অপেক্ষার বসন্ত পর্ব-২০

0
283

#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ২০

[কপি করা নিষিদ্ধ]

এই বলে আরাফের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে অর্নি বেরিয়ে গেলো।আরাফ অবাক চোখে অর্নির যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।

অর্নি আরাফের কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে অবনিকে বললো: আমি আমাদের বাড়ি যাচ্ছি। তোমরা এখানে থাকো।
_হঠাৎ বাড়ি যাচ্ছো কেনো?
_ভালো লাগছে না তাই।
_শরীর খারাপ লাগছে?
_না,এমনটা নয়।
_তাহলে?

অর্নি কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ চলে আসলো।অবনি অর্নির দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার অনুমান করছে। হঠাৎ এমন কি হলো যার জন্য অর্নি এভাবে চলে গেলো? তার ভাই কি আবার কিছু করলো নাকি?এসব আর নিতে পারছে না অবনি।আর তার ভাইটাও এমন এমন কিছু কাজ করে যার জন্য অর্নির বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।সে এসব ভেবে আরাফের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো।আরাফ থেকে জিজ্ঞেস করতে হবে কি হয়েছে। কেবিনে গিয়ে শান্ত কন্ঠে আরাফকে প্রশ্ন করলো:এই, তোদের মাঝে আবার কি হয়েছে?
অবনির কথায় আরাফ চোখ তুলে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো:কেনো? তুই জেনে কি করবি?
_অর্নি তো হাসপাতাল থেকে চলে গেলো। যাওয়ার সময় বললো তোকে খেয়াল রাখতে।

অবনির কথায় আরাফ উঠে বসলো। অবাক চোখে বললো:চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে সে?
_বললো ওদের বাসায় যাবে‌।
_তুই যেতে দিলি কেনো? এখন চলে যাওয়ার পর আমাকে বলতে আসছিস অর্নি চলে গেছে সেটা?
_এখন সব দোষ আমার।নিজে তো ওরে ঠিকমতো আগলে রাখতে পারিস না।তাই তো ওর চলে যেতে হলো। এখন সব আমার দোষ?
_তোর ফোন থেকে একটা কল দে।কথা বলবো ওর সাথে।
অবনি কিছু না বলে ফোনটা আরাফের হাতে দিলো।আরাফ অর্নির নম্বরে ডায়াল করতেই ফোনটা কেটে দিলো। অবনি বললো: হয়তো নেটওয়ার্কের প্রবলেম। আবারো ফোন দিয়ে দেখ।
আরাফ আবারো ফোন দিলো। কিন্তু এবার ফোনটা বন্ধ পেলো।আরাফ আর অবনি দুজন দুজনের দিকে তাকালো।অবনি চেহারা কাঁচুমাচু করে বললো:এই,অর্নির ফোনটা বন্ধ বলছে কেনো?
_সেটাই তো ভাবছি।
_কোনো বিপদে পড়ে নি তো আবার?
আরাফ কোনো জবাব দিলো না তবে অবনির দিকে একবার তাকালো। দুজনেই চুপচাপ ভাবছে কি করা যায়। কিন্তু মাথায় টেনশন থাকলে মাথাও কাজ করে না। একটু পর আরাফ বললো: শোন, অর্নি তোকে বলেছে ওদের বাসায় যাবে।আর এখান থেকে ওদের বাসায় যেতে যেতে আধ ঘন্টার চেয়ে বেশি লাগবে। আমরা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর খালামনিকে ফোন দিয়ে দেখবো অর্নি পৌঁছেছে কিনা।
_হুম গুড আইডিয়া।

দুজনেই কথাটা বললো ঠিক কিন্তু মনে মনে একটা অজানা ভয় কাজ করছে। অর্নির ফোনে কল যাবে না এটা ন্যাচারালি হয় না।সে খুব সচেতন একজন মেয়ে। কিন্তু আজ এমন কি হলো যার জন্য তার ফোন বন্ধ বলছে।আরাফ আর অবনি দুজনেই ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু একটু করে কাঁটা নড়ছে আর আরাফ সেকেন্ডগুলো গুনছে। এমন একটা অবস্থা তার মধ্যে। বেশ রাগ হচ্ছে নিজের উপর।কেনো যে মেয়েটার সাথে এমন করতে গেলো সে?আজ যদি বাড়াবাড়ি না করতো তাহলে এসব এক্সট্রা টেনশন আর এক্সট্রা ঝামেলায় তাকে পড়তে হতো না।অবনি একটু পর পর এক লাইন করে করে কথা শোনাচ্ছে আবার। এমনে সে টেনশনে মরছে তার মধ্যে উপরি পাওনা হয়ে অবনির কথাগুলো গিলতে হচ্ছে।অবনিও সুযোগ বুঝে ইচ্ছামতো কয়েক লাইন শুনিয়ে দিলো আরাফকে।

অবশেষে ঘড়ির কাঁটা জানান দিলো পঁয়তাল্লিশ মিনিট শেষ হতে চলেছে।আরাফ দ্রুত অবনিকে বললো অর্নিদের বাসায় ফোন দিতে।অবনিও তার মতো করে প্রস্তুতি নিয়ে আছে ফোন দেওয়ার জন্য। কয়েকটা রিং হতে অর্নির ছোট বোন অরিন ফোনটা তুললো।অবনি কথা বলছে আর আরাফ কান খাড়া করে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছে।
_হ্যালো অবনি আপু
_অরিন বলছো?
_জি
_অর্নি তোমাদের বাসায় পৌঁছেছে?
_না আপু তো আসেনি।আম্মু আব্বু এসেছে শুধু।আপু আরাফ ভাইয়ার সাথে হাসপাতালে আছে।

অবনি অরিনকে কিছু না বলে শুধু “আচ্ছা” বলে কেটে দিলো। ফোনটা কেটে সে আরাফের দিকে তাকালো।আরাফ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। অবনি রাগী গলায় বললো: এখন কি করবি?
_অর্নিকে আরেকটা ফোন দিয়ে দেখ।
অবনি আবারো অর্নিকে ফোন দিলো কিন্তু লাভ হলো না।আগের মতো “সুইচ অফ”বলছে। এখন কি করবে তারা। দুজনেই ভাবছে কাকে বলা যায়।আরাফ আবারো ভেবেচিন্তে বললো:রুমানাকে একটা ফোন দিয়ে দেখ তো‌।নাকি অফিসে গেলো?
_অফিসে গেলে ফোন অফ করবে কেনো?
_তবু দেখতে তো ক্ষতি নেই।যদি যায় তাহলে তো আমরা খবরটা পেয়ে টেনশন মুক্ত হতে পারবো।

অবনি এবার বাধ্য মেয়ের মতো রুমানাকে ফোন দিলো। ভাগ্য ভালো বলেই রুমানার নম্বরটা আছে তার কাছে। একবার অর্নি দিয়েছিল অবনির পার্সোনাল কাজের জন্য। তখন বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে আর অবনি রুমানার নম্বরটা সেইভ করে রেখেছিল। আগে কথা হ‌ওয়ায় রুমানাও খুব ভালো করে চিনে অবনিকে। অবনি ফোন দিতেই রুমানা রিসিভ করলো ফোনটা।রুমানাকে অর্নির কথা জিজ্ঞেস করতেই সেও সেইম জবাব দিলো:ম্যাম তো অফিসে আসেননি।
অবনি এবার থতমত খেয়ে গেলো। মেয়েটা গেলো কোথায়। ভাবলো রুমানাকে বলা উচিত ফোনে পাচ্ছে না সেটা।তা না হলে কেউ জানতে পারবে না অর্নি কোথায় আছে সেটা। ভাবনা মতো বলে দিলো রুমানাকে।
_আসলে অর্নিকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।তাই দেখছিলাম অফিসে আছে কিনা।
_অফিসে তো আসেনি হয়তো বাড়ি গেছে।
_বাড়িতে খবর নিয়েছি। অরিন বললো বাড়ি যায়নি।
কথাটা শুনে রুমানাও বেশ অবাক হলো।তাহলে গেলো কোথায়?কারো মাথায় আসছে না। রুমানা খোঁজ নিবে বলে ফোনটা কেটে দিলো।আরাফ আর বসে থাকতে পারলো না।সে উঠে দাঁড়ালো।অবনি তা দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো: তোর আবার কি হলো? এভাবে উঠে দাঁড়ালি কেনো?
_তাহলে কি এভাবে বসে থাকবো?
_শোন, তুই একজন প্যাশেন্ট তাও মুটামুটি সিরিয়াস কেস। তোকে এতো সহজে কেউ ছাড়বে না।আই মিন তোকে হাসপাতাল থেকে বের হতে দিবে না।
_আরে পাগল হয়েছিস তুই। আমি কি কাকে বলে বের হবো নাকি?সোজা বেরিয়ে পড়বো।

অবনি তো আরাফের কথায় এক প্রকার টাস্কি খেলো।এই ছেলের মাথা নিশ্চয় গেছে! নিচে সিকিউরিটি গার্ড কি তাকে বের হতে দিবে? তাছাড়া নার্স আছে এখানে।সে কি কখনো রুম থেকে বের হতে দিবে? পাগলের মতো চিন্তাভাবনা বললে চলে।আরাফ হাঁটা দিতেই অবনি তার হাত ধরে ফেললো। ইশারায় সামনে থাকা নার্সকে দেখালো।আরাফ একবার নার্সের দিকে তাকিয়ে বললো:ও আমাকে আটকাবে?ওর এতো সাহস আছে?
_হুম অবশ্যই। এখানে সাহসের কথা আসছে না। দায়িত্বের কথা আসছে।ওর দায়িত্ব এখন তোকে টেইক কেয়ার করা। তুই এই অবস্থায় এভাবে বেরিয়ে যেতে পারিস না।
_তাহলে আমি কি করবো?আরে অর্নির খবরটা তো নিতে হবে। এভাবে চুপ করে থাকলে তো হয় না।যদি কোনো বিপদে পড়ে তাহলে ভেবে দেখেছিস কি হতে পারে?
_সেটা তোর ভাবা উচিত ছিল আমার নয়। আমি তোকে যেতে দিবো না এই অবস্থায়।
_কষিয়ে একটা চড় দেবো। তুই ছোট মানুষ। বড়দের কথাতে তুই মাষ্টারি করবি কেনো? আমাকে যেতে দে।

আরাফ বেশ কড়া গলায় কথাটা বললো অবনিকে।অবনির পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে,আমাকে এতো কথা শোনালি আর তোকে এতো সহজে ছেড়ে দিবো?হুট করে সে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেলো।অবনির আচমকা বেরিয়ে যাওয়া দেখে আরাফ শান্ত হলো।এই চান্সে সেও বেরিয়ে যাবে।নার্স বা সিকিউরিটি গার্ড তাকে আটকাতে পারবে না কখনো। এমনকি তারা তাকে আটকাতে আসবেও না। তাছাড়া তার কন্ডিশন আগের চেয়ে অনেক বেটার।সে তো একজন ডাক্তার। নিজের শরীরের অবস্থা তো সে বুঝবে। একটু দূর্বলতা আছে শরীরে কিন্তু তাতে কি?এতো বড় বিপদের কাছে এটা তুচ্ছ। তবে বুকের ব্যান্ডেজ এখনো খুলেনি।তাতে কি? ব্যান্ডেজ ব্যান্ডেজের জায়গায় থাকুক।সে তার মতো অর্নিকে খুঁজে আসুক।তাতে তো সমস্যা নাই কারো। যেখানে তার নিজের সমস্যা হবে না সেখানে অন্যদের সমস্যা হ‌ওয়ার কথাও নয়।সে যাবে অর্নিকে খুঁজতে।যেখান থেকে পারে সেখান থেকে খুঁজে নিয়ে আসবে।এই মেয়েটা সবসময় তাকে সবকিছু দিয়ে আগলে রাখে।সে কি তার জন্য এই সামান্যটুকু করতে পারবে না? করতেই হবে তাকে। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ছে যাতে অর্নির কোনো বিপদ না হয়। একটা অজানা ভয় কাজ করছে সেই সাথে। অর্নিকে হারানোর ভয়।সে নিতে পারছে না এটা।সে তো অর্নিকে হারাতে চায় না। এতো কিছুর পর সব ঠিক হয়েছিল যখন হৃদয়টা একটু প্রশান্তি পেয়েছিল। অর্নি তার থাকবে আজীবন বিশ্বাসটা দৃঢ় হয়েছিল।কিন্তু হুট করে কি হয়ে গেলো! বুঝতে পারছে না আরাফ। এখন খুঁজতে যাবে কোথায় সেটাও বুঝতে পারছে না সে।সব যেন জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেললো সে।

তখনি কেবিনে প্রবেশ করলো আরাফের বাবা,অবনি আর আরাবি।তারা তিনজন মূলত হাসপাতালে ছিল। ড্রাইভার আছে একজন।তিনি নিচে আছেন।আরাফ মুটামুটি সুস্থ হ‌ওয়ায় বাকিরা চলে গেছে বাড়িতে।আরাফ তার বাবাকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো কিন্তু তিনি আরাফের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাদের বাব-ছেলের সম্পর্কটা একটু ভিন্ন।দুজনের মাঝে বেশ দূরত্ব। অচেনা কেউ কখনো বিশ্বাস করবে না তারা বাবা-ছেলে। দুজনেই একে অপরের সাথে খুব কম কথা বলে।তার কারণটা অবশ্য কেউ জানে না। শুধু তারা দুজন জানে।আরাফের বাবা এসে ছেলের গায়ে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। অসুস্থ ছেলে বলে মারতে ইচ্ছে করেনি কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে একটা দিতে হলো।আর কতো ধৈর্য ধরবে?ছেলেটা তো সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখন এতটুকু তার প্রাপ্য। রাগী গলায় বললেন তিনি:নিজে মেয়েটার সাথে জঘন্য আচরণ করলে।আমি অর্নির বাবা-মাকে জোর করে বলায় তারা তাকে রেখে গেছিল। মেয়েটাকে থাকতে তো দিলে না ‌এখন নাটক শুরু করেছো?
বাবার কথায় আরাফ চোখ তুলে তাকালো।এই অবনি তার বাবাকে সব বলে দিলো।ভাবা যায়? অবনিকে কষিয়ে চড় দেওয়ার পরিবর্তে চড়টা উল্টো তাকে খাওয়ালো অবনি।এই মেয়েকে সে দেখে নিবে। আপাতত একবার অর্নিকে খুঁজে পেলে তবেই তার শান্তি। বাবার কথার কোনো জবাব দিলো না।তা দেখে তার বাবা বললেন: চুপচাপ এখানে বসে থাকবে।এমনে তো অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছো। তবু থামতে ইচ্ছে করছে না তোমার। নতুন করে কোনো অঘটন চাই না আমি।এই রুম থেকে এক পা বাইরে দিলে তোমাকে দেখে নিবো।

বেশ কড়া গলায় কথাগুলো বলে আরাফের বাবা বেরিয়ে গেলো।আরাফ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে। মনে মনে ভীষণ ভয় হচ্ছে তার। এতোক্ষণ একটা সাহস ছিল। যে করেই হোক সে অর্নিকে খুঁজে আনবে। কিন্তু এখন বাবার কড়া আদেশ বের হ‌ওয়া যাবে না। তাহলে অর্নিকে খুঁজবে কে?অর্নি যদি কোনো বিপদে পড়ে। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে তার।অজানা একটা ভয় তাকে যেনো দাঁড়িয়ে থাকতে দিচ্ছে না।ধুম করে বসে পড়লো সে। অবনি একবার তার দিকে তাকালো।তার‌ও খারাপ লাগছে। কিন্তু সে চায়নি এই অবস্থায় আরাফ বাইরে যাক। এখন আরাফের নিজের চলাফেরা করতে কষ্ট হচ্ছে সে কি করে অর্নিকে খুঁজবে?তাই মূলত আরাফের বাবাকে বিষয়টা বলতে হলো।এখন তো তিনি খুঁজবেন।তাতে অবনির কোনো সন্দেহ নেই।অবনি ধীর পায়ে গিয়ে আরাফের কাঁধে হাত রাখলো। কিন্তু আরাফ হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। রাগী গলায় বললো: আমার তেরটা বাজিয়ে সিমপ্যাথি দেখাতে আসছিস?তোর সিমপ্যাথি তোর কাছে রাখ।এসব আদিখ্যেতা আমাকে দেখাতে হবে না।

অবনি আরাফের কথায় কিছু মনে করলো না।সে এমন।রেগে গেলে কি বলে কি করে তার হুঁশ থাকে না আরাফের।শান্ত কন্ঠে বললো: তুই এই অবস্থায় বাইরে যেতে পারবি না। তোর এটা বুঝতে হবে। এখন চাচ্চুকে বলায় তিনি যে করেই হোক অর্নির খোঁজ নিয়ে আসবে। এতটুকু বিশ্বাস আমার আছে। টেনশন করিস না।এতে তোর শরীরটা আরো খারাপ হয়ে যাবে।

চলবে…