখানকার ডাক্তার।ডাক্তার রিশা।হয়তো তাকে চেকআপ করতে এসেছে।এসেই সে চমকে গেলো। সাথে থাকা নার্সকে বললো: কোথায় ছিলে তোমরা? এভাবে প্যাশেন্টের গায়ের উপর কেউ মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে?ডেকে দাওনি কেনো ওকে?
_সরি ম্যাম। খেয়াল করিনি।
_এক্ষুনি ডেকে দাও।
নার্স সাথে সাথে অর্নিকে ঘুম থেকে ডাকতে আসলো। কিন্তু আরাফ থামিয়ে দিলো।”এই যে থামো, ওকে ঘুম থেকে ডাকবে না। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”
আরাফের গলার আওয়াজ শুনে রিশা আরাফের দিকে তাকালো। হেসে বললো:আরাফ ঠিক আছিস?
_হুম অনেকটাই।
_মেয়েটাকে ডেকে দিই।তোর কষ্ট হবে তো।
_না।এতে কষ্টের কি?তোর চেকআপ করা দরকার তুই চেকআপ করে চলে যা।
রিশা এবার কিছু না বলে আরাফকে একটা ইনজেকশন দিয়ে চলে গেলো।অর্নি এখনো ঘুমে বিভোর। এতো কথা হলো এদের মাঝে কিন্তু অর্নির কানে পৌছালো না কিছু।তাকে দেখেই আরাফ বুঝতে পারছে কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে।তাই শুধু শুধু ডেকে দেওয়ার কি দরকার?তার তো অর্নিকে পাশে পেয়ে ভালোই লাগছে।
চলবে….