#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব৫
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
সময় কেটে যাচ্ছে বহমান নদীর স্রোতের ন্যায়। দেখতে দেখতে উৎসাও বড় হচ্ছে। বন্ধু বান্ধবী নিয়ে তার এক আলাদা জগৎ তৈরী হচ্ছে। তবে সেই জগতে কোথায় না কোথাও এক কোণে ঘাপটি মেরে “অপ্রিয়”রূপে পরে আছে মেহরাব নামক মানুষটা। উৎসার মাঝে মাঝে মনে হয় “অপ্রিয়” নামটা বোধ হয় মেহরাবের জন্যই তৈরি হয়েছে। নাহলে যখনই মানুষটার সাথে দেখা হবে তখনই কোনো না কোনো বিষয়ে দুজনের ঝগড়া হবে। তাও আবার যেন তেন না একদম মা*রা*মা*রি টাইপ ঝগড়া। দুজন দুজনকে দেখতেই পারে না। ওদের ঝগড়ায় বলির পাঠা হয় তিয়াস। শেষে দুজন তিয়াসকে ঝাড়ি দিয়ে দুদিকে চলে যায়। আর মাঝ থেকে বেচারা তিয়াস বাক্কেলের মতো দুজনের ঝাড়ি খায়।
উৎসা অনেক বার চেষ্টা করেছে মেহরাবের সাথে ঝগড়া না করার কিন্তু পারলে তো! মেহরাব এমন কিছু বলবে বা করবে যে ও ঝগড়া করতে বাধ্য। মাঝে মাঝে উৎসার ইচ্ছে হয় ইট মেরে মেহরাবের মাথা ফাটিয়ে দিতে। খালি ভাইয়ের বন্ধু হয় সেই খাতিরে কিছু বলতে পারে না। নাহয় এতদিনে বেটাকে হসপিটালে পাঠিয়ে ছাড়তো।
মেহরাবকে “অপ্রিয়’র”তালিকায় ফেলার আরো কিছু কারণ আছে। উৎসা তখন কিশোরী। ক্লাস নাইনে উঠেছে সবে মাত্র। ওর প্রায় সব বান্ধবীরাই প্রেম করতো। একমাত্র ও আর ওর বেস্ট ফ্রেন্ড তানজিলা বাদে। বান্ধবীদের বিভিন্ন অনুভূতির কথা শুনে বেচারি উৎসারও অবচেতন মনে ইচ্ছে হয় প্রেম করার। কেউ একজন থাকবে যে তাকে উন্মাদের মতো ভালোবাসবে, তার চিন্তায় চিন্তিত থাকবে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে। কিন্তু ও জানে তিয়াস জানলে খু*ন করে ফেলবে। তিয়াস এসব পছন্দ করে না। উৎসার ও এসব পছন্দ হয়না। কিন্তু কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। উৎসার বেলায় কিছুটা তেমনই হলো। সবে কিশোরী বয়স, আবেগে ঠাসা মন, আশেপাশে রঙিন দুনিয়া সাথে বান্ধবীদের আবেঙ রঙ চং মেশানো কথা। সব কিছুর মাঝে উৎসা নিজেকেই ঠিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রাণ পণ। ও চায় না ওর জন্য ওর বাবা-মা, ভাই এদের কোনো সম্মানহানি হোক। তাই নিজেকেই যথা সাধ্য সামলে রাখার চেষ্টা করছে। তবে শেষ রক্ষা বুঝি হলো না। শুরুটা ছেলেটাই করেছে। উৎসার এতে বিন্দু মাত্র দোষ নেই। ছেলেটার নাম শাওন। শাওন উৎসার ক্লাস মেট সাথে ক্লাস টপার। হুট্ করে শাওন উৎসার অনেক খেয়াল রাখতে শুরু করে দেয়। শাওন ছেলেটা উৎসার খুব ভালো বন্ধু তাই উৎসা তেমন কিছু ভাবেনি। ভেবেছে ফ্রেন্ড হিসেবে ওকে ট্রিট করছে । ক্লাসে উৎসার কোনো সমস্যা হলে শাওন এসে পাশে দাঁড়াতো। কোনো পড়া বুঝতে সমস্যা হলে নিজ উদ্যোগে উৎসাকে ডেকে নিয়ে পড়া বুঝিয়ে দিতো। উৎসা কখনো শাওন কে নিয়ে কিছু ভাবেনি। বন্ধু হিসেবে এতো টুকু করতে পারে স্বাভাবিক। এমনই একদিন উৎসা আর তার সব বান্ধবীরা মিলে গল্প করছে। এর মাঝে হুট্ করে শান্তা বলে উঠলো,
“তোরা কিছুদিন ধরে একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?”
সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। শান্তা কি বোঝাতে চাইছে কেউ বুঝতে পারছে না। ওর কথার মানে বুঝতে না পেরে তানজিলা ধমক দিয়ে বলল,
“অতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সোজাসুজি বল”
শান্তা আসতে করে বলল,
“ইদানিং আমি একটা বিষয় খেয়াল করলাম শাওন কয়েকদিন যাবত উৎসার পিছনে ঘুর ঘুর করছে। নিজে থেকে এসে উৎসার হেল্প করছে। ক্লাস টাইমে উৎসা দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। কাহিনী তো কিছু একটা আছে তাই না?”
সবাই ওর কথার সাথে তাল দিলো। আরেকজন বলল,
“দোস্ত আমিও বিষয়টা খেয়াল করেছি”
শান্তা ফের বলল,
“আমার মনে হয় শাওন উৎসাকে পছন্দ করে”
সবাই সহমত পোষণ করলো। বিরোধীতা করে উঠলো উৎসা। বলল,
“তোরা ভুল ভাবছিস এমন কিছুই না। ও শুধু বন্ধু হিসেবেই ট্রিট করে”
শান্তা এক প্রকার গ্যারেন্টি দিয়ে বলল,
“গুনে রাখ আগামী এক সপ্তাহের মাঝে শাওন যদি তোকে প্রপোজ না করে তাহলে আমি আমার নাম বদলে রাখবো”
“ঠিক আছে দেখা যাক”
শাওনের এমন কেয়ারিং আচরণ জারিই রইলো। উৎসা বিরক্ত হয়ে উঠেছে ওর আচরণে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। একে তো ভালো বন্ধু তার ওপর ক্লাস টপার। উৎসা চায় না কোনো ঝামেলায় জড়াতে। তাই নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।
এক দিন বিকেল বেলা উৎসা আর ওর বান্ধবীরা কোচিং করে একসাথে ফিরছিলো। সবাই একসাথে গল্প করতে করতে আসছে রাস্তার এক পাশ দিয়ে অপর পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে শাওন। এসে থামলো উৎসার বরাবর। উৎসা হঠাৎ কাউকে সামনে দাঁড়াতে দেখে চমকে গেল। বান্ধবীদের সাথে কথায় মশগুল থাকায় বেচারি খেয়াল করেনি। চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো। যখন খেয়াল করলো মানুষটা শাওন তখন শুকনো ঢোক গিললো।উৎসার এক ফ্রেন্ড জিজ্ঞেস করে বসলো,
“কিছু বলবি শাওন?”
ছেলেটা মুখ খুলল,
“হ্যাঁ! উৎসার সাথে কিছু কথা ছিল”
উৎসার উদ্দেশ্যে বলল,
“উৎসা একটু মাঠের পাশটায় আসবে? কথা ছিল”
উৎসা যেতে চাইলো না। বার বার নাকোচ করলো। এলাকায় চারপাশে তিয়াস বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে থাকে। দেখতে পেলে খু*ন করে ফেলবে। তিয়াস যেমন ভাই হিসেবে আদর করতে পারে তেমনই উল্টোপাল্টা দেখলে মাইরও দিতে পারে। বান্ধবীরা জোরাজুড়ি করছে। উৎসা বার বার বলছে ও যাবে না।
“আমি বেশি সময় নিবো না জাস্ট ২ মিনিট”
শান্তা বলল,
“২ মিনিটই তো ইয়ার। সমস্যা কোথায়?”
উৎসা চেয়েও ওদের বোঝাতে পারলো না ওর মনের অবস্থা। অগত্যা বেচারি গেল। মাঠের এক পাশে উৎসা আর মেহরাব। মাঠের অন্য পাশে ওদের থেকে কিছু টা দুরুত্ব নিয়ে দাঁড়ালো উৎসার সকল বান্ধবরা। আচমকা শাওন হাঁটু গেড়ে বসে পারলো উৎসার সামনে। উৎসা চমকে গেল। চমকিত নয়নে সরে গেল দু পা। শাওন বলা শুরু করলো,
“আমার তোকে অনেক ভালো লাগে উৎসা। বন্ধু হিসেবে না, বন্ধুত্বের বাহিরেও আমি তোকে নিয়ে কিছু ফিল করি। তোর জন্য সব সময় মনের কোণে সফট কর্ণার বিরাজ করে। তুই আমাকে পছন্দ করিস? উইল ইউ বি মাইন গার্লফ্রেন্ড?”
উৎসা কিছু না বলে সরে যেতে নিলো। ওর মনের মাঝে কু গাইছে। ভয়ে হাত পা শির শির করছে। হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই বুঝি বেচারি ফিট খেলো বলে। এর মাঝেই সাঁই সাঁই করে কতো গুলো বাইক ঢুকলো মাঠে। একটা বাইক এসে থামলো ওদের সামনে। ছেলে গুলো হেলমেট পড়া থাকায় উৎসা চিনতে পারলো না। আস্তে আস্তে পিছয়ে যেত নিলো পিছনে। বাইক থেকে নেমে এলো একটা ছেলে। মাথা থেকে হেলমেট খুলল। ছেলেটার চেহারা দেখে উৎসার প্রাণ পাখি উড়ে যাওয়ার জোগাড়। ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে থা*প্প*ড় বসিয়ে দিলো শাওনের গালে। হিস হিসিয়ে বলল,
“নাকি টিপলে এখনো দুধ বের হবে ছেলে এসেছে প্রেম করতে? এখনো দুধের দাঁত পড়েনি মেয়ে পটানো শুরু করেছিস? দাঁড়া আজ তোর ব্যাবস্থা করছি। এমন হাল করবো এরপর মেয়েদের দিকে তাকাতেও ভয় পাবি”
বন্ধুদের কিছু একটা ইশারা করে তির্যক দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করলো উৎসার পানে। ওই এক চাহনিতে কি হলো উৎসা জানে না! ঘোরের মাঝে চলে গেল। ছেলেটা এগিয়ে এসে ঠাস করে ওকে ও এক খান চড় বসিয়ে দিলো। এক চড়ে উৎসা ঢোলে পড়লো। সাইডে হেলে পড়ে যেতে নিলে ছেলেটা বাহু হেলিয়ে ধরে ফেলল উৎসাকে। নিজের সাথে আগলে নিলো আবেশে। বাকিদের শাওনের খবর নিতে বলে এগিয়ে গেল বাইকের দিকে।
সেই এক চড়ের ভারে উৎসা অজ্ঞান ছিল দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা। মেয়ের এমন হলে অবস্থা দেখে তনয়া বেগমের থেকেও উজ্জ্বল সাহেব বেশি চিন্তিত। দু মিনিট পর পর বলছেন ডক্টরের কাছে নিলে হয় না? মেয়েটার হঠাৎ করে কি হলো? অজ্ঞান হয়ে গেল কিভাবে? তিয়াস টিকতে না পেরে ডক্টর কে কল করলো। উজ্জ্বল সাহেব মেয়ের পাশ থেকে সরছেই না। ডক্টর এলো খানিক খন বাদে। উৎসাকে ভালো করে চেক করে বলল,
“গুরুতর কিছুই হয়নি। টেনশন করার কিছু নেই। কোনো কিছু দেখে ভয় পেয়েছে মনে হয় তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে”
উজ্জ্বন সাহেব উৎকন্ঠীত হয়ে সুধালেন,
“তাহলে গালের ওই দাগ?”
“কেউ জোরে থাপ্পড় দিয়েছে বোধ হয়। তাই গাল লাল হয়ে গেছে”
মেহরাব ঢোক গিললো। উৎসার উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ গাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। গালে স্পষ্ট পাঁচ আঙ্গলের ছাপ পরে গেছে। উৎসা অবচেতন হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। মেহরাবের মনে মনে গিল্ট ফিল হচ্ছে। এতটা জোরে মা*রা উচিত হয়নি। বাচ্চা মেয়ে বুঝে শুনে মা*রা উচিত ছিল। মুহূর্তের ব্যাবধানে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
“মে*রেছি বেশ করেছি। এইটুকু বয়েসে প্রেম করার শখ জেগেছে তাই না? ওই শখ যদি ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো না করেছি তাহলে আমার নাম মেহরাব না”
উৎসার জ্ঞান ফিরলো রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ। পিট পিট করে চোখ খুলে নিজের অবস্থা জানার চেষ্টা করলো। নিজেকে নিজের বিছানায় পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আশেপাশে বাবা-মা, ভাই দাঁড়িয়ে আছে। পুরো রুমে চোখ বুলাতে নজরে এলো মেহরাবকে। বেটা বুকে হাত গুঁজে এটিটিউড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাবকে দেখে বিকেলের ঘটনা মনে পরে গেল। মেহরাব কি বাসায় বলে দিয়েছে? উজ্জ্বল সাহেব মেয়েকে চোখ খুলতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন কেমন লাগছে মা? শরীর বেশি খারাপ করছে?”
উৎসা মাথা নেড়ে নাকোচ করলো। উজ্জ্বল সাহেব হাঁক ছাড়লেন তনয়া বেগমকে,
“তাড়াতাড়ি যাও আমার মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে এসো”
তনয়া বেগম খাবার আনতে চলে গেলেন। তিয়াস এগিয়ে এসে উৎসার মাথায় চাপর মেরে বলল,
“পাঁচ ঘন্টা অজ্ঞান থেকে যা খেল দেখালি বইন! দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোমর ধরে গেছে। আমি গেলাম বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতে”
তিয়াসও চলে গেল। উজ্জ্বল সাহেব বলল,
“তুই একটু রেস্ট নে মা। আমি তোর পছন্দের খাবার নিয়ে আসছি”
একে একে সবাই চলে গেল। রুমে শুধু উৎসা আর মেহরাব। উৎসা এতক্ষনে বুঝে গেছে মেহরাব এখনো কিছুই বলেনি। বললে এতক্ষনে সবার রিয়েকশন এমন হতো না। উৎসা মনে মনে কিছুটা খুশি হলো। তবে ওর খুশি বেশিক্ষণ টিকলো না। মেহরাব এগিয়ে এলো। মেহরাবকে এগিয়ে আসতে দেখে উৎসা ঘাবড়ে গেল। সবাই চলে গেল এই বেটা রয়ে গেছে কি করতে? একটা থা*প্প*ড় দিয়ে শান্তি হয়নি? নাকি এখনো আরো থা*প্প*ড় দেওয়া বাকি রয়ে গেছে? উৎসা কিছুই বুঝতে পারলো না। মেহরাব কাছে এসে পাশে বসলো।
“বেশি খুশি হয়ে লাভ নেই। আমার কথা শুনে না চললে সবাইকে বলে দিবো”
“আপনার কথা শুনবো মানে?”
“মানে এখন থেকে আমি যা বলবো তোমাকে সেগুলো শুনে চলতে হবে। নাহয় সোজা গিয়ে তিয়াসকে তোমার গুনের কাহিনী শুনিয়ে আসবো তিয়াস ও শুনুক তার বোনের কু কীর্তির কাহিনী”
উৎসা আঁতকে উঠে বলল,
“না! না! ভাইয়া কে কিছু বলবেন না প্লিজ। আমি আপনার কথা মেনে চলবো। তাও কাউকে কিছু বলবেন না”
মেহরাব উৎসার গাল টেনে বলল,
“গুড গার্ল। এখন থেকে সব সময় ছেলেদের থেকে দশ হাত দূরে থাকবে। ভুলেও যদি তোমাকে ছেলেদের আশেপাশে দেখি তাহলে খবর আছে”
উৎসা এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
“কি করবেন শুনি?”
মেহরাব আচমকা ঝুঁকে এলো উৎসার দিকে। উৎসা ভয়ে পিছনে বিছানার বোর্ডের সাথে মিশে গেল। মেহরাব উৎসার ওষ্ঠের পানে নজর রেখে ঠোঁট কামড়ে নেশালো কণ্ঠে বলল,
“কি করবো? যখন করবো তখনই লাইভ দেখতে প্লাস ফিল করতে পারবে। তবে ভালো কিছু করবো না সেটা জেনে রাখো”
#চলবে?