#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ১৮
[কপি করা নিষিদ্ধ]
তাকে দেখেই আরাফ বুঝতে পারছে কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে।তাই শুধু শুধু ডেকে দেওয়ার কি দরকার?তার তো অর্নিকে পাশে পেয়ে ভালোই লাগছে।
বেশ কিছুদিন পর অর্নির ঘুম ভাঙলো। নিজের মাথাটা আরাফের কাঁধের উপর আবিষ্কার করে সে দ্রুত মাথা তুলে নিলো।একপাশ করে ঘুমানোর কারণে ঘাড়ের রগটা একদম ব্যথা হয়ে গেছে। অর্নি মাথা তোলার সাথে সাথে আরাফ চোখ খুলে তার দিকে তাকালো।তার মানে আরাফ জেগে আছে? তাহলে তাকে ডেকে দিলো না কেনো?ভেবে উত্তর পায় না অর্নি।আরাফ এখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্নি তা দেখে বললো: কোনো সমস্যা?শরীর খারাপ লাগছে?
_না
_তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?
_শরীর ভালো লাগছে বলেই তো তাকিয়ে আছি।খারাপ লাগলে কি আর তোর দিকে তাকানোর কথা মনে থাকতো?
_হুম তাও ঠিক।
আরাফের কথায় মুখটা ভার হয়ে গেলো।কি সুন্দর করে বললো খারাপ লাগলে তার কথা মনে থাকতো না। ভালোবাসা থাকলে সবসময় তো প্রিয় মানুষটার কথা মনে পড়ে। অর্নি শান্ত কন্ঠে বললো: জুঁইয়ের কথা হলে কি মনে পড়তো না?
আরাফ এবার অর্নির দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো: এখানে জুঁই আসলো কোথা থেকে?
_আমি এনেছি বলেই এসেছে।
আরাফ আর কিছু বললো না।এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না।তাই সে কম কথা বলে বাঁচতে চায়। আরাফের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অর্নি চুপচাপ বসে আছে। একটু পর আরাফ বললো: তখন থেকে কিছু খেয়েছিস বলে তো মনে হয় না।আমি এখানে ঠিক আছি। অথবা বাইরে থেকে কাউকে পাঠিয়ে দে। তারপর তুই বাইরে গিয়ে খেয়ে আয়।
অর্নির ক্ষিধা লেগেছিল কিন্তু আগে। এখন কেমন জানি ক্ষিধা কোথায় চলে গেছে।তাই আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।তাই সে জবাব দিলো:খেতে ইচ্ছে করছে না।
_এক্ষুনি বাইরে গিয়ে খেয়ে আসবি। আমাকে দেখাশোনা করছে নাকি সে, উল্টো তার সব খবর আমাকেই রাখতে হচ্ছে।
_আপনাকে কে বলেছে আমার খবর নিতে?
_আমার বউয়ের খবর নিতে আমাকে মানুষের কেন বলতে হবে?
আরাফের মুখে বউ শব্দটা শুনে অর্নির বুকটা কেঁপে উঠলো।পুরো শরীর জুড়ে এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে একটু লজ্জা লাগছে।প্রকৃত ভালোবাসা তো একেই বলে।প্রেমিক পুরুষের একটা কথা প্রেমিকার মনটা উত্তাল করতে পারলে, প্রেমিকার মাঝে অজানা একটা শিহরণ ছড়িয়ে দিতে পারলে তো প্রশান্তি। অর্নি কিছু না বলে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।আরাফ সেদিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিলো।
অর্নি আরাফের কেবিন থেকে বাইরে এসে দেখলো সবাই চেয়ারে বসে আছে।অর্নিকে দেখে তার মা বললো: তখন থেকে এক গ্লাস পানিও তো মুখে দিলি না। কিছু খেয়ে নে এবার।আরাফকে তো তার বন্ধুরা দেখাশোনা করছে।
অর্নি মায়ের কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। খাবার বাড়ি থেকে আনা আছে। কিন্তু তার এক সমস্যা।সে হাসপাতালে বসে খাবার খেতে পারে না। কেমন জানি বমি পায় তার। কিন্তু আজ তো না খেয়ে উপায় নেই।শরীরটা ভালো লাগছে না আর। আপাতত বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে আসবে এমন অবস্থায় নাই সে। শরীর-মন ভালো থাকলে এসব ইচ্ছা করে। এখন তো শরীর সায় দিলেও মন সায় দিচ্ছে না।মাকে বললো: আম্মু, হাসপাতালে খেতে ইচ্ছে করে না।ভাবছি খাবো না।
_এটা কোনো কথা? হাসপাতালের নিচে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানে গিয়ে কিছু খেয়ে আয়।
অর্নির মায়ের কথার সাথে তাল মিলিয়ে আরাফের বাবাও বললো নিচের রেস্টুরেন্টটায় যেতে। তাদের কথা শুনে সে ভাবলো,নিচে যখন রেস্টুরেন্ট আছে তাহলে যেতে কোনো অসুবিধা নেই।এমনেও শরীরটা দূর্বল হয়ে যাওয়ায় কিছু খেতে হবে। কিন্তু তার কাছে ব্যাগ না থাকায় মায়ের থেকে টাকা নিতে হবে। মাকে ফিসফিসিয়ে বললো: কিছু টাকা দাও। আমার ব্যাগটা এখনো পায়নি।তাই টাকা নেই।
_অবনির কাছে আছে তোর ব্যাগ।
এই বলে তিনি তার ব্যাগ থেকে কিছু টাকা দিলেন অর্নিকে। অর্নি ভ্রু কুঁচকে বললো:আমার ব্যাগ অবনি কি করে পেলো?
_রুমানা থানায় গিয়ে ব্যাগটা এনেছিল। আবার এখানে এসে আমাকে দেয়।আমি অবনিকে রাখতে দিয়েছি।
_ওহ্ আচ্ছা।রুমানা তাহলে একটা কাজের কাজ করেছে।বেশ ভালো মেয়ে সে।দেখলে কতো দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে।
অর্নির কথায় তার মা হাসলো। আসলেই মেয়েটা বেশ ভালো । অর্নি তার পার্সোনাল সব কাজ রুমানাকে দিয়ে করায়।তাই তার মা রুমানাকে ভালো করে চিনে।
অর্নি অবনির থেকে ব্যাগটা নিলো আর তার মায়ের টাকাগুলো তাকে আবার দিয়ে দিলো। নিজে যখন রোজগার করে তাহলে মায়ের কাছ থেকে কেনো টাকা নিবে?এখন তো মাকে উল্টো তার টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু তার মা নেয়নি। রাগী গলায় বললেন:বেয়াদবি করিস না।টাকা দিয়েছি সোজা নিয়ে নিবি।এটাই তো জানি।
মুখে কথাটা বললেও মেয়ের কাণ্ডে তিনি মনে মনে হাসলেন।
অর্নি হাসপাতালের নিচে এসে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে যাবে তখনি দেখলো পারভেজকে। পারভেজও তাকে দেখে এগিয়ে আসলো। হেসে বললো:হাই ম্যাম।কি কাজে আসলেন?
পারভেজের কথায় অর্নি অবাক হলো। দুইদিন ধরে হাসপাতালের সবাই আরাফকে নিয়ে বেশ ব্যস্ত আছে। তাহলে পারভেজের তো সব জানার কথা।সে কেনো এমন প্রশ্ন করছে?সে কি আরাফের এমন অবস্থায় মজা নিতে চাইছে? অর্নি কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালো। তারপর প্রশ্ন করলো: আপনি নিশ্চয় জানেন?
অর্নির প্রশ্নে পারভেজ কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। নিজেকে ঠিক করে বললো:আসলে আমি জানি। তবু আপনার কাছ থেকে শুনতে চাইছিলাম।হুট করে তো কথা বলা যায় না।ফর্মালিটি মেইনটেইন করছিলাম। আমাকে ভুল বুঝবেন না।
অর্নি কিছু বললো না। সোজা রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে বসলো।পারভেজও তার পেছন পেছন গিয়ে বসলো। অর্নি পারভেজকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার দিকে।
_আসলে আমিও নাস্তা করতে আসছিলাম। আপনাকে পাওয়ায় ভালো হলো। একসাথে গল্প করতে করতে সময়টা ভালোভাবে কাটাতে পারবো।
_আপনাকে কে বললো আমি আপনার সাথে গল্প করতে চাই?আমি একা একা এসেছি আর একা একা খেয়ে চলে যাবো। আমার এখন সময়টা ভালোভাবে কাটানোর কোনো আগ্রহ নেই।আমি খারাপভাবে কাটাতে চাই। আপনি অন্য জায়গায় গিয়ে বসুন।
পারভেজ অর্নির কথায় একটু হাসলো। তারপর বললো: আপনি কি কোনো কারণে রেগে আছেন আমার উপর? আমাকে বলতে পারেন তাহলে।
_আপনার উপর কেনো আমি রেগে থাকবো? আমি আমার কাছের মানুষদের উপর রেগে যায় শুধু।
_আরাফের উপরও রেগে যান বুঝি?ওর সাথে তো সহজে রেগে যাওয়া যায় না। যতটুকু দেখলাম।
_এসব পার্সোনাল মেটার। আপনাকে বলতে চাই না।
পারভেজের বকবকানির মাঝে খাবার অর্ডার দিয়েছে। কিন্তু এখনো খাবার আসেনি।তাই চুপচাপ পারভেজের কথাগুলো শুনছে সে। আজকে কেনো জানি পারভেজকে রাগ লাগছে। মনে হচ্ছে পারভেজ আরাফকে হিংসা করছে।আরাফের অসুস্থতাও তার কাছে মজা মনে হচ্ছে। তাহলে অর্নি কেনো তার সাথে ভালো ভালো কথা বলবে? কিসে পেয়েছে তাকে এতো আহ্লাদ দেখানোর? পারভেজ দমে যাচ্ছে না কিছুতেই। তাতে অর্নির কি? খাবার আসতেই সে চুপচাপ খাচ্ছে।
পারভেজ কথা বলতে বলতে জুঁইয়ের প্রসঙ্গ তুললো।শান্ত কন্ঠে বললো:ম্যাম জুঁই এখন কোথায়?
_জেলে আছে আপাতত। হাইকোর্টের রায় যা হবে সেই অনুযায়ী শাস্তি হবে।আমি আর এসবে নেই।আমার দায়িত্ব শেষ।
পারভেজ হাসলো। তারপর বললো: আপনার সাথে তখনও কথা বলতে চেয়েছিলাম। জানি আপনি টেনশনে আছেন আরাফকে নিয়ে।তাই আর বলিনি।
_হুম বলুন।
_আপনি অনেক মহৎ একটা কাজ করেছেন। হয়তো নিজের জন্য।তবু তো অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারলেন।আমি তো কিছুই করতে পারিনি তখন। আমার চোখের সামনে অন্য ছেলের সাথে পরকীয়া করেছে।চুপচাপ তার কাণ্ড দেখতে হয়েছে। কিছুই বলতে পারিনি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
_আমি আমার কাজ করেছি।এতে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছুই নেই।
_যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি।
_হুম বলুন।
_আরাফের সাথে আমার মেডিকেল লাইফের শুরু থেকে খারাপ সম্পর্ক ছিল।সেও আমাকে পছন্দ করতো না। আমিও তাকে পছন্দ করতাম না।তার মধ্যে আমি তার লাইফের একটা জঘন্য অংশের সাথে জুড়ে আছি।বলা চলে তার লাইফটা শেষ করতে আমার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল। আপনি যদি তার লাইফে না থাকতেন এতোদিনে জুঁই আর রকি আরাফের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলতো। কিন্তু দেখুন, প্রকৃতির কি প্রতিশোধ। আমি আমার শাস্তি পেয়েছি। আজীবন আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।কারণ আমি জুঁইকে ভুলতে পারবো না। প্রথম ভালোবাসা কি ভোলা যায়?
_এসব আমি জানি। এখন কি বলতে চান বলুন।
_আমি আরাফের সাথে কথা বলতে চাই।তার কাছ থেকে ক্ষমা না চাইলে আমি হয়তো আজীবন এভাবে অপরাধী হয়ে থাকবো। প্লিজ ম্যাম একবার আরাফকে দেখা করার সুযোগ করে দিন। আমি চাইলে ওর সাথে দেখা করতে পারি। কিন্তু ও আমার এতো কথা শুনবে না।
অর্নি হাসলো পারভেজের কথায়।ছেলেটাকে আসলে খারাপ মনে হলেও খারাপ নয় এতোটা। হয়তো অর্নি বুঝতে পারছে না। শান্ত কন্ঠে বললো:আরাফ সুস্থ হোক। তারপর কোনো একদিন দেখা যাক।
_ধন্যবাদ ম্যাম।
পারভেজ কথাগুলো বলতে বলতে অর্নির খাওয়া শেষ হয়েছে।সে ওঠে দাঁড়ালো।
_আপনার তো এখনো খাওয়া হয়নি।আমি এখন আসি।
এই বলে সে রিসিপশনে গেলো পেই করতে। কিন্তু তারা বললো ম্যাম খাবার অর্ডার করেছে তখন বিল পেই করা হয়েছে। পারভেজ খাবার অর্ডার করেছিল।তার মানে বিলটা সে দিয়ে দিলো? অর্নি আবার পারভেজের কাছে গেলো। ভ্রু কুঁচকে বললো:বিল আপনি দিয়ে দিলেন কেনো?
_আপনি আমার এতো বড় উপকার করলেন আর আমি সামান্য বিল দিতে পারবো না?
_কি উপকার করলাম আমি?
_অনেক বড়ো উপকার করেছেন। আচ্ছা ভাই হিসেবে দিলাম। ডোন্ট মাইন্ড। আপনি পরে কখনো শোধ করে দিবেন।
অর্নি আর কিছুই বললো না। রেস্টুরেন্টের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা অর্নির ভালো না লাগায় সে আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো সে। হাসপাতালে গিয়ে আবারো আরাফের কেবিনে গেলো।অবনি আছে আরাফের সাথে। একজন নার্স সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য আছে সাথে। অর্নিকে দেখে অবনি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।আরাফ চোখ তুলে অর্নির দিকে তাকালো।সে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। অবনি বের হতেই অর্নি আরাফের সিটের পাশে থাকা চেয়ারে গিয়ে বসলো।আরাফ এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।অর্নি তার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো আরাফের দৃষ্টি একটু অন্যরকম।সে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। তবু শান্ত কন্ঠে বললো: কোথায় গিয়েছিলি?
_আপনি তো বললেন খেয়ে আসতে।তাই খেতে গিয়েছিলাম।
_আমি খেয়ে আসতে বলেছিলাম।অন্য ছেলের সাথে আড্ডা দিতে যেতে বলেছি?
আরাফের কথায় অর্নি বেশ অবাক হলো।সে জানলো কি করে?সে তো তখন থেকে শুয়ে আছে। তাহলে কিভাবে কি?অর্নির মাথায় আসছে না।
চলবে…