#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব৮
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
তানজিলা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। উৎসা ওকে এভাবে তাকাতে দেখে ভরকে গেল। কি এমন হলো যে মেয়েটা এভাবে মাথায় হাত দিয়েছে? ও কি উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে? নাকি বাজে কিছু বলেছে? কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
“মাথায় হাত দিয়ে বসে আছিস কেন? কিছু তো বল ইয়ার”
তানজিলা হতাশ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ভাই তোদের কাহিনী তো কোনো ফিল্মের থেকে কম না। আমি কটা দিনের জন্য বেড়াতে গেলাম এর মধ্যে তুই সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হয়ে গেলি তাও আবার কিনা পাত্র বদল। কাহিনী মে টুইস্ট? কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। আমার মনে হচ্ছে আমি এখনো ঘোরের মাঝেই আছি। আমায় ধর ইয়ার”
উৎসা তানজিলার বাহুতে চাপর মেরে বলল,
“নাটক কম কর। তুই যতোটা বলছিস ততটাও হয়নি”
“আচ্ছা সে সব কথা বাদ দে। একটা কথা বল তো”
“কি কথা?”
তানজিলা এগিয়ে এলো। চাঁপা কণ্ঠে বলল,
“তোদের মাঝে কিছু হয়নি?”
উৎসা প্রথমে বুঝতে পারলো না। বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে?”
তানজিলা ওকে বুঝিয়ে বলতেই উৎসা ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“জুতা চিনিস? অ*সভ্য, লুচু বেডি। তোকে আমি ভালো ভেবেছিলাম”
তানজিলার সোজা সাবলীল উত্তর,
“এখন খারাপ ভেবে নে”
“সর বেলাজ বেডি”
উৎসা ভেংচি কাটলো। তানজিলা এগিয়ে এসে বলল,
“তবে একটা কথা কি জানিস?”
“কি?”
“মেহরাব ভাই তোকে অনেক ভালোবাসে”
“তুই কি পা*গল হলি তানু? উনি তাও আমায় ভালোবাসবে? যার সাথে কিনা আমার সারাদিন ঝগড়া লেগে থাকে। আমরা একসাথে থাকলে কথা কম ঝগড়া বেশি হয়। এখন বল তুই যেটা বলছিস এটা মানা যায়?”
“তোর কি মনে হয়? তোর বাবার বন্ধুর ছেলে সে এমনি এমনি কোনো কারণ ছাড়াই বিয়ে করতে আসেনি? কোনো সমস্যা হলে তো তারা জানাতো নাকি? হুট্ করে কোনো কারণ ছাড়া বিয়ে করতে আসবে না কারণ কি? ভেবেছিস কখনো?”
উৎসা ভাবুক কণ্ঠে বলল,
“তাও কথা”
তানজিলা দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“তুই দেখে নিস শেষে আমার কথাই মিলবে”
উৎসা হাহ করে উড়িয়ে দিতে গিয়েও পারলো না। আসলেই তো এখানে একটা কিন্তু রয়েই যায়। উৎসা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ক্লাসে টিচার চলে এলো।
কলেজ শেষে উৎসা তানজিলার সাথে কথা বলতে বলতে গেট দিয়ে বের হচ্ছিলো। চোখ আটকালো ফর্মাল ড্রেসে, চোখে সানগ্লাস পরিহিত মেহরাবের দিকে। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। বেটার কথা বলার ভঙ্গিতেও নায়ক নায়ক ভাইব আসে। উৎসা আশেপাশে খেয়াল করলো। কতগুলো মেয়ে ছেচড়াদের মতন তাকিয়ে আছে মেহরাবের দিকে। এরা পারছে না চোখ দিয়েই গিলে খায়। এগুলো কেমন স্বভাব ভাই? আর এই বেটাকেও বলি হারি এতো মাঞ্জা মেরে আসতে হবে কেন? মেহরাব যে একেবারে ধব ধোবে ফর্সা এমনও না। তাও মেয়ে গুলো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে ওকে। শ্যাম বর্ণ গাঁয়ের রঙ, গালে চাপ দাঁড়ি, চুলগুলো খাঁড়া দেখেই বোঝা যায় বেটার রাগ অনেক কিন্তু উৎসাকে কখনো রাগ দেখায় নি।তবে উৎসা শুনেছে মেহরাবের রাগ প্রচুর। রাগের বশে অনেক কে মে*রে হসপিটালে পাঠিয়েছে। মেয়েগুলো কে বেহায়ার মতো মেহরাবের দিকে তাকিয়ে থাকতে উৎসার মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে গেল। ইচ্ছে করলো মেয়েগুলোর চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। অন্যের বরের দিকে তাকায় সাহস কতো? একজন তো বলেই বসলো,
“ছেলেটাকে দেখেছিস? একদম ডার্ক চকলেট। ইচ্ছে কররে একেবারে খেয়ে ফেলি”
আরেকজন বলল,
“লুইচ্চা বেডি নজর সামলা ওটা তোর জিজু হয়”
“জিজু টিজু কিচ্ছু না। যে পটাতে পারবে হ্যান্ডসাম তার”
“ওক্কে ডিল ডান”
মেয়ে গুলোর কথা শুনে উৎসার গাঁয়ে জ্বালা দিয়ে উঠলো। কথার কি শ্রী! এতদিন জানতো ছেলেরা মেয়েদের নিয়ে এমন উক্তি করে। আজ মেয়েগুলো কে দেখে উৎসার গাঁ গুলিয়ে আসলো। উৎসা কোনো কথা না বল গট গট পায়ে এগিয়ে গেল। উৎসা কে আসতে দেখে মেহরাব কল কেটে ফোন পকেটে ঢুকালো। জিজ্ঞেস করলো,
“এতদিন পর ক্লাস কেমন গেল?”
উৎসা কোনো উত্তর করলো না। মুখ ভেংচি কেটে পিছনের সিটে যেয়ে বসলো। মেহরাব কিছুই বুঝতে পারলো না। তানজিলা এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ভালো আছেন ভাইয়া?”
“তোমার বান্ধবীর জ্বালায় আর ভালো থাকা!
দেখছো না গাল ফুলিয়ে বসে আছে”
“আপনি এটা কিন্তু ঠিক করেন নি। আমার বান্ধবীকে চুপিচুপি বিয়ে করে নিলেন। আমাদের জানালেনও না। ইটস নট ফেয়ার। আমাদের ট্রিট কই?”
“এখন চলো ট্রিট দেই?”
“থাক অন্য দিন। আপনার বউ যেভাবে ক্ষেপে আছে আমায় সহ কাঁচা চিবিয়ে খাবে”
“রেগেছে কেন? ক্লাসে কিছু হয়েছে?”
“এতক্ষন তো ভালোই ছিলো। হটাৎ কি হলো কে জানে?”
তানজিলা কে বিদায় দিয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো মেহরাব। উৎসা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাব শান্ত কণ্ঠে বলল,
“সামনে এসে বসো”
উৎসা জবাব দিলো না। একই ভঙ্গিততে বসে রইলো।
“কি বলছি কথা কানে যাচ্ছে না? সামনে এসো”
মুখ খুলল উৎসা,
“আমি এখানে বসলে আপনার কি সমস্যা?”
“আমার সমস্যা আছে। তুমি এসো”
“আমাকে কি তোমার ড্রাইভার মনে হয়? তুই ড্যাং ড্যাং করে পিছনে বসে থাকবে আর আমি গাড়ি চালাবো”
“ড্রাইভার হলে হবেন। সমস্যা কি?”
মেহরাব আশেপাশে তাকালো। মেয়েগুলো এখনো তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তাই দুস্টু হেসে বলল,
“তুমি দেখতে পাচ্ছ না মেয়েগুলো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা আমায় ড্রাইভার রূপে দেখলে কষ্ট পাবে। তাই বলছি ভালোয় ভালোয় সামনে এসে বসো”
উৎসা গাঁয়ে জ্বালা দিয়ে উঠলো। তারমানে লুচু বেডা ইচ্ছে করেই ওকে আসতে বলছিলো। উৎসা তো ভেবেছে মেহরাব বোধ হয় ওকে অন্য কোনো কারণে ডাকছে। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। বিড়বিড় করে বলল,
“লুচু বেডা”
থেমে মিন মিনে কণ্ঠে বলল,
“যেই পে*ত্নী গুলো এতক্ষন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো তাদের এসে বসতে বলেন। আমি যাবো কেন? আমি সামনে যাবো না। আপনার পাশে তো আরো আগে না”
মেহরাব ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
“তাহলে যাই মেয়ে গুলোকে ডেকে নিয়ে আসি। কি বলো? বউ বলেছে বলে কথা আমি তার কথা না মেনে পারি? অন্যদের বউ তো তাদের এই টুকুও বলে না। উল্টো রাগ দেখায়। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে আমি অনেক ভাগ্যবান”
“ভাগ্যবান না ছাই। মেয়েগুলোর কাছে যান তারপর মজা বুঝাবো। কতো ধ্যানে কতো চাল”
উৎসার কাণ্ডে মেহরাব মনে মনে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। ও প্রথমেই খেয়াল করেছে মেয়েগুলো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তার ওপর উৎসার হঠাৎ রাগের কথা শুনে বুঝতে দেরি হলো না ওর রাগের কারণ মেয়েগুলোই। মেয়েটা যে জেলাস এতে কোনো সন্দেহ নেই। কথায় আছে “নারী তার প্ৰিয় মানুষের পাশে তো দূরে তার দিকে কেউ তাকালেও সেটা সহ্য করতে পারে না”।
মেহরাব ফের বলল,
“তুমি আসবে কি না?”
উৎসা এবার চিল্লিয়ে উঠলো,
“কথা কানে যায় না? বলেছি না সামনে বসবো না, মানে বসবোই না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে নেমে হেঁটে চলে যাবো”
মেহরাব বুঝলো উৎসা সেই লেভেলে খেপেছে ওকে আর খেপিয়ে লাভ নেই। তাই কথা না বাড়িয়ে নেমে উৎসার পাশের দরজা খুলল। উৎসা কিছু বুঝে ওঠার আগে ওকে টেনে এনে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো। উৎসা কিছু বলারও সুযোগ পেল না। তড়িৎ গতিত্তে ওকে সামনে বসিয়ে নিজে এসে বসলো ড্রাইভিং সিটে। উৎসা নিজেকে সামলে কিছু তেতে উঠে বলল,
“কি সমস্যা? আমায় এখানে এনেছেন কেন?”
“ভালো করে বলছিলাম কানে লাগেনি তাই না?”
উৎসা মেজাজ দেখিয়ে নেমে যেতে নিলো। মেহরাব ওর হাত টেনে সিটে বসিয় দিলো। বেচারির হাত সিটের সাথে আটকে ধরে আচমকাই অধরে অধর মিলিয়ে দিলো। উৎসা নিজেকে সামলানোর সময়ও পেল না। মিনিট খানেকের ব্যাবধানে সরে এলো। উৎসা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বেচারি হঠাৎ মেহরাবের আক্রমণে ভয় পেয়ে গেছে। নিজেকে সামলানোর সময় অবধি পায় নি। মেহরাব গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে।
“এর পর আমার কথা না শুনলে এর চেয়েও ভয়াবহ কিছু হবে মনে রেখে”
উৎসা নিজেকে সামলে নিলো। হাত দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে বলছে,
“অ*সভ্য, লুচু বেডা। খালি সুযোগ খোঁজে লুচু গিরি করার। আমি আজই বাড়ি চলে যাবো। থাকবো না”
মেহরাব শক্ত কণ্ঠে বলল,
“ও কথা মাথায় ও এনো না। তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। তখন আমার দোষ দিতে পারবে না”
উৎসা পুরো চুপ হয়ে গেল। বাকি রাস্তা মনে মনে মেহরাবের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করেই কাটিয়ে দিলো। মেহরাব ওকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,
“বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে ঘুম দিবে। আমি কখন আসবো তার ঠিক নেই”
উৎসা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“এমন ভাব করছে জেন আমি তাকে দেখতে না পেয়ে মরিয়া হয়ে যাবো। ঢং”
মেহরাবের কানে এলো কথাটা। ঠোঁট এলিয়ে বলল,
“এমন হতে কতক্ষন? হতেও তো পারে একটা সময় তুমি মরিয়া হয়ে আমায় খুঁজবে তাও আমায় পাবে না”
“আপনাকে খুঁজতে আমার বয়েই গেছে, হুহ”
“আমাকে তোমার খোজা লাগবে না। সময় বলে দিবে কে কি করবে”
মেহরাব চলে গেল। উৎসা বাড়িতে ঢুকলো। রিনি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
“ক্লাস কেমন গেল বনু”
“কোনো রকম। এতদিন পড়ে যাওয়ায় অনেক কিছুই মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছে”
“সমস্যা নেই। আমি আছিনা! আমি তোকে বুঝিয়ে দিবো”
উৎসা এক্সাইটেড হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“সত্যি?”
“হ্যাঁ”
উৎসা রিনিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই খবিসটার সাথে বিয়ে না হলে তোমার মতো বনু টাইপ জা আমি কোথায় পেতাম?”
“এই মোটেও আমার ভাইটাকে খবিস বলবি না”
“খবিস বলবো না তো কি করবো? জানো আজকে কি করেছে?”
রিনি অতি আগ্রহের সাথে সুধালো,
“কি করেছে?”
“বজ্জাত টা আমায়…”
বলতে গিয়ে জিভে কামড় দিলো। ছিঃ! ছিঃ! ও এগুলো কি বলতে যাচ্ছিলো। শেষে তো ওকেই লজ্জা পেতে হতো। উৎসার ইচ্ছে করলো নিজের গালে নিজেরই থাপ্পড় বসাতে। পেট পাতলা মুখ একটা!
“কি হলো বল?”
উৎসা কথা ঘুরাতে বলল,
“আরে কিছু না। ঝগড়া করেছে আমার সাথে। বজ্জাত লোক একটা”
একটু থেমে রিনি কে কিছু বলতে না দিয়ে বলে উঠলো,
“জানো আমার ছোটো বেলা থেকে অনেক ইচ্ছে ছিলো আমার একটা বড় বোন থাকবে যে আমায় আদর করবে, প্রয়োজনে শাসন করবে। যাকে আমি আমার মনের কথা খুলে বলতে পারবো। তোমায় পেয়ে সেই আশা আমার পূরণ হয়ে গেছে”
রিনি উৎসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“পা*গলী মেয়ে। যা ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। সকালে কি না কি খেয়েছিস?”
উৎসা সায় জানিয়ে চলে এলো। রুমে এসে টেবিলের ওপর ব্যাগ রাখলো। চোখে পড়লো মেহরাবের ঘড়ি টেবিলের ওপর রাখা। মেহরাব কি তবে ঘড়ি ছাড়াই গিয়েছে? হয়তো অন্যটা পড়ে গেছে। বেটার তো ঘড়ির অভাব নেই। ঘড়ি লাভারের ঘড়ি দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে টা ভরা। উৎসা ঘড়িটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখে দিলো। মাথায় খেলে গেল মেহরাবের কিছুক্ষণ আগের কথা গুলো। সত্যি কি এমন দিন আদোও আসবে? যেদিন উৎসা মেহরাবকে আশেপাশে খুঁজে বেড়াবে কিন্তু পাবে না। মেহরাবকে না পেলে উৎসা কি করবে? তার কি নিজেকে পা*গল পা*গল লাগবে? উন্মাদ মনে হবে নিজেকে? নাকি ও মেহরাবকে খুজবেই না? হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে। উৎসা আর ভাবতে পারলো না। মাথা হ্যাং হয়ে আসছে ওর। এই কয়েকটা দিনে মেহরাব ওর অজান্তেই ওর মনে অনেকটা জুড়ে বসবাস করছে। তবে উৎসা সে বিষয়ে অবগত নয়। মনের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলল,
“আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য হলেও আপনি আমার সাথে থেকে যান মিস্টার লুচু”
#চলবে?