অপেক্ষার রক্তচোখ পর্ব-০২

0
11

#অপেক্ষার_রক্তচোখ।
পর্ব:- দুই।
লেখা:- সিহাব হোসেন।

মেলা শেষে আত্মীয়-স্বজনরা একে একে বিদায় নিয়েছে। বাড়িটা আবার আগের মতো শান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু এই নিস্তব্ধতার মাঝেও একটা চাপা অস্বস্তি যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মারিয়া খেয়াল করল, তার শাশুড়ি হালিমা বেগম ঠিকমতো কথা বলছেন না। তার হাসিখুশি মুখটায় কে যেন বিষাদের কালি লেপে দিয়েছে। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছেন।

আসিফ মায়ের এই পরিবর্তনটা খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে। সে জানে এই ঝড়ের উৎস কোথায়। তার খালারা যখনই আসেন, তখনই কিছু না কিছু অশান্তির বীজ বুনে দিয়ে যান। বিয়ের পর থেকেই তারা হালিমাকে বোঝাতেন, – “ছেলের বউকে বেশি মাথায় তুলে রেখো না, পরে দেখবে সংসারে তোমার কোনো দামই থাকবে না।”
প্রথম প্রথম হালিমা বেগম এই কথাগুলো শুনে প্রভাবিত হতেন। মাঝে মাঝে মারিয়ার সাথে অকারণেই রুক্ষ ব্যবহার করতেন। আসিফ তখন মাকে বোঝানোর চেষ্টা করত।
– “মা, অন্যের কথা শুনলে সংসারে অশান্তি বাড়া ছাড়া কমবে না। আজ যাদের কথা শুনে তুমি ভাবছ মারিয়া তোমাকে মানবে না, তারা কিন্তু কখনোই চায় না আমরা শান্তিতে থাকি।”
হালিমা বেগম রেগে গিয়ে বলতেন,
– “তুই কী বলতে চাইছিস?”
আসিফ শান্ত গলায় উত্তর দিত,
– “বলতে এটাই চাইছি, তুমি সবসময়ই ভালো থাকো। কিন্তু যখনই খালাদের ওখান থেকে ঘুরে আসো, তারপর থেকেই মারিয়ার সাথে তোমার আচরণ বদলে যায়। এটা আমার চোখে পড়ে।”
– “এই কথা কি তোর বউ তোকে শিখিয়ে দিয়েছে?”
– “সে কেন বলবে? আমি তো আর ছোট নেই, মা। আমি সবই দেখি, সবই বুঝি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, তারা তোমাকে বাবার থেকে আলাদা হওয়ার পরামর্শ দিত। এখন তারা ঠিক কী চায়, তা আমি জানি না। কিন্তু এটা জানি, যখনই তুমি তাদের কথা শুনেছ, তখনই আমাদের সংসারে অশান্তি হয়েছে।”
শ্বশুর আকবর হোসেনও তখন ছেলেকে সমর্থন করে বলেছিলেন,
– “আমার ছেলে আজ একটা ঠিক কথা বলেছে। তারা তোমার বোন, তাদের সাথে মেশা বন্ধ করতে বলছি না। কিন্তু তাদের কথায় কান দিয়ে নিজের ঘরের শান্তি নষ্ট করো না।”
সেই ঘটনার পর থেকে হালিমা বেগম অনেকটাই বদলে গিয়েছিলেন। শাশুড়ি-বউমার সম্পর্কটা হয়ে উঠেছিল আরও মধুর, আরও সহজ। কিন্তু আজ আবার মায়ের চেহারায় সেই পুরনো বিষাদের ছায়া দেখে আসিফের মনটা কুঁকড়ে গেল। সে বুঝতে পারল, তার খালারা আবার কোনো বিষাক্ত মন্ত্র কানে দিয়ে গেছে।

আসিফ মায়ের পাশে গিয়ে বসল। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল,
– “মা, তোমাকে এমন মনমরা লাগছে কেন? কিছু হয়েছে?”
হালিমা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– “বয়স তো আর কম হলো না, বাবা। আর ক’দিনই বা বাঁচব। মরার আগে যদি নাতি-নাতনির মুখটা দেখে যেতে না পারি, তাহলে মরেও শান্তি পাব না।”
আসিফ এবার বুঝতে পারল, তার খালারা এবার কোন দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছে। সে মায়ের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,
– “মা, তোমার যেমন ‘দাদি’ ডাক শোনার খুব ইচ্ছা, তেমনি মারিয়ারও কিন্তু ‘মা’ ডাক শোনার ইচ্ছাটা কোনো অংশে কম নয়। তুমি একজন নারী হয়ে নিশ্চয়ই বোঝো, মাতৃত্ব একটা মেয়ের কাছে কতটা কাঙ্ক্ষিত, কতটা পবিত্র।”
হালিমা বেগম বিড়বিড় করে বললেন,
– “আমার তো মনে হয়, মারিয়ারই কোনো সমস্যা আছে। নাহলে এতদিনেও…”
আশিফ শান্তভাবে মাকে থামিয়ে দিল।
– “মা, রিপোর্টে তো দেখা গেছে আমাদের কারও কোনো সমস্যা নেই। আর সমস্যা যে শুধু মেয়েদেরই হয়, এমন তো কোনো কথা নেই। ছেলেদের সমস্যার কারণেও অনেক সময় সন্তান হয় না। তাই শুধু একজনকে দোষ দেওয়াটা ঠিক না। এই মুহূর্তে আমাদের ধৈর্য ধরা আর আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।”

এই বলে আসিফ মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার মনটা তেতো হয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবল, “মানুষ কেন এমন হয়? কেন তারা অন্যের সুখ সহ্য করতে পারে না? আঠার মতো লেগে থাকে, শুধু এই আশায় যে কীভাবে একটা সাজানো সংসারে অশান্তির আগুন লাগানো যায়।”

নিজের ঘরে ঢুকে আসিফ দেখল, মারিয়া বিছানায় চুপ করে বসে আছে। তার মুখটা ফ্যাকাসে, চোখ দুটো ছলছল করছে। আসিফ তার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখতেই মারিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সে আসিফের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
– “আমি কি সত্যিই কোনোদিন ‘মা’ ডাক শুনতে পারব না, আসিফ? প্লিজ, বলো না।”
তার ভেঙে পড়া কণ্ঠস্বর শুনে আসিফের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে মারিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিল, তার কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে বলল,
– “অবশ্যই পারবে, পা*গলী। কে বলেছে পারবে না? এত চিন্তা করছ কেন?”
– “কিন্তু… মানুষ যে এত কথা বলে।”
– “মানুষ কি সব জানে নাকি? ওদের কথায় কান দিও না তো। তুমি এসব একদম ভাববে না। দেখবে, একদিন আমাদের কোল জুড়ে খুব সুন্দর একটা ফুটফুটে বাবু আসবে। তখন এই মানুষগুলোই আর তোমাকে কিছু বলার সুযোগ পাবে না।”

আসিফের কথায়, তার মারিয়ার মনটা শান্ত হলো। সে মুচকি হেসে আসিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এই আলিঙ্গনের মধ্যে ছিল বিশ্বাস, ভরসা আর আগামী দিনের একরাশ স্বপ্ন। বাইরের জগতের সব কানাকানি, সব বি*ষাক্ত কথা যেন এই মুহূর্তে তাদের ভালোবাসার দেয়ালের বাইরেই থমকে গেল।

মিরার সাথে সেই দিনের ঘটনার পর থেকে মারিয়ার আর কথা হয় না। বোনের অভিমানী নীরবতা তাকে কষ্ট দেয়, কিন্তু সংসারের কথা ভেবে সে নিজেকে শক্ত রাখে। দিনগুলো তার নিজস্ব ছন্দে বয়ে চলে। সকালে আসিফ আর শ্বশুর আকবর সাহেব একসাথে ব্যবসার কাজে বেরিয়ে যান। এরপর বিশাল বাড়িটাতে মারিয়া আর তার শাশুড়ি হালিমা বেগম থাকেন। হালিমা বেগম এগারোটার দিকে পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করতে বের হন। ঠিক সেই সময়টাতেই রুবিনার আগমন ঘটে।

আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। হালিমা বেগম বেরিয়ে যেতেই রুবিনা এসে হাজির। দুজনে বসে এটা-সেটা গল্প করছিল। কথার এক পর্যায়ে রুবিনা প্রসঙ্গটা তুলল।
– “আচ্ছা মারিয়া, সেদিন তোমার বোনকে নিয়ে এত কিছু বললাম, তুমি মন খারাপ করোনি তো?”
মারিয়া শান্তভাবে হাসল।
– “না ভাবি, মন খারাপ কেন করব? তবে আপনি যা বলেছেন, সত্যি বলতে, আসিফের মধ্যে আমি তেমন কিছুই দেখিনি। যদি ওদের মধ্যে কিছু থাকত, তাহলে আমি বারণ করার পরও সে নিশ্চয়ই মিরাকে আনার জন্য জেদ করত। কিন্তু আমি বলা মাত্রই সে মেনে নিল। বলল, ‘তুমি যা বলবে, তাই হবে’।”

এই কথা শোনার সাথে সাথে রুবিনার মুখের হাসিটা কেমন যেন নিভে গেল। তার চোখে খেলে গেল এক মুহূর্তের হতাশা। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, – “তা আসিফ তো আঙ্কেলের সাথেই ব্যবসা করে। আঙ্কেল ওকে মাস শেষে কেমন টাকা-পয়সা দেন?”
– “যা দেন, তাতে আমাদের বেশ ভালোভাবেই চলে যায়। খাওয়া-দাওয়ার খরচ তো শ্বশুর দেখেন। বাকি যা থাকে, তাতে মাসটা আরামে কেটে যায়।”
রুবিনা যেন মারিয়ার এই উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারল না। সে আরও ঝুঁকে এসে বলল,
– “কিন্তু আমার মনে হয়, তোমাদের এখন থেকেই ব্যবসার লাভের ভাগটা বুঝে নেওয়া উচিত। ভাবো তো, যখন তোমরা দুজন থেকে তিনজন হবে, তখন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য টাকার দরকার হবে না?”
– “হ্যাঁ, তা তো হবেই।”
– “সেজন্যই বলছি, সময় থাকতে থাকতে নিজেদেরটা গুছিয়ে নাও।”
মারিয়া সহজভাবে বলল,
– “আমি এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না, ভাবি। কারণ শ্বশুরের যা কিছু আছে, সবই তো একদিন আসিফেরই হবে।”
রুবিনা যেন মারিয়ার এই সরলতায় হতাশ হলো।
– “হুম, কিন্তু সেটা তো ভবিষ্যতের কথা। ব্যবসার লাভ-লোকসান দুটোই আছে, তাই না? ধরো, ব্যবসায় যদি বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, আর তোমার হাতে যদি জমানো টাকা না থাকে, তখন কী করবে? অভাবে পড়তে হবে তো?”

মারিয়া চুপ করে গেল। রুবিনার কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। কথাগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন থেকেই ভাবা উচিত। রুবিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “আমার একটু মার্কেটে যেতে হবে, আসি তাহলে।”
রুবিনা চলে যাওয়ার পর মারিয়ার মনটা চিন্তার জালে জড়িয়ে গেল। এতদিন যে বিষয়গুলো নিয়ে সে ভাবেনি, আজ সেগুলোই তাকে ভাবাচ্ছে। রুবিনা ভাবি কি ঠিকই বলছেন?

শহরের রাস্তায় তখন গনগনে রোদ। গরমে মানুষের হাসফাঁস অবস্থা। আসিফ মার্কেটের পাশে একটা শরবতের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল একটু গলা ভেজানোর জন্য। এমন সময় সে দেখল, মার্কেট থেকে রুবিনা ভাবি বেরিয়ে আসছেন।
রুবিনা আসিফকে দেখেই অবাক হওয়ার ভান করে বলল, – “আরে আসিফ, তুমি এখানে কী করছ?”
– “আজ যা গরম পড়েছে ভাবি! তাই ভাবলাম, এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাই।”
রুবিনা নাক সিঁটকে বলল,
– “ধুর! রাস্তার ধারের এসব অস্বাস্থ্যকর জিনিস কেউ খায় নাকি? এসো তো আমার সাথে।”
– “কোথায় যাব?”
আসিফের উত্তরের অপেক্ষা না করেই রুবিনা প্রায় জোর করে তাকে টেনে পাশের একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। দুটো লাচ্ছির অর্ডার দিয়ে আসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “কী ব্যাপার, তোমার চেহারাটা দিন দিন এমন খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন? মারিয়া বুঝি আজকাল যত্ন-টত্ন করে না?”
আসিফ অপ্রস্তুত হয়ে হাসল।
– “কী যে বলেন না ভাবি! ও আমার খুব যত্ন করে।”
রুবিনা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
– “হ্যাঁ, সেটা তো তোমার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”
আসিফ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– “আসলে ইদানীং কাজের চাপটা একটু বেশি যাচ্ছে, তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে।”
– “ও, বুঝলাম।”

লাচ্ছি আসার পর আরও কিছুক্ষণ এটা-সেটা কথা বলে দুজনে দুই দিকে চলে গেল। আসিফ পুরো ব্যাপারটায় তেমন কিছু মনে না করলেও, রুবিনার চোখে ছিল এক অদ্ভুত রহস্যময় ঝিলিক। তার মাথায় তখন অন্য কোনো পরিকল্পনা ঘুরছিল, যার আঁচ পাওয়া সাধারণ কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।

চলবে……!