অপেক্ষার বসন্ত পর্ব-২১

0
217

#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ২১

[কপি করা নিষিদ্ধ]

অবনি আরাফের কথায় কিছু মনে করলো না।সে এমন।রেগে গেলে কি বলে কি করে তার হুঁশ থাকে না আরাফের।শান্ত কন্ঠে বললো: তুই এই অবস্থায় বাইরে যেতে পারবি না। তোর এটা বুঝতে হবে। এখন চাচ্চুকে বলায় তিনি যে করেই হোক অর্নির খোঁজ নিয়ে আসবে। এতটুকু বিশ্বাস আমার আছে। টেনশন করিস না।এতে তোর শরীরটা আরো খারাপ হয়ে যাবে।

আরাফ মাথা নিচু করে আছে।অবনির এতো গুলো কথা তার কানে পৌঁছালো কিনা এই নিয়ে অবনি সন্দিহান। হঠাৎ অবনির ফোনটা বেজে উঠলো।অরিন ফোন করেছে। অরিনের ফোন পেয়ে অবনি দ্রুত ফোনটা রিসিভ করলো:হুম অরিন,বলো।
_আমি বলছি
অবনি গলাটা শুনে খুশিতে চিল্লিয়ে উঠলো। “অর্নি তুমি?জানো তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমরা। কোথায় ছিলে..
অবনির কথা শুনে বুঝতে পারলো অপর পাশে অর্নি কথা বলছে।তাই অবনির কথা শেষ হ‌ওয়ার আগে আরাফ অবনির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো। শান্ত কন্ঠে বললো: কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?
_সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নয় আমি।
_আরেকটু হলে টেনশনে দম বন্ধ হয়ে যেতো আমার।
_আমার জন্য আপনার কেনো এতো টেনশন করতে হচ্ছে?
_আমার ব‌উয়ের জন্য আমি টেনশন করবো। ইটস্ নরমাল।
_কে আপনার ব‌উ?কেউ আপনার ব‌উ নয়।
_একবার সুস্থ হ‌ই তারপর বুঝিয়ে দিবো কে আমার ব‌উ।বাই দ্যা ওয়ে,সরি ফর এভরিথিং

আরাফ সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিলো। অর্নিকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না পর্যন্ত।অবনি আরাফের কাণ্ড দেখে হাসছে ।অবনি প্রথমবারের মতো দেখলো আরাফ কাউকে সরি বলছে। তার কাছে বিষয়টি দারুণ লাগলো। একবার ভালোবাসার জ্বালে পা দিলে ইগোকে এক পাশে সরিয়ে রাখতে হয়।আরাফের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।হাঁসি থামিয়ে আরাফের বাবাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো অর্নির সাথে কথা হয়েছে সেটা।

আরাফ কিছুক্ষণ চুপ ছিলো। তারপর অবনিকে বললো: আচ্ছা অর্নির কাছ থেকে জিজ্ঞেস কর তো ও কোথায় গিয়েছিলো?
_তুই কি অর্নিকে সন্দেহ করছিস?
_আরে ধুর, আমি কেনো ওকে সন্দেহ করবো। আমি ওকে খুব ভালো করে চিনি।
_তাহলে এই দুদিন কথা বলিসনি কেনো ওর সাথে?
_আমার পারভেজকে পছন্দ নয়।তার চেয়েও বড় কথা পারভেজ ছেলেটা ভালো নয়।আমি চাই না অর্নি পারভেজের সাথে মেলামেশা করুক। ঝামেলায় পড়তে পারে।তাই এমনটা করেছি যাতে অর্নি আর পারভেজের সাথে কথা না বলে।

অবনি আরাফের কথামতো অর্নিদের বাসায় ফোন দিলো। সাথে সাথে অর্নি রিসিভ করেছে।যেমনকি সে ফোনের অপেক্ষায় ছিল এতোক্ষণ ধরে।
_কোথায় গিয়েছিলে তুমি?জানো কতো টেনশন করেছি আমরা।
_আসলে আপু আর বলো না। হাসপাতালে ছিলাম তাই ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল জানতাম না।আরাফ ফোন দেওয়ার সাথে সাথে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর পথে নন্দিনীর সাথে দেখা হয়েছিল।তাই বাসায় আসতে দেরি হয়েছে।সরি আসলে বুঝতেই পারিনি তোমরা এতো কাণ্ড করবে।তা না হলে নন্দিনীর ফোন থেকে বাসায় জানিয়ে দিতাম।
_ইটস ওকে। ‌সমস্যা নাই। তুমি যে কোনো বিপদে পড়ো নাই এতেই আমরা খুশি।
_আরাফের কি অবস্থা এখন?
_ডাক্তার বলেছেন আগামী কাল ডিসচার্জ করে দিবেন।
_যাক ভালোই হলো তাহলে।

অবনি কথা বলছে আর আরাফ তার পাশে বসে বসোসব শুনছে। মনে মনে অনেক খুশি সে এখন।আর একটা রাত কোনোরকম কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো।কাল বাসায় চলে যেতে পারবে।সব ঝামেলা থেকে মুক্ত। কয়েকটা দিন রেস্টে থাকতে হবে বলে হাসপাতালেও আসতে হবে না।এই সময়টা সে অর্নিকে জ্বালিয়ে কাটিয়ে দিবে।এর চেয়ে মজার বিষয় আইর কি হতে পারে? বেশ মজা লাগছে আরাফের।

রাত শেষ হয়ে ভোরের সূর্য উদিত হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। ভোরের রেখা কাটিয়ে আবছা আবছা রোদ উঠেছে কিছুক্ষণ হলো।সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো একটা আননোন নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার ফোন আসছে।কে ফোন করলো তাকে?আরাফের নম্বর তো সেইভ করা আছে তার ফোনে। তাহলে এই নম্বরটা কার? অর্নি ভাবলো একবার ফোন দিয়ে দেখবে। ভেবেচিন্তে ফোনটায় ডায়াল করলো সে। কয়েকটা রিং হ‌ওয়ার পর রিসিভ করলো অপরপাশে লোকটা।
_কে বলছেন?
_আমি পারভেজ।
_ওহ্ আচ্ছা। কেমন আছেন?
_ভালো। আপনি কেমন আছেন?
_ভালো।
_কাল হাসপাতালে দেখলাম না। চলে গেলেন কেন?
_এমনে এসেছি।ফোন দিলেন যে?
_ভেবেছি আপনি অসুস্থ তাই হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন।তাই ফোন দিলাম।
_না আমি সুস্থ আছি। এবার ফোনটা রাখুন।
_আরেকটা কথা ছিল।
_হুম বলুন।
_আপনার সাথে আরাফের ডিভোর্স হয়েছে?
পারভেজের এমন জঘন্য প্রশ্ন অর্নি নিতে পারলো না। মেজাজ তার চরম পর্যায়ে। রেগে গিয়ে বললো:কেন? আপনি খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন আমাদের ডিভোর্স দেখার জন্য।এসব আজাইরা কথা বলার জন্য আমাকে ফোন দিবেন না। শুধু আজাইরা কথা নয়। কোনো প্রয়োজনীয় কথা বলতেও আমাকে ফোন দিবেন না।বুঝলেন?
পারভেজ হেসে বললো:রেগে যাচ্ছেন কেন? মনের কথ বলা কি দোষের কিছু?আমি আমার মনের কথাগুলো বলতে চাই।
_আমাকে জুঁই ভেবেছেন?আবার জুঁইয়ের মতো আমাকে আপনার জ্বালে জিম্মি করে আরাফ থেকে নতুন করে প্রতিশোধ নিতে চাইছেন? মনে রাখবেন আমি জুঁইয়ের মতো ছোটলোক নয়। আমি আরাফকে প্রকৃত ভালোবেসেছি বলেই এতো কিছুর পরেও তার হাতটা ছাড়িনি।আর কখনো ছেড়ে যাবো না।
_আরাফ আপনাকে ভালোবাসে? আমি তো আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
_আরাফ আমাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক সেটা আমার দেখার বিষয়। আমার এসব পার্সোনাল বিষয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি আপনার চরকায় তেল দিন।

এই বলে অর্নি ফোনটা কেটে দিলো। মনে মনে ভাবছে আসলেই আরাফ ঠিক বলেছিল। পারভেজ বিশ্বাস করার মতো লোক নয়। হয়তো আরাফ ভালো করে চিনে তাই বুঝতে পেরেছিল সব।যাক এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভাবার প্রশ্ন‌ই আসে না। ফোনটা এক পাশে রেখে সে ফ্রেশ হতে গেলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফোনটা আবারো বেজে উঠলো। ফোনের আওয়াজ শুনে অর্নি রেগে গিয়ে অরিনকে বললো:এই ফোনটা সাইলেন্ট করে একপাশে রেখে দে তো।

অরিন কথামতো ফোনটা হাতে নিয়ে বললো:আরে আপু, ভাইয়া অসুস্থ মানুষ। এই অবস্থায় তোমাকে ফোন করছে আর তুমি বলছো ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখতে।এটা তো জঘন্য রকমের অপরাধ। তুমি কথা না বললেও আমি বলবো।তাই বলে এভাবে তো রেখে দিতে পারি না।

অরিন কথার আগামাথা অর্নি বুঝতে পারছে না। পারভেজ আবার অসুস্থ হলো কখন আর অরিন পারভেজকে চিনলো কি করে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো:কে ফোন করেছে?
অরিন তার কথার জবাব না দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে নিলো।অর্নি কোন উত্তর না পেয়ে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।সে দেখছে অরিন বেশ হেসে হেসে কথা বলছে।অর্নি ইশারা করে বললো:কার সাথে কথা বলছিস?
অরিন এবার ফোনটা অর্নিকে দিয়ে বললো: নে কথা বল।

অর্নি ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকালো। স্ক্রিনে “আরাফ ভাই” নামটা স্পষ্ট হয়ে আছে। ফোনটা প্রথম দিন কিনে “আরাফ ভাই” দিয়ে সেইভ করেছিল। এখনো এমনভাবে আছে।বিয়ের পর‌ও স্ক্রিনের নাম পরিবর্তন করা হয়নি। অর্নি কোনো কথা না বলে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।সে ইচ্ছে করেই কথা বলছে না। অপরপাশ থেকে আরাফ ডেকে যাচ্ছে।আরাফের ডাকাডাকি শুনে সে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ লাগছে তার। এমনটাই তো চেয়েছিল সে।আরাফ বেশ কয়েকবার ডেকে থেমে গেলো।দুজনেই চুপচাপ এখন।যেন একজন অপরজনের নিঃশ্বাস গুনছে। অরিন বোকার মতো তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে।একটু পর আরাফ ফোনটা কেটে দিলো। সাথে সাথে অর্নি আওয়াজ করে হেসে উঠলো।আরাফকে নাকানিচোবানি খাওয়াতে পেরে বেশ মজা লাগছে তার। অরিন মুখটাকে বাংলার পাঁচ করে বললো: ভাইয়া মনে হয় রেগে গেছে। তুই এমন করলি কেনো?
_বেশ করেছি।এসব বাদ দে। কাল নন্দিনীর সাথে দেখা হয়েছিল।বলেছে আন্টি অসুস্থ।চল আন্টিকে দেখে আসি আজ।
অরিন ভ্রু কুঁচকে বললো: অফিসে যাবি না আজকে?

অর্নি হাসলো।আরাফের সাথে হাসপাতালে থাকবে বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল সে। কিন্তু এখন তো হাসপাতাল থেকে চলে এসেছে।তাই ফ্রি আছে।এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। নন্দিনী তার খুব কাছের বান্ধবী। তার মা অসুস্থ আর অর্নি দেখতে যাবে না তা তো হতে পারে না।অরিনকে সাথে নিয়ে যাবে।কারণ অরিন অনেকদিন পর ভার্সিটি থেকে বাসায় এসেছে।সে ভার্সিটির হলে থাকে।তাই খুব একটা একসাথে ঘুরাঘুরি হয়ে উঠে না।মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।আরাফ অনেকটা সুস্থ হ‌ওয়ায় টেনশন‌ও নেই মনের মধ্যে।তাই দুজনে হালকা নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লো।

এদিকে আরাফকে আজ হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করা হবে।তাই দুজন সিনিয়র ডাক্তার এসে চেক‌আপ করে গেলো তাকে। তার টিচার হ‌ওয়ায় তারা আলাদা করে এসেছে। তারা চেক‌আপ করে বলেছেন:এক মাসের মতো রেস্টে থাকতে হবে। কোনো বিষয়ে খুব একটা প্রেসার নেওয়া যাবে না।
সেই সাথে একটা নিয়মাবলী ধরিয়ে দিলো।এটা মেইনটেইন করে আপাতত চলতে হবে।আরাফ খুশি মনে সব মেনে নিলো। এখন তার সবকিছুর বিনিময়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় যেতে হবে।এটাই জানে সে।আর কিছু মাথায় আসছে না। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আরাফকে নিয়ে অবনিরা সবাই হাসপাতাল থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

অর্নি আর অরিন নন্দিনীদের বাসা থেকে সন্ধ্যার দিকে এসেছে।আগে চলে আসতে চেয়েছিল কিন্তু নন্দিনীর মা আসতে দেয়নি। বাসায় এসে কলিংবেল দিতেই অর্নির মা এসে দরজা খুললেন। বেশ রেগে গিয়ে বললেন: কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? সেই সকালে বেরিয়েছে বাসায় আসার কোনো নাম গন্ধ নেই।ছেলেটা কখন থেকে এসে বসে আছে।আর মহারানী এতোক্ষণ পর আসছে।
অর্নি মায়ের কথায় হেসে বললো:আর বলো না। গল্প করতে করতে কখন যে এতোক্ষণ হয়ে গেলো জানা ছিল না।

অর্নি কথাটা বলে ভেতরে ঢুকলো। তার রুমে যেতে যেতে ওড়নার প্যাঁচ খুলছে সে। ওড়নাটা হাতে নিয়ে রুমে ঢুকতেই সে বোকা বনে গেলো।আরাফ তার বিছানায় শুয়ে আছে।চোখ দুটো কি নষ্ট হয়ে গেছে নাকি তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে?এমনটা তো হ‌ওয়ার কথা নয়। চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সে সামনের দিকে।আরাফ তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।
_বেশ তো ঘোরাঘুরি করলে। এবার তো একটু জামাইয়ের কাছে এসে খোঁজ খবর নাও।

চলবে….