#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব৭
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
কেটে গেছে সপ্তাহ খানেক। উৎসা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। রেডি হয়ে কলেজ যাবে। সেদিন ওদের বাড়ি থেকে আসার সময় বই নিয়ে এসেছে। কতো গুলো দিন মিস গেল পড়াশোনা। এই পড়া গুলো তুলবে কি করে কে জানে? এমন সময় ওয়াশরুম থেকে সদ্য শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো মেহরাব। পরনে তার সাফেদ রঙা টাওয়াল ব্যাতিত আর কিছুই নেই। উৎসা তাকাবে না তাকাবে না করেও তাকিয়ে ফেলল। আয়নায় মেহরাবের প্রতিবিম্ব বিদ্যামান। উন্মুক্ত বুকে বিন্দু বিন্দু পানির অস্তিত্ব। উৎসার নজর আটকে গেল মেহরাবের লোমস বুকে। মেহরাবের জিম করা বডি চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করছে ওকে। উৎসা শুকনো ঢোক গিলো। মেহরাব দ্রুত গতিতে তোয়ালে চালাচ্ছে চুলের ভাঁজে। বিন্দু বিন্দু পানি এসে পড়ছে উৎসার গাঁয়ে। মেহরাব ওর পাশ কেটে যেতে যেতে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি জানি আমি হট, তাই বলে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকবে? একটু তো লজ্জা রাখো বউ”
উৎসা থতমত খেয়ে গেল। এভাবে ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারনি। নিজেকে সামলে আমতা আমতা করে বলল,
“কে হা করে দেখছিলো আপনাকে? নিজেকে কি ভাবেন? সালমান খান নাই শারুখ খান?”
মেহরাব উৎসার মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
“কে আর দেখবে? আমার ঘরে একজন বোকা রানী আছে না? সে দেখছিলো”
“আমার সময় নেই আপনাকে দেখার। নিজেকে ভাবেন টা কি?”
মেহরাব উৎসার দিকে ঝুঁকে এসে বলল,
“হট, হ্যান্ডসাম, ড্যাসিং ম্যান”
উৎসা মেহরাবের বুকে আঙ্গুলের ডগা স্পর্শ করে ওকে সরিয়ে দিলো। মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“যেই না চেহারা ঢক, নাম রাখছে আব্দুল হক”
একটু থেমে বলল,
“আপনি এখান থেকে যান আমি রেডি হবো”
“আমি কি তোমায় ধরে রেখেছি নাকি আটকে রেখেছি?”
উৎসা জবাব দিলো না। ও ভালো করেই জানে এখন কথা বাড়ালে মেহরাব আরো বক বক করবে। এর চেয়ে ভালো চুপ করে থাকা। চুপচাপ চুল বাধঁতে লাগলো। আয়নায় মেহরাবের প্রতি বিম্ব দেখা যাচ্ছে। ও রেডি হচ্ছে। চুল বাধা শেষে নিচে নেমে এলো। খাবার টেবিলে বসে আছে মাহিন আর মিজান মির্জা। ওনারা খেয়ে অফিসে যাবেন। উৎসা এসে টেবিলে বসলো। রিনি এসে খাবার দিয়ে গেল। কিছুক্ষনের মাঝে মেহরাবও চলে এলো। মিজান সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“এতদিন বেয়ারা গিরি করে বেরিয়েছ। এখনও কি সেই মতলবই আছে নাকি?”
মেহরাব খেতে খেতে মুখ খুলল,
“মানে?”
“বিয়ে করেছো সেটা মাথায় আছে? একটা মেয়ের দায়িত্ব তোমার ঘাড়ে। এতদিন বেয়ারা গিরি করে বেরিয়েছ সমস্যা নেই। এবার কাঁধে দায়িত্ব এসেছে, দায়িত্ব যখন নিয়েছো সেটা যথাযথ ভাবে পালন করবে আশা করি”
মেহরাব গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি বুঝে শুনেই শুনেই বিয়ে করেছি। আমার দায়িত্ব জ্ঞান সম্পর্কে আপনার না ভাবলেও চলবে। আমি আমার বউয়ের দায়িত্ব ঠিকই পালন করতে পারবো”
মিজান সাহেব দাঁতে দাঁত চাপলেন। বড় ছেলেটা মনের মতন হলেও, ছোটো ছেলেটা একদম যাচ্ছে তাই হয়েছে। ঘাড়ত্যাড়া একটা ছেলে। সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে পারে না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলবে। মাহিন বেচারা বাবা আর ভাইয়ের মধ্যে ফেঁসে যায়। উৎসার ইচ্ছে করলো মেহরাবকে শাসন করতে। বাবার সাথে কথা বলার এ কি নিয়ম? এই অভদ্র আচরণের জন্যই মেহরাবকে ওর পছন্দ না। বাবা বুঝালো এক, ছেলে বুঝলো আরেক।
খাবার টেবিলে পিন পতন নীরবতা। আর একটাও শব্দ হলো না। উৎসা খেয়ে উঠবে এমন সময় মেহরাবের কণ্ঠ,
“গাড়িতে যেয়ে বসো। আমি আসছি”
উৎসা ভদ্র মেয়ের মতো ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে যেয়ে বসলো। আসার আগে সালেহা বেগমকে বলে এসেছে। মনে পড়ে গেল বাবার বাড়ি থেকে আসার পরের ঘটনা,
উৎসারা এসেছে পরের দিন বিকেলে। মেহরাব সেদিন রাতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু উজ্জ্বল সাহেব আসতে দেন নি। একমাত্র মেয়েকে এই টুকু সময় কাছে পেয়ে আবদার করে বসে রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য। মেহরাবও আর জোরাজুড়ি করেনি। উৎসা এসে ফ্রেশ হয়েই রান্না ঘরে ঢুকেছে। কাজ করতে গেলে সালেহা বেগম বাঁধা দিলেন। উৎসা ভয় পেয়ে গেল। ও কোনো ভুল করে ফেলেছি কি? ভীতু কণ্ঠে সুধালো,
“আমি কি কোনো ভুল করেছি আম্মু?”
উৎসার ভীতু কণ্ঠ শুনে সালেহা বেগম রিনি দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। হেসে দিয়ে বলল,
“না মা। তুমি কোনো ভুল করোনি”
“তাহলে কাজ করতে মানা করলেন যে?”
“তোমার এখন পড়াশোনার বয়স। তুমি মন দিয়ে পড়ো। রান্না ঘর সামলানোর জন্য আমি আর বড় বউমা তো আছি”
“তাই বলে আমি কোনো কাজই করবো না?”
সালেহা বেগম উৎসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“বোকা মেয়ে, কাজ করার সময় চলে যাচ্ছে নাকি? কাজ করার সময় এখনো পড়ে আছে। তোমার পড়াশোনা শেষ হলে দুই বউমার হাতে সংসার ছেড়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে খাবো আমি। তখন সব তোমাদেরই করতে হবে”
সালেহা বেগম মনে মনে ভয়ে আছেন। ছেলের তার মাথা গরম। বউকে কাজ করতে দেখলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে। তার চেয়ে বড় কথা উৎসা মেয়েটা এখনো বয়সে ছোটো। বাবার একমাত্র মেয়ে। নিশ্চই বাবার সংসারে কাজ করেনি। উনি আগেকার দিনের ডা*ইনি শাশুড়িদের মতো হতে চান না। যাদের দেখে বউমারা ভয় পাবে, উনি বউদের মেয়ের মতোই আদর দিয়ে রাখবেন।
উৎসার খুশির শেষ নেই। ও ভাবেনি এতো ভালো শশুর বাড়ি জুটবে ওর কপালে। শশুর বাড়ির লোক জন বিশেষ করে শাশুড়িকে নিয়ে বেচরি ভয়ে ছিলো। রুমে এসে বলে উঠলো,
“জামাই যেমন তেমন শশুর বাড়ি একদম মনের মতন”
পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
“জামাই যেমন তেমন মানে?”
উৎসা বেচারি ভয় পেয়ে গেল। কে কথা বলল? রুমে তো ও ছাড়া কেউই ছিলো না। পিছনে ঘুরতে নিলো। ধাক্কা খেল কারো প্রশস্ত বুকের সাথে। ইসস বুক তো নয় যেন আস্ত এক শক্ত পাথর। ধাক্কা খেয়ে পরে যেতে নিলে মেহরাব ওর কোমর আঁকড়ে ধরে নিলো। উৎসা আঁকড়ে ধরলো মেহরাবের বুকের কাছটার শার্টের অংশ। এ যাত্রায় বেঁচে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পড়লে নিঃঘাত মাথা ফেটে খান খান হয়ে যেত। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কি সমস্যা? ভুতের মতো উদয় হলেন কোথা থেকে? যদি পড়ে যেতাম তাহলে কি হতো?”
“আমি তোমাকে পড়ে যেতে দিলে তো! আমি থাকতে তুমি পড়বে ভাবাও বোকামো। ভয় নেই, আমি তোমায় আগলে রাখবো জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত”
উৎসা থমকে গেল। মেহরাবের মুখ থেকে এমন কাব্যিক কথা শুনতে পাবে কখনো ভাবেনি। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো মেহরাবের মুখ পানে। মেহরাব উৎসার কপালে টোকা দিয়ে বলল,
“একটু আগে কি বলছিলে?”
উৎসা ভরকে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“কোথায় কি বলেছি?”
“তোমার জামাই নাকি যেমন তেমন শশুরবাড়ি মনের মতো”
“বলবো না তো কি করবো? ফাটা কপাল আমার। মানুষের কপালে ভদ্র, সুশীল, আদব ওয়ালা জামাই জোটে আমার কপালে গু*ন্ডা, মা*স্তা*ন, দ*জ্জা*ল, অ*শ্লীল, বেয়াবদ জামাই জুটেছে”
“আরেকটা সম্মোধন তো ভুলেই গেল”
“কি?”
“লুচু”
“হ্যাঁ!”
“সেটা ভুললে কি করে হবে? ওটা সবার আগে বলা দরকার ছিলো”
মেহরাব হুট্ করে উৎসাকে হালকা ধাক্কা দিলো। উৎসা আচমকা আক্রমণে ধরার মতো কিছু না পেয়ে ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেল। উঠতে যাবে তার আগে মেহরাব ঝুঁকে এলো ওর ওপরে। উৎসা ঘাবড়ে গেল। মেহরাব দুহাতের মাঝে আবদ্ধ করে নিলো ওকে। উৎসার পালানোর কোনো উপায় নেই। মেহরাব নেশালো দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর গোলাপ রঙা ওষ্ঠের পানে। উৎসার খেয়াল হতেই দুহাত দিয়ে চেপে ধরতে অগ্রসর হলো। তার আগেই মেহরাব ওর হাতে বন্দি করে নিলো উৎসার ছোট্ট কোমল হাত দুটো। উৎসা নড়াচড়া করার জন্য ফাঁক ফোকর পাচ্ছে না। মেহরাব একটু একটু করে এগিয়ে আসতে নিলো উৎসার কাছে। উৎসা মেহরাবকে এগিয়ে আসতে দেখে ঢোক গিললো। বেচারির হৃদ স্পন্দন বেড়ে চলেছে ট্রেনের গতিতে। এই বুঝি হার্ট লাফিয়ে বেরিয়ে এলো। মেহরাবের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ছে উৎসার মুখের ওপর। মেহরাবকে এতো কাছে অনুভব করে চোখ বুজে নিলো। মেহরাব এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো উৎসার কপালে। উৎসা চট করে চোখ খুলে তাকালো। মেহরাব বাঁকা হেসে বলল,
“তুমি চাইলে যেটা হওয়ার সেটা হতেই পারে। কি বলো হবে নাকি একটু আকটু রোমান্স?”
উৎসা কাঁদো কাঁদো মুখ করে চাইলো। মেহরাবের হাসি পাচ্ছে উৎসার অবস্থা দেখে। গাল দেখিয়ে বলল,
“দু গালে গুনে গুনে দশটা চুমু দিবে তাহলে ছেড়ে দিবো”
উৎসা করুণ চোখে তাকালো। মেহরাব ফিরেও দেখলো না। উৎসা বুঝলো ঠ্যাটা লোক ওকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবে না।
“দশটা চুমু দিলে ছেড়ে দিবেন পাক্কা?”
“প্রমিস”
উৎসা চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিজেকে প্রস্তুত করলো। অতঃপর একে একে নয় খানা চুমু এঁকে দিলো মেহরাবের কপোলে। মেহরাব ওর কাণ্ড দেখছে।
“এবার যেতে দিন”
“এখনো এক খানা বাকি”
উৎসার ইচ্ছে হলো বেটার মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। সামান্য একটা চুমুর জন্য এমন করছে? খবিস লোক একটা! শেষ চুমু দিতেই মেহরাব সরে এলো ওর ওপর থেকে। উৎসা উঠে এক দৌড়ে রুমের বাহিরে। বুকে হাত দিয়ে দম নিতে নিতে বলল,
“লুচু বেডা, দেখিস তোর বিয়ে হবে না”
একটু বাদেই মনে পড়লো বেটার তো বিয়ে হয়েই গেছে। তাও আবার ওর সাথেই। বিড়বিড় করে বলল,
“পোড়া কপাল আমার”
মেহরাব উৎসার যাওয়ার ধরণ দেখে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বলল,
“পিচ্চি বউ আমার”
————
ভাবনার ঘোরে কখন যে বজ্জাত টা এসে পাশে বসেছে সে খেয়াল নেই উৎসার। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। হঠাৎ খেয়াল হলো উৎসার,
“আরে আমি তো সিট্ বেল্টই বাধিনি”
খেয়াল হতেই তাড়াতাড়ি সিট বেল্ট বাধঁতে নিলো। গাড়ি চালাতে চালাতে মেহরাব বলে উঠলো,
“সিটবেল্ট বেঁধে দিয়েছি। সারাদিন আমার ঘোরে থাকলে এসব খেয়াল থাকবে কি করে বউ?”
“আমার আপনাকে নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে”
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি”
মিনিট দশেকের মাঝে গাড়ি এসে থামলো কলেজের সামনে। উৎসা নামার আগে মেহরাব বলল,
“কলেজ ছুটি হলে সোজা বাহিরে চলে আসবে। এদিক ওদিক কোথাও যাবে না, আমি অপেক্ষা করবো বাহিরে”
উৎসা সায় জানিয়ে নেমে পড়লো। কলেজ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন তানজিলা। অনেক দিন বাদে বেস্ট ফেন্ডকে পেয়ে উৎসা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তানজিলার ও সেম অবস্থা। নেকা স্বরে বলল,
“বান্ধবী তুই কি করে পারলি আমায় ছেড়ে একা একা বিয়ে করতে? এখন আমার কি হবে?”
“নাটক কম করো পিও। তুমি যে তলে তলে টেম্পু চালাও এটা আমিও জানি”
তানজিলা ঢোক গিললো। উৎসা কি করে জানলো ও তিয়াস এর সাথে প্রেম করে? তবে কি তিয়াস বলে দিয়েছে? শিওর না হয়ে বলা উচিত না। তানজিলা জানে ও যদি উৎসাকে এখন এই বিষয়ে জানায় তাহলে ওর অবস্থা খারাপ হবে। এর চেয়ে ভালো এখন মানে মানে কেটে পড়া। তানজিলা তাই কথা ঘুরাতে বলল,
“জিজু কেমন রে?”
“গু*ন্ডা, মা*স্তা*ন, বদমাইশ আর কি শুনতে চাস?”
“আরে এগুলো তো তুই মেহরাব ভাইয়া কে বলিস”
“ওই গু*ন্ডার টাকেই বলেছি”
“মানে? কি বলছিস? আর বিয়ের পর আজ প্রথম কলেজে এলি জিজু না এসে মেহরাব ভাই দিয়ে গেল যে?”
“ওই গু*ন্ডাটাই তোর জিজু”
তানজিলা উচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করে বসলো,
“কি?”
আশেপাশের সবাই তাকালো ওদের দিকে। তানজিলা বেচারি বুঝতে পারেনি এতো জোরে বলে ফেলবে। সবাইকে কোনো মতে ‘সরি’ বলে। উৎসার দিকে তাকালো।
“কি না জি”
“ক্যামনে কি ইয়ার? মেহরাব ভাই আর তুই? কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার”
“ক্লাসে চল সব বলছি”
উৎসা তানজিলার হাত ধরে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। কতদিন দেখা হয়না দুজনের। কতো কথা জমে আছে দুজনের মনে। দুই বান্ধবী মনের সুখে আলাপ করা শুরু করলো।
#চলবে?