অপ্রিয় তুমি পর্ব-০১

0
40

#সূচনা_পর্ব
#অপ্রিয়_তুমি
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

বরের জায়গায় ভাইয়ের গুন্ডা, রাগী, বদমেজাজি বন্ধুকে দেখে চমকে উঠলো উৎসা। অবাক নেত্রে তাকিয়ে রইলো শেরওয়ানি পরিহিত মেহরাবের পানে। মেহরাব কে দেখে মনে হচ্ছে না সে একটুও চমকেছে। বরং সে ফুরফুরে মেজাজেই আছে। যেন সে আগে থেকে সব জানতো। বেটার ভাব ভঙ্গি একদম স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। উৎসা তার দিকে তাকাতেই মেহরাব চোখ টিপ মারলো, সাথে সবার অগোচরে উড়ন্ত চুমুও ছুড়ে দিলো। উৎসা বিষম খেয়ে গেল। লাজ লজ্জাহীন বেয়াদব একটা পুরুষ। এই জন্যই বেটাকে ও দু চোখে দেখতে পারে না। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে ইট মেরে এর মাথা ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু একটা জিনিস উৎসা বুঝে পাচ্ছে না এই বজ্জাত লোক এখানে কি করছে? এখানে তো রিয়াদের থাকার কথা ছিল। তার মানে কি উৎসার সাথে এই বজ্জাত লোকটার বিয়ে হবে? রিয়াদ কোথায়?
কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। উৎকণ্ঠার ইচ্ছে করলো চিৎকার করে বলতে,
“আমি এই গুন্ডা, মাস্তান, লাজ লজ্জা হীন, বেয়াদব, ভন্ড লোককে বিয়ে করবো না। তোমরা আমায় এর সাথে বিয়ে দিও না”

আশেপাশে মা, বাবা, ভাই কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। উৎকণ্ঠার নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে। ওর কান্না পাচ্ছে। ও কিছুতেই এই বদ লোকটাকে বিয়ে করবে না। কিন্তু বলবে টা কাকে? পাশে থাকা এক কাজিন কে ইশারায় ডাক দিলো। মেয়েটা কাছে এলে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
“রিয়াদ কোথায়? রিয়াদের জায়গায় এই বজ্জাত বেটা কি করছে? আম্মু, আব্বু, ভাইয়া কোথায়?”

“রিয়াদ হা*রা*ম*জা*দা*র কথা তুই বলিস না। ওকে সামনে পেলে তিয়াস ভাই হাত, পা ভেঙ্গে গলায় ঝুলিয়ে দিবে। এমনও হতে পারে এক বারিতে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে। ভাইয়ার মেজাজ এমনি খারাপ। চাচ্চু একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই চাচী আর ভাইয়া চাচ্চুকে সামলাচ্ছে”

উৎসা উত্তেজিত হলো। উঠে যেতে নিলো আসন ছেড়ে। মিলি বলল,
“আরে কোথায় যাচ্ছিস? বিয়ের আসর থেকে উঠছিস কেন? কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন এখনই কবুল বলতে বলবেন”

“যা ইচ্ছে হোক আমি আমার বাবার কাছে যাবো। বাবা কোথায়? কি হয়েছে বাবার? কেমন আছে?”

কথা গুলো বলতে বলতে কান্না করে দিলো উৎসা। মিলি ওকে বসিয়ে দিলো। চাপা কণ্ঠে বলল,
“কি করছিস? পা*গল নাকি তুই? বিয়ের আসর থেকে কেউ ওঠে?”

“বিয়ে উচ্ছন্নে যাক আমি বাবার কাছে যাবোই যাবো”

“তুই একটু শান্ত হয়ে বস। আমি তিয়াস ভাইকে ডেকে নিয়েছি আসছি”

মিলি চলে গেল। উৎসা বসে বসে হাত মোচড়াচ্ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। বাবা ভক্ত মেয়েটা। বাবার কিছু হলে ওর দিশ থাকে না। বাবার সামান্য অসুস্থতায় মেয়েটা দিশেহারা হয়ে পড়ে। সেই মেয়ের বিয়েতে এতো আয়োজন করে বাবা এখন অসুস্থ শুনে কিভাবে নিজেকে শান্ত রাখবে উৎসা?

মিনিট দুই বাদে কাজী সাহেব বলে উঠলো,
“বলো মা কবুল”

উৎসা শিউরে উঠলো। গলা ধরে এসেছে ওর। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের কাছের মানুষ গুলোকে খুঁজছে কিন্তু কাউকেই পাচ্ছে না। উৎসা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। কাজী সাহেব আরো দুবার বলল কিন্তু উৎসার কোনো জবাব নেই। বেচারি একই ভঙ্গিতে বসে আছে। দেখে মনে হবে রোবট হয়ে গিয়েছে। কোনো অনুভূতি নেই ওর মাঝে। মেহরাবের মেজাজ খারাপ হলো। ধমক দিয়ে বলল,
“কি হলো কবুল বলছো না কেন? সমস্যা কি?”

মেহরাবের ধমকে কেঁপে উঠলো উৎসা। বেচারি ভয় পেয়েছে। তবুও কিছু বলল না। এমন সময় সেখানে আগমন ঘটলো তিয়াসে। তিয়াস বোনের কাছে এসে দাঁড়ালো। ঝুঁকে সুধালো,
“কোনো সমস্যা? কবুল বলছিস না কেন?”

উৎসা মাথা নেড়ে সায় জানালো। ধীর কণ্ঠে আস্তে করে বলল,
“আমি বাবার কাছে যাবো”

“আগে বিয়েটা হোক তারপর আমি তোকে বাবার কাছে নিয়ে যাবো”

উৎসা ফের বলল,
“আমি তোমার গুন্ডা বন্ধুকে বিয়ে করবো না। রিয়াদ কোথায়? তার জায়গায় এ কেন?”

তিয়াস রেগে গেল মিনিটের মাঝে। রাগের তোপে নাকের পাটা ফুলে ফেঁপে উঠছে। তিয়াস রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে নিলো। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“ওই হা*রা*মির বাচ্চার নাম এবার নিয়েছিস তাই কিছু বললাম না। পরের বার বললে খবর আছে বলে দিলাম। ওর নাম আমার সামনে নিবি না”

উৎসা কিছুই বুঝতে পারলো না। এতদিন বাড়ির সবাই রিয়াদ বলতে যে পরিমান পাগল ছিল কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে এমন কি হলো যে তারা সেই মানুষটার নামই সহ্য করতে পারছে না? আজব কাহিনী তো! তিয়াস পুনরায় বলল,
“তাড়াতাড়ি কবুল বল”

“তুমি অন্য যাকে বলবে আমি তাকে বিয়ে করে নিবো তাও তোমার এই গুন্ডা বন্ধুকে বিয়ে করবো না”

“মেজাজ খারাপ করিস না বনু। যা বলছি তাই কর। তোর মেহরাবকেই বিয়ে করতে হবে। এতে হোক ও গুন্ডা, মস্তান, বাজে ছেলে”

উৎসার অভিমান হলো। অভিমানের পারদে কান্না পেয়ে গেল ওর। ফ্যাচা ফ্যাচা করে কান্না করে দিলো। তিয়াস শক্ত চোখের বোনের দিকে চাইলে উৎসা ইতি উতি না ভেবে কবুল বলে দিলো। ও এতক্ষনে বুঝে গেছে এই লোককে বিয়ে করা ছাড়া ওর কাছে অন্য কোনো অপশন নেই। কাজী সাহেব মেহরাব কে কবুল বলতে বললে ও রিলাক্স এ বলল। বেটা একদম ফুরফুরে মেজাজে আছে। উৎসা অবাক হলো। যেই লোক ওকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না সে কি করে এতো সাচ্ছন্দে ওকে বিয়ে করে নিলো? বিয়ে পড়ানো শেষ হলে আশেপাশে সবাই “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠলো। উৎসা কান্না মাখা কণ্ঠে তিয়াসের উদ্দেশ্যে বলল,
“বাবার কাছে যাবো”

তিয়াসের বোনের কান্না দেখে মায়া হলো। কতো আদরের বোন তার। বোনের হাত শক্ত করে মুষ্ঠিতে নিয়ে বলল,
“চল”

মেহরাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই ও আয়। বাবা তার মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে একসাথে দেখে শান্তি পাবে”

বলে রুম থেকে বের হলো। মেহরাব পিছু পিছু এগুলো।
————
উজ্জ্বল সাহেব এবং তনয়া বেগমের অতি আদরের একমাত্র কন্যা উৎসা। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। উৎসা পড়াশোনায় মাঝামাঝি কাটারের ছাত্রী। উজ্জ্বল সাহেবের ইচ্ছে মেয়েকে অনেক দূর পড়াবেন। সপ্তাহ খানেক আগে হুট্ করে বাড়িতে আগমন ঘটলো তার বন্ধুর পরিবার। হুট্ করে তাঁদের আসার কারণ বুঝতে পারলেন না উজ্জ্বল সাহেব। পরবর্তীতে করণ জানতে পারলেন তারা উৎসাকে ছেলের বউ করে নিতে চায়। উজ্জ্বল সাহেব অমত করলেন। অপর দিকে তার বন্ধু, বন্ধুর বউ নাছোড় বান্দা। তারা উৎসাকেই চায়। দরকার পড়লে কাবিন করে রাখবে তাঁদের ছেলে বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে এলে উৎসাকে তুলে নিয়ে যাবে। অবশেষে তাঁদের জোরাজুরি তে উজ্জ্বল সাহেব রাজি হলেন। আজ উৎসার ঘরোয়া ভাবে কাবিন ছিল। ঘরোয়া ভাবে হলেই উৎসদের পুরো পরিবার এসেছে। মামা, চাচা, খালা, ফুপু সবাই। সকাল থেকে সব ঠিকই ছিল হঠাৎ কি হলো উৎসা নিজেও জানে না।সব কিছুই ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
—————

উজ্জ্বল সাহেব বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছেন। তার হাতে স্যালাইন লাগানো। তনয়া বেগম বসে আছে তার পাশে। উৎসা বাবার এই অবস্থা দেখে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। উজ্জ্বল সাহেব মেয়ের কান্নার শব্দে চোখ মেলে চাইলেন। ইশারায় মেয়েকে কাছে ডাকলেন। উৎসা দৌড়ে যেয়ে লুটিয়ে পড়লো বাবার বুকে। এই জায়গাটা তার জন্য একেবারে সেফ। সকাল থেকে উজ্জ্বল সাহেব একদম ফিট ছিলেন। মেয়ের বিয়ে নিয়ে কতো উৎসাহ ছিল তার। হুট্ করে এমন কি হলো যে মানুষটা অসুস্থ হয়ে গেল? তাকে স্যালাইন দিতে হচ্ছে? উৎসা জানে বাবা সেখানে থাকলে নিশ্চই এই লুচু লোকের সাথে তার বিয়ে দিত না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো ভাইয়ের সাথে কথা বলবে না। গুন্ডার সাথে থাকতে থাকতে ওর ভাইটাও দিন দিন জল্লাদ হয়ে যাচ্ছে। কেমন পাষানের মতো বলল,
“ওই বজ্জাত বেটাকেই বিয়ে করতে হবে ওর”

উৎসা কান্না মাখা কণ্ঠে বলল,
“বাবা তোমার কি হয়েছে? তুমি নাকি অসুস্থ হয়ে গিয়েছো। হটাৎ কি হলো তোমার বাবা?”

উজ্জ্বল সাহেব মেয়ের উত্তেজনা দেখে মুচকি হাসলো। ছোটো বেলা থেকেই মেয়ে তার বাবা পাগল। বাবার কিছু হলে চিন্তায় পাগল হয়ে যায়। উজ্জ্বল সাহেব হাসি মুখে বলল,
“তেমন কিছু না মা। সারাদিন ছুটোছুটি করায় শরীর একটু খারাপ হয়েছে এই আরকি। তুই টেনশন করিস না”

উৎsসা কিছু টা শান্ত হলো। উজ্জ্বল সাহেব মেহরাবকে কাছে ডাকলেন। মেহরাব পাশে এসে দাঁড়ালে ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“বাবা তোমায় যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো আমি সেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তুমি না থাকলে আজ আমার মান সম্মান সব শেষ হয়ে যেত”

“আমি তো আপনার ছেলের মতোই। এটা আমার দায়িত্ব”

“আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা। মেয়েটা আমার বড্ড বাচ্চামো করে। এখনো নিজেকে সব খানে মানিয়ে নিতে পারেনা। ওর কোনো ভুল হলে বুঝিয়ে বলো”

মেহরাব একবার উৎসার পানে চেয়ে আস্বস্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না বাবা। আমি উৎসা কে সব সময় আগলে রাখবো। একটা আঁচড় আস্তে দিবো না ওর গাঁয়ে”

উজ্জ্বল সাহেবের কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল। ছেলেটা কি সুন্দর তাকে বাবা বলে সম্মোধন করলো। আরো কিছুক্ষণ কথা হলো সবার মাঝে। পুরোটা সময় উৎসা চুপ রইলো। যেখানে তার কথার মূল্য নেই সেখানে সে কথা বলবে না। হুহ!

রাত তখন আটটার কাছাকাছি। এবার যাওয়ার পালা। মেহরাব উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বাবা এবার আমাদের যেতে হবে”

উৎসার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো,
“আমি এই লুচু বেটার সাথে যাবো না”

কিন্তু বলতে পারলো না। এখন উল্টো পাল্টা কিছু বললে মেহরাব ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখবে এটা সে ভালো করেই জানে। খবিস লোক একটা!

চলবে।