#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব৯
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
“হতেও তো পারে একটা সময় তুমি মরিয়া হয়ে আমায় খুঁজবে তাও আমায় পাবে না”
উৎসা বই খুলে বসে আছে টেবিলে। অনেক দিন ক্লাসে যায় নি তাই অনেক পড়া জমে গেছে। তানজিলার কাছ থেকে ওর নোট খাতা নিয়ে এসেছে সব নোট করার জন্য। কিন্তু নোট তো দূর কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। কেমন একটা ঘোরের মাঝে ডুবে রয়েছে বেচারি। মেহরাবের বলা কথাটা বার বার কানে বাজছে। উৎসা চেয়েও মস্তিস্ক থেকে কথাটা বের করতে পারছে না। একটা লাইন উৎসা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ওর পুরো সত্ত্বা এলোমেলো করে দিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকালো উৎসা। ঘড়িতে সাড়ে নয়টা বাজে। মেহরাব এখনো আসছে না কেন? অন্যান্য দিন তো আট টা বাজতেই চলে আসে। এসেই শুরু করে উৎসাকে জ্বালানো। তাহলে আজকে কেন আসছে না। মেহরাবের কিছু হলো না তো! কোথায় গেছে ও? কিছু তো বলেও যায়নি। শুধু বলেছে আসতে দেরি হবে। উৎসার ইচ্ছে করছে নিজের কপালে নিজেই চাপর দিতে। কেন যে তখন জিজ্ঞেস করেনি। তখন জিজ্ঞেস করলে অন্তত এখন টেনশন করতে হতো না। কোথায় আছে মানুষটা? উৎসা আর কিছু ভাবতেই পারলো না। মাথা ধরে আসছে। মাথা চেপে ধরলো বেচারি। ফোন করবে সেই উপায় ও নেই। ওর কাছে মেহরাবের নাম্বারও নেই। নাম্বার থাকবেই বা কি করে? দুজন ঝগড়া করে পারে না। আবার নাকি নাম্বার আদান প্রদান করবে?
উৎসাকে অনেক ক্ষন ধরে ডাকছে রিনি। কিন্তু ওর সারা শব্দই নেই। তাই সোজা রুমেই চলে এসেছে। উৎসাকে মাথা ধরে বসে থাকতে দেখে ছুটে এলো,
“কিরে মাথা ধরে বসে আছিস কেন? মাথা ব্যাথা করছে?”
উৎসার ধ্যান ভাঙলো। জবাব দিলো,
“না”
“তাহলে মাথা ধরে রেখেছিস কেন?”
উৎসা স্বাভাবিক গলায় বলল,
“আরে এমনি। পড়া মাথায় ঢুকছিল না তাই মাথা ধরে বসে ছিলাম। তুমি আমার কথা বাদ দেও। হঠাৎ রুমে এলে যে”
“তোকে সেই কখন থেকে ডেকে চলেছি সে খেয়াল আছে? সারাদিন আমার দেবরের ধ্যানে থাকলে হবে? আশেপাশের খেয়াল ও রাখ। তোকে ডাকতে ডাকতে আমার গলা বসে গেছে”
উৎসা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“আমার অতো শখ নেই তোমার দেবরের ধ্যানে বসে থাকার। বাজে লোক একটা”
সত্যিটা বললে রিনি ওকে খ্যাপাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
“একদম আমার দেবর কে বাজে বলবি না”
“১০০ বার বলবো কি করবে?”
রিনি উৎসার কান মুলে দিয়ে বলল,
“এভাবে কান মুলে দিবো। এখন খেতে আয়”
“খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও, আমি পড়ে খেয়ে নিবো”
রিনি উৎসার কাঁধে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বলল,
“একসাথে দুজন রোমান্স করবি আর খাবি বললেই পারিস! এতো ঢং করার কি আছে?”
“তোমার দেবরের সাথে রোমান্স? আমার দিনকাল খারাপ যাচ্ছে নাকি? যে ওই গু”ন্ডাটার সাথে খেতে যাবো”
উৎসা মুখে এ কথা বললেও সত্যি তো এটাই বেচারি মেহরাবের চিন্তায় খেতে যাচ্ছে না। খেতে গেলেও ওর গলা দিয়ে খাবার নামবে না। যতোই ঝগড়া করুক মেহরাব ওর হাজবেন্ড। মনের কোণে কোথাও একটা অদৃশ্য টান রয়েই গেছে। রিনি আরো কিছু কথা বলে চলে গেল।
রাত এগারোটা বেজে গেছে। বাড়ির সবাই যার যার রুমে। মেহরাবদের বাড়ির নিয়ম সবাই দশটার আগে খেয়ে যার যার রুমে চলে যায়। উৎসা ব্যালকনি তে পায়চারি করছে। এতো রাত হয়ে গেল তাও বজ্জাত লোকটার আসার নাম নেই। উৎসার ইচ্ছে করছে মেহরাবকে সামনে পেলে ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতে। লোকটার কি খেয়াল আছে বাড়িতে তার বউ আছে? যে তাকে নিয়ে টেনশন করতে পারে? না! নেই। থাকলে নিশ্চই এতো দেরি করতো না। উৎসার ভাবনার মাঝে গাড়ির শব্দ হলো। উৎসা উঁকি দিলো ব্যালকনি থেকে। মেহরাবের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকছে। উৎসার কি হলো বেচারি নিজেও জানে না। হুট্ করে দৌড়ে লাগলো নিচে যাওয়ার জন্য। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই ধাক্কা লাগলো কারো প্রশস্ত বুকের সাথে। সামনের মানুষটা উৎসার কোমর আঁকড়ে ধরলো। নাহলে বেচারি ধপাস করে পড়ে যেত। উৎসা সামনের মানুষটাকে দেখার জন্য চোখ তুলল। ওর সামনে মেহরাব দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর গলায় বলল,
“পা*গলের মতো কোথায় ছুটছিলে? পড়ে ব্যথা পেলে কি হতো?”
উৎসা কি জবাব দিবে ভেবে পেল না। সোজা সুজি তো আর বলা যায় না আমি আপনাকে মিস করছিলাম তাই ছুটে এসেছি। এটা বললে মেহরাব নিশ্চই খেপাবে। ওর মজা নিবে। মেহরাব কে সত্যি টা বলা যাবে না।
“কি হলো বলো? তুমি আবার আমায় মিস টিস্ করছিলে নাকি? তাই সিনেমার হিরোইনদের মতো ছুটে আসছিলে”
উৎসা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আপনাকে মিস করতে যাবো কোন দুঃখে? আমি তো পানি খেতে এসেছিলাম আর আপনি খাম্বার মতো আমার সামনে এসে গেছেন”
মেহরাব সেকেন্ডের ব্যাবধানে উৎসাকে ছেড়ে দিলো।পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,
“পানি নিয়ে রুমে এসো”
বলে চলে গেল। উৎসা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহরাব কি রাগ করলো ওর কথায়? রাগ করলে করুক গিয়ে ওর কি? মানুষটা যে সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছে এই অনেক। উৎসা পানি নিয়ে রুমে ঢুকলো। নজরে এলো মেহরাব এক হাতে শার্টের বোতাম খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। উৎসা কাছে যেয়ে খেয়াল করলো মেহরাবের হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচানো। উৎসা চমকে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে মেহরাবের শার্ট এর বোতাম খুলতে দেওয়া শুরু করলো।
“হাতে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ করা কেন?”
মেহরাবের ত্যাড়া জবাব,
“হাত টা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো তাই ব্যান্ডেজ করেছি সুন্দর লাগছে না?”
উৎসা কিল বসিয়ে দিলো মেহরাবের বুকে। তিরিক্ষি মেজাজে বলল,
“উল্টোপাল্টা কথা না বললে হয় না?”
“পাষান বউ! দেখছো হাতে ব্যান্ডেজ তার ওপর অ*ত্যা*চার করছো? একটু তো মায়া দয়া রাখো”
“আপনার মতো বজ্জাত লোকের ওপর মায়া করতে আমার বয়েই গেছে”
শার্ট খুলতেই মেহরাবের স্যাম বর্ণ বুক দৃশ্যমান হলো। উৎসা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অন্য দিকে ফিরে টিশার্ট নিয়ে এসে গাঁয়ে জড়িয়ে দিলো। মেহরাব ওর অবস্থা দেখে মিটি মিটি হাসছে।
“চাইলে দেখতে পারো সমস্যা নেই। এগুলো তো তোমারই সম্পদ। তুমি ছাড়া আর কে দেখবে? চাইলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখতে পারো, আমি মাইন্ড করবো না”
“এই আপনি চুপ করবেন? মুখে লাগাম নেই? বেলাজ পুরুষ”
“শোনো মেয়ে পৃথিবীর সব পুরুষই তার বউয়ের সামনে বেলাজ”
উৎসা কোনো জবাব দিলো না। টিশার্ট পড়িয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হতে নিলে পিছনে থেকে মেহরাব ডেকে উঠলো,
“ও বউ প্যান্ট চেঞ্জ না করে কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
“আমি পারবো না। আপনি নিজে করে নিন। আমি খাবার গরম করতে যাচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন”
মেহরাব আরো দুবার ডাকলো উৎসা ফিরেও তাকালো না। মেহরাব বুঝলো পাষান বউ আসবে না
ওকে একা একাই করতে হবে। কি আর করার! উৎসা খাবার গরম করার মাঝে মেহরাব নিচে নেমে এলো। টেবিলে বসলে উৎসা খাবার বেড়ে দিলো। মেহরাব একবার খাবারের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার নিজের ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাতের দিকে তাকাচ্ছে। আচমকা ধমক দিয়ে বলল,
“দেখছো না হাতে ব্যান্ডেজ? আমি খাবো কিভাবে? খাওয়াবেনা বললেই পারো”
উৎসা জিভে কামড় দিলো। ওর খেয়ালই ছিলো না মেহরাবের হাতে ব্যান্ডেজ।
“সরি! সরি! আমার খেয়াল ছিলো না। আপনি বসুন আমি খাইয়ে দিচ্ছি”
উৎসা মেহরাবকে খাইয়ে দিচ্ছে আর মেহবার বসে বসে খাচ্ছে।
“তুমি খেয়েছো?”
উৎসা তোতালো কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ খেয়েছি”
“মিথ্যা বলছো কেন?”
“আমি সত্যি খেয়েছি”
“খেলেও এখন আমার এখান থেকে খাও”
“বললাম তো খেয়েছি?”
“তুমি খাবে নাকি আমি উঠে চলে যাবো?”
“কথায় কথায় রাগ করেন কেন? খাচ্ছি তো”
“গুড গার্ল”
উৎসা নিজেও খাচ্ছে মেহরাবকেও খাইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু অবাক করা কাণ্ড মেহরাব কিভাবে বুঝলো ও খায়নি? খাওয়ার মাঝে মেহরাব ছোটো ছোটো কামড় বসাচ্ছে উৎসার আঙুলে। উৎসা চোখ রাঙিয়ে তাকালো। মেহরাব ওর চাহনি পাত্তাও দিলো না। একই কাজ পুনরাবৃত্তি করলো। উৎসা তেতে উঠে বলল,
“দেখুন”
মেহরাব দুস্টু নজরে একবার উৎসার পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করলো। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
“দেখাও”
উৎসার মেজাজ খারাপ হলো। ও বলতে চাইলো কি আর এই লুচু বেটা বুঝলো কি? খামোখাই কি উৎসা ওকে দেখতে পারে না?
“ভাষা সংযত করুণ”
“আজব! ভাষায় কি হলো?”
“আপনি? আপনি? আপনি একটা যাচ্ছে তাই”
দাঁতে দাঁত চেপে খাওয়া শেষ করলো। উৎসা প্লেট বেসিনে রেখে আসতে যাবে এমন সয় মেহরাব মুখ এগিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
“তোমার মিথ্যা বলার অভিনয় টা বড্ড কাঁচা। মেহরাব মির্জার সামনে এসব অভিনয় কাজ করবে না বউ”
বলে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল। উৎসা ওর যাওয়ার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।
পুরো রুম অন্ধকার। ড্রিম লাইট জ্বলছে। মেহরাব বিছানার এক কোণে শুয়ে আছে। উৎসা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভাবলো মেহরাব ঘুমিয়ে গেছে। দরজা লাগিয়ে যেয়ে বিছানার অপর পাশে শুয়ে পড়লো। মুহূর্তের ব্যাবধানে এক জোড়া হাত উৎসাকে পেঁচিয়ে ধরলো। এটা নতুন কিছু না। নিত্য দিনের ঘটনা। মেহরাব প্রতিদিন সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে ঘুমাবে। প্রথম প্রথম উৎসা বিরক্ত হলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তাও মুখ খুলল,
“এভাবে সাপের মতো পেঁচিয়ে না ধরলে হয় না?”
মেহরাবের ঘুম ঘুম কণ্ঠ,
“কেন?”
“আমার ঘুম আসে না”
“অভ্যাস করে নেও। ধীরে ধীরে ঘুম চলে আসবে”
কি বজ্জাত লোক? তাও বলবে না, তোমার যেহেতু সমস্যা হচ্ছে আমি সরে ঘুমাচ্ছি। উৎসা মোচড়া মুচরি করছে। কিছু বলতে চাইছে। মেহরাব বিরক্ত হলো। রুষ্ট গলায় বলল,
“কি সমস্যা? মোচড়া মুচরি করছো কেন?”
“আপনার নাম্বার টা দেওয়া যাবে?”
“আমার নাম্বার দিয়ে তুমি কি করবে?”
চোটে গেল উৎসা। মানুষ নাম্বার দিয়ে কি করে? অবশ্যই কল দিবে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“সকালে যে মেয়ে গুলো আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো তাদের দিবো। খুশি?”
“থাক এতো বেশি উপকার করতে হবে না। তুমি রাখো তাহলেই হবে”
কিছুক্ষণ বাদে মেহরাব ফিসফিস করে বলল,
“মিস করছিলে বললেই পারো। এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কি আছে? তুমি চাইলে আমি নির্দ্বিধায় আমার নিজেকে তোমার হাতে সপে দিতে রাজি সেখানে সামান্য ফোন নাম্বার চাইতে এতো অস্বস্তি, এতো দ্বিধা কেন, উৎসা?”
উৎসা কোনো জবাব দিতে পারলো না। চুপ রইলো বাকিটা সময়। উৎসার জবাব না পেয়ে মেহরাব ভাবলো ঘুমিয়ে গেছে। তাই আর ডাকলো না। নিজেও পারি জমালো ঘুমের দেশে।
#চলবে?
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)